এক সময় শরীয়তপুর জেলার বিশেষ করে সদর উপজেলার পালং, বিলাশখান, বাঘিয়া, দাসার্তা গ্রামে প্রবেশ করলে মানুষ কান হাত দিয়ে দু’কান বন্ধ করে হাটতো। কাশ-পিতল কারিগরদের পিতল পাতের উপর অবিরাম হাতুরির বাড়িতে হওয়া টুং-টাং শব্দ কানে তালা লাগাতো অনেকের।

এটা আমাদের কাছে এখন কেবলই স্মৃতি। কারন সেই অতীত ঐতিহ্যের কাশ-পিতল শিল্পীও নেই, নেই শিল্পও। নানা সমস্যার কারনে, নানা সমস্যার অযুহাতে, নানা অভিযোগে দেড়শ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ এলাকার পিতল শিল্প আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক সময় পাঁচ শতাধিক পরিবারে দুই হাজারের উপরে কর্মী কাজ করলেও এখন সাত-আটটি পরিবারে বিশ-পচিশ জন শিল্পী এ শিল্প ধরে রেখেছে। এ শিল্পের প্রকৃত শিল্পী যারা তারা চলে গেছেন ওপার বাংলায়। এপারে যারা এই শিল্পকে আকরে ধরে আছেন তারা জাত শিল্পী না। জাত শিল্পীদের কাছে একসময় রুটি-রুজির জন্য কাজ করেছে বা শিল্পকে ভালবেসে কাজ শিখেছে তারাই ধরে রেখেছে শিল্পকে।

একেবারে গোড়ার কথাঃ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেন এমন ব্যক্তি ও শিল্পের সাথে জড়িতদের সাথে আলাপ করে জানাযায়, অষ্টাদশ শতাব্দির শেষ দিকে কাশ-পিতল শিল্পের সাথে জড়িত কংসবণিক সম্প্রদায় প্রথমে ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিম বঙ্গের হুগলির চন্দন নগর এসে বসতি গড়ে। সেখান থেকে একটা অংশ বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের লৌহজং গ্রামে এসে বসতি গড়ে। পদ্মা নদীর ভাঙ্গনের ফলে লৌহজং থেকে কংসবণিক সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ অংশ শরীয়তপুরের দাসার্তা, বাঘিয়া, পালং, বিলাশখান গ্রামে এসে বসতি গড়ে কারখানা স্থাপন করে। শরীয়তপুর সদরে তথা পালং ছাড়াও জেলার অন্যান্য উপজেলাতে বসতি গড়লেও সংখ্যায় তা কম। তবে পালং বাজারটাই ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে।

শিল্পের প্রসারঃ বাঘিয়া, দাসার্তা, বিলাশখান ও পালং গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে কারখানা গড়ে উঠলেও পালং বাজার প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। তৎকালীন সময়ে কাশ-পিতলের ধাতব মূল্য ও সৌন্দর্যের কারনে এ শিল্পের এতটাই প্রসার লাভ করে যে, বাংলাদেশের মধ্যে পালং হয়ে ওঠে কাশ পিতল শিল্পের প্রধান উৎপাদন ও ব্যবসা কেন্দ্র। এখান থেকে দেশের প্রধান বিভাগীয় শহর এবং বিভাগীয় শহর থেকে বিদেশে রপ্তানি হওয়া শুরু হয়। এই শিল্পের প্রসার প্রথমে হিন্দুদের হাতে শুরু হয়। পরবর্তীতে মুসলমানরাও জড়িয়ে পরে এ শিল্পের সাথে।

পেশার সাথে যুক্ত পরিবারের অতীত ও বর্তমান সংখ্যাঃ গত বিশ-ত্রিশ বছর পূর্বেও এ শিল্পের সাথে চার শতাধিক পরিবার জড়িত ছিল। এখানে কাশ-পিতল শিল্পের প্রায় দুই থেকে তিন শতাধিক কারখানা গড়ে উঠেছিল। পর্যায়ক্রমে মুসলমানরা এ শিল্পে শ্রম দিতে দিতে কারিগর হয়ে ওঠে। নানাবিধ কারনে শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দুরা ভারতের পশ্চিম বঙ্গে চলে যেতে থাকলে মুসলমান কারিগররা আস্তে আস্তে কারখানা স্থাপন করে শিল্পটা ধরে রাখে। বর্তমানে জেলায় সাত-আটটি পরিবার এ শিল্পকে ধরে রেখেছে। এক সময় শুধু পালং বাজারেই ত্রিশ থেকে চল্লিশটি কাশ-পিতল সামগ্রী বিক্রির দোকান থাকলেও এখন মাত্র চারটি দোকান আছে।

শিল্প সামগ্রীঃ একসময় এ জেলায় মালা, কলসি, জগ, বালতি, বদনা, চামচ, পানদান, ডাবর, পানি খাবার গ্লাস-মগ, ধান-চাল পরিমাপের পুড়, কুপি, বিভিন্ন প্রকার প্রদীপ, পাতিল, ঘন্টি, বিন্দাবনী, চারা, কড়াই, ধুপদানী, ছোট ঘটি (পুঁজার জন্য), মালসা, কোসা-কুসি, পুস্প পত্র, করাতথাল, বাস বেড়া, বগি থাল, পঞ্চপত্র সহ নিত্যব্যবহার্য ও নানান দর্শনীয় সামগ্রী তৈরী করা হতো।

ওপারে (পশ্চিম বঙ্গে) চলে যাওয়ার কারনঃ নানা সময়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তণের কারনে বিনিয়োগের ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, চাঁদাবাজি, সহজলভ্য সামগ্রী হাতে পেয়ে মানুষ পিতলের সামগ্রী ব্যবহার না করার কারনে এ শিল্পের সাথে জড়িত হিন্দুরা দেশ ছাড়তে থাকে। কাশ-পিতল শিল্পীরা সাধারণত অন্য কাজ করতে না পারায় পশ্চিম বঙ্গে এ শিল্পের চর্চা কিছুটা অব্যাহত থাকায় হিন্দুরা চলে যায়। আবার অনেকের মতে হিন্দুরা বাংলাদেশকে নিজের মত করে ভাবতে পারে না তাই তারা সর্বদা ওপার যাওয়ার চিন্তায় বিভোর থাকে। পশ্চিমবঙ্গে আপনজন থাকায় মনের টানে চলে যায় অনেকে। অনেকের মতে সংকট আছে থাকবেই। মুসলিম পরিবার গুলো তাদের পেশার সংকটের কারনে কি অন্যত্র চলে যাবে? সংকটের সাথে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়, টিকে থাকতে হবে। তাই শিল্প ধ্বংসের পিছনে শুধু সংকট, সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, বাজার মূল্য, সামাজিক প্রেক্ষাপটকে দায়ী করলে ঠিক হবে না।

শিল্প বিলুপ্তর কারণঃ পালং বাজারের কাশ-পিতল ব্যবসায়ীরা জানান, একসময় কাশ-পিতল সামগ্রী তৈরীর কাঁচামাল ‘পাত’ কেজি ছিল একসময় আশি টাকা। আর এখন প্রতি কেজি পাতের দাম তিনশত টাকা। এতেই অনুমান করা যায় কাঁচামালের মূল্য কি হারে বেড়েছে। বাজারে প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, সিলভার, এমনকি লেহার তৈরী পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত সামগ্রীর সহজ লভ্যতা, কম মূল্যর কারনে এবং কাশ-পিতলে তৈরী সামগ্রীর অধিক মূল্যের কারনে মানুষ কাশ-পিতল সামগ্রী ব্যবহারে অনিহা দেখায়। ফলে শিল্পীরা তাদের উৎপাদনের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কাশ-পিতলের ধাতব মূল্য, স্থায়ীত্ব বিবেচনা না করেই সহজলভ্য সামগ্রী ব্যবহারের কারনে এ শিল্প বিলুপ্তপ্রায়। তাছাড়া কাশ-পিতলের তৈরী সামগ্রীর চেয়ে সিলভার, প্লাস্টিক, সিরামিক, মেলামাইন, লোহার সামগ্রী দেখতে অনেক দৃষ্টিনন্দন।

চাহিদাঃ এক সময় মানুষ আচার-অনুষ্ঠানে উপহার দিতে বা পারিবারিক কাজে ব্যবহার করতে প্রধান ও প্রথম পছন্দের তালিকায় ছিল কাশ-পিতল সামগ্রী। কাশ-পিতল সামগ্রী ছিল আভিজাত্যের প্রকাশও। বর্তমানে মেলামাইন গিফট বক্স জাতীয় জিনিসের ছড়াছরি ও সহজলভ্যতার কারনে মানুষ কাশ-পিতল সামগ্রী উপহার তালিকা থেকে বাদ দেয়। তাছাড়া এখন উপহারের তালিকায় নগদ টাকার প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় এর কদর কমেছে। এখন একান্ত ব্যবহার্য কিছু সামগ্রী যেমন, বিন্দাবনী, বালতি, কলস, পানদান ছাড়া আর কোন সামগ্রীর চাহিদা নেই।

বর্তমান পরিস্থিতিঃ বর্তমানে সাত-আটটি পরিবার এ শিল্পকে কোনমতে বাঁচিয়ে রেখেছে। সাত-আটটি পরিবারের মধ্যে হিন্দু পরিবারের সংখ্যা নেই বললেই চলে। পূর্বে যারা এ শিল্পে শ্রম দিতেন তারাই মূলত এ শিল্পকে ধরে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের কেউ এই শিল্পে শ্রম দেয় না। ফলে এই সাত-আটটি পরিবার বিলুপ্ত হলে বা পেশা ছেড়ে দিলে নতুন প্রজন্ম এই শিল্পের হাল ধরবে না বলেই পর্যবেক মহলের এবং শিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের ধারনা।

মুসলমান শিল্পীদের আবির্ভাবঃ একটা সময়ে পাঁচশতাধিক পরিবার এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল। প্রচন্ড চাহিদার কারনে শ্রমিক সংকট মেটাতে কংসবণিক সম্প্রদায় স্থানীয় মুসলমান শ্রমিকদের এ কাজে নিয়োগ দেয়। কালক্রমে এখান থেকে হিন্দু ব্যবসায়ীরা চলে যাওয়ায় এখন মুসলমানরা যে চহিদা আছে তা মেটানোর চেষ্টা করছে। এ শিল্প ধরে রাখার কারণ হিসেবে জানা যায়, মুসলমান শিল্পীরা এ কাজ শিখার কারনে অন্য কাজ পারে না। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পশ্চিম বঙ্গে চাহিদা থাকায় এবং সেখানে অধিকাংশের আত্মীয় পরিজন থাকায় চলে গেলেও মুসলমানরা যাবে কোথায়। তাই তারা এখানে এই পেশাকে ধরে রেখেছে।

শিল্পীদের কথাঃ দাসার্তার শিবের বাড়ি চেনেন না এমন লোক শরীয়তপুরে খুব কমই পাওয়া যাবে। ঐ শিবের বাড়ি এক সময় দশটি পরিবার এ কাজের সাথে জড়িত ছিল। বর্তমানে একটি মাত্র পরিবার কাজ করে বাকি সবাই পশ্চিম বঙ্গে চলে গেছে। রঞ্জীত কুমার কংসবণিক, সিদাম কংসবণিক, বাসুদেব কংসবণিক ও স্যামসুন্দর কংসবণিক এ চার ভাই এখনও এ শিল্পকে ধরে রেখে এদেশে পরে আছে। রঞ্জিত কুমার কংসবণিক বলেন, ভোর রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে কাজ হতো। হাতুরি-পিতলের এতই সম্পর্ক ছিল যে টুং-টাং শব্দ সাধারণ মানুষের কাছে কানে তালা লাগার মত মনে হলেও আমাদের কাছে এটা গানের মতো। এখন আর এ শব্দ শোনা যায় না। আবুল কাশেম বেপারী বলেন, ছোট বেলায় এ শিল্পের চাহিদা এতই বেশি ছিল যে বাবা অন্য কাজে না দিয়ে কাশ-পিতলের কাজে দিলেন। এ কাজ শিখেছি, এখনতো আর অন্য কাজ পারি না। তাই ধরে রেখেছি। বর্তমান অবস্থা এতটাই খারাপ যে, আগে এখানকার আফিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালে প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন টন কাঁচামাল বিক্রি হতো আর এখন এক টন কাঁচামাল এক মাসেও শেষ হয় না। এতেই বোঝেন অবস্থাটা কি।

শিল্পীদের দাবীঃ বর্তমান পিতল শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পীরা দাবি করেন এ শিল্পের বিকাশের জন্য তাদের সহজ শর্তে ঋণ ও বাজারজাতকরণের পরামর্শ প্রদান করা দরকার। তাছাড়া সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দাবি ‘পিতল এমন একটি দ্রব্য এটা পুরাতন হলেও এর মূল্য খুব একটা কমে না। তাই পিতল ব্যবহার করার প্রতি মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করতে হবে। পিতল স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশ বান্ধব।

কাঁচামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কথাঃ জেলার পিতল শিল্পের কাঁচামাল প্রকৃয়াজাত প্রতিষ্ঠানের পথিকৃত শরীয়তপুর ব্রাস ইন্ডাষ্ট্রি এর প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ কোতোয়াল। বর্তমানে উৎপাদন ও সরবরাহকারী মেসার্স আফিদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ সাদিকুর রহমান কোতোয়াল লিটন বলেন, কাঁচামালের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি, কাঁচামাল ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া এবং শিল্পীরা ভারতে চলে যাওয়ায় মিলটি বন্ধপ্রায়। ১৯৮৭ সালেও এখানে কাঁচামালের চাহিদা এত বেশি ছিল যে এখানে কারখানা স্থাপন করতে আমার বাবা আগ্রহী হয়েছিলো। মাত্র পনের-ষোল বছরের ব্যবধানে দেখা গেল চাহিদা শুনের কোঠায়। শিল্প ও শিল্পী উভয়ই বিলুপ্তপ্রায়।

বিসিকের ভাষ্যঃ বিসিক শিল্প নগরী শরীয়তপুর এর এক সম্প্রসারণ কর্মকর্তার সাথে কথা বললে তিনি জানান, দশ বছর আগে যখন এখানে একবার এসেছিলাম তখন টুংটাং শন্দে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কুটির শিল্প হিসেবে (যেহেতু হাতের কাজ) উদ্যোক্তারা আমাদের কাছে আসলে তাদের ঋণদান, উৎপাদন, বাজারজাত, পরামর্শসহ তাদের জন্য কিছু করার সুযোগ ছিল। কিন্তু কেউই আমাদের কাছে আসে না।

গবেষকের কথাঃ শরীয়তপুর জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে গবেষনা করেন এমনই একজন বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক অধ্যাপক এম এ আজিজ মিয়া। তিঁনি বলেন, কাশ পিতল শিল্পীরা নানান কারনে ধাপে ধাপে এদেশ ত্যাগ করেছে। শুধু জেলারই নয়, এই দেশের অন্যতম কাশ-পিতল শিল্পের উৎপাদন হতো এখানে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কারনে পর্যায়ক্রমে তারা দেশ ছাড়ে। পিতলের স্থায়ীত্ব অনেক বেশি, সংরক্ষণের সুবিধা, পুরাতন হলেও এর দাম কমে না এবং পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত। এসব দিক বিবেচনা করে আমাদের উচিত কাশ পিতলের সামগ্রী ব্যবহার করা।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here