আমি ছোট বেলা থেকেই একটু ভোজন রসিক। খেতে খুব পছন্দ করি। এক সময় প্রচুর মিষ্টি খেতাম। শুধু কী দোকান থেকে কেনা মিষ্টি, শীতের দিনে খেজুরের গুর আর সারা বছরই মজুত থাকতো সেই আখের গুরও পছন্দ ছিলো। স্বাস্থ্যটা তো একদিনে এমনিই এবং বাতাশ খেয়ে হয়নি! আমার মা আমাকে ভালোই খাইয়েছে এবং খুব যত্ন করে খাইয়েছে। খাওয়ার সেই অভ্যাসটা এখনও হয়তো আছে, তবে পরিস্থিতির কারনে চাপানোর চেষ্টায় থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। ছোটবেলা নানীর হাতে প্রচুর গুর খেয়েছি যা আজও ভুলতে পারি না।

আমার কিছু প্রিয় মানুষ আছে যাদের মধ্যে অনেক প্রিয় আমার মা আর দুনিয়াতে নেই। আরেক প্রিয়জন আমার নানু যাকে আমি নানী বলেই ডাকতাম সেও নেই। নানীর মৃত্যু হয়েছে আজ থেকে সতের বছর আগে। নানীর জন্য আজও আমার হৃদয় কাঁদে। কোন কষ্টই চিরস্থায়ী হয় না। আমার মা হারানোর কষ্ট, নানী হারানোর কষ্ট, বু’কে (দাদী) হারানোর কষ্টও চিরস্থায়ী হয়নি। হৃদয়ের গভীরে এক গভীর ক্ষত হয়ে আছে সেটা টের পাই ঠিকই কিন্তু কষ্টটা এখন অনেকটা ফ্যাকাশে। তাঁদের মাঝে মাঝেই বিশেষ বিশেষ ক্ষণে মনে পরে। যখন মনে পরে তখন হৃদয়টা দূমরে মুচরে যায়, অনেক ভারি একটা পাথর বুকের উপর ভর করে, বুকটা ভারি হয়ে যায়। নিঃস্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় কেউ যেন চেপে ধরেছে টুটিটা। মুখ দিয়ে কথা বেরুতে চায় না।

নানা বাড়ির খুব কাছে বাড়ি হওয়ায় নানীর সাথে রয়েছে আমার অনেক স্মৃতি। মৃত্যুর সতের বছর পরেও ছোটবেলার সেই স্মৃতিগুলো আজও চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠে। ছোট বেলা থেকেই আমরা পালং গ্রামে বসবাস শুরু করি। আমাদের গ্রামের বাড়ি ছিলো স্বর্ণষোষ। অনেক ছোট থাকতেই আমরা পালং গ্রামে জায়গা কিনে বাড়ি করি। স্বর্ণঘোষ থাকতে বেড়াতে এসে কি করেছি, কেমন করেছি সেটা হয়তো মনে নেই। কিন্তু পালং এসে বাড়ি করার পর নানা বাড়ি খুব কাছে হওয়ায় যাতায়াতটা ছিলো অনেক বেশি। আমাদের বাড়ি থেকে হাটা পথ সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের। স্কুল থেকে ফিরে মাকে না পেলে বুঝতে বাকি থাকতো না কোথায় আছে। বইপত্র রেখে ছুটতাম নানা বাড়ি। গিয়ে ঠিকই দেখতাম নানীর সাথে বসে মা গল্প করছে। আমি যাওয়া মাত্র নানী আমাকে যে জিনিসটা দিতো তা হলো আখের গুর বা শীতের দিনে খেজুর গুরের মুছি। যাকে আমরা বলি মিডাই। একটা কাচের বয়ামে ভরা থাকতো আখের পাটালি বা খেজুর গুর। একটা টুকরা হাতে ধরিয়ে দিলেই মুখে পুরে নিতাম। তখন গ্রামের মোড়ে মোড়ে দোকানও ছিলো না, আর বাড়িতে চকলেটও থাকতো না। নানীর বয়ামের গুর ছিলো আমার খুবই প্রিয়। কখনো একটা শেষ হলে আরেকটা চেয়ে নিতাম বা নিজেই আলমারির উপর থেকে নামিয়ে নিতাম। নানীর মৃত্যুর সতের বছর পর বলতে ইচ্ছে করছে, নানী আমি এখন আর মিডাই খাই না, আপনার দেয়া মিডাইর মত এখন আর ভালোও লাগে না।

নানীর রান্না ঘরের সামনে একটা ডালিম গাছ ছিলো। গাছে ডালিমও ধরতো প্রচুর পরিমানে। প্রতিটি নাতি-নাতনির জন্য নানী সেই ডালিম বরাদ্দ রাখতো। সাধারণত কেউই বাদ পরতো না। আসলে নানীরা এমনই হয়। তাদের কাছে সকল নাতী-নাতনিই সমান। নানা বাড়ির উঠানে একটা বেল গাছ ছিলো। অসাধারণ স্বাদ ও ঘ্রাণ ছিলো সেই গাছের বেলে। চিকন চাকন একটা গাছে প্রচুর পরিমানে বেল ধরতো। পরবর্তী বছরের বেলের জন্য গাছে ফুল চলে আসতো কিন্তু আগের বছরের বেল পাকা শেষ হতো না। আমি যেহেতু ছিলাম কাছে তাই সেই গাছের বেল অনেক খেয়েছি আমি। কখনো কখনো বাড়িতে গেলে আমি নিজেই গাছে উঠে বেল পেড়ে আনতাম। তখন আমি এখনকার মত ভূরিওয়ালা মোটা ছিলাম না! সেই সুস্বাদু বেলের গাছটাও আজ আর নেই, নানীও আর নেই।এখন আর কেউ আদর করে বেল দেয় না, বেল খাওয়ার সময় এখনও মনে পরে নানীকে, মনে পরে তার মায়াভরা মুখখানি।

মানুষ সারাজীবন একই রকম থাকে না। আমিও আস্তে আস্তে বড় হলাম। যাওয়ার পরিমান ছোটবেলা থেকে একটু কমে গেলো। আমার খালাতো ভাই নয়ন আর আমার বয়সের পার্থক্য কম। সমসাময়ীক হওয়াতে ভাইয়ের চেয়ে বন্ধুত্বই বেশি দুজনের মধ্যে। মাদারীপুর থেকে নয়ন যখন বেড়াতে আসতো তখন আমাদের বাড়িতেই বেশি সময় থাকতো। ছোট মামা অথবা নানী তখন এসে মাঝে মাঝেই দুপুরে বা রাতের খাবার খাওয়ার জন্য বাড়িতে এসে মাকে বলে যেতো। আমরা গিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেরাতাম। খাবার সময় হলে ঠিকই নানী খুজে বের করতো, ডেকে আনতো। নানীর সেই শাসন, ডাক, ভালোবাসা ভুলার সাধ্য কী কারো আছে!

নানা বাড়ীর সামনেই কালিবাড়ি। বৈশাখী মেলা হয় সেখানে। লিটন, আমি মেলায় ঘুরে ফিরে ক্লান্ত হয়ে চলে আসতাম নানীর কাছে। ঠান্ডা সরবত, তরমুজ, মিষ্টি খাওয়াতো আদর করে। শরীর একটু শীতল হলে আবার যেতাম মেলায়। সকালে প্রথমেই আমাদের জন্য মেলা উপলক্ষে সেলামী রেডি করে রাখতো। বয়স ভেদে ভিন্ন ভিন্ন পরিমান সেলামী ধরিয়ে দিতো হাতে, টাকাটা হয়তো ছোট মামার পকেট থেকেই যেতো, কিন্তু দিতো নানীই। দুপুরে খাওয়ার সময় হলে গোসল করতে পাঠাতো। গোসলে গেলে আর ফেরার খবর থাকতো না। রান্না ফেলেই ছুটতো পুকুর ঘাটে। উঠিয়ে আনতো, পরম যত্নে খাওয়াতো কিন্তু রাগ করতো না। আমার নানুর ছোট্ট শরীরটায় এত ধৈর্য্য ধারণ করতো কিভাবে মহান আল্লাহই জানেন।

নানা বাড়ী থেকে এক রাস্তা ধরে পশ্চিমে আসলেই আমাদের বাড়ি। আমাদের বাড়ি থেকে আরো পশ্চিমে বাজারের কাছেই বড় মামার বাড়ি। চিকন ছিপছিপে ছোট্ট মানুষটা সপ্তাহের সাতদিনের মধ্যে পাঁচ দিনই একটা করে ঘুল্লা দিতো বড় মামার বাড়ি। আর হয় যাওয়ার পথে নয় ফেরার পথে সময় দিতো আমাদের বাড়ি। বাতাশের মত ছুটতো নানী। সেই নানী সতের বছর আগেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

বিশাল নাতি-নাতনির বহর ছিলো নানীর। কারো প্রতিই নানীর আদর যত্নের কমতি ছিলো না। মাঝে মাঝে আমার মনে প্রশ্ন জাগতো, ছোট্ট একটু মানুষ, কিভাবে তার মনে এত বিশাল সংখ্যক নাতি-নাতনিদের জায়গা দিতো? একটা মানুষের মনে কতটা মমতা ধারণ করতে পারে? একটা মানুষ এক জীবনে কতটা উদার হতে পারে? একটা মানুষ এক জীবনে কতটা দয়াবান, দানশীল, ধৈর্য্যশীল, স্নেহশীল, মানবিক হতে পারে? নানীর দিকে তাকালে তার উত্তর মিলাতে পারি না কারন সে ছিলো সীমার উর্ধ্বে। সতেরটি বছর হয়ে গেছে নানী নাই এই দুনিয়াতে। সত্যি বলতে কী, নানী মারা যাওয়ার পর নানা বাড়িতে যাওয়ার আগ্রহটাই কমে গেছে। মামার আদরের কোন কমতি হয়নি। কিন্তু নানী বিহীন নানা বাড়ি এক বিরাণ ভূমি ছাড়া আর কিছুই নয়। মহান আল্লাহর কাছে আমার প্রার্থনা, নানীকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ স্থানের মেহমান হিসাবে কবুল করুন। আমিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here