২২ জুলাই ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ। কুষ্টিয়ার আদালতে একটি মানহানির মামলায় জামিন স্থায়ী করতে গিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ার পার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। জামিন পাওয়ার পর আদালতে অবরুদ্ধ হয়ে পরেন। এক পর্যায়ে তার উপর হামলা হয়, তার গাড়ি ভাংচুর হয়, তিনি রক্তাক্ত আহত হন। মাহমুদুর রহমান মামলার স্বীকার হন তার চোপার জন্য। দলের হয়ে সবসময় বেফাস কথা বলে সর্বদা সংবাদ শিরোনাম হয়ে আসছেন তিনি। হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন মাহমুদুরের সঙ্গীরা। তবে পুলিশ হামলাকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি।

ফিরে যাই ২০০৬ সালে। ২৯ মে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ। কুষ্টিয়ায় আয়োজন করা হয়েছিলো সাংবাদিক নির্যাতন বিরোধী সমাবেশ। পালিয়ে ঢাকায় অবস্থান নেয়া চার সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে আসেন সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। সঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক ওমর ফারুক, ফরাজী আজমল হোসেনসহ ছোট্ট একটি দল। সমাবেশস্থল কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে জড়ো হয়েছিলেন আশপাশের বিভিন্ন জেলার সাংবাদিক নেতারাও। ক্ষমতাসীন বিএনপি দলীয় সাংসদ ও নেতাকর্মীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এসেছিলেন জেলার সর্বস্তরের সাংবাদিকরা। দু’জন বক্তব্য দেবার পর শুরু করেছিলেন ফরিদপুরের সাংবাদিক নেতা লায়েকুজ্জামান। বিএনপির নেতা কর্মীদের উদ্দেশ্য করে তিনি যখন বলেছিলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল কতটা দেউলিয়া হলে সাংবাদিকদের নামে মিথ্যা মামলা করতে পারে।’ এই বক্তব্যের পরই পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া ছাত্রদল ও যুবদলের ক্যাডাররা হামলে পড়েছিলো সমাবেশের উপর। অদূরে অবস্থিত জেলা বিএনপি অফিসের ভেতর থেকে বের হয়ে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে সমাবেশ স্থলে এসে মারপিট-ভাঙচুর শুরু করেছিলো। কপাল ফেটে রক্ত ঝড়েছিলো সাংবাদিক নেতা ও অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরীর। আহত হয়েছিলেন ২৩ জন সাংবাদিক। বিএনপি সরকারের ঐ সময়টায় মামলা হামলার কারনে কুষ্টিয়ার সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তারই প্রতিবাদে সমাবেশে যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী।

উপরের দুটি ঘটনা মূলত একই সূত্রে গাথা। সেদিন হামলার মূল হোতা ছিলো কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপি দলীয় সাংসদ এবং বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা আর আজ অভিযোগ কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের উপর।

সে সময় মাহমুদুর রহমান ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা। আর ২০০৬ সালে যে রক্তাক্ত হয়েছিলো সেই ইকবাল সোবহান চৌধুরী এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা।

দুটি ঘটনার কোনটাকেই আমি সমর্থন করি না। দুটি ঘটনাই ন্যাক্কারজনক। কিন্তু আজ মনে প্রশ্ন জাগে, ২০০৬ সালে মাহমুদুর রহমানের বিবেক কি কেদেছিলো? আর আজ কি ইকবাল সোবহান চৌধুরীর বিবেক কাদছে? আমি জানি, আমার এই প্রশ্ন কর্তাদের কানে পৌছাবে না। আর তারা বিষয়টাকে তুচ্ছ বলে এর জবাবও কোনদিন দিবেন না। যদিও তারা কোন জবাব দিতে অভ্যস্তও না।

আমাদের দেশে আজ শিক্ষকরা বিভক্ত। সাদা প্যানেল মার খায় নীল প্যানেলের কাছে আর নীল প্যানেল মার খায় সাদা প্যানেলের কাছে। উভয় প্যানেলই স্বস্ব দলের নেতাদের সামনে ল্যাজ নাড়ে। শিক্ষকতার মত মহান পেশার পেশাজীবীদের এমন কাজ দেখলে খুব কষ্ট হয়।

সাংবাদিকরা আজ অংশে অংশে বিভক্ত। এক অংশের নেতারা মার খায় অপর অংশের হাতে। এক অংশ মার খার আর অপর অংশ দুধের সর খায়। মামলা হামলা দিয়ে ক্ষমতাশীন অংশ ক্ষমতাহীন অংশকে দমিয়ে রাখে। পেশাদারিত্ব ভুলে সাংবাদিকতাকে নিয়ে গেছে দালালির সর্বোচ্চ শীখড়ে। সংবাদ মাধ্যম ও তার কর্মিরা এখন রাজনীতির হাতিয়ার। সংবাদ এখন শিল্প নয় ব্যবসায় পড়িনত হয়েছে আর সাংবাদিকরা হয়েছে ভাড়–য়া। খুবই দুঃখজনক এটা।

চিকিৎসকরা দু’ভাগে বিভক্ত। এক অংশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হলে অন্য অংশকে মনে করা হয় বিজাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী তাই ওদের নিপিড়ন কর, ওদের নিপিড়ন করা জায়েজ। ক্ষমতাশীন গ্রুপের হলে কাঙ্খীত ওএসডি, ঢাকাসহ ভালো জায়গায় পদায়ন আর ক্ষমতাহারাদের জন্য দূর্গম স্থানে পোষ্টিং।

ধর্মীয় নেতারা পর্যন্ত বিভক্ত হয়ে গেছে। তারাও লেজুর নাড়ে ধর্মের লেবাস ধরে। কে কার চেয়ে বেশি ভালো পা’চাটতে পারবে তার অসুভ প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত। দল বুঝে ফতোয়া দেয়। সুযোগ সুবিধা পেলে ফতোয়া ফেলে ক্ষমতার দিকে ঢলে।

আর রাজনীতিবীদরাতো অনেক আগেই বিভক্ত হয়ে আছে। ক্ষমতায় থাকলে টিনের চশমা পড়ে থাকে। বিরোধী গ্রুপের নেতাদের রাস্তায় ফেলে পিটায়, বস্ত্র হরণ করে, অপহরণ করে, মামলা হামলা দেয়। আবার দীর্ঘ নির্যাতনের স্বীকার হয়ে ক্ষমতায় গেলে প্রতিশোধ নেয়, অপর গ্রুপকে হামলা করে, মামলা দেয়, রক্তাক্ত করে। যতটা পেয়েছিলো তার চেয়ে বহু গুন বাড়িয়ে ফেরত দেয়। ক্ষমতায় এলে ক্ষমতাহীনদের ধার দেনা শোধ দেয় বহু গুন মুনাফা বাড়িয়ে। এ যেন এক অশুভ প্রতিযোগিতা। শুধু প্রতিযোগীতা নেই মেধার, প্রতিযোগীতা নেই সেবার, প্রতিযোগীতা নেই কর্মের।

কিন্তু এভাবে আর কতদিন? একটি বাসযোগ্য সমাজ গড়তে চাইলে এখনই সবার সহনশীল হতে হবে। হতে হবে দেশ প্রেমিক। হতে হবে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ২০০৬ সালের হামলার ঘটনার দৃষ্টান্ত মূলক বিচার হলে হয়তো আজকের ঘটনা ঘটতো না। আবার আজকের ঘটনার যদি দৃষ্টান্ত মূলক বিচার না করা হয় তবে সামনে এর চেয়েও ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে, সে জন্য অপেক্ষায় থাকুন সবাই।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here