আমার প্রিয় বন্ধু, প্রিয়জন, প্রিয় খালাতো ভাই আমির হোসেন নয়ন। নয়ন শরীয়তপুরে পা রাখার পরই শুরু হয় আমাদের ঘুরে বেড়ানো। কাছে-দূরে যত আত্মীয় স্বজন আছে সবার সাথে দেখা করার চেষ্টা করি।

আমার একটা মোটর বাইক আছে। পুরাতন, তবে ঐতিহ্যবাহী বাইক। প্রমিনেন্ট কোম্পানির তৈরী। হোন্ডা মটরস কোম্পানির তৈরী হোন্ডা সিজি ১২৫ সিসি। লাল রংয়ের মোটর সাইকেলটি আমার খুবই প্রিয়। গাড়িটি আমার কথা শোনে। আমার মনমত চলে।

এমনি একদিন দুই বন্ধু চলে যাই ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার গ্রামে। সেখানে আমাদের মেঝ খালা থাকে। আমার মায়ের বড় এই খালা। রবি খালা বলেই ডাকি আমরা। রবি খালা সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। আমার এ খালার হৃদয় অত্যন্ত নরম প্রকৃতির। আমার জীবনে খালাকে যতবার তার বাবার বাড়ি মানে আমার নানার বাড়ি আসতে দেখেছি ততবারই বাড়ির ঘাটা থেকে কাদতে কাদতে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি। সবাই বলে-কোতোয়াল বাড়ির সীমানায় পা রাখার সাথে সাথে খালার চোখে জল চলে আসে।

খালা আসতোও দীর্ঘদিন পর পর। একসময় আমাদের খাল বিল ছিলো পানিতে পূর্ণ। রাস্তা ঘাট এখনকার মত পিচঢালাতো দূরের কথা, ইট বসানোও ছিলো না। তখন যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম-শীতকালে মানবগাড়ি মানে দুই পা আর বর্ষাকালে নৌকা। খালা যেই নৌকা করে আসতো তাকে বলা হতো একমালাই নৌকা। নৌকার উপর ছাওনি দেয়া থাকতো। পর্দা থাকতো। মাঝি একমনে বাইতে থাকতো নৌকা। নৌকায় বাঁশের লগির সাথে সুন্দর বৈঠাও থাকতো। কখনো লগি দিয়ে কখনো বৈঠা দিয়ে চালাতো নৌকা। দীর্ঘ সময় নিয়ে আসতে হতো। আর নৌকা যখন নানা বাড়ির পাশের খালে ভীরতো তখনই আমরা ছোটরা দৌড়ে যেতাম নৌকার কাছে। খালাকে দেখার চেয়েও মনে হয় নৌকা দেখতেই বেশি আগ্রহ ছিলো। খালা নেমে কাদতে কাদতে বাড়িতে যেত আর আমরা নৌকায় উঠে বাদরামো করতাম। ক্লান্ত মাঝি আমাদের নিয়ে তখন আর নৌকা চালাতে চাইতো না, তাই আমরা নৌকায় উঠে বসে থাকতাম। পরে অবশ্য মাঝিকে নিয়ে ঘুরতে বেরোতাম।

আর শীতের সময়কার কথা বললে বলতে হয়-শীতকালে মাঠ ঘাট সব শুকিয়ে যেতো। তখন সব বিলের মাঝে ধান, কলই, সরিষাসহ বিভিন্ন শীতকালিন শাক সবজি চাষ হতো। খালা তখন আসতো পালকিতে চড়ে। আমরা খালার বাড়ি শীতকালে বেড়াতে গেলে পায়ে হেটে যেতাম। খালের তীর ধরে, ধান ক্ষেতের আল ধরে, কলই ক্ষেতের ধার দিয়ে হাটতে হাটতে চলে যেতাম। রবি খালার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সময় আমরা রওয়ানা দিতাম একদম কাকডাকা ভোরে। ভোর বেলা শিশির ভেজা ঘাষের মাড়াতে মাড়াতে যেতাম। কলই ক্ষেতের প্রতিটি কলইর ডগায় থাকতো শিশির বিন্দু। কনকনে শীতেও সেই শিশির বিন্দুতে হাত স্পর্শ করার লোভ সামলাতে পারতাম না। হাত শিশিরে ভিজে ঠান্ডা বরফের মত হয়ে যেতো। সামনে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পথ। কুয়াশায় এমনিতেই মাথা, শরীরের ছুয়াটার ভিজা ভিজা ভাব থাকতো। তার ওপর যদি শিশির বিন্দু হাতে মাখি অবস্থা কি হতে পারে ভাবাযায়? মায়ের বকুনি খেতে হতো। তবুও বাদরামোর স্বভাবের কারনে শিশির বিন্দু নাড়া দিয়ে ঘুমন্ত ঘাসকে, কলই শাককে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতাম।

যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। ছোট মানুষ হাটতে পাতাম না। তখন মাঝে মাঝে ক্ষেতের পাশে বসে একটু জিরিয়ে নিতে হতো। খালার বাড়িতে পৌছানোর সাথে সাথে আমাদের দানা পড়া খেজুরের গুরের হাড়ি আর বড় ডালা ভর্তি মুড়ি দিতো খেতে। হাড়িতে হাত ঢুকিয়ে গুর বের করে খাওয়ার যে কি আনন্দ সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে আজও কষ্ট হয়! এই কষ্ট শৈশব হারানোর কষ্ট! গুরগুলো দেখে মনে হতো লাল রং দিয়ে চিনি ভিজিয়ে রেখেছে। এতটাই সুস্বাদু ছিলো যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। শীতে খেজুরের গুর দুই ধরনের রস থেকে হয়। বিকেলে গাছ ছিলে হাড়ি পেতে রাখার পর খুব ভোরে রস নামিয়ে জ্বাল দিয়ে যে গুর হয় সেটা খুবই উপাদেয়। আর সকালে রস নামানোর পর আবার হাড়ি পেতে রাখলে বিকালে গাছ কাটার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত যে রসটা পরে সেটাকে ঝড়া বলে। ঝড়ার রসের গুর একটু টক টক ভাব থাকে। আমাদের জন্য ঝড়ার গুর নয়, সকালের টাটকা রসের গুরই রাখা হতো। যা আমরা কব্জি ডুবিয়ে খেতাম।

যা হোক, সেদিন দুজনে রবি খালার সাথে দেখা করতে গিয়ে দ্বিগম্বরী দীঘির পাড়ে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম। দীঘির পাড়ে ছোট একটা চায়ের দোকান আছে। আমরা দু’কাপ চা নিয়ে দীঘির ধারে গিয়ে অল্প অল্প চা খেয়েছি, বেশি সময় কাটিয়েছি। এরই ফাঁকে ফাঁকে চলেছে ফটো তোলার কাজ। নয়নের আইফোন দিয়ে আমার বেশ কয়েকটি ছবি তুলে দিয়েছিলো। চেহারা খারাপ বলাই যায়, কিন্তু ছবি তোলার হাত খারাপ সেটা বলার ধৃষ্টতা আমি দেখাতে পারি না। সুন্দর পরিবেশে দাড় করিয়ে সুন্দর ছবিটি তুলেছে আমার বন্ধু নয়ন। দীঘির পারটি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত ও আপন। এই দীঘির পারে প্রতি বৈশাখের প্রথম সাতদিন মেলা বসে। বিশাল জমজমাট হয় মেলা প্রাঙ্গন। আমরা ছোটবেলা শীতের রস-পিঠা খেতে আর বৈশাখে মেলা দেখতে অবশ্যই আসতাম। কখনো কখনো শীত আর মেলা একসময় পড়ে যেতো। তখন খুব খারাপ লাগতো, মেলাটা শীতের সময় না হলে দুইবার বেড়াতে আসাযেত এই ভেবে।

নয়ন একজন গুণি মানুষ। একাধারে একজন ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় তার সবগুণাগুন তার আছে এবং একজন সাহিত্য প্রেমি ব্যক্তিত্ব। নয়ন একজন অতি মানবিক গুন সম্পন্ন এবং সামাজিক মানুষ। তার দায়িত্ববোধ অনুকরণ ও অনুসরণ করার মত। আমি সবসময় ওকে ফলো করি এবং ওর অনেক আইডোলজি মেনে চলার চেষ্টাও করি, হয়তো পারি না। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাশের মানুষগুলোর প্রতি দায়িত্ববান একজন স্বার্থক মানুষ। আমার আদর্শ বলতেই পারি। যারা ওর সাথে চলেছে তারাই শুধু জানেন নয়ন কেমন মানুষ। নয়নের রয়েছে বই সংগ্রহের সখ। লেখালিখিও করেছেন একদা। একটা উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু লাজুক স্বভাবের মানুষ হওয়ায় সেই উপন্যাস কৃপণের মত নিজের কাছে রেখে আমাদের বঞ্চিত করেছেন। আমাদের বলা মনে হয় ঠিক হবে না। কারন আমিতো পড়েছি। আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। সকল পাঠক পড়তে পারলে তাদের কাছ থেকে পাওয়া মূল্যায়নে বুঝতে পারতাম আসলে কেমন হয়েছে। কবিতাও লিখতেন আমার বন্ধু নয়ন।

আমার গায়ের এই গেঞ্জিটা আমার খুবই প্রিয় একটি গেঞ্জি। গেঞ্জির কালারটা টাটকা লাল। আমার লাল পোশাকের প্রতি ভীষণ আগ্রহ তা কিন্তু নয়। তবে লাল ভালো লাগে মাঝে মাঝে! গেঞ্জির লাল রংটা আমার কাছে মিস্টি লাল মনে হয়। ডায়াবেটিকসে আক্রান্তরা ভয় পাবেন না! কিন্তু দুর্ভাগ্য গেঞ্জিটার রং জ্বলে গেছে। অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও আমি স্বজত্নে তুলে রেখেছি। এমন গেঞ্জি আর হয়তো পাবো না। ভালো লাগার জিনিস বেশিদিন টিকে না। যে পোশাকটা আপনার বেশি প্রিয়, যে পোশাকটা আপনার বেশি পছন্দের সেই পোশাকেই দেখবেন হয় চা পরে, ঝোল পরে, ডাল পরে নষ্ট হয়ে গেছে বা রোদে রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। যাকে বেশি ভালোবাসবেন সে দেখবেন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক আগেই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। যে জিনিস আপনি অবহেলা করে ব্যবহার করবেন, ভালোবাসবেন সে জিনিস বেশিদিন টিকে থাকে। শুনেছি গড়িলা বা বনমানুষ যে বাচ্চাটাকে বেশি ভালোবাসে সে বাচ্চাটা বাঁচে না! কারন সেই বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে আদর করতে গিয়ে এতটা জোরে চাপ দেয় যে সে মারা যায়, আর যে বাচ্চাগুলোকে কম আদর করে তারাই টিকে থাকে অবলিলায়! আমরা চারপাশে তাকালে দেখতে পাই যে শিশুগুলোকে বেশি আদর করে তারাই সামান্য মাটি মুখে দেয়ার করনে পেট খারাপ হয়, মাটিতে হামাগুড়ি দেয়ার কারনে ঠান্ডালেগে যায়, একটু পুকুরে গোসল করলে নিমুনিয়া হয়ে যায় এমনকি এসব ঘটনায় মারাও যায়। অপরদিকে যে বাচ্চাগুলো অবহেলায় বড় হয় তারা দিব্যি টিকে থাকে। রাজধানী ঢাকাসহ সকল শহরের ফুটপাতে যে শিশুগুলো ডাস্টবিনের খাবার খায়, রাতে খালিগায়ে ঘুমায়, শরীরে ময়লার স্তর পরে থাকে, অত্যন্ত অযত্ন-অবহেলায় বাড়তে থাকে তারা খুব একটা অসুস্থ্য হয় না, দিব্বি বড় হচ্ছে! এটা আমার একান্ত নিজস্ব ভাবনা। আপনাদের কাছে অন্য কিছুও হতে পারে। আমি আমারটা শেয়ার করলাম আপনাদের সাথে। আপনারাও আপনাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন।

সেদিনের রবি খালার বাড়ি ভ্রমণ স্মৃতির জানালায় কড়া নাড়লো এই ছবিটা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেখি একবছর আগের পোষ্ট করা ছবিটা ভেসে উঠেছে। ছবিটার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খালাবাড়ি বেড়ানোর অনেক কথাই মনের জানালা দিয়ে উকি দিলো। আরো অনেক কথাই আছে যা আরেকদিন বলবো। আজ নয়নকে ধন্যবাদ দিয়েই শেষ করতে চাই। ধন্যবাদ নয়ন, সুন্দর ছবিটা উপহার দেয়ার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here