শরীয়তপুর সরকারি কলেজের যাত্রা শুরু সেই ৯ জুন ১৯৭৮ সাল থেকে। পরবর্তীতে ১ মার্চ, ১৯৮০ সালে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। কলেজটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পশ্চাৎপদ শরীয়তপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীসহ আশ পাশের জেলার শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা লাভে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। শরীয়তপুর সরকারি কলেজ শুধু শিক্ষাগ্রহণের উন্নত পরিবেশ তৈরীই নয় বরং কলেজটি শরীয়তপুর বাসির আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কেন্দ্রস্থলে রূপান্তর করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় আমারমত হাজারো শিক্ষার্থী আজ শরীয়তপুর সরকারি কলেজ থেকে শিক্ষার আলো নিয়ে পথ চলছে।

প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পর ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাশ করে আমি শরীয়তপুর সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে সান্নিধ্য পেয়েছিলাম পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক এম এ আজিজ মিয়া, রসায়ন বিদ্যার শিক্ষক শামসুল আলম খান, গণিত বিভাগের শিক্ষক কালিপদ স্যার, বাংলা বিভাগের শিক্ষক বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ মনোয়ার হোসেন, প্রাণী বিজ্ঞানের তোফাজ্জল হোসেন স্যারের মত গুণী শিক্ষকদের। যাদের স্নেহ, ভালোবাসা, শিক্ষা, উৎসাহ ও প্রদর্শিত পথ ধরে আজও হাটার চেষ্টা করছি আমরা।

কলেজ জীবনের প্রথম একটা ঘটনা আজও হৃদয়ে গেথে আছে। ঘটনা আমার হৃদয়ে যতটা দাগ কেটেছে তারচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে বন্ধু মাহমুদুল হাসান মিলনের গালে। প্রধান সড়ক থেকে কলেজে প্রবেশের রাস্তার শেষ ভাগের ভবনের নিচ তলায় ছিলো আমাদের একটি শ্রেণীকক্ষ। ক্লাশের প্রথম দিনেই আমি, বন্ধু মাহমুদুল হাসান মিলন, মোল্লা আলিমুজ্জামান, শামীম আজিজ, সরদার আজিজুর রহমান রোকন, আনোয়ার হোসেন, সুশান্ত কুমার কংসবণিক সহ অন্য সহপাঠীরা বসেছিলাম জানালার কাছে। ভবনের সামনে ছিলো একটা খেজুর গাছ। হঠাৎ একটা মিছিল নিয়ে কিছু ছাত্র কলেজের ভিতরের দিকে যাওয়ার সময় আতংক সৃষ্টি করার জন্য খেজুর গাছ লক্ষ্য করে একটি ককটেল নিক্ষেপ করে। হাতের নিশানা ভালো না হওয়ায় ককটেল গিয়ে গাছের পরিবর্তে আঘাত করে ভবনের দেয়ালে। বিস্ফোরনের সাথে সাথে কিছু স্প্রিন্টার জানালা দিয়ে আঘাত করে মাহমুদুল হাসান মিলনের গালে। আজও সেই দাগ বয়ে বেরাচ্ছে মিলন।

একদিন বাংলা পাঠদানের সময় ক্লাস নিচ্ছেন মোঃ মনোয়ার হোসেন স্যার। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার করছেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ওপার বাংলায়। আলোচনার এক পর্যায়ে আমি অজ্ঞতা বসত পিছন থেকে বলেছিলাম ‘তাহলে কাজী নজরুল ইসলাম হলো আমাদের দেশের ধার করা কবি’। কথাটা স্যারের কানে যাওয়ার সাথে সাথে ভীষণ ক্ষেপেগিয়েছিলেন। কথাটা কে বলেছে সেটা নির্ধারণ করে আমাকে লজ্জা দিতে পারতেন। কিন্তু স্যার সেদিন তার উদারতা দিয়ে তা না করে বরং আলোচনার মাধ্যমেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেদিনের সেই অনাকাঙ্খিত কথাটা বলায় স্যার আমাকে সরাসরি লজ্জা না দিলেও মনে পড়লে এখনও আমি লজ্জাবোধ করি।

কলেজ জীবনে সাইন্সের ছাত্র হিসাবে যদিও খুব বেশি অবসর সময় আমরা পেতাম না, তবুও যতটুকু সময় পেয়েছি তা কেটেছে জামরুল গাছের নিচে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে, কখনো মাঠে খেলাধুলা করে। বেশিরভাগ সময়ই কাটতো আমাদের লাইব্রেরীতে, ল্যাবে অথবা ক্লাসরুমে। ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়তাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। সাইন্সের ছাত্ররা রাজনীতি করার সময় ও সুযোগ পেত কম। কিন্তু ক্লাসে বসে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা কাজী নজরুল ইসলাম ভাইর দরাজ কন্ঠে স্লোগান, ভাষন আজও মনে আছে। আনন্দ ঘন সময় কাটতো বিজ্ঞান মেলায়, কলেজের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতায়, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আর বন্ধু-বান্ধবিদের সাথে গল্প করে। কলেজের বান্ধবী লাবনী লুবনা রাজ যদিও অল্প কয়েকদিন আমাদের কলেজে ছিলো, তবুও তাকে আমরা ভুলতে পারিনি। রিমা, সাম্মী রহমান, মেবিন, সুমি, রানু, তানিয়া, রিনা, নাজমা, সোনালী দেবনাথ, মানিক দেবনাথ, দীপক কুমার কংসবণিক, বশির, জ্ঞান প্রকাশ সহ সকল বন্ধুরা আজ শরীয়তপুর সরকারি কলেজের দেয়া সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পদ অর্জন করে দেশের সেবা করে যাচ্ছে। সাইন্সের ছাত্র হলেও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে আমাদের ছিলো সমান হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক। ল্যাব সহকারী মনসুর ভাই, খালেক ভাইদের সহযোগীতাও ভুলে যাওয়া মত নয়।

শরীয়তপুর সরকারি কলেজ এখন কতটা সমৃদ্ধ সেটা বলে বোঝানো যাবে না। কলেজে এখন বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পড়ছে। কলেজে হোস্টেল হয়েছে। দূর দূরান্ত থেকে আর বাই সাইকেল চালিয়ে বা লজিং থেকে পড়তে হয় না শিক্ষার্থীদের। একাধিক একাডেমিক ভবন হয়েছে। সেই চিরচেনা পরিবেশ আর নেই। বদলে গেছে কলেজের পরিবেশ। অনেকটা উন্নত হয়েছে যা প্রত্যাশা করতাম আমরা।

দেখতে দেখতে চল্লিশ বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে শরীয়তপুর সরকারি কলেজ। এই কলেজের অনেক শিক্ষার্থী আজ প্রফেসর, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আইনজীবী, কবি, লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিক হয়ে স্বস্ব পেশায় কৃতিত্বের সাক্ষর রাখছেন, ভবিষ্যতে নানান শাখায় কৃতিত্বের পরিচয় দিবেন।

শরীয়তপুর সরকারি কলেজ শরীয়তপুর জেলাই নয়, আশ পাশের জেলাগুলোর শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে সমৃদ্ধ করে চলেছে। একসময় স্নাতক পর্যন্ত পড়ানো হতো, পর্যায় ক্রমে তা স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর শ্রেণী যুক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে পদ্মা পাড়ের জেলা শরীয়তপুরের উপর দিয়ে তৈরী হচ্ছে দেশের সবচেয়ে মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু কেবল দেশের দক্ষিণ আর পূর্বাঞ্চলের সেতুবন্ধনই হবে না, এই সেতু এশিয়ান হাইওয়ের রুট এর অংশ হিসেবেও ব্যবহার হবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। পদ্মা সেতুর দুই তীরে হংকংয়ের আদলে শহর গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। এখানে একটা ভালো কনভেনশন সেন্টার করা হবে, বাণিজ্য মেলাটাও ঢাকা থেকে স্থানান্তরের পরিকল্পনা চলছে। ফলে এখানে বিনোদনের জন্য চমৎকার ব্যবস্থা হবে। পদ্মা তীর ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে। কাজেই পদ্মা পাড়ে নতুন একটা আলাদা শহর গড়ে তুলতে নানান পরিকল্পনা হাতে নিচ্ছে সরকার। পদ্মার এপাড়েই নতুন একটি বিমানবন্দর নির্মাণ করা হবে। অলিম্পিক ভিলেজ, তাত পল্লীসহ দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে হংকংয়ের মতো শহর হবে শরীয়তপুরের পদ্মা পাড়।

শিক্ষায় সমৃদ্ধ হলেই একটি জেলা পরিপূর্ণরূপে সমৃদ্ধ হয়। ঢাকার উপর চাপ কমাতে হলে পশ্চাৎপদ শরীয়তপুর জেলায় একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন সবার প্রাণের ও যৌক্তিক দাবী হতে পারে। শরীয়তপুর সরকারি কলেজ একদিন বিশ্ববিদ্যালয় হবে, এতদাঞ্চলের মানুষ উন্নত ও মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ পাবে সেই প্রত্যাশা কলেজ প্রতিষ্ঠার চল্লিশ বছর পর আমরা করতেই পারি। সরকারের কাছে আমাদের দৃঢ় প্রত্যাশা, শরীয়তপুর সরকারি কলেজকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর করুক। রাজধানী ঢাকার উপর চাপ কমাতে এবং পশ্চাৎপদ জেলাটিকে একটি সমৃদ্ধ জেলা হিসাবে রূপদানের জন্য এর চেয়ে ভালো পদক্ষেপ হতে পারে বলে আমরা মনে করি না।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here