উহান থেকে এহানে এসে গেছে করোনা ভাইরাস! এটা আবার কেমন কথা? হ্যা এটাই সত্যি। আমরা হলাম গ্রামের মানুষ। যারা গ্রামে থাকেন বা কোন সময় গ্রামে কাটিয়েছেন তারা আমার উহান-এহান বুঝবেন। করোনা ভাইরাস আজ বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছে ক্ষুদ্রকে অবজ্ঞা করো না। ছোট হলেও তার ভিতর তেজ থাকতে পারে, ক্ষমতা থাকতে পারে, পারে সব ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দিতে। চোখে দেখা যায় না এমন ক্ষুদ্র ভাইরাসই কিন্তু ক্ষমতা দেখিয়েছে গত শতকের প্রথম দশকে। জ্বী, আমি ১৯১৮-১৯১৯ সালের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি। আজ থেকে একশ বছর পূর্বে চোখে দেখা যায় না এমনই এক ভাইরাস বিশ্বের পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিলো। এবার আবার হানা দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায় কতজন নেয় আর পরিসংখ্যানের বাইরে কতজন নেয় তা হয়তো জানাযাবে কিছুদিন পরে। অবশ্য আপনি জেনে যেতে পারবেন কীনা সেটা আপনিও বলতে পারেন না আর আমিও জানাতে পারবো কীনা সেটাও আমি বলতে পারি না।
করোনাভাইরাসের যে ধরনটি ইতোমধ্যেই বিশ্বের অর্ধলক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে সেটি খুবই পরিচিত ও ভীতিকর বলে চিকিৎসকরা উল্লেখ করছেন। এই ভাইরাসটি যে প্যাথোজেন পরিবারের, তার নাম করোনাভাইরাস, যার কারণে এর আগে সার্স ও মার্স ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছিল। সার্সে আক্রান্তদের ৯% এবং মার্সে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৩৫% মারা গেছেন। হঠাৎ এই নতুন ভাইরাসটি কোত্থেকে এলো এবং এটা কতোটা ভয়াবহ? বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যে ধরনের করোনা ভাইরাস থেকে সার্স ও মার্স ভাইরাসের জন্ম হয়েছিল এবং এখন নতুন করে যে ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিয়েছে সেগুলোর কোনটির উৎপত্তি মানুষ থেকে হয়নি। বরং এসবের জন্ম হয়েছে প্রাণী থেকে। অনেক প্রাণীই তাদের শরীরে বিপদজনক ভাইরাস বহন করে কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য যে এসব ভাইরাস এক লাফে মানবদেহে চলে আসতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটি বাধা আছে এবং ভাইরাসটি সেই বাধা অতিক্রম করতে পারে না, কথাগুলো বলেছেন ওয়ারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী প্রফেসর অ্যান্ড্রু ইস্টন। তবে কখনো কখনো কারো শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা যদি দুর্বল থাকে, অথবা অন্য কোন বিশেষ কারণ থাকে, তখনও ভাইরাসটি প্রাণী থেকে মানুষের শরীরেও চলে আসতে পারে। আর এটি ঘটে ভাইরাসটির রূপান্তরের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ প্রাণীর দেহে ওই ভাইরাসটির জিনগত গঠন যেরকম ছিল তাতে সে পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষের শরীরে আশ্রয় নিতে পারে। নতুন পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য ভাইরাসটিকে নিজের গঠনে কিছু পরিবর্তন ঘটাতে হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ঘটনা বিরল এবং এই প্রক্রিয়ায় করোনা ভাইরাস যখন মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তখন সেটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। সব ধরনের করোনা ভাইরাসই অতোটা বিপদজনক নয়। কিন্তু যেসব ভাইরাস পশুপাখি থেকে মানুষে চলে আসতে পারে সেগুলো খুবই বিপদজনক হয়। প্রফেসর ইস্টন বলেন, যখন একটি ভাইরাস এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতিতে চলে যায় তখন আগে থেকে ধারণা করা যায় না যে এটি ঠিক কী ধরনের কাণ্ড ঘটাবে। তবে এটি তার নতুন আবাসস্থলে গিয়ে প্রাথমিক পর্যায়েই মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এর পেছনে কারণ হচ্ছে, যখন ভাইরাসটি কোন প্রাণী থেকে হঠাৎ মানুষের শরীরে গিয়ে প্রবেশ করে, তখন আমাদের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা তাকে চিনতে পারে না। কারণ এই ভাইরাস মোকাবেলায় মানবদেহের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। ফলে ভাইরাসটির কারণে মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সমস্যা হয়। যেমন জলজ পাখি থেকে যে ফ্লু ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে আসে, তখন সংক্রমণের তীব্রতা অনেক বেড়ে যায়। ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে উঠেছিল ১৯১৮ থেকে ১৯১৯ সালে। ওই ভাইরাসে পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ধারণা করা হয় যে ওই ভাইরাসটি এসেছিল পাখি থেকে।
প্রথম দিকে করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের আঙ্গুল উঠেছিলো চীনের দিকে। সবাই বলাবলি করছিলো যে করোনা ভাইরাস চীনের সৃষ্টি। চীনের কোন এক ল্যাবে জীবানু অস্ত্র তৈরীর জন্য ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা করছিলো। গবেষণাগারে ভাইরাসটির চাষবাসের সময় অসাবধানতাবশত লোকালয়ে চলে এসেছে এবং মহামারি রূপ ধারণ করেছে। এ নিয়ে মুখোরোচক গল্প তার ডালপালা বিস্তার ঘটিয়েছে সারা বিশ্বে যেমনটি বিস্তার ঘটিয়েছে ভাইরাসটি। SARS-CoV-19 মানুষের তৈরি ভাইরাস না হয়ে বরং বাদুড় থেকে মানুষের মধ্যে প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত হতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারনা। এই ভাইরাসটির কারণে সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রাথমিকভাবে উহানের হুয়ানান সামুদ্রিক খাবারের পাইকারী মার্কেটটিকে, পশু উৎস থেকে সংক্রমণের প্রাথমিক স্থান বলে মনে করা হয়, কারণ ৪১ জন ভাইরাল নিউমোনিয়ার রোগীর মধ্যে ২৭ জনের ক্ষেত্রে এই বাজারের সাথে সরাসরি সংলগ্নতা ছিল, যার মধ্যে কিছু ছিল খুচরা বিক্রেতা এবং কিছু ছিল গ্রাহক। ১২ই ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে এই মহামারীর শুরু হয় করোনা ভাইরাসের একটি নতুন স্ট্রেইনের মাধ্যমে, যা ৭ জানুয়ারী ২০২০-এ অস্থায়ীভাবে nCOV-2019 নামকরন করা হয়। এই বৃহত্তর বৈশ্বয়িক মহামারীর প্রতিক্রিয়ায় চীন এবং অন্যান্য দেশ উভয়ই ভ্রমণ সীমাবদ্ধতা, পৃথকীকরণ এবং কারফিউ শুরু করে। নতুন আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২৩ জানুয়ারী ২০২০ একে জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা বলে ঘোষনা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মহামারীকে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের চেয়েও বেশি শক্তিশালী বলে আখ্যায়িত করে। অবশেষে, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ এ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একে COVID-19 নামে নামকরণ করে এবং একই দিনে ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ইন টেক্সোনমি অব ভাইরাস এর করোনা ভাইরাস স্টাডি গ্রুপ (CSG) এই ভাইরাসের নামকরণ করে SARS-CoV-2। প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ভাইরাসটি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পরেছে। প্রাণ কেড়ে নিয়েছে প্রায় সত্তর হাজারের উপরে। আরো কতটা প্রাণ কেড়ে নিয়ে সে থামবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে ভাইরাসটি টিকে থাকার স্বার্থে ৩৮০ বার নিজের জিন বদলে ফেলেছে। থামার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত আরো কতবার রূপ বদলায় তা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবে, কিন্তু তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ভাইরাসটির উদ্ভব হয়েছে বা জানান দিয়েছে চীন থেকে। চীন থেকে উদ্ভব হয়ে সবাইকে চিনে ফেলছে। চিনতে চিনতে পৌছে যাচ্ছে সকলের বাড়ি বাড়ি, শরীরে শরীরে। আমরাই আমন্ত্রণ করছি তাকে। অচিনা হলে আমন্ত্রণ নিশ্চই কেউ করতো না, চীন থেকে আগত চিনা ভাইরাসটিকে হাতে নিয়ে নাকে, মুখে, চোখে পৌছে দিচ্ছি। আমি লেখার শুরুতেই বলেছিলাম আমরা হলাম গ্রামের মানুষ। গ্রামের মানুষ শহুরে মানুষ থেকে একটু বেশিই অতিথিপরায়ন হয়। এটা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। গ্রামে উহান মানে ঐখান আর এহান মানে এখানে। তাইতো বলছি যে, চীনের উহান (ঐখান) থেকে এহান (বাংলার এইখান) পৌছে গেছে করোনা ভাইরাস। শরীয়তপুরের নড়িয়ায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনায় চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে অতিথিপরায়ন নড়িয়াবাসী এহানেও নিয়ে এসেছে করোনাকে। অতিথি এসে গেছে, কিন্তু সাবধান, অতিথিকে পাশের বাড়ি, পাশের গ্রামে, পাশের থানায়, পাশের জেলায় পাঠাবেন না। নিজে এনেছেন নিজেই কোয়ারেন্টিনে থেকে আতিথেয়তা করেন, অন্যকে সুস্থ্য রাখেন।