বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে ভয়ংকর মারনাস্ত্র কি, যদি এমন প্রশ্ন করা হয় তবে এক বাক্যে সবাই বলবে, আবার কি? করোনা ভাইরাস, যাকে কেভিড-১৯ বলে! হ্যা, সত্যিই তাই। করোনাই এখন সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র যা কিনা একটি ভাইরা, চোখে দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। এই ভাইরাস দারা কেউ কাউকে আঘাত করে না, একজন থেকে আরেকজনে বাহিত হয়। কিভাবে বাহিত হয় তা বহনকারী নিজেও জানেনি, যে বহন করলো সেও জানলো না কার কাছ থেকে বহন করলো। হতে পারে কোন চেয়ার-টেবিল থেকে, হতে পারে সিড়ির হাতল থেকে, হতে পারে কোন মানুষের হাত থেকে, হতে পারে মানুষের হাচি-কাশির সময় সামনে থাকলে সেখান থেকে। কী ভয়ংকর ভাবা যায়!
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ থেকে উত্তোরণের একটাই উপায় বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সেটা হলো ট্রান্সমিশন রুখে দেয়া। ভাইরাসটাকে একঘরে করে রাখা আরকি। সেটা করার উপায় কি? এই অদৃশ্য ভাইরাস যদি কাউকে আক্রান্ত করে তাকে আইসোলেশনে রাখতে হবে। যারা আক্রান্তর সংস্পর্শে আসছে তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে অন্তত চৌদ্দ দিন। এই চৌদ্দ দিনে যদি নতুন কারো মধ্যে এর উপসর্গ দেখা না দেয় তবে ধরে নেয়া যাবে তারা আশংকা মুক্ত। এভাবেই ব্যক্তিকে একঘরে করলেই পরিবার বাঁচবে, পরিবারকে একঘরে করলে গ্রাম বাঁচবে। গ্রামে যদি ছড়িয়ে যায় তাহলে গ্রাম একঘরে করে রাখলে থানা এলাকার অন্যরা বাঁচবে, থানা এলাকা একঘরে করে রাখলে জেলার অন্যরা বাঁচবে এবং জেলা একঘরে করে রাখলে সারা দেশ বাঁচবে।
এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন চিকিৎসা সেবা প্রাপ্তি। এর পাশাপাশি যেটা প্রয়োজন হয়ে দাড়িয়েছে সেটা খাদ্য সরবরাহ। সবকিছু লকডাউন। শুধু লকডাউনের বাইরে আছে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের দোকান, কাচা সবজির দোকান, ঔষধের দোকন, হাসপাতাল, চিকিৎসকদের মন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, সংকট মোকাবিলা সমন্বয়ের জন্য প্রশাসন। পৃথিবীতে যেটা কখনোই বন্ধ থাকে না সেটা হলো আমাদের ক্ষুধার দূয়ার, সেটা ঠিকই খোলা আছে। দেশে বিদেশে এখন লকডাউন, এই পরিস্থিতিতে যা নেই তা হলো মানুষের হাতে কাজ নেই। কাজ নেই তো রোজগারও নেই। আমাদের দেশে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের কাজ নেইতো ঘরে খাবারও নেই। এমন পরিস্থিতিতে খাবার সরবরাহটা খুবই জরুরী।
জরুরী এমন পরিস্থিতিতে সরকার নানান কর্মসূচী হাতে নেয়। দেশের অনেক বিত্তবান মানুষ এগিয়ে আসে সাহায্যের হাত নিয়ে। সরকার বা বিত্তবান মানুষ যা দেয় তাকে আমরা বলি ত্রাণ। ত্রাণ এর আবিধানিক অর্থ খুজলে বাংলায় পাওয়া যায়-রক্ষা, মুক্তি, উদ্ধার আর ইংরেজীতে-Saving, rescue, salvation, deliverance, protection, relief. ত্রাণ বলতে আমরা সাহায্যও বুঝি। সাহায্যের আবিধানিক অর্থ সহায়তা (যুক্তির সাহায্যে), উপকার, আনুকূল্য (বিপদে সাহায্য করা), সহায়তা। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে সহযোগিতা হলো দু’জন বা আরও বেশি লোক বা সংস্থাগুলি একসাথে কোনও কাজ শেষ করতে বা লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করা। সহযোগিতা সাহায্যর অনুরূপ। বেশিরভাগ সহযোগিতায় নেতৃত্বের প্রয়োজন, যদিও নেতৃত্বের গঠনটি বিকেন্দ্রীভূত। সীমাবদ্ধ সম্পদের প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে যে দলগুলি যৌথভাবে কাজ করে তারা প্রায়শই বৃহত্তর সংস্থান, স্বীকৃতি এবং পুরস্কারপ্রাপ্তিতে অধিগমন করে। সহযোগিতার কাঠামোগত পদ্ধতিগুলি আচরণ এবং যোগাযোগের অন্তঃদর্শনকে উৎসাহ দেয়। এটি দলগুলির সাফল্য বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। সহযোগিতা বিদ্বেষমূলক সহযোগিতার ধারণাটি প্রদর্শনের বিরোধী লক্ষ্যে উপস্থিত রয়েছে, যদিও এটি এই শব্দটির সাধারণ ব্যবহার নয়। এর প্রয়োগকৃত অর্থে, সহযোগিতা হলো উদ্দেশ্যমূলক সম্পর্ক, যাতে অংশীদারি ফল অর্জনের জন্য সমস্ত পক্ষ কৌশলগতভাবে সহযোগিতা করতে বেছে নেয়।
এই সময়ে ত্রাণ বলি, সহায্য বলি বা সহযোগিতা যাই বলিনা কেন সেটা মানুষের খুব প্রয়োজন।এখানে কিছু মানুষের জীবন বাঁচাতে ত্রাণ প্রয়োজন। হাতে কাজ নেই, ঘরে জমানো অর্থ নেই যে তা দিয়ে একবেলার খাবারের ব্যবস্থা করবে পরিবারের জন্য। এমন অনেক মানুষ আছে যারা খাবারের ব্যবস্থা যেমন করতে পারছে না তেমনি কারো কাছে হাতও পাততে পারছে না। হ্যা, আমি সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর কথাই বলছি। আমরা অনেকেই বলছি বড়লোকের ধন আছে, গরীবের সরকার আছে কিন্তু মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তদের কেউ নেই। তারা বলতেও পারে না, ক্ষুধার জ্বালা সহ্যও করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে কিভাবে তাদের সহযোগিতা করা যায় তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। আর এই পরিস্থিতিতে যেটা করা হচ্ছে সেটা অবশ্যই ভিক্ষা নয়, এটা আমাদের মাথায় থাকা উচিত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা কি দেখছি সেটা সবারই জানা আছে। এক প্যাকেট ত্রাণ বিলি করার জন্য পনের থেকে বিশ জন মানুষ হাত বাড়ায়। কোথাও কোথাও এক প্যাকেট ত্রাণের জন্য কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার মানুষ হাত বাড়ায় সেটাও আমরা দেখি। কিন্তু কয়েক হাজার মানুষের হাত বাড়ানোর সাথে পনের বিশ জনের হাত বাড়ানোর একটা পার্থক্য আছে। ফটো সেশনের জন্য করা হয় এটা। করোনার কারনে এমনিতেই বলা হয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। কিন্তু এমন ভাবে ত্রাণ বিলি করা হচ্ছে দেখা বুঝার উপায় নাই যে কে ত্রাণ দিচ্ছে! আমরা ছবিগুলো দেখেই অনুমান করতে পারি মলিন পোশাক পড়া মানুষটাই ত্রাণ নিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা এমন যে, দেখে মনে হয় মলিন পোশাক পড়া মানুষটা পরিপাটি পোশাক পড়া একদল ভুভুক্ষ মানুষের হাতে ত্রাণ তুলে দিচ্ছে এবং সেই তেল চকচকে পরিপাটি পোশাক পড়া মানুষগুলো একসাথে ত্রাণের প্যাকেটটা কেড়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে মজার মজার প্রশ্নও তৈরী হয়েছে। মানুষ এখন প্রশ্ন করে, একজন ত্রাণ গ্রহীতা মানুষকে এক মগ চাল দিতে যদি বিশ জন লাগে তবে এক কোটি মানুষকে ত্রাণ দিতে কতজন মানুষ লাগবে? কথাটা হাস্যকর মনে হলেও এটাই এখনকার চিত্র। আসলে সাধারণ মানুষগুলোর জন্য জীবন বাঁচাতে ত্রাণ।
ত্রাণ। শব্দটা কালে আসলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে কিছু লুটেরার মুখ। এরা আর কেউ না, হয় কোন চেয়ারম্যান, কোন মেম্বার, কোন ডিলার, দলীয় কোন নেতা এর উপরেও আছে, বলতে ভয় লাগছে তাই আর বলছি না। হয়তো বলবেন চেয়ারম্যান-মেম্বার-নেতার সাথে ফাইট করে পারবেন ভাবছেন! আসলে তাও না। সময় খারাপ হলে সাদা কাপড় ধুইলেও তা থেকে রংওঠে! আইনজীবীতো আমি। তাই নানান আইন চোখের সামনে ভাসে। তথ্য প্রযুক্তি আইন এখন এমনই একটা আইন যা করোনার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তাই সেদিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে, না? আমিওতো একটা পরিবারের কর্তা। মধ্যবিত্ত পরিবারের কর্তা হওয়ায় আমাকেও সবদিক ভেবে কথা বলা উচিত। এই লুটেরাদের কাছে ত্রাণ জীবন সাজাতে প্রয়োজন। যখন সরকার জনগন বান্ধব প্রকল্প হাতে নিয়ে দশ টাকার কেজি চাল বাজারে ছাড়লো তখন দেশের কোন দোকানেই বিশ-ত্রিশও নয় চাল চলে গেছে চল্লিশ টাকার উপরে। একটু ভালো খেতে চাইলে চাল কিনতে হয় ষাট টাকা কেজিতে। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া দশ টাকা কেজির চাল দরিদ্র জনগণের কাছে না পৌছে চলে গেলো অনেক চেয়ারম্যানের নিজস্ব গুদামে, নেতাদের আড়তে, মেম্বারের ড্রামে, ডিলারের গোপন আস্তানায়। সবাই যে খারাপ তা কিন্তু নয়। অনেক চেয়ারম্যান-মেম্বার আছেন যারা সরকার থেকে পাওয়া সাহায্যের সাথে নিজে আরো যুক্ত করে দিচ্ছেন। অনেক নেতা আছেন যারা নিজ কাধে ত্রাণ সামগ্রী বয়ে নিয়ে নিরবে নিভৃতে পৌছে দিচ্ছেন। মন্দ লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু প্রবাদে পড়েছি, এক ঝুড়ি আম পচিয়ে ফেলতে একটা পচা আমই যথেষ্ট। আর সেটাই সবসময় হয়। গুটিকয়েক পচা মানুষ নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সমগ্র কমিনিটির উপর কালিমা লেপন করেন।
ত্রাণ বিতরণ দরকার মানুষের জন্য, সেলফি তোলার জন্য নয়। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশ নেয়া দরকার জীবন বাঁচাতে, নিজের সংসার সাজাতে নয়। আপনি-আমি কেউই জানিনা, যে চাল-ডাল-ত্রাণ আমি মারছি, সেটা নিজে ভোগ করে যেতে পারবো কিনা। মৃত্যু দুয়ারে দাড়িয়ে আছে। যে কোন সময় যে কেউ চলে যেতে পারেন। আপনার রেখে যাওয়া চোরাই ত্রাণ কোন কাজে লাগবে না, কিন্তু সাধারণ মানুষের অভিষাপ ঠিকই লাগবে। মানুষের পাশে দাড়ান, এমন ভাবে দাড়ান যেন সে টেরও না পায়, সে যেন লজ্জিত না হয়, সে যেন হীনমন্যতায় না ভোগে। তাই আবারও বলবো, ত্রাণঃ জীবন বাঁচাতে, জীবন সাজাতে নয়।