সারা বিশ্বে এখন চলছে এক ভয়াবহ মহামারী। করোনার তান্ডবে দিশেহারা বিশ্ব। করোনা মোকাবিলার সাথে সাথে ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে হচ্ছে রাষ্ট্র প্রধানদের। করোনা পরবর্তী ধাক্কা মোকাবিলায় বিভিন্ন কর্মসূচী চিন্তাভাবনা করছে এবং বিভিন্ন প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করছে সরকার। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে ৭২,৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। পরে কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা এছাড়াও সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা অর্থাৎ ধান কাটা ও মাড়াইয়ে মোট ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়াও চিকিৎসা সেবা কর্মী, নিরাপত্তা বাহিনীর জন্যও বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রনোদনা প্রয়োজনের তুলনায় কোথাও কম বেশি আছে। এর একটা কারনও আছে, যাদের জোর বেশি তারাই প্রনোদনা বেশি বাগিয়ে নিতে পেরেছে। এটা অবশ্য ভিন্ন বিতর্কের বিষয়। তবে বিভিন্ন সেক্টরের প্রনোদনা ঘোষণা দেখে আমাদের দেশের ফেবুজীবীরা (ফেসবুক বুদ্ধিজীবী) নানান রকম হিসাব নিকাশ করছেন। বাহাত্তর হাজার সাতশত পঞ্চাশ কোটি টাকাকে সামনে এনে কেই কেউ হিসাব করে দেখেছেন তারা মাথাপিছু কত করে পান। হিসাবে কেউ দেখছেন চার হাজার দুইশত উনআশি টাকা হারে পান, কেউ বলেন চার হাজার দুইশত চুয়াত্তর আবার কেউ আরো বেশি দাবী করছেন। তারা বলছেন, আমার ভাগেরটা কই? বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন, আমার ভাগের কম্বলটা কই? সেই সুরেই সবাই বলতে শুরু করছেন আমার ভাগের টাকাটা কোথায়, আমার টাকা আমাকে দেয়া হোক। কতটা হাস্যকর দাবী ভাবাযায়? প্রনোদনা কী কখনো মাথাপিছু বরাদ্দ করা হয়? আমি অর্থনীতি বুঝি না, তাই বলতে পারবো না। তবে প্রনোদনা ঘোষণার সাথে সাথে সেটা কোন কোন খাতে, কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সেই নির্দেশও দেয়া হয়েছে। কেউ সেদিকে নজর না দিলেও পরিবারের সংখ্যা অনুযায় ভাগ করে দাবী করতে কার্পন্য করেনি।

নাম প্রকাশ না করে একজন ফেবুজীবীর স্টাটাস হুবহু তুলে ধরলাম। তার শব্দ গঠন ও বানান নিয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। তার স্টাটাসটি এমন-“বাংলা দেশে মোট জন সংখ্যা ১৬ কুটি ৪৬ লাখ । ১ কুটি প্রবাসে ১ কুটি শিশু ২ কুটি বিত্ত বান ১০ কুটি মধ্য বিত্ত ৩ কুটি গরিব। দরুন টোটাল জনসংখ্যা ১৭ কুটি। সরকার বর্তমান মহামারীতে জনগণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন। ৭২৭২৬ কুটি টাকা তা হলে প্রতি টা মাথা পিচু পাওয়ার কথা = ৪২৭৪ টাকা কিন্তু ১০% লোকজন চাউল পাচ্ছে। কোথায় ও ৫ কেজি কোথাও ১০ কেজি। কেউ কেউ চাউলের জন্য গিয়ে সাথে পিডা ও খাচ্ছেন। চার দিগে হাহাকার ৫ কেজি চাউল দিয়ে চবি তুলে ১০ টা ফেসবুকে আপলোড দেয় আমরা চাউল দিচ্ছি চাউল কি তোদের বাবার টাকা দিয়ে কিনে দিসচ্চ নাকি এই চাউল জনগণের টাকা”; আরেক ফেবুজীবীর স্টাটাস এমন-“সরকার ৭২৭৫০ কোটি টাকা দিছে। ১৭ কোটি জনগন দরে মাথাপতি ভাগ করলে পায় ৪২৭৯ টাকা। আমার পরিবারে ৭ জন আছি। সে হিসাবে আমরা পাই ২৯৯৫৩ টাকা। আমার টাকাডা গেলো কই?”

এবার বুঝুন কী ভয়ংকর হিসাব নিয়ে বসে গেছে এই বুদ্ধিজীবীরা! তারা যেভাবে টাকা দাবী করছে তা অর্থনীতির কোন সূত্রে পরে আমার জানা নেই, আপনাদের জানা থাকলে একটু দয়া করে জানাবেন। ভাগ্য ভালো তারা শুধু বাহাত্তর হাজার সাতশত পঞ্চাশ কোটির কথাই শুনেছে, আরো যে বিভিন্ন খাতে প্রনোদনা দিয়েছে সেটা এখনও খবর পায়নি। অন্যান্য প্রনোদনা যোগ করে যদি মাথাপিছু ভাগ করা শুরু করে তবে সরকার কিভাবে দেবেন তা মহান আল্লাহই ভালো জানেন!

এবার আসি মূল প্রনোদনার বিষয়ে। বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যম থেকে জানাযায়, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ৭২,৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণের জন্য নতুন ৪টি সহ ৫টি প্যাকেজে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেন তিনি। এতে করোনার সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরার পাশাপাশি প্রাণঘাতী করোনা মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত নানান পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ইতোপূর্বে রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলাম। সেটিসহ মোট আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের পরিমাণ হবে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা যা জিডিপি’র প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত আর্থিক সহায়তার প্যাকেজে যা রয়েছে- সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি: সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা ও মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি এই চারটি কার্যক্রম নিয়ে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে দেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব ও উত্তরণের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। কর্মপরিকল্পনার আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের আওতায় এ টাকা প্রদান করা হবে।

প্যাকেজ-১: ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান: ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সংশ্লিষ্ট শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ প্রদান করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণ গ্রহিতা শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রদান করবে।

প্যাকেজ-২: ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান: ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্পসুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ প্রদান করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। প্রদত্ত ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণ গ্রহিতা শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রদান করবে।

প্যাকেজ-৩: বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো: ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি এর আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফ-এর বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমান অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফ-এর বর্তমান সুদের হার এলআইবিওআর + ১.৫ শতাংশ (যা প্রকৃত পক্ষে ২ দশমিক ৭৩%) হতে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।

প্যাকেজ-৪: প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।

প্যাকেজ-৫: রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন বা ভাতা পরিশোধ করার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ যা ইতোপূর্বে ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

সারা বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে এসব প্যাকেজ ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আশা করি, পূর্বে এবং আজকে ঘোষিত আর্থিক সহায়তার প্যাকেজসমূহ দ্রুত বাস্তবায়িত হলে আমাদের অর্থনীতি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবে এবং আমরা কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাছাকাছি পৌঁছতে পারবো, ইনশাআল্লাহ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি খাতের ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।এছাড়াও সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা অর্থাৎ ধান কাটা ও মাড়াইয়ে মোট ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রনোদনার এই টাকা কৃষকের মাঝে বিতরণ করার জন্য সুদ হার ৫ শতাংশ প্রস্তাব করলেও পরে কমিয়ে ৪ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষিঋণ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের কারণে কৃষি খাতের ক্ষতি মোকাবিলায় চলতি মূলধন সরবরাহের উদ্দেশ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করা হয়েছে। ৬ মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৮ মাস মেয়াদি এ ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৪ শতাংশ।

প্রনোদনার টাকা ভাগাভাগি নয়, এখন আমাদের নজর রাখা উচিত এবং সতর্ক থাকা উচিত এই টাকা যেন বেহাত হয়ে না যায়। প্রনোদনার এই টাকায় যেন বিদেশে কারো সেকেন্ড হোম না হয়। এই টাকা যেন কারো চালের ট্রামে, সিন্দুকে, বিছানার নিচে, বউয়ের গলায়, শালির ফ্ল্যাটে চলে না যায়। এই টাকা যেন চলে না যায় কোন ক্যাসনোতে। এই টাকা যদি সঠিক ভাবে ব্যবহার করা হয় তবে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় আমরা আবার মেরুদন্ড সোজা করে দাড়াতে পারবো, করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দিয়ে দু’বেলা দু’মুঠু ভাত খেতে পারবো। ত্রাণ বিতরণ নিয়ে আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। এই চোরের দল করোনার মত নুতন কোন বিষাক্ত জীবানু নয়। সবসময়ই ছিলো, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। চোর যেমন থাকবে তেমনি সাধুকেও সজাগ থাকতে হবে। চোরের ধর্ম চুরি করা, আর আমাদের কাজ হবে নিজের সম্পদ রক্ষা করা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here