কলিজা ছিড়ে যায়, হৃদয় ভেঙ্গে যায় আমরা মাঝে মাঝেই বলি এবং অনুভবও করি। আসলে আমরা প্রচন্ড কষ্ট পাওয়ার ভাষাগত প্রকাশ কিভাবে করি? সাধারণত বলি কষ্টে কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে, হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে, আরো নানান শব্দ ব্যবহার করি। কিছু ঘটনা আছে যা দেখলে সাধারণ মানুষের এমনই অনুভূতি হয়। পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে মানুষকেই ধরা হয়। অবশ্য আমাদের সম্পর্কে এই মূল্যায়নটা আমরাই করি। আমাদের সম্পর্কে জানোয়ারের মূল্যায়ন কি সেটা আমরা কোনদিন জানতে পারি না। পারলে হয়তো বুঝাযেতো তারা কিভাবে দেখে আমাদের বা কিভাবে মূল্যায়ন করে। আর দ্বিতীয় কোন পক্ষও নেই যে তাকে দিয়ে মূল্যায়ন করবো কারা বেশি শ্রেষ্ঠ, সভ্য, মানবিক।

কোন কোন সময় মানুষ জানোয়ারের মুখোমুখি হয়। সব পশুকে আমরা জানোয়ার হিসাবে মূল্যায়ন করি না। যারা সাধারণত একটু বেশি হিংস্র স্বভাবের হয় তাদেরকে জানোয়ার বলি। মাঝে মাঝে মানুষও এমন আচরন করে যে তাদের জানোয়ার বললেও কম বলা হয়। মানুষরূপী জানোয়ার যখন কোন মানুষকে আঘাত করে আমরা দুঃখ পাই। কিন্তু সেই জানোয়ার যখন কোন শিশুকে আঘাত করে, ক্ষতবিক্ষত করে তখন হৃদয়ে প্রচন্ড আঘাত পাই। তখন কলিজা ছিড়ে যায়, হৃদয় ভেঙ্গে যায়।

আজ একটি ছবি দেখে ও সংবাদ পড়ে আমার কলিজা যেন ছিড়ে যাচ্ছে, হৃদয় ভেঙ্গে যাচ্ছে, দূমড়ে মুচড়ে উঠছে বার বার। ভাবতেই কষ্ট হয়, মানুষ এমনটা করতে পারে? পশু তার ক্রোধ নিবৃত্ত করতে বা ক্ষুধা নিবারণের জন্য অন্য কোন পশুর সাথে বা মানুষের সাথে সাধারণত এমন হিংস্র আচরন করতে পারে। আমরা তাতে কষ্ট পাই কিন্তু মানুষ কিভাবে এমনটা করতে পারে? তাও আবার একজন শিশুর সাথে। মাথায়ই ধরে না।

২০১৯ সালের ১৪ অক্টোবর আর দশটা দিনের মতই হতে পারতো। কিন্তু দুপুরের দিকে একটা খবর নজরে আসে। অনলাইন গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবরটা ছড়িয়ে পড়ায় নজর এড়ায়নি। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ৫ বছরের হাস্যোজ্বোল শিশু তুহিন। ঘুমিয়েছিল মা বাবার সঙ্গে। সকালে প্রতিদিনের মত সবার আগেই ঘুম থেকে উঠে নিশ্চই দুরন্তপনায় ব্যস্ত হয়ে যেত তুহিন। কিন্তু সোমবার সকালটা আর দেখা হলো না তুহিনের। বুধবার রাতের শেষের দিকে বলি আর সোমবার ভোরেই বলি এর কোন এক সময় ঘুম থেকে তুলে নিয়ে তুহিনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে মানুষরূপি জানোয়াররা বা তথাকথিত দুর্বৃত্তরা। স্থানীয় সংবাদ কর্মীরা জানান, সোমবার ভোরে শিশুটিকে হত্যা করা হয়। তুহিন দিরাই উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের কেজাউরা গ্রামের আব্দুল বাছিরের ছেলে।

হত্যাতো হত্যাই। একজন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে দিলেই হলো। সেটা কতভাবেই না করা যায়। গলার শ্বাসনালীটা একটু চেপে রাখলেই কিছুক্ষণের মধ্যে ছোট্ট তুহিন নিস্তেজ হয়ে যেতে পারতো। সেটা ভালো না লাগলে ছোট্ট তুহিনের কোমল গলায় যেখানে হাজারো চুমুর চিন্হ আছে তার বাবা মায়ের সেখানে একটা ছুরির পোচই যথেষ্ট ছিলো। একটা মাত্র ছিুরির পোচ, কিছুক্ষণের মধ্যেই তুহিনের শরীরের শেষ বিন্দু তরল রক্ত ঝড়ে পরে মিশে যেত মাটিতে। ঘাতকের এসবে রুচি না হলে গলায় রশি বেধে কোন গাছের সাথে ঝুলিয়ে দিলেই কর্ম সারা হয়ে যেত! শেষ পর্যন্ত ঝুলিয়েই দিয়েছিলো তুহিনকে তবে তার আগে সকল নির্মমতার চিত্র একেছে তুহিনের শরীরে। ঘাতকরা তুহিনের কান কেটেছে, তার দাদা-নানার ঠাট্টার বস্তু নুনু যা সভ্য ভাষায় লিখলে লিখতে হয় ‘লিঙ্গ’ সেই লিঙ্গ কেটে নিয়ে গেছে। কান কেটে, লিঙ্গ কেটে, গলায় দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখেও ক্রোধ মিটেনি ঘাতকদের। শেষ পর্যন্ত হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরি দুটি পেটের ভেতর ডুকিয়ে রেখে গেছে। দেখলে মনে হবে যেন কলাগাছে ছুরি গেথে রেখে গেছে! কোমলমতি শিশুর সঙ্গে এমন নির্মম, নিষ্টুর ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে ওঠে এলাকাবাসী। মুষরেপড়া পরিবারকে সান্ত্বনা দেবার ভাষাও হারিয়ে ফেলছেন প্রতিবেশিরা। এলাকাবাসী এ ঘটনায় জড়িত পাষণ্ডদের কঠিন শাস্তি দাবি করেছেন। শুধু কী এলাকাবাসী, যার যার নজরে পরবে ঘটনাটি সবাই মুষরে পরবে, হতবাক হবে, হৃদয় ভেঙ্গে যাবে, কলিজা ছিড়ে যাবে। আমাদের যদি এমন অনুভূতি হয় তবে তুহিনের বাবা-মায়ের কেমন অনুভূতি হচ্ছে ভাবাযায়!

দিন দিন আমাদের মধ্যে হিংস্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে তারই সহপাঠী মেধাবী কিছু ছাত্র নামের কলঙ্ক। তুহিনও হয়তো তুচ্ছ কোন ঘটনার বলি হয়েই নির্মম ভাবে হত্যার স্বীকার হলো। ঘাতকরা হয়তো একদিন ধরা পরবে। দীর্ঘ প্রকৃয়া শেষে একদিন ঘাতকদের বিচারও শেষ হবে। কিন্তু তুহিনরা, আবরাররা ফিরে আসবে না। মায়ের কান্না থামবে না আমৃত্যু। ঘাতকদেরও হয়তো একসময় বোধদয় হবে, কারো কারো নাও হতে পারে। কিন্তু যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা আর পূরণ হবার নয়। আমাদের আচরনে এমন পরিবর্তন কেন হচ্ছে, কেন আমরা মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যাকান্ডে জড়িয়ে পড়ছি, কিভাবেই আমরা এ থেকে উত্তোরণ ঘটাবো তার পথ আমাদের মনস্তত্ববীদ-সমাজ বিজ্ঞানীদের ভেবে দেখা উচিত। আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাচ্ছি। জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যুর স্বাদ নিতেই হবে। কিন্তু তুহিনদের মতো করে চলে যেতে চাই না। সমাজে কইলজা কাটা অপরাধ থামাতে হবে এখনই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here