দিনে গরম আর রাতে ঠান্ডা। প্রকৃতি কেন যেন বিরুপ আচরন করছে আমাদের সাথে। ষড়ঋতুর দেশ ছিলো এই সোনার বাংলা। একেক ঋতুর একেক স্বাদ উপভোগ করতাম আমরা। এখন দেখাযায় বদলে গেছে সোনার বাংলার ঋতুবৈচিত্র। প্রকৃতির ভাব দেখে মনে হয় ঋতু কমে তিনটিতে চলে এসেছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতেই ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের ঋতু। ছোট বেলায় ঋতু নিয়ে রচনা লিখতে হতো। কত সুন্দর সুন্দর কথা লিখতাম আমরা ঋতু নিয়ে। আজো মনে পরে সেকথা। একটু পিছনে ফিরে গেলে মনে পরবে ঋতুর রচনা।

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ, ঋতুবৈচিত্রের দেশ বাংলাদেশ। একেক ঋতুর একেক রূপ। ঋতুতে ঋতুতে এখানে চলে সাজ বদলের পালা। নতুন নতুন রং-রেখায় প্রকৃতি আলপনা আঁকে মাটির বুকে, আকাশের গায়ে, মানুষের মনে। তাই ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে এখানে জীবনেরও রং বদলায়। প্রতি দুই মাস অন্তর একটি নতুন ঋতুর আবির্ভাব ঘটে। ঋতুগুলো হলো গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসস্ত।

গ্রীষ্মকালঃ ঋতুচক্রের শুরুতেই আসে গ্রীষ্ম। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ দুই মাস গ্রীষ্মকাল। আগুনের মশাল হাতে মাঠ-ঘাট পোড়াতে পোড়াতে গ্রীষ্ম ঋতুর আগমন। তখন আকাশ-বাতাস ধুলায় ধূসরিত হয়ে ওঠে। প্রকৃতির শ্যামল-স্নিগ্ধ রূপ হারিয়ে যায়। খাল-বিল, নদী-নালা শুকিয়ে যায়। অসহ্য গরমে প্রাণিকুল একটু শীতল পানি ও ছায়ার জন্য কাতর হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে কখনো হঠাৎ শুরু হয় কালবৈশাখীর দুরন্ত তান্ড। ভেঙেচুরে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে যায়। তবে গ্রীষ্ম শুধু পোড়ায় না, অকৃপণ হাতে দান করে আম, জাম, জামরুল, লিচু, তরমুজসহ নানান রকম অমৃত ফল।

বর্ষাকালঃ গ্রীষ্মের পরই মহাসমারোহে বর্ষা আসে। আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল। মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জনে প্রকৃতি থেমে থেমে শিউরে ওঠে। শুরু হয় মুষলধারায় বৃষ্টি। মাঠ-ঘাট পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। প্রকৃতিতে দেখা দেয় মনোরম সজীবতা। জনজীবনে ফিরে আসে প্রশান্তি। কৃষকেরা জমিতে ধান-পাটের বীজ রোপণ করেন। গাছে গাছে ফোটে কদম, কেয়া, জুঁই। বর্ষায় পাওয়া যায় আনারস, পেয়ারা প্রভৃতি ফল।

শরৎকালঃ বাতাসে শিউলি ফুলের সুবাস ছড়িয়ে আসে শরৎ। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। এ সময় বর্ষার কালো মেঘ সাদা হয়ে স্বচ্ছ নীল আকাশে তুলার মতো ভেসে বেড়ায়। নদীর তীরে তীরে বসে সাদা কাশফুলের মেলা। বিকেল বেলা মালা গেঁথে উড়ে চলে সাদা বকের সারি। সবুজ ঢেউয়ের দোলায় দুলে ওঠে ধানের খেত। রাতের আকাশে জ্বল জ্বল করে অজ¯্র তারার মেলা। শাপলার হাসিতে বিলের পানি ঝলমল ঝলমল করে।

হেমন্তকালঃ ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসবের আনন্দ নিয়ে আগমন ঘটে হেমন্তের। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। প্রকৃতিতে হেমন্তের রূপ হলুদ। শর্ষে ফুলে ছেয়ে যায় মাঠের বুক। মাঠে মাঠে পাকা ধান। কৃষক ব্যস্ত হয়ে পড়েন ফসল কাটার কাজে। সোনালি ধানে কৃষকের গোলা ভরে ওঠে, মুখে ফোটে আনন্দের হাসি। শুরু হয় নবান্নের উৎসব। হেমন্ত আসে নীরবে, আবার শীতের কুয়াশার আড়ালে গোপনে হারিয়ে যায়।

শীতকালঃ কুয়াশার চাদর গায়ে উত্তুরে হাওয়ার সঙ্গে আসে শীত। পৌষ-মাঘ দুই মাস শীতকাল। শীত রিক্ততার ঋতু। কনকনে শীতের দাপটে মানুষ ও প্রকৃতি অসহায় হয়ে পড়ে। তবে রকমারি শাকসবজি, ফল ও ফুলের সমারোহে বিষন্ন প্রকৃতি ভরে ওঠে। বাতাসে ভাসে খেজুর রসের ঘ্রাণ। ক্ষীর, পায়েস আর পিঠা-পুলির উৎসবে মাতোয়ারা হয় গ্রামবাংলা।

বসন্তকালঃ সবশেষে বসন্ত আসে রাজবেশে। ফাল্গুন-চৈত্র দুই মাস বসন্তকাল। বসন্ত নিয়ে আসে সবুজের সমারোহ। বাতাসে ফুলের সুবাস। গাছে গাছে কোকিল-পাপিয়ার সুমধুর গান। দখিনা বাতাস বুলিয়ে দেয় শীতল পরশ। মানুষের প্রাণে বেজে ওঠে মিলনের সুর। তাই বসন্তকে বলা হয় ঋতুরাজ।

রচনাটা পড়লেই হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কত বৈচিত্রময় ছিলো আমাদের দেশ। এখন আমরা কি দেখছি? গ্রীষ্ম গেলে আসে বর্ষা, বর্ষা গেলে আসে শীত আবার শীত গেলে আসে গ্রীষ্ম। বাকী ঋতুগুলোর কোন খবরই নেই। ওরা আছে এখন বইয়ের পাতায়। ঋতুর আচরনের সাথে সাথে দেশে দুর্যোগের আচরনও বদলে গেছে। শীত এখন যেতেই চায় না। চৈত্রের শেষেও রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে হয়। আবার দিনে গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়তে হয়। বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি ঠান্ডা, জ্বর, কাশির মত নানান রোগব্যাধি।

এবার চৈত্রের শুরুতেই দেশে শুরু হয়েছে আগুনের ধ্বংসলীলা। ঢাকা হলো বিশাল জায়গা, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। সেই বিশাল জায়গায় কিছুদিন পর পরই ঘটছে অগ্নিকান্ড। শুধুযে ঢাকায় তা কিন্তু নয়। সারা দেশেই এমটা ঘটছে। আগুন কেড়ে নিচ্ছে সম্পদ, সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো মানুষ। একেকটা অগ্নিকান্ডে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটছে শতের উপরেও। আগুনের সাথে লড়াই করে বাঁচা কঠিন। চৈত্রের এমন রূপ হলে বৈশাখে যে কি অবস্থা হবে তা ভেবেই গা শিউরে ওঠে। বৈশাখের তাপদাহে আরো কতযে প্রাণ যাবে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বৈশাখে অগ্নিকান্ডর প্রয়োজন পড়ে না, তাপদাহে হিটস্ট্রক করেও অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। আসলে প্রকৃতি কি আমাদের উপর বিরুপ হয়ে গেছে! কেন এমন হচ্ছে সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনো, না দেখছি? প্রকৃতির এমন আচরনের কারনও আছে নিশ্চই।

শুধুযে আমাদের দেশে তা নয়, সারা বিশ্বেই প্রকৃতি এখন আমাদের উপর বিরুপ। বিরুপ হওয়ার কারনও আছে অনেক। আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতির কারন। নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করার জন্য আমরাই দায়ী। বৈশ্বিক তাপমাত্র বেড়ে গেছে, গলে যাচ্ছে বরফ, ভরাট হয়ে যাচ্ছে খাল, বিল, নদী নালা। সমুদ্র তল ফুলে উঠছে। পাহাড়ও কেটে সমতল করে ফেলি আমরা। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে গাছ কাটি, বাঁশ কেটে নিজেদের পিছনে নিজেরাই নিচ্ছি। বিলাসিতার কারনে রুমে রুমে এসি লাগিয়ে ঠান্ডার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। এ যেন গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢেলে গাছ বাঁচানোর ব্যর্থ চেষ্টা। উন্নয়নের নামে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করে মেগা প্রকল্প তৈরী করছি। প্রকৃতিকেতো আমরাই ক্ষেপিয়ে তুলেছি, প্রকৃতির দোষ দিয়ে কি লাভ হবে? সবুজ বনভূমি এখন আর সবুজ নেই, কাটতে কাটতে ধূষর করে ফেলেছি। সবুজ মাঠ এখন ইট ভাটার ধুয়ায় সয়লাব। জলাভূমি বালু দিয়ে ভরাট করে নিজেরাই তৈরী করছি মরুভূমি। প্রকৃতি ধ্বংস করে করছি ইট পাথরের জঞ্জাল। এখন আর আমরা প্রকৃতির রংয়ে সাজি না, নিজেরাই তৈরী করি নকল প্রকৃতি। বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি ধ্বংসলীলা।

আমাদের বাঁচতে হবে, আমরা বাঁচতে চাই। প্রকৃতির দান যেমন হাত খোলা, তেমনি প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞও অসীম। প্রকৃতি যেমন দিতে পারে তেমনি নিতেও পারে। আমাদের জন্য, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে না পারলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ঘৃণাভরে গালি দেবে। আমাদের যত অর্জন, আমাদের যত চেষ্টা সবইতো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। যাদের জন্য আমাদের এত শ্রম, এত ত্যাগ তাদের কাছে যদি আমরা নিকৃষ্ট হয়ে যাই তবেতো এই মানব জনমই বৃথা হয়ে যাবে। চৈৎ মাসের বিরুপ আচরনে ভাবছি বৈশাখে কি হবে, কিন্তু একবারও কি ভাবছি যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি হবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি ভাববে? আমাদের এখনই ভাবা উচিত। একটু ভাবুন।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here