জঞ্জাল একদিনে জমে না। আস্ত আস্তে জমে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকনা জমতে জমতে পাহাড় না হলেও বালিয়াড়ি তৈরী হয়, বিন্দু বিন্দু জলকনা জমে সিন্ধুতে রূপ নেয় ঠিক জঞ্জালও তেমনি অল্প অল্প আকারে জমতে থাকে। একদিন তা পাহাড়সম হয়ে দাড়ায়। সেই পাহাড়সম জঞ্জাল একদিনের প্রচেষ্টায় পরিস্কারও সম্ভব নয়। তাই হঠাৎ করে অতি উৎসাহ দেখিয়ে লাভ নেই। মাঝে মাঝেই আবেগের বসে বা লোক দেখানোর জন্য আমরা জঞ্জাল পরিস্কার করতে নামি, পরিস্কারের কথাও বলি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমাদের প্রয়োজন জনসচেতনাত বৃদ্ধি করা, নিজ নিজ দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অবগত থাকা, নিজ নিজ কাজগুলো যথা সময়ে সঠিকভাবে করা, আইন ও নীতিবোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো। তবেই মুক্তি আসবে সকল জঞ্জাল থেকে।

জঞ্জাল বলতে শুধু পূতিগন্ধময় ময়লাই নয়। দেশে সকল সেক্টরে এখন জঞ্জালে ভরা। কোন কোন জঞ্জাল গন্ধ ছড়ায় আবার কোন কোন জঞ্জাল গন্ধ ছড়ায় না। জঞ্জাল আছে অনুভব করা যায় কিন্তু গন্ধ পাওয়া যায় না। মানুষের মাঝে ভেজাল মানুষের জঞ্জাল, খাদ্যে বিষের জঞ্জাল, অফিস আদালতে ঘুষখোরের জঞ্জাল, ধর্মে লেবাসধারীর জঞ্জাল, রাস্তাঘাটে ফিটনেসবিহীন গাড়ির জঞ্জাল, রাস্তার পাশে-পরিবেশে ময়লার জঞ্জাল, রাজনীতিতে সুবিধাবাদী লোভী নেতাদের জঞ্জাল। জঞ্জালে জঞ্জালে সয়লাব হয়ে গেছে। এ জাতি এখন জঞ্জালের ভারে নূয়ে পড়ার জোগার। আর কত জঞ্জাল বয়ে বেড়াবো আমরা? এরতো একটা বিহিত করা দরকার। জঞ্জাল যখন নাকের কাছে এসে সুরসুরি দেয় তখনই আমাদের চেতনা জাগ্রত হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় জঞ্জালের মোকাবিলা করছি আমরা। মশা এদেশে আগেও ছিলো, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। সেই মশা যখন ডেঙ্গুর জিবানু বহন করে পৌছে দিচ্ছে আমাদের শিরায় শিরায় ঠিক তখনই আমরা নড়েচড়ে বসছি। মানুষ মরে যখন প্রমান করলো মশা দ্বারা ডেঙ্গু জিবানু শরীরে ঢুকছে, অসুস্থ করছে মানব দেহ। ঠিক তখনই বুঝতে পারলাম জঞ্জালে এডিস আছে, ডিম পাড়ছে, বাচ্চা করছে আর আমাদের মারছে। এবার উঠে পড়ে লাগলাম জঞ্জাল পরিস্কারে। কিন্তু এডিস মশার বাসাটা আমরাই তৈরী করে দিয়েছি। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে রেখেছি, সেই ময়লায় পানি জমেছে, অপরিকল্পিত ভাবে ছাদকৃষি করছি, টবে পানি জমিয়ে রাখছি। সেই পানিতে পরম যতেœ ডিম পারছে এডিস সাহেব। অতঃপর ডিম ফুটে বাচ্চা এবং আমাদের কামড়ে ডেঙ্গুর জিবানু পৌছে দেয়ার কাজটি করে দিচ্ছে। ময়লা ফেলার ক্ষেত্রে যদি একটু সতর্ক হতাম, যথাযথ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলতাম এবং সেই ময়লা নিয়ম মত রিসাইকেল করতাম বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতাম তবে আজ ময়লার এত জঞ্জাল জমতো না। সখের বসে যে ছাদকৃষি করছি, টবে সুন্দর ফুল-ফল গাছ লাগাচ্ছি, সেটা যদি পরিস্কার রাখতাম তবে মশা আর ডিম পেরে বংশ বিস্তার করতে পারতো না। নাড়িকেল-ডাব খেয়ে, দই-আইসক্রিম খেয়ে, অপ্রয়োজনীয় গাড়ির টায়ারটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে সেখানে মশার বংশ বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছি আমরাই। তা যদি না করতাম তবে আজ এডিস নিয়ে এতো চিন্তা করতে হতো না।

আজ যখন এডিস মশার দাপট শুরু হয়েগেছে ঠিক তখন আমাদের চেতনা জাগ্রত হয়েছে। ঝাড়– নিয়ে নেমে পড়ছি পরিস্কার রাস্তায় যে রাস্তাটা হয়তো একটু আগেই কোন প্রকৃত সেবক ঝাড়–দার তার দায়িত্ব হিসাবে বা নির্ধারিত কাজ হিসাবে পরিস্কার করে গেছে। নির্লজ্জ, বেহায়ার মত একটা ঝাড়–র হাতলে তিন-চারজনে ধরে ঝাড়– দেয়ার ভান করছি। চোখে কালো সানগ্লাস লাগিয়ে, কেউ কেউ জামার উপর গেঞ্জি পড়ে মাঠে নেমেছি। অথচ ঐ গেঞ্জিটা আসল ঝাড়–দারকে দিলে সে পরম যতেœ গায়ে দিতো। কেউ কেউ ভূড়ির কারনে ঝাড়– ধরে নিচু হতে পারে না। এভাবে ক্যামেরার সামনে আসার কি দরকার আমাদের? হয়তো অনেকেই বলবেন, এটা একটা প্রতীকী রূপ। মানুষকে উৎসাহিত করতে এটা করছেন। তাদের দেখে সাধারণ মানুষ উদ্ভুদ্ধ হবেন, ঝাপিয়ে পরবেন ময়লার স্তুপে! বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন প্রতীকী কাজও বিরুপ কর্ম হয়ে দাড়ায়। মানুষ উদ্ভুদ্ধ হওয়ার চেয়ে ঘৃণাই প্রকাশ করে বেশি। যারা এমনটা করছে তারা হয়তো ভাবছে মানুষ এসব ভন্ডামি বোঝে না, কিন্তু তারা এটা বোঝে না যে মানুষ এখন সব বুঝতে পারে!

এটাতো গেলো জঞ্জালের কারনে প্রকৃতির এক বিরূপ আচরনের কথা। দেশে আরও জঞ্জাল আছে। আগেই যেটা বলেছি। অফিস আদালতে ঘুষ বাণিজ্যের কারনে কোন কাজই ন্যায়সঙ্গত ভাবে করা যায় না। অফিস আদালতে ঘুষখোররা হচ্ছে জঞ্জাল। মাঝে মাঝেই দুদক সহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এসব জঞ্জাল সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু সেটা মাছ দিয়ে উদাহরণ টানলে বলা যায় চুনোপুটির সাইজ। রাঘব বোয়ালদের ধরা হয় না। আর রাঘব বোয়ালরা বহাল তবিয়তে থাকার কারনে ঘুষখোর জঞ্জাল পরিস্কারের মহরা দেখে আমরা হাসি। সেটা কর্তৃপক্ষ হয়তো বুঝতে চায় না বা পারে না।

খাদ্যে এক আজব জঞ্জাল ভেজাল। ভেজালে ভেজালে, বিষে বিষে খাদ্য এখন অখাদ্য হয়ে যাচ্ছে। ছাগল কম খেলে কিছু হয় না, কিন্তু বেশি খেলে পেট ফুলে মরে। আমাদের অবস্থাও এখন ছাগলে মত কম খাদ্যে বেশি বেশি ভেজাল খেয়ে মরতে হবে। দেশে কতজনই বা মাদক সেবন করেন? গুটিকতেক লোক মাদক সেবন ও ব্যবসা করে তার জন্য আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করি। অথচ ষোল কোটি মানুষ যে খাবার খায় সেই খাবারে দেদারছে বিষ মেশাচ্ছে, ভেজাল মেশাচ্ছে তার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করি না। যতটুক কাজ হয় তা আই ওয়াশ বলেই আমাদের কাছে বিবেচিত হয়। খাদ্যে যারা ভেজাল দেয় তারাও সমাজে খাদ্যের জঞ্জাল হিসাবেই গণ্য। এদেরও পরিস্কার করা উচিত।

আরও জঞ্জাল আছে। এত জঞ্জাল নিয়ে কচলালে আমার এ লেখাটাকেই মানুষ জঞ্জাল ভেবে ভাগাড়ে ফেলে দিবে। তাই থেমে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে হয়! তার পরেও কিছু কথা না বললেই নয়। প্রতিটি সেক্টরের জঞ্জালগুলো একদিনে স্তুপ হয়নি। আস্তে আস্তে হয়েছে। আস্তে আস্তেই পরিস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা যদি আমাদের যার যার দায়িত্ব, কর্তব্য সঠিক ভাবে করি তবে একদিন পরিচ্ছন্ন দেশ হয়ে যাবে সোনার বাংলাদেশ। রাত পোহালেই একটি পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ দেখতে পাবো এটা আশা করা ভুল এবং আমরা কেউ আশাও করি না। আমরা জঞ্জালে পেচিয়ে গেছি। এর থেকে বের হতে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে, ন্যায়-নীতিবোধ সমুন্নত রাখতে হবে, অপরের প্রতি সহনশীল হতে হবে। এমন আরো অনেক কথা বলা যাবে। আর কথাগুলো আমরা সবাই জানি এবং বুঝি। একটু সচেতন ও সক্রিয় হলেই আমরা সুন্দর একটা দেশে সু-নাগরিক হিসাবে জীবনযাপন করতে পারবো। তাই সবশেষে আবারও বলবো, জঞ্জাল একদিনের নয়, পরিস্কারও একদিনে হবে না। তাই হতাশ না হয়ে সক্রিয় হই।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here