দ্বিগম্বরী দীঘির নাম শরীয়তপুর তথা শরীয়তপুরের বাইরের অনেকেই জানেন। দিগম্বরী দীঘি কত মানুষকে দিগম্বর করেছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। দিগম্বরী দীঘির নাম অনেকেই জানেন বললাম এই কারনে যে, যারা নতুন প্রজন্ম তাদের কাছে পরিচিত নাও হতে পারে তবে, যারা আমার বা আমার আগের প্রজন্ম তাদের কাছে নামটা বেশ পরিচিত। দিগম্বর বা দিগম্বরী শব্দের অর্থ ডিকশনারী ঘাটলে পাওয়া যায়-দিগম্বর (বিশেষণ)-উলঙ্গ; বিবস্ত্র আর দিগম্বরী (বিশেষণ) (স্ত্রীলিঙ্গ) উলঙ্গিনী; বিবস্ত্রা; বিবসনা। {(তৎসম বা সংস্কৃত) দিক্+অম্বর; (বহুব্রীহি সমাস)}! দিগম্বরী দীঘি কাদের দিগম্বর করেছে বা কতজন দিগম্বর করেছে সেই গল্প শেষে বলছি। প্রথমেই দিগম্বরী দীঘি ভ্রমণের গল্পটা পাঠকদের সাথে শেয়ার করি।

আমার প্রিয় বন্ধু, প্রিয়জন, প্রিয় খালাতো ভাই আমির হোসেন নয়ন। নয়নের বাড়ি শরীয়তপুরের পার্শবর্তী জেলা মাদারীপুরে। আমার নানা বাড়ী ও নয়নের নানা বাড়ী একই জায়গাল মানে শরীয়তপুরের ঐতিহ্যবাহী কোতোয়াল বাড়ি! নয়ন শরীয়তপুরে পা রাখার পরই শুরু হয় আমাদের বিরামহীন ঘুরে বেড়ানো। কাছে-দূরে যত আত্মীয় স্বজন আছে সবার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে দেখা করার চেষ্টা করি। কিছুটা সময় কাটাই প্রিয় স্বজনদের সাথে। দীর্ঘ দিন পর পর যাওয়ায়, আমাদের দেখা পেয়ে স্বজনরা আকাশের চাঁদ হাতে পায়। কী করবে, কী খাওয়াবে তা নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে! আবেগঘন পরিবেশটা আমি হয়তো ভাষায় বুঝাতে পারছি না। পরিবেশটা আপনিও অনুভব করতে পারবেন। কারন আপনিও কোন না কোন সময় এমন পরিস্থিতিতে পরেন এবং এমন আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করেছেন। ঠিক যেমনটা আপনার সাথে ঘটে, আমাদের সাথেও তেমনি ঘটে প্রতিটি স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার পরে।

আমার একটা মোটর বাইক আছে। পুরাতন, তবে ঐতিহ্যবাহী বাইক। বিশ্বের একটি প্রমিনেন্ট কোম্পানির তৈরী। জাপানের হোন্ডা মটরস কোম্পানির তৈরী হোন্ডা সিজি ১২৫ সিসি। লাল রংয়ের মোটর সাইকেলটি আমার খুবই প্রিয়। গাড়িটি আমার কথা শোনে। আমার মন মত চলে। বিজ্ঞাপনে বলে লাক্স আপনার ত্বকের ভাষা বোঝে! তবে লাক্স ত্বকের ভাষা বোঝে কিনা জানিনা, আমার মোটর সাইকেলটিযে আমার মনের ভাষা বোঝে এটা বলতেই পারি। আমার পুরাতন গাড়িটি নিয়ে আমি ছাড়া সবার এলার্জি আছে। আমি কেন গাড়িটি বদলাই না, কেন নতুন গাড়ি কিনি না সবারই এই একই প্রশ্ন আমার কাছে থাকে। আমি উত্তরে বলি, ভালো জিনিস দেখতে ভালো না হলেও সেটা গ্রহণযোগ্য। বিচার করতে হবে গুনের। দেখতে ভালোতো মাকাল ফলও। কিন্তু সেটা খাওয়ার অযোগ্য। কালিজিরা দেখতে কুচকুচে কালো হলেও ভর্তা খেতে খুবই উপাদেয় এবং সেটা বিভিন্ন খাবারে ব্যবহার করা হয়। আর কিছু জিনিস ঘন ঘন পরিবর্তনও করতে নেই। যেমন বউ, মোবাইলের সিম, ব্যবহৃত গাড়ি ইত্যাদি। এটা আমার আইডোলজি। আপনার ভিন্নমত থাকতেই পারে। আমি আপনার ভিন্ন মতকে শ্রদ্ধার সাথে সম্মান করি। প্রত্যেকটি মানুষ আলাদা, তাদের চিন্তা চেতনাও আলাদা হতেই পারে।

এমনি একদিন বন্ধু নয়ন শরীয়তপুরে এসে হাজির। সাথে সাথে বসে যাই পরিকল্পনা করতে। কোন দিক দিয়ে ঢুকবো, কোন দিক দিয়ে বেরুবো, কার বাড়ি আগে যাবো, কার কার সাথে দেখা করবো, কার বাড়ি কতটা সময় কাটাবো, আরো অনেক কথা যা হয়তো বলা যাবে না ইত্যাদি! সেদিন পরিকল্পনা মাফিক দুই বন্ধু চলে যাই ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার গ্রামে। সেখানে আমাদের মেঝ খালা থাকেন। আমার মায়ের বড় এই খালা। রবি খালা বলেই ডাকি আমরা। রবি খালা সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। আমার এ খালার হৃদয় অত্যন্ত নরম, দয়ালু ও মমতাময়ী প্রকৃতির। আমার জীবনে খালাকে যতবার তার বাবার বাড়ি মানে আমার নানার বাড়ি আসতে দেখেছি ততবারই বাড়ির ঘাটা থেকে কাদতে কাদতে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি। সবাই বলে-কোতোয়াল বাড়ির সীমানায় পা রাখার সাথে সাথে খালার চোখে জল চলে আসে।

খালা বেরাতে আসতো দীর্ঘদিন পর পর। একসময় আমাদের দেশে প্রচুর খাল-বিল ছিলো। এমন কোন বাড়ি পাওয়া যেতো না যার পাশ দিয়ে একটি ছোট্ট প্রবাহমান খাল বয়ে যায়নি। শীতের সময় কোন কোন খালের পানি তলানিতে নেমে যেতো। তখন সেই খাল থেকে মাছ ধরতো ঝাপি জাল দিয়ে, পলো দিয়ে। গুনি লোকজন শুধু হাতকে স্বম্বল করেও প্রচুর মাছ ধরতে পারতো। শুধু হাত ব্যবহার করে মাছ ধরাকে আমাদের এলাকায় হাতায়ে মাছ ধরা বলে, আপনার এলাকায় হয়তো অন্য কিছু বলতে পারে। আর বর্ষার মৌসুমে খাল পেতো নতুন যৌবন। তখন খাল পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ থাকতো। এই খালগুলোই ছিলো বর্ষার সময়ে কোথাও যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। এখন খাল হয়ে গেছে দখল বা ভরাট করে গিলে খেয়েছে ভূমি দস্যুরা। যা কিছু আছে তাতে মাছ পাওয়া যায় না। বিষ প্রয়োগে ঝেড়ে মুছে খেয়েছি আমরা। আর বিলের কথা কিইবা বলবো! বিলগুলোতে বিশাল স্কেবেটর যন্ত্র নামিয়ে যাকে স্থানীয়রা ভেকু মেশিন বলে সেই যন্ত্র দিয়ে মূহুর্তের মধ্যে কেটে বিশাল বিশাল পুকুর তৈরী করেছে। একেকটাকে পুকুর না বলে সাগরও বলা যায়! একশ একর, দেড়শো একর নিয়ে পুকুর খনন করছে। দুর্গাসাগর যদি পুকুর হয়েও সাগর নাম নিতে পারে তবে তারচেয়েও বড় হয়ে সাগর নাম নিতে পারবে না কেন! এখন দেশের আনাচে কানাচে রাস্তা হয়েছে। তখনকার যা রাস্তা ঘাট ছিলো তা এখনকার মত পিচঢালাতো দূরের কথা, ইট বসানোও ছিলো না। তখন যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম-শীতকালে মানবগাড়ি মানে দুই পা আর বর্ষাকালে নৌকা।

খালা যেই নৌকা করে আসতো তাকে বলা হতো একমালাই নৌকা। নৌকার উপর ছাওনি দেয়া থাকতো। পর্দা থাকতো। মাঝি এক মনে বাইতে থাকতো নৌকা। ঝোপ-ঝাড়ের ছাউনি থাকতো খালের উপর। সেই ছাউনির নিচ দিয়ে কখনো জোয়ারের তালে কখনো উজান ঠেলে চলতে হতো মাঝির। খালের মোড়ে মোড়ে থাকতো মাছ ধরার গড়া। গড়ার স্থানে থাকতো প্রচন্ড স্রোত। সেই স্রোত ঠেলে এগিয়ে চলতে হতো। নৌকায় বাঁশের লগির সাথে সুন্দর বৈঠাও থাকতো। কখনো লগি দিয়ে কখনো বৈঠা দিয়ে চালাতো নৌকা। দীর্ঘ সময় নিয়ে আসতে হতো। আর নৌকা যখন নানা বাড়ির পাশের খালে ভীরতো তখনই আমরা ছোটরা দৌড়ে যেতাম নৌকার কাছে। খালাকে দেখার চেয়েও মনে হয় নৌকা দেখতেই বেশি আগ্রহ ছিলো। খালা নেমে কাদতে কাদতে বাড়িতে যেত আর আমরা নৌকায় উঠে বাদরামো করতাম। ক্লান্ত মাঝি আমাদের নিয়ে তখন আর নৌকা চালাতে চাইতো না, তাই আমরা নৌকায় উঠে বসে থাকতাম। খালের কিনারায় সাধারণত হিজল গাছের গোড়ায় নৌকা তালা মেরে কোমড়ে চাবিটা ঝুলিয়ে মাঝি চলে যেত নানার বাড়িতে খাবার খেতে। আমাদের সতর্ক করে যেতো যেন নৌকায় পানি না ওঠে! পরে অবশ্য মাঝিকে নিয়ে ঘুরতে বেরোতাম।

আর শীতের সময়কার কথা বললে বলতে হয়-শীতকালে মাঠ ঘাট সব শুকিয়ে যেতো। তখন সব বিলের মাঝে ধান, কলই, সরিষাসহ বিভিন্ন শীতকালিন শাক সবজি চাষ হতো। খালা তখন আসতো পালকিতে চড়ে। আমরা খালার বাড়ি শীতকালে বেড়াতে গেলে পায়ে হেটে যেতাম। শীতের ছুটিতে মা-খালারা খালাতো-মামাতো ভাই-বোনদের নিয়ে দল বেধে রওয়ানা দিতো। দূর থেকে দেখলে মনে হত বেদুইনের দল শুধু সাথে নেই উট অথবা আজকের রোহিঙ্গা শরনার্থীর দল। আমরা খালের তীর ধরে, ধান ক্ষেতের আল ধরে, কলই ক্ষেতের ধার দিয়ে, লাউয়ের মাচার নিচ দিয়ে হাটতে হাটতে চলে যেতাম পালং থেকে মহিষার। রবি খালার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সময় আমরা রওয়ানা দিতাম একদম কাকডাকা ভোরে। এর কারনটা ছোটবেলায় না বুঝলেও বড়বেলায় এসে ঠিকই বুঝতে পারছি। কাকডাকা ভোরে রওয়ানা দিয়ে হাটতে হাটতে সকাল সকাল চলে যেতে পারতাম। সূর্যের তেজ বারার আগেই আমরা খালা বাড়ি পৌছে যেতাম। তীব্র রোদ থেকে বাঁচতেই আমাদের নিয়ে ভোর বেলা রওয়ানা দিতো। ভোর বেলা শিশির ভেজা ঘাষের ডগা মাড়াতে মাড়াতে যেতাম। কলই ক্ষেতের প্রতিটি কলইর ডগায় থাকতো শিশির বিন্দু। কনকনে শীতেও সেই শিশির বিন্দুতে হাত স্পর্শ করার লোভ সামলাতে পারতাম না। হাত শিশিরে ভিজে ঠান্ডা বরফের মত হয়ে যেতো। রাস্তার মাঝ দিয়ে সরু আলের মত পথ থাকতো যেখানে কোন ঘাস থাকতো না। রাস্তার বাকী অংশ দুর্বাঘাসে আবৃত থাকতো। আমরা ইচ্ছে করেই মাটির রাস্তাটা বাদ দিয়ে দুর্বা ঘাসের উপর দিয়ে হাটতাম। দুর্বার ডগায় শিশির বিন্দুর উপরে যখন নতুন ভোরের সূর্যের সোনালী রোদ পড়তো তখন একেকটা শিশির বিন্দু একেকটা সূর্যের মত জ্বলজ্বল করে জলতো। কোথাও কোথাও মাকড়সার ঝাল ছড়ানো থাকতো। মাকড়সার জালে শিশির বিন্দু আটকে থাকতো। সেই জালে যখন সূর্য মামা তার আলো ফেলতো তখন রংধনুর আভা ছড়াতো। শীতের সকালের অপরূপ দৃশ্য লিখে বুঝানো কঠিন। যারা এই দৃশ্যের সাথে পরিচিত তারা হয়তো সেই সোনালী অতীতে ফিরে যাবেন লেখাটা পড়ে। আমরা এগিয়ে যাই কাফেলা নিয়ে আর সামনে থাকে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পথ। কুয়াশায় এমনিতেই মাথা, শরীরের ছুয়েটার ভিজা ভিজা ভাব থাকতো। তার ওপর যদি শিশির বিন্দু হাতে মাখি অবস্থা কি হতে পারে ভাবাযায়? মায়ের বকুনি খেতে হতো। তবুও বাদরামোর স্বভাবের কারনে শিশির বিন্দু নাড়া দিয়ে ঘুমন্ত ঘাসকে, কলই শাককে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতাম। কোমল হাতগুলো ডগায় বুলিয়ে দেয়ার সাথে সাথে চনমনে হয়ে উঠতো ঘাসগুলো। শরীর ঝাড়া দিয়ে আমাদের দেখে এক গাল হেসে দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতো শুভ সকালে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য।

দীর্ঘ পথ হেটে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে যেতাম। ছোট মানুষ হাটতে পাতাম না। তখন মাঝে মাঝে ক্ষেতের পাশে বসে একটু জিরিয়ে নিতে হতো। আর কতদূর? কথাটা জিজ্ঞেস করতাম কিছুক্ষণ পরপরই। আমাদের আস্বস্ত করতে গিয়ে বলতো-আর একটু বাবা, ঐতো…..। আসলে পথ আর ফুরাতেই চাইতো না। অনেকটা এই ধুধুর পরের ধুধু… এমন অবস্থা। ধুধু আর শেষ হতে চাইতো না শীতের সকালে। খালার বাড়িতে পৌছানোর সাথে সাথে আমাদের দানা পড়া খেজুরের গুরের হাড়ি আর বড় ডালা বা ধামা ভর্তি মুড়ি দিতো খেতে। সাথে থাকতো খই। মুখে দিলেই মিলিয়ে যেতো খই! এক স্বর্গীয় অনুভূতি। গুরের এতটাই স্বাদ তা এক দরিদ্র বালকের ইচ্ছের কথার মতই মনে হতো। এক দরিদ্র বালক গুর খেয়ে বলেছিলো-আমি যদি রাজা হইতাম, সব ভাত মিডাই দিয়া খাইতাম! বালকের কথায়ই বুঝতে পারছেন গুর কতটা মিঠা! আর কতটা সুস্বাদু। আমি নিশ্চিত আমার খালার বাড়ির হাড়ির দানা পড়া গুর খেলে বালক হয়তো বলতো-আমি যদি ডোনাল্ট ট্রাম্প হইতাম সারাজীবণ খালি এই দানাপড়া মিডাইই খাইতাম। হাড়িতে হাত ঢুকিয়ে গুর বের করে খাওয়ার যে কি আনন্দ সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে আজও কষ্ট হয়! এই কষ্ট শৈশব হারানোর কষ্ট! গুরগুলো দেখে মনে হতো লাল রং দিয়ে চিনি ভিজিয়ে রেখেছে। এতটাই সুস্বাদু ছিলো যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। যারা খেয়েছেন তারাই বুঝবেন আমি কোন গুরের কথা বলছি। দীর্ঘ হাটা পথের ক্লান্তি নিমিশেই দূর হয়ে যেতো গুর, মুড়ি, খই খেয়ে।

দিগম্বরী দীঘির পাড়ের গাছ ও মাঠ

আমাদের দেশে একসময় খেজুরের গাছের কোন অভাব ছিলো না। আমাদের দেশের খেজুরের গাছে সৌদি আরবের খুরমার মত খেজুর হতনা ঠিকই কিন্তু আমরা যে রস পেতাম তা অমৃতর চেয়ে কম ছিলো না। খালের ধারে, ক্ষেতের আলে, পুকুরের পারে, পতিত ভিটায় খেজুর গাছের সমারহ ছিলো। এখন হয়তো নাই। নতুন প্রজন্মকে খেজুর গাছ চেনাতে বহু কষ্টে খুজতে হয়। তাদের বুঝাতে হবে ঐ যে পাম গাছ, ঐরকম, ডালায় কাটা থাকতো, চৌক্কা চৌক্কা!! সব খেয়েছে, সব খেয়েছি, ইটভাটায় খেয়েছে আমাদের খেজুর গাছ। শীতে খেজুরের গুর দুই ধরনের রস থেকে করা হতো। বিকেলে গাছ ছিলে হাড়ি পেতে রাখতো। সারারাত পাতা থাকতো। খুব ভোরে গাছ থেকে হাড়ি নামিয়ে রস সংগ্রহ করে জ্বাল দিয়ে যে গুর পাওয়া যেতো সেটা খুবই উপাদেয় হতো। আর সকালে রস নামানোর পর আবার হাড়ি পেতে রাখলে বিকালে গাছ কাটার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত যে রসটা পরে সেটাকে ঝড়া বলে। ঝড়ার রসের গুর একটু টক টক ভাব থাকে। আমাদের জন্য ঝড়ার গুর নয়, সকালের টাটকা রসের গুরই রাখা হতো। যা আমরা কব্জি ডুবিয়ে খেতাম। যারা খেজুর গাছ ছিলে রস বের করতো তাদেরকে গাছি বা শিউলি বলেই ডাকতো। শীতকালে খেজুর গাছ ছিলার সময় ছোট শিশুরা শিউলিদের পিছন পিছন ঘুরতো। খেজুরের ডালা দিয়ে ঘোড়া বানিয়ে সেই ঘোড়া নিয়ে সারা বাড়ি ছুটে বেড়াতো বাড়ির দুরন্ত শিশুরা। খেজুরের ডাল যাকে স্থানীয়রা বাউগরা বলতো সেটা দিয়ে কলই-মুশুরি-সরিষা-তিল-তিষি মাড়াইয়ের কাজ করতো বাড়ির গৃহিনীরা। মেয়ে খেজুর গাছে যে ফুল ধরতো তাকে বলা হতো চুমুর বা চুমইর। একটা চুমইর পাওয়অর জন্য অনায়াসেই একাধিক চুমু দিতে পারতাম যদি চাইতো! চুমুরগুলোতে সাদা পাউডারের মত মুঞ্জুরী থাকতো। পুরুষ গাছেও ফুল আসতো, সেই ফুল থেকে খেজুর হতো যা আরবের খুরমার মত নয়, তবে তার চেয়ে কোন অংশে কম লোভনীয় ছিলো না শিশু-কিশোরদের কাছে। শিউলিরা সারাদিন ব্যস্ত সময় পার করতে শীতের সময়। ভোরে রস সংগ্রহ করে হাড়িগুলো ধুয়ে রোদে শুকিয়ে হাড়ির ভিতর চুন দিতো। এর পর শুকিয়ে সেই হাড়িগুলোকে বিশেষ কায়দায় আগুন জ্বেলে ধুয়া দিতো। এর কারন হিসেবে জানতাম রস পরিস্কার-স্বচ্ছ পাওয়ার জন্য এগুলো করা হতো। শৈশবে বেড়াতে গিয়ে কতই না বাদরামি করেছি আজ মনে পরলে হাসি পায়। শিউলি খেজুর গাছে হাড়ি দিয়ে যাওয়ার পর সন্ধা নামার সাথে সাথে পাটখড়ি নিয়ে খেজুর গাছে উঠে যেতাম। হাড়ির ভিতরে পাটকাঠি ঢুকিয়ে স্ট্র বানিয়ে রস খেয়ে নিতাম। মেয়েরা বড় গাছে উঠতে পারতো না। কিছু গাছ আছে মাটিতে দাড়িয়েই নাগাল পাওয়া গেতো। মেয়েদের ছোট গাছগুলোতে রস খাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে কতই না উদারতা দেখাতাম! রাতে চোরের মত খেজুরের রস খেয়েই ক্ষ্যান্ত দিতাম না। ভোরে গাছ থেকে হাড়ি নামানোর পরে গ্লাসে ভরে মুড়ি দিয়ে ফেনায় ভরা রস খেতাম আমরা। এখন ভাবলে মনে হয়, হায়রে হারিয়ে যাওয়া দিন! কোথায় হারিয়ে গেছে?

যা হোক, সেদিন দুজনে রবি খালার সাথে দেখা করতে গিয়ে দ্বিগম্বরী দীঘির পাড়ে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম। দীঘির পাড়ে ছোট একটা চায়ের দোকান আছে। আমরা দু’কাপ চা নিয়ে দীঘির ধারে গিয়ে অল্প অল্প চা খেয়েছি, বেশি সময় কাটিয়েছি। এরই ফাঁকে ফাঁকে চলেছে ফটো তোলার কাজ। নয়নের আইফোন দিয়ে আমার বেশ কয়েকটি ছবি তুলে দিয়েছিলো। চেহারা খারাপ বলাই যায়, কিন্তু ছবি তোলার হাত খারাপ সেটা বলার ধৃষ্টতা আমি দেখাতে পারি না। সুন্দর পরিবেশে দাড় করিয়ে সুন্দর ছবিটি তুলেছে আমার বন্ধু নয়ন। দীঘির পারটি আমাদের কাছে খুবই পরিচিত ও আপন। এই দীঘির পারে প্রতি বৈশাখের প্রথম সাতদিন মেলা বসে। বিশাল জমজমাট হয় মেলা প্রাঙ্গন। আমরা ছোটবেলা শীতের রস-পিঠা খেতে আর বৈশাখে মেলা দেখতে অবশ্যই আসতাম। কখনো কখনো শীত আর মেলা একসময় পড়ে যেতো। তখন খুব খারাপ লাগতো, মেলাটা শীতের সময় না হলে দুইবার বেড়াতে আসাযেত এই ভেবে। মেলায় মাটির বাশি, হাতি, ঘোড়া, গরু, মহিষ, হরিণ, খরগোশ, বাশের বাশি, পিস্তল, কাগজের ফুল, খেলনা নৌকা, লঞ্চ, ঢোলসহ কতকিছুই না উঠতো! কিনে নিয়েই খেলতে বসতাম খালার উঠানে।

নয়ন একজন গুণি মানুষ। একাধারে একজন ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় তার সবগুণাগুন তার আছে এবং একজন সাহিত্যপ্রেমি, প্রকৃতিপ্রেমি ও ভ্রমণ পিপাষু ব্যক্তিত্ব। নয়ন একজন অতি মানবিক গুন সম্পন্ন এবং সামাজিক মানুষ। তার দায়িত্ববোধ অনুকরণ ও অনুসরণ করার মত। আমি সবসময় ওকে ফলো করি এবং ওর অনেক আইডোলজি মেনে চলার চেষ্টাও করি, হয়তো পারি না। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, পাশের মানুষগুলোর প্রতি দায়িত্ববান একজন স্বার্থক মানুষ। আমার আদর্শ বলতেই পারি। যারা ওর সাথে চলেছে তারাই শুধু জানেন নয়ন কেমন মানুষ। নয়নের রয়েছে বই সংগ্রহের সখ। লেখালিখিও করেছেন একদা। একটা উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু লাজুক স্বভাবের মানুষ হওয়ায় সেই উপন্যাস কৃপণের মত নিজের কাছে রেখে আমাদের বঞ্চিত করেছেন। আমাদের বলা মনে হয় ঠিক হবে না। কারন আমিতো পড়েছি। আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। সকল পাঠক পড়তে পারলে তাদের কাছ থেকে পাওয়া মূল্যায়নে বুঝতে পারতাম আসলে কেমন হয়েছে। কবিতাও লিখতেন আমার বন্ধু নয়ন।

আমার গায়ের এই গেঞ্জিটা আমার খুবই প্রিয় একটি গেঞ্জি। গেঞ্জির কালারটা টাটকা লাল। আমার লাল পোশাকের প্রতি ভীষণ আগ্রহ তা কিন্তু নয়। তবে লাল ভালো লাগে মাঝে মাঝে! গেঞ্জির লাল রংটা আমার কাছে মিস্টি লাল মনে হয়। ডায়াবেটিকসে আক্রান্তরা ভয় পাবেন না! কিন্তু দুর্ভাগ্য গেঞ্জিটার রং জ্বলে গেছে। অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও আমি স্বজত্নে তুলে রেখেছি। এমন গেঞ্জি আর হয়তো পাবো না। ভালো লাগার জিনিস বেশিদিন টিকে না। যে পোশাকটা আপনার বেশি প্রিয়, যে পোশাকটা আপনার বেশি পছন্দের সেই পোশাকেই দেখবেন হয় চা পরে, ঝোল পরে, ডাল পরে নষ্ট হয়ে গেছে বা রোদে রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। রিক্সা থেকে নামার সময় প্রিয় পোশাকটাই ছিড়ে যায়। বেঞ্চ-চেয়ার থেকে উঠার সময় পেরেকে আটকে প্রিয় পোশাকটাই ফুটো হয়। যাকে বেশি ভালোবাসবেন সে দেখবেন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক আগেই আপনাকে ছেড়ে চলে যাবে। যে জিনিস আপনি অবহেলা করে ব্যবহার করবেন, কম ভালোবাসবেন সে জিনিস বেশিদিন টিকে থাকে। শুনেছি গড়িলা বা বনমানুষ যে বাচ্চাটাকে বেশি ভালোবাসে সে বাচ্চাটা বাঁচে না! কারন সেই বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে আদর করতে গিয়ে এতটা জোরে চাপ দেয় যে সে মারা যায়, আর যে বাচ্চাগুলোকে কম আদর করে তারাই টিকে থাকে অবলিলায়! আমরা চারপাশে তাকালে দেখতে পাই যে শিশুগুলোকে বেশি আদর করে প্রতিপালন করে তারাই সামান্য মাটি মুখে দেয়ার করনে পেট খারাপ হয়, মাটিতে হামাগুড়ি দেয়ার কারনে ঠান্ডালেগে যায়, একটু পুকুরে গোসল করলে নিমুনিয়া হয়ে যায় এমনকি এসব ঘটনায় মারাও যায়। অপরদিকে যে বাচ্চাগুলো অবহেলায় বড় হয় তারা দিব্যি টিকে থাকে। রাজধানী ঢাকাসহ সকল শহরের ফুটপাতে যে শিশুগুলো ডাস্টবিনের খাবার খায়, রাতে খালিগায়ে ঘুমায়, শরীরে ময়লার স্তর পরে থাকে, অত্যন্ত অযত্ন-অবহেলায় বাড়তে থাকে তারা খুব একটা অসুস্থ্য হয় না, দিব্বি বড় হচ্ছে! অবহেলিত শিশুদের প্রতি আমার মমত্ববোধ, সমবেদনা রয়েছে। আমি তাদের কটাক্ষ করতে কথাগুলো শেয়ার করছি না। এটা আমার একান্ত নিজস্ব ভাবনা। আপনাদের কাছে অন্য কিছুও হতে পারে। আমি আমারটা শেয়ার করলাম আপনাদের সাথে। আপনারাও আপনাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন।

সেদিনের রবি খালার বাড়ি ভ্রমণ স্মৃতির জানালায় কড়া নাড়লো একটা ছবি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেখি তিনবছর আগে পোষ্ট করা ছবিটা ভেসে উঠেছে। ছবিটার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খালাবাড়ি বেড়ানোর অনেক কথাই মনের জানালা দিয়ে উকি দিলো। ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখে গিয়েছিলাম দুজনে। তার আগেও গিয়েছি অনেকবার। সেই সময়ও ঘুরেছি দিগম্বরী দীঘি। নতুন-পুরাতন সেই সব স্মৃতিকথাই কচলালাম। তিতা লাগলে আমারই দোষ! তবে আমার এই লেখাটি পড়ে প্রিয় খালাতো যদি এমনই একটি লাল গেঞ্জি উপহার দেয় তবে মন্দ হয় না!! আরো অনেক কথাই আছে যা আরেকদিন বলবো। আজ নয়নকে ধন্যবাদ দিয়েই শেষ করতে চাই। ধন্যবাদ নয়ন, সুন্দর ছবিটা উপহার দেয়ার জন্য।

এবার দিগম্বরী দীঘি কাদের দিগম্বর করেছে বা কতজন দিগম্বর করেছে সেই গল্পে আসি। বিশাল আকারের এই দীঘি নিয়ে রয়েছে নানান রকম মিথ। অনেক পৌরানিক কাহিনী সমৃদ্ধ এই দীঘি। এক মহিলা এই দীঘির তীরে দিগম্বর হয়ে যা কিছু চাইতো দীঘি নাকি তাকে তাই দিতো। গল্পতো গল্পই। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, গল্পের গরু গাছে চড়ে, গাঁজাখোর পাহাড় দিয়ে নৌকা চালাতে পারে। তবে দীঘির স্বচ্ছ জল দেখলে যে কোন শিশুরই দিগম্বর হয়ে গোসল করতে মন চাইবে। ছোটবেলা এখানে দিগম্বর হয়ে অনেক শিশু-কিশোরকে গোসল করতে দেখেছি। কতজন দিগম্বর হয়ে গোসল করতে নেমেছিলো এই দীঘিতে সেই পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। আমি আসলে সেটাই বলতে চেয়েছি। এই দিগম্বরী দীঘি অনেককেই দিগম্বর করেছে, তবে তারা সবাই শিশু-কিশোর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here