সম্প্রতি ধর্মানুভূতিতে নাকি আঘাত লেগেছে নাসির নগরের মুসলমানের! কেউ দেখেছে, কেউ শুনেছে, কেউবা সুযোগ পেয়েছে। আর অমনি শুরু হয়েছে হিন্দু বাড়িতে আগুন দেয়া, মন্দিরে মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাংচুর, লুট তরাজ। যে যেমন বুঝেছে, যে যেমন সুযোগ পেয়েছে তাই করেছে আমাদের হুজুগে বাঙ্গালি কিছু বিপথগামী নষ্ট জনতা। সেই নিয়ে প্রশাসনে তোলপাড়, নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাস্ত, মন্ত্রীর গদি গরম, বেফাস কথায় ফেসে যাওয়া কত কি। বিষয়টা নিয়ে কিছু লিখতে যাওয়াও বিপদজনক! কোন কথা বেফাস হয়ে যায়! কোন কথা যে উস্কানিমূলক হয়ে যায় বলা বা বুঝা মুসকিল!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। সমাজে অসামাজিক লোক যেমন আছে, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু অসামাজিক লোকও আছে। অসামাজিক মানুষগুলো সমাজে নানা অপকর্ম করে বেরায়। অসামাজিক মানুষগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসৈজন্যমূলক পোষ্ট লেখা, বিকৃত রুচির ভিডিও-স্থির চিত্র পোষ্ট দেয়া, উষ্কানিমূলক কথা প্রচারের মাধ্যমে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সমাজে অসামাজিক মানুষের অবস্থান তা সংখ্যায় কত? সবাই বলে মন্দ লোকের সংখ্যা নাকি কম, ভাল মানুষই নাকি বেশি। তবে কেন অল্প সংখ্যক লোক বেশি সংখ্যক লোকের অশান্তির জন্ম দেয়?? এটা আমার কাছে লাখ টাকার প্রশ্ন হলেও কোন উত্তর নাই। উত্তর যা আসে তা কাজে আসে না। অল্প সংখ্যক অসামাজিক লোক অধিক সংখ্যক ভাল মানুষকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। কারন নাকি, অসামাজিক লোকগুলো নির্বোধ, নির্লজ্জ, বেহায়া ও সহসি হয়ে থাকে। পাশাপাশি সামাজিক লোকগুলো আত্ম মর্জাদার কথা চিন্তা করে একটু ভীরু প্রকৃতির হয়। সেই সুযোগই অসামাজিক লোকগুলো কাজে লাগায়। অসামাজিক লোকগুলোর ইউনিটি ভাল। সামাজিক লোকগুলোর ইউনিটির অভাব আছে। তারা একে অপরের বিপদে সহজে এগিয়ে আসতে চায় না, পাছে নিজের কোন ক্ষতি হয়ে যায়!!

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার উস্কানিতে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগর দেশের বেশ কিছু স্থানে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে যা সবাই জানে। কে করেছে সেটা তদন্ত সাপেক্ষ ব্যাপার হলেও উস্কানির আগুনে পুড়েছে অনেক অসহায় হিন্দু পরিবারের ঘর, মন্দির, প্রতিমা। কোন প্রকার যাচাই বাছাই ছাড়াই নির্বিচারে সাধারণ হিন্দুদের উপর হামলা হয়েছে। হামলা করেছে মুসলমানরা এটাতে কারো কোন সন্দেহ নেই। হামলা ঠেকাতে গিয়ে আহত হয়েছে অনেক মুসলমান সন্তানও। তাহলে কেন এমন হলো? আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি কি এতই ঠুনকো যে সামান্য উস্কানিতেই আঘাত লেগে যাবে? পবিত্র ধম গ্রন্থে বলা আছে, কোন কোন গর্হিত অপরাধকে স্বচক্ষে অন্তত ১৩ বার দেখবার আগে সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না নিতে বা সেটি প্রচার না করতে। অনেক সময় নিজের চোখে দেখা বা কানে শোনা বিষয়ও সব সময় সত্যি না হতে পারে। ঘটনার আড়ালে অনেক ঘটনা থাকে যা হয়তো আমরা কখনো জেনেই উঠতে পারিনা। কারন, এখন খারাপ মানুষের জয় জয়কার। আর তারা ওঁত পেতে আছে ভালো মানুষের ক্ষতি করবার জন্য। হয়তো কোন কারন ছাঁডাই, শুধুমাত্র তাদের বিকৃত আনন্দ চরিতার্থ করবার জন্য, নিজেদের ফায়দা লোটার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে অন্য ধর্মের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ভালো মানুষেরা কখনও কখনও সত্যিই অসহায়।

নাসিরনগরের ঘটনায় স্থানীয় সাংসদ ও মন্ত্রী নাকি বলে বসলেন মালাউনরা বারাবারি করছে!!! পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে পারুক না পারুক উত্তেজনা বসত হোক আর ঠান্ডা মাথায় হোক মালাউন শব্দটা চলে আসলো আমাদের সামনে। মন্দিরে মন্দিরে ঘরে ঘরে আগুন নিভুক আর না নিভুক ফেসবুকে নিন্দার আগুন ছরিয়ে পড়লো। মালাউন শব্দটা কেউ তার ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার করে প্রচার শুরু করলো। কেউ কেউ তার ওয়ালে লিখলো আমি মালাউন, আপনি? এভাবে সামাজিক মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে মন্ত্রীর গদী গরম করে ফেললো। মন্ত্রী বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন, পদত্যাগ দাবীতে স্লোগান আরো কত কি! কিছুদিন পরে সেটা থেমেও গেল। কিন্তু এরই মধ্যে ক্ষতি যা হওয়ার নিরীহ হিন্দুদের হয়ে গেছে।

একটা সময় আমাদের এই অঞ্চল ছিল হিন্দু অধ্যষিত। আমাদের পূর্ববর্তী বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে শোনা কাহিনী। হাতে গোনা মুসলমান ছিল। মুসলমানরা ছিল সংখ্যা লঘু শ্রেণীর। মুসলমানরা ছিল কেবলই গৃহস্ত। রহিম, করিম, গণি, কাদের ছিল একান্তই নিচু জাতের। আর হিন্দুরা ছিল কুলিন! কোন মুসলমান কোন হিন্দু বাড়ির সামনে দিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে পারতো না। পায়ে স্যান্ডেল থাকতে পারতো না। স্যান্ডেল হাতে করে, ছাতা বন্ধ করে যেতে হতো হিন্দু বাড়ির সামনে দিয়ে। কালে কালে সেসব এখন আর নেই। তখন মুসলমানদের বলা হতো হ্যাকা, হ্যাকার পো!!! গোসল করে যাওয়ার সময় কোন হ্যাকার পোর ছায়া যদি নিজের ছায়ার উপর পড়তো তবে আবার গোলস করতে হতো। সকাল বেলা ঘরের বাইরে গিয়ে হ্যাকার পোলার মুখ দেখলে যাত্রা ভঙ্গ হতো। এমনই গোরামী ছিল বলে দাদা দাদীর মুখে শুনেছি গল্পের মতো। তখন মুসলমানদের শিক্ষার অভাব ছিল, খাদ্যের অভাব ছিল, সম্পদের অভাব ছিল। অভাবী মানুষের প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও ছিল না। সেই সময় বদলে গেছে। আস্তে আস্তে এলাকার হিন্দুরা বিভিন্ন কারনে ও অযুহাতে চলে যেতে শুরু করে দেশ ছেড়ে। এলাকার মুসলমানরাও শিক্ষায় দীক্ষায় এগিয়ে গেল। আস্তে আস্তে হিন্দুদের হ্যাকা বলা বা হ্যাকার পো বলা কমে গেল। তখনকার হ্যাকা বলাটা ছিল আত্মমর্জাদার উপর আঘাত। মুসলমানদের হ্যাকা বলাটা উচিত হয়নি হিন্দুদের।

আজ অনেকদিন পর আবার মিডিয়ার মাধ্যমে শুনতে পেলাম মালাউন ডাক। কথাটা যদি সত্যি হয় তবে মন্ত্রী মহোদয় ঠিক করেননি। মুসলমানদের হ্যাকা বলার কারনে আমরা যেমন মনে কষ্ট পেতাম, এখনও মনে কষ্ট পাই ঠিক তেমনি হিন্দুদের মালাউন বললে তারাও মনে কষ্ট পায়। আজ মনে হচ্ছে, হ্যাকার পোলা মালাউন বলা শিখে যেছে, এটা ঠিক নয়। প্রত্যেকেরই আছে আত্ম সম্মানবোধ, ধর্মীয় অনুভূতি, সামাজিক মর্যাদা। অন্য ধর্মের অনুসারীদের সম্মান দিয়ে কথা বলাই ধর্মের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। ধর্ম অন্য ধর্মের অনুসারীদের হেফাজতের শিক্ষা দেয়, নির্যাতন নয়, অন্য ধর্মের অনুসারীদের সম্মান করার শিক্ষা দেয়, নিপিড়ন বা অপমান নয়। যে হিন্দুরা হ্যাকা বলতো তাদের আমরা ঘৃণা ভরে স্মরণ করি, আজ অমি যদি মালাউন বলি তবে আমাকেও ইতিহাস ঘৃণা ভরে স্মরণ করবে, অশ্রদ্ধা করবে। ধর্মীয় অনুভূতি এত হালকা নয়, সামান্য আঘাত দিলে ভেঙ্গে যাবে। ধর্মের বড় শিক্ষা ধৈর্য, সহনশীলতা, সহানুভূতি পরায়নতা এবং অন্যকে সম্মান করা। আসুন আমরা ধর্মের চর্চা করি, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে ধ্বংষযজ্ঞ নয়।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here