সমকালীন ভাবনা
আসাদুজ্জামান জুয়েল

সমকালীন ভাবনা
লেখক আসাদুজ্জামান জুয়েল
প্রকাশক বৈশাখী প্রকাশ
৩৮, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
মোবাইল : ০১৭১২৮১৮৩০৩, ০১৭৩৪৯০১১৩৯
প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০১৯
গ্রন্থস্বত্ব লেখক
প্রচ্ছদ মোঃ ফরিদ হোসেন
বর্ণবিন্যাস স্বদেশ কম্পিউটার সিস্টেম
মুদ্রণ রাবেয়া প্রিন্টার্স
মূল্য ৩০০ টাকা মাত্র

উ। ৎ। স। র্গ

আমার প্রয়াত মা রওশনারা বেগম

পিতা আবদুর রশিদ খান
যাদের জন্য আজ আমার লেখালিখি।

কিছু কথা
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাথায় যে চিন্তা ভর করে, সেই চিন্তাগুলো অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করি। প্রকাশের পর পাঠকের যে সাড়া পেয়েছি তাতে আরো বেশি লিখার তাগিদ অনুভব করি। আমি কোনো কলামিস্ট নই। আমার লেখাগুলো বরেণ্য সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের পত্রিকায় আমার এক শ্রদ্ধেয় ভাই মীর নাসিমুল ইসলাম প্রকাশের সুযোগ করে দেয়ার পর পরিচিতির জায়গায় দেখি কলামিস্ট জুড়ে দিয়েছেন। সেই থেকে লেখার গতি গেল বেড়ে। লিখতে লিখতে দেখি প্রকাশযোগ্য কিছু লেখা জমে গেছে। আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করেছি মাত্র, কোনো সাহিত্য রচনা করিনি। আমার নিজস্ব মতামতগুলো পড়ে যদি কেউ আনন্দ পায়, ভালো লাগে সেটাই আমার স্বার্থকতা।
আমি কৃতার্থ আমার বন্ধু আইনজীবী ভাইদের কাছে যারা আমার লেখা গ্রহণ করে আরো লিখতে উৎসাহিত করেছেন। আমি কৃতার্থ আমার সহধর্মিণী মুনমুন সুলতানা লুনার কাছে যে আমাকে লিখতে সর্বদা উৎসাহ দিয়েছে। বিশেষ করে যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই দায় শেষ হয় না তারা হলেন, বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাহবুবুল হক, জাপানের সিমানী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত ভূতত্ববিদ শামীম আজিজ, প্রফেশনাল প্রচ্ছদ শিল্পী না হয়েও আমার বইগুলোর সুন্দর সুন্দর প্রচ্ছদ একেছেন সেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিষ্টার মোঃ ফরিদ হোসেন, শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির বারবার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোঃ আবু সাঈদ, খালাতো ভাইয়ের চেয়েও বেশি বন্ধু আমির হোসেন নয়ন, বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান নয়ন, শামীম সরদার, আমার বোন কোহিনুর আক্তার শিখা।
আগেও বলেছি, আমি কোনো লেখক বা কলামিস্ট নই। তাই আমার লেখায় শব্দ গঠনে, বানানে অনেক ভুল থাকে। আমি আমার অযোগ্যতাকে লুকাতে চাই না। অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো আমার অজ্ঞতা, অযোগ্যতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই না। তাই আমার ভুলগুলো বন্ধুরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে লেখাটা গ্রহণ করবেন বলেই আমার আশা। সবাই ভালো থাকবেন।

আসাদুজ্জামান জুয়েল
আইনজীবী
শরীয়তপুর।

সূচিপত্র

জোঁকের তেল, তাবিজ-হালুয়া আর কত কাল?-৯
ছেঁড়া দুই টাকার নোট-১৫
নগরীর উৎপাত ঃ লিফলেট বিলি-১৮
ভাল ঋণ-মন্দ ঋণ ॥ ব্যাংকার ও আইনজীবীর দায়-২১
কুকুর-বিড়াল-বৃদ্ধ-মহিলা-শিশু-গরু-গ-মূর্খ দেখলে সাবধান!-২৭
আমার মায়ের ডাক ও মুখ-৩১
সাগরে ভাসছে মানবতা ঃ কোথায় এখন মানবাধিকার?-৩৪
নেতা ভক্তির নমুনা!-৩৮
কেন এমন হয়! এই দেশেতে মৃত্যু ভাগ্য তাদের কেন নয়?-৪০
চোখের বালি-৪২
পাগল নিয়ে পাগলামি-৪৬
আপা নিয়ে চাপাচাপি-৫৪
দাদুর নির্বাচনী গল্প-৫৮
শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়ক ও হরমুজ মিয়ার শেষ ইচ্ছা!-৬৫

জোঁকের তেল, তাবিজ-হালুয়া আর কত কাল?

॥ ০১ ॥
নিয়াজ সাহেব ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গেলেন। পাশেই একটি জটলা। গোল হয়ে উৎসুক মানুষের ভিড়। কথার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কৌতূহল আটকে রাখতে পারলেন না। নিয়াজ সাহেব তাকালেন ভিড়ের দিকে।
ভিড়ের দিকে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেল একটি লাল প্লাস্টিকের বড় বলের দিকে। বল ভর্তি তরতাজা জোঁক কিলবিল করছে। গ্রামে এই জোঁকগুলোকে বলা হয় করাতি জোঁক। ময়লা আবর্জনা ভর্তি পুকুরে নামলে এই জোঁকগুলো পায়ের সাথে লেপটে থাকে। রক্তচোষা জোঁকগুলো মুহূর্তেই মোটা হয়ে যায় রক্ত পান করে। দেখলেই কেমন গা ঘিনঘিন করে!
নিয়াজ সাহেব কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখলেন বল একটি নয় পাঁচটি। প্রতিটি বলে হাজার হাজার জ্যান্ত জোঁক। কিলবিল করছে। দেখলেই কেমন গা গুলায়! একটার গা বেয়ে আরেকটা বলের প্রাচীর বেয়ে উপর উঠে আসার চেষ্টা করছে পেট মোটা জোঁকগুলো। জোঁকগুলো বল বেয়ে বেয়ে উঠে যেতে চাইছে বাইরে। যেই না উঠতে চাইছে অমনি এক ব্যক্তি লাঠি দিয়ে বলের কাঁধে বাড়ি দিল। আর অমনি উঠতে থাকা লকলকে জোঁকগুলো ঝর ঝর করে পড়ে গেল বলে রাখা পানিতে। ছোটখাট একটি জটলা। ছিপছিপে রোগা পাতলা একজন লোক। বিদঘুটে চেহারা। জোঁক দেখলে যেমন গা ঘিনঘিন করে তেমনি লোকটাকে দেখলেও গা ঘিনঘিন করে। তেল চিটচিটে একটি ফতুয়া পড়া। পান খাওয়া দাঁত। তরমুজের বিচির মতো দেখতে। মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। লোকটি প্লাস্টিকের মোড়ার উপর বসা। হাতে একটি তেলতেলে লাঠি। লাঠিটাই তার প্রধান হাতিয়ার। কোনো কিছু দেখাতে লাঠিটা ব্যবহার করছেন। আবার প্লাস্টিকের বল বেয়ে উঠে যাওয়া জোঁকগুলোকে নামাচ্ছেন। লাঠি দিয়ে বলের উপর বাড়ি মারলে মন্ত্রের মতো কিছু জোঁক সুরসুর করে নেমে যাচ্ছে আর কিছু জোঁক যেন লাফ দিয়ে বলের পানিতে ঝাপ দিচ্ছে। মোড়ায় বসে লাঠি হাতে লোকটা লেকচার দিচ্ছে। তাদের কথাকে সবাই লেকচার আর তাদেরকে সবাই লেকচারার বলেই ডাকে।
না, এই ব্যক্তি পিএসসির মাধ্যমে বিসিএস দিয়ে লেকচারার হননি। আবার বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও লেকচারার নন তিনি। তিনি রাস্তার লেকচারার। রাস্তায় লেকচার দিতে দিতে লেকচারার হয়েছেন। কথায় আছে না? বকতে বকতে হয় বক্তা, আর পিটাতে পিটাতে হয় তক্তা! উনি বকতে বকতে বক্তা অর্থাৎ লেকচারার হয়েছেন!
তো, লেকচারার সাহেব বসে আছেন লাঠি হাতে। বলগুলো ভর্তি জোঁক। একটা বড় প্লাষ্টিকের কাগজ বিছানো। তার চতুর্দিকে সারি সারি বয়াম। বয়াম ভর্তি বড় সাইজের জোঁক। এক একটি জোঁকের সাইজ হবে আট থেকে দশ ইঞ্চি। দেখলে মনে হবে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে জোঁকগুলো।
নিয়াজ সাহেব দাঁড়িয়ে পড়লেন জোঁকগুলো দেখে। জোঁক দেখে তার গা ঘিনঘিন করতে লাগলো। তবুও দেখার ও লেকচার শোনার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারলেন না। লেকচারার সাহেব তার লেকচার শুরু করলেন-
-ভাই সাব। জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন আর অনেক কিছু শুনেছেন আবার অনেক চিকিৎসা নিয়েছেন। কোনো ওষুধে কাম হয় নাই। আমার কাছে আজ শুনে যান কীভাবে সফল হবেন। ঔষধ কিনতে হবে না। শুনলে কিনতে হয় না, দেখলেও কিনতে হবে না। কেনা না কেনা আপনার ব্যাপার! নিয়মটা শুনে যান কীভাবে বানাইবেন আর কীভাবে ব্যবহার করবেন। এই জোঁকের তেল ব্যবহার করলে —শক্ত মজবুত হবে। ব্যথা-বেদনা দূর হবে।
প্লাস্টিকের বলের উপর তেলতেলে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে বললেন-
যাবেন না। নিয়মটা শুনে যাবেন। আমার এই ঔষধের নিয়ম জানলে ঔষধ আর নিয়ম না জানলে বিষ। তাই নিয়মটা শুনে যাবেন।
এভাবে প্রায় অর্ধশত রোগের নাম বলল যা কিনা অনেক এমবিবিএস ডাক্তাররাও ভাল করার কথা বলতে পারেন না। সেইসব রোগের জন্য লেকচারার সাহেব শতভাগ গ্যারান্টিসহ চিকিৎসার নিশ্চয়তা দিলেন।
একটু দম নিয়ে লেকচারার সাহেব আবার শুরু করলেন-
আমার ঔষধ আপনাদেরকে কিনতে হবে না। নিয়মটা শুনে যান। আর ঔষধ বানানের পদ্ধতিটা জেনে যান। নিজে বানাইয়া ব্যবহার করবেন। ভাল না হলে মুখের উপরে ছুড়ে মারবেন। এই দেহেন, এরকম দুইটি মোটা জীবন্ত জোঁক নিবেন। জোঁক দুটির মুখে লবণ দিয়ে মেরে একটি ঝুনা নারিকেল (পাকা নারিকেল) নিবেন। নারিকেলের মুখ ছিদ্র করে পানি ফেলে দিবেন। চাইলে পানিটা নিজে খেতে পারেন অথবা আপনার বিবি, বাচ্চাকেও খাওয়াইতে পারেন। পানি শেষ হলে এই জোঁক দু’টাকে ভিতরে ভরবেন। এর সাথে ভরবেন পারদ, —- সহ —
এভাবে আট দশটি উপাদানের নাম বলে একটু দম নিলেন। প্লাস্টিকের বলের ঘাড়ে বাড়ি মারতে মারতে আবার শুরু করলেন।
এরপর নারিকেলের মুখটা বন্ধ করে অমাবস্যা-পূর্ণিমার মাঝামাঝি রাতে কালিঘাটে গিয়ে এক নিঃশ্বাসে মাটির নিচে পুতে রাখবেন। রাতটা যেন শনিবার হয়। এরপর তিন মাস পরে আবার শনিবার রাতে তুলে আনবেন। হাতল ছাড়া ভোতা দা দিয়ে এক কোপে কেটে নারিকেল দুই ভাগ করে ফেলবেন।
মনে রাখবেন কোপ দেওয়ার সময় নিঃশ্বাসটা যেন বন্ধ থাকে। আর কাটবেন এক কোপে! সামচুর মতো কোপাইলেই হইবো না।
কাটার পরে দেখবেন ভিতরে ক্যাদার মতো হয়ে গেছে। সেই ক্যাদার মতো বস্তু এক নিঃশ্বাসে তুলে একটি মাটির পাতিলে এক পোয়া সরিষার তেল, এক পোয়া তিলের তেল, —– দিয়ে মাটির পাতিলে মাটির চুলায় তেঁতুলের লাকরি (চলা কাঠ) দিয়ে ভাল করে জাল দিতে হইবো।
মনে রাখবেন, গ্যাসের চুলায় রানলে কিন্তু হইবো না। এরপর যেই তেল বাইর হইবো সেই তেল নতুন একটা গামছা দিয়া ছাঁকবেন। ছাঁকা তেল দিয়া মালিশ করবেন। ঘা, প্যাচরা, দাউদ, একজিমায় লাগাইবেন। রাতে খাউজাইয়া রাতেই লাগাইবেন সকালে কইতে পারবেন না কোন খানে খাউজাইছেন আর কোন খানে লাগাইছেন। এত ভাল কাজ করবো। ইনশল্লাহ। ভাল নিয়ত করে লাগাইবেন। দেখবেন সকল রোগ ভাল হয়ে গেছে।
ভাই সাব। আমি আগেই কইছি, আমার ঔষধ নিয়ম জানলে ঔষধ নিয়ম না জানলে বিষ!। সেদিন হাটে থেকে এক লোক ঔষধ কিনছে। পরদিন তার পুতেরে লইয়া আইছে। বলে, মিয়া কী ওষুধ দিছেন? পুতের বিচি ফুইল্যা গেছেগা! আমি কইলাম, ক্যা কী হইছে? লোকটায় কয় ঔষধ লাগানোর পর তার পুতের বিচি ফুইল্যা ঢোল হইয়া গেছে! আমি জিগাইলাম কেমনে ব্যবহার করছেন? লোকটায় কয়, ক্যান? আপনি যেমনে বলছে তেমনেইতো লাগাইছি।
আমি জিগাইলাম কেমনে লাগাইতে কইছি কনদিহি?
লোকটায় কয় প্রথমে হারিকেনের উপর পুতের বিচি গরম করছি, তারপর তেলডা লাগাইছি। এহন দেহি পুতের বিচি ফইল্যা বড় ঢোল হইয়া গেছে।
এইবার বোঝেন অবস্থা! আমি কইছি, হারিকেনের উপর তেলডা গরম কইরা বিচিতে লাগাইতে আর উনি বিচি গরম কইরা তেল লাগাইছে! দোষ কি আমার ভাই সাব? তাইতো বলি নিয়ম না জানলে বিষ।
তবে ভাই আর একটা কথা, আমার ওষুধ ঘাড়ে ব্যথায় লাগাইবেন, মাজায় ব্যথায় লাগাইবেন, পিঠে ব্যথায় লাগাইবেন কিন্তু মনের ব্যথা হলে লাগাইবেন না। এ ঔষধ মনের ব্যথা সারে না।
কিন্তু ভাই সাব। আমি জানি আপনারা এত কিছু যোগার করতে পারবেন না। একটা যদি ভুল হয় তবে ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই আমি আপনাদের কথা ভেবে তৈরি করে রেখেছি। মূল্য এক দাম পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু প্রচার পাবলিসিটির জন্য আজ পঞ্চাশ টাকা নেব না। আজ একদম পানির দরে দিয়ে যাব দু’একটা কাস্টমার ধরার জন্য। আমার ঔষধে যদি রোগ ভাল হয় তবে দু’একটা রুগি আমারে আপনারা দিবেন না বাজান? আমি জানি দিবেন। তাই একে দুই ভাগে ভাগ করে এক ভাগ ফেলে দিলাম। বাবারা হাতে থাকে কত? জোরে বলুন।
পাঁচ-ছয়জন লোক বলে উঠলো-
পঁচিশ টাকা।
পঁচিশ টাকাকে পাঁচ ভাগ করে দুই ভাগ ফেলে দিলাম। থাকে কত?
পনেরো টাকা।
হ্যাঁ! পনেরো টাকা দিয়ে এখন সর্ব প্রথম যে ভাই আমারে সরমান (সম্মান) করবেন আমি তাকে এমন একটা সরমান করবো যা আপনি ভাবতেও পারছেন না।
প্রথম একজন হাত তুলতেই একে একে দশ-বার জন হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেল। বেশ ভালই বিক্রি হলো। নিয়াজ সাহেব হতাশ হয়ে চলে গেল তার কাজে। যেতে যেতে ভাবছেন, এও কেনে মানুষ? কীভাবে সহজসরল মানুষগুলোকে ঠকাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে।

॥ ০২ ॥
বিশিষ্ট আলেম মানুষ। চারমুষ্ঠি দাড়ি। কাঁচা-পাকা দাড়িতে মেহেদি দেয়ায় বেশ ভালই লাগছে। নুরানি চেহারা দেখলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করবে। সামনে নানান রকম জিনিস নিয়ে বসে আছেন। একটা করে ধরেন আর একদমে বলে যান-
এটা ধনেশ পাখির ঠোঁট, একটু দিয়ে দিলাম; এটা মহাসমুদ্রের কট মাছের কাটা, একটু কেটে দিলাম; এটা বনরুই এর ছাল, একটু কেটে দিলাম; এটা কুলুকুলু গাছের ছাল, একটু কেটে দিলাম; এটা ফাঁসির দড়ি, একটু কেটে দিলাম; এটা জারজ মানুষের হাড়, একটু কেটে দিলাম; — ।
এভাবে প্রায় পঞ্চাশ ধরনের জিনিস একটু কেটে দিলাম-একটু কেটে দিলাম বলে কেটে দিল। এরপর কিছু কাগজ পেঁচিয়ে একটা তাবিজ তৈরি করলো। একটা মাদুলিতে ভরে বলে-
ভায়েরা। নিজের চোখে দেখলেন কতগুলি আইটেম একটু করে কেটে দিয়ে দিলাম। এর হাদিয়া যদি হাজার টাকাও ধরা হয় তবে এর মূল্য দেওয়া হবে না। শুধুমাত্র আপনাদের কথা ভেবে এর হাদিয়া নেব দশ টাকা চার আনা। এক দাম এক রেট। কোনো দামাদামি নেই। এটা তেলে চুবাইয়া গায়ে মাখবেন, গায়ের রং ফরসা হবে। পানিতে চুবাইয়া পানি খাইবেন পেটের সকল ওষুক ভাল হইবো। গলায় বাধবেন- ভাল গান গাইতে পারবেন, হাতে বাধবেন- হাতে শক্তি বাড়বো। কিন্তু মাজায় বাধবেন না। যে যেই নিয়ত করে বাধবেন ভাল হয়ে যাবে ইনশল্লাহ। একশত ভাগ গ্যারান্টি। ভাল হয় নাই এমন প্রমাণ এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারে নাই। দিতে পারলে মূল্য ফেরত। আর আমি জানি কেউ দিতে পারবেও না।
এখানেও একজন প্রথম ‘সরমান’ করার জন্য দাঁড়িয়ে গেল। এরপর আর ক্রেতার অভাব হলো না। সরলমতি-কোমলমতি সাধারণ লোকের কা- দেখে হতাশ নিয়াজ সাহেব দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে চলে গেলেন।

॥ ০৩ ॥
বিশাল একটি লাল ত্রিপল বিছিয়ে তার উপর চলচ্চিত্রের ফিল্ম রাখার বাক্সে ভরা বিভিন্ন শুকনা দ্রব্য। এক একটা দেখাচ্ছে, তার নাম ও গুনাগুন বলছেন হাকিম সাহেব। না এই হাকিম কোনো হুকুম করার হাকিম না। ইনি ইউনানি দাওয়াখানার চিকিৎসক বিশিষ্ট হারবাল গবেষক! হেকিম আবদুল কুদ্দুস মিয়া। পাত্রে সাজানো দুই শতাধিক দ্রব্য দেখিয়ে পাশে রাখা দশ-বারোটি হরলিকস এর বয়াম ভর্তি গুঁড়া একটা চকচকে স্টিলের বলে রাখলেন। সেই সাথে কিছুটা মধু, ঘি, কিসমিস দিয়ে মাখালেন। এরপর নাম না জানা অপরিচিত কিছু গুঁড়া দিলেন। দেয়ার সময় এক একটি দেখিয়ে বললেন-
এটার নাম বাতাসের আগা, আর এটার নাম রৌদ্রের গুঁড়া। আর এখন দিচ্ছি কিছু পাহাড়ের ঘাম।
এই সব মিশিয়ে তৈরি হলো এক অনন্য হালুয়া। যা দেখতে অনেকটা চাটনির মতো। হাকিম সাহেব ঘোষণা দিলেন এই হালুয়া খেলে নব্বই বছরের বুড়োর বয়স মনে হবে আঠারো কী উনিশ্। আর বারো বছরের কিশোর খেলে বিশ কী বাইশ বছরের যুবকের মতো উন্মাদ হয়ে যাবে। ওষুখ থাকলেও খাবেন আর না থাকলেও খাবেন। যতবড় কোষ্ঠকাঠিন্যই হোক না কেন এটা খেলে বাথরুমে যেয়ে কোৎনা দিতে হবে না। শুধু পিছনের কাপড়টা তুলে বসলেই হবে। দেখবেন ঔষুধের কেরামতি। খেয়ে আপনি রাতে ঘুমাবেন কিন্তু আমার ঔষুধ ঘুমাবে না। আমার ঔষুধ সমানে কাজ করবে।
চটকদার কথা শুনে রিকশাচালক, শ্রমজীবি টাইপের লোকজন তিরিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা মূল্যের বিভিন্ন ফাইল কিনে নিল। সর্ব রোগের মহৌষধ মাত্র ত্রিশ টাকা-পঞ্চাশ টাকা। এ সুযোগ হাতছাড়া করাটাই যেন বোকামি!
নিয়াজ সাহেব বোকা বনে গেলেন। হায়রে বোকার দল! এগুলো খেলে এমনিতেই পেট খারাপ হয়ে পেট নেমে যাবে। কষাতো থাকবেই না নির্ঘাৎ ডায়রিয়া হয়ে যাবে।
বন্ধুরা, উপরের তিনটা ঘটনা কোনো গালগল্প নয়। আমাদের দেশের পথের ধারের বাস্তব ঘটনা। এভাবেই প্রশাসনের নাকের ডগায় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ সকল রোগের ঔষধ হিসেবে ফুটপাতের লেকচারারদের পাতা ফাঁদে ধরা দিয়ে কিনে নিচ্ছে নানান তেল-মালিশ করার জন্য, নিচ্ছে তাবিজ, খাচ্ছে হালুয়া আপদ-বালা-মুসিবত থেকে ভাল হবার জন্য।
সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কেনই বা তারা এসব কিনে নিচ্ছে। ব্যবহার করে অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছে। আসলে অজ্ঞতা, অশিক্ষার সাথে সাথে সরকারের অবহেলা কি নাই? আছে। সরকার যদি যথাযথ স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারতো। চিকিৎসক নামের একশ্রেণির কিছু কষাই এর হাতে যদি রোগীকে জবাই হতে না হতো তবে কেউ এই শর্টকার্ট চিকিৎসায় উৎসাহী হতো না। আমাদের যেমন শিক্ষার অভাব আছে। আছে অবকাঠামোর অভাব। তেমনি আছে চিকিৎসকদের মানসিকতার অভাব। চিকিৎসকদের সুচিকিৎসা এখন সেবা নয় পণ্য হয়ে গেছে। চিকিৎসকরা যদি অজ্ঞ, সহজ, সরল রোগীদের হাসপাতালমুখী করে সঠিক চিকিৎসা নিতে উৎসাহী না করে তবে তারা হাসপাতাল বিমুখ থেকেই যাবে। আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিনবে জোঁকের তেল, তাবিজ আর হালুয়া।
আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের? আসুন সবাই মিলে সচেতন হই। অসুখ-বিসুখ হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। সকল চিকিৎসকই খারাপ না। গুটিকয়েক অপচিকিৎসকের কারণে মানুষ হতাশ হচ্ছে। এখনো অনেক চিকিৎসক আছে যারা সমাজকে দিয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে অপচিকিৎসা থেকে দূরে থাকি এবং সবাই মিলে অপচিকিৎসকদেরও মানসিক চিকিৎসা করাই।

ছেঁড়া দুই টাকার নোট …..

কেমন আছেন?
জাবেদ সাহেব রিভলবিং চেয়ারে বসা। চোখ আধ বোজা, একটু একটু দোল খাচ্ছিলেন। প্রশ্নটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন। এক গাল অরেঞ্জ ফ্লেভারের হাসি হেসে উত্তর দিলেন- ভাই ছেঁড়া দুই টাকার নোটের মতো আছি আর কী।
উত্তরটা শুনে একটু অবাকই হলাম। এটা আবার কেমন ভাল থাকা!
তার মানে ?
মানে? মানে বাসে বলেন, দোকানে বলেন, যেখানেই যাবেন ছেঁড়া ফাটা দুই টাকার নোটের অবস্থা খারাপ হলেও চলছে। আমার অবস্থা অনেকটা তাই। ভাল না হলেও জীবন চলে যাচ্ছে একরকম।
কথাটা জাবেদ সাহেব মন্দ বলেননি। দুই টাকার নোটের যা অবস্থা! ছেঁড়া, ময়লা, দেখলেই মনে হবে বাংলাদেশের এই দুই টাকার নোটের উপর দিয়ে সিডর বয়ে গেছে বারবার। ধ্বংসের ছাপটা তাই স্পষ্ট।
দুই টাকার নোটের মূল্যমান যদিও দুই টাকা অর্থাৎ দুই শত পয়সা এটা সবারই জানা। যে বিষয়টা না জানেন সে হয় শিশু নয় পাগল। কিন্তু দুই টাকার একটি নোট জোড়া দিতে অনেক সময় দেখা গেছে পঁচাত্তর পয়সার আঠা, পঁচিশ পয়সার স্কচ টেপ, কখনওবা কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। দুই টাকার একটি নোটে দুই থেকে দুই দশে বিশটি জোড়া তালি পেলে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং কোনো দুই টাকার নোটে যদি জোড়াতালি না পাওয়া যায় তবে ভাবতে হয়;
হায়! দেশের জালিয়াত চক্রের মাথা বুঝি গেছে! দুই টাকার মতো মূল্যমানের নোটেরও কি শেষ পর্যন্ত জাল ছেপে নিল? হ্যাঁ! নতুন দুই টাকার নোট দেখলে জাল কিনা সেটাই চিন্তা করে প্রথম!
তবে নোট যতই ছেঁড়া বা ফাটা হোকনা কেন তার কদর আছে। বাসের কণ্ট্রাক্টরকে যতই ছেঁড়া-ফাটা নোট দেন কোনো সমস্যা হবে না। মামা ডেকে প্লাস্টিকের হাসি হেসে সাদরে গ্রহণ করবে টাকাটা। আবার যখন ভাংতি দেবে তখন ঐ দুই টাকার ছেঁড়া-ময়লা নোটই আপনাকে ধরিয়ে দেবে। যদি নিতে না চান তবে হাসি মাখা মুখে বলবে-
মামা নেন। না চললে আমারে ফেরত দিয়েন।
তোমাকে পাব কোথায়?
গাড়ির নাম্বারটা লেইখা লন! কোনো সমস্যা হইবো না।
তোমার তো সমস্যা নাই, সমস্যা তো আমার।
মামা আমারতো সমস্যা নাই, আপনারও সমস্যা হইবো না।
তবে সত্যিই কোনো সমস্যা নাই। যাকে দেই তাকেই বলি সমস্যা নাই। যে দেয় সেই বলে সমস্যা নাই। সত্যিই এক সময় ছেঁড়া দুই টাকার নোট এতটা ‘চল’ হয়ে গেল যে কয়েন পকেট থেকে পড়ে যাবে ভেবে মানুষ ছেঁড়া দুই টাকার নোট চেয়ে নেওয়া শুরু করে।
ছেঁড়া টাকার কথা বলতে বলতে ছেঁড়া টাকা নিয়ে তৈরি করা একটা বিজ্ঞাপন চিত্রের কথা মনে পড়ল। ভালই লেগেছে দেখে, আপনাদেরও নিশ্চয়ই মনে আছে!
এক ভদ্রমহিলা বাজারে গিয়ে দোকানির কাছ থেকে কিছু তরি-তরকারি, শাক-সবজি কিনলেন। যার মূল্য হলো- ধরুন আটানব্বই টাকা। দোকানিকে ভদ্রমহিলা একশত টাকার একটি তরতাজা কচকচে নতুন নোট দিলেন। দোকানি ভদ্রমহিলাকে দিল ছেঁড়া দুই টাকার একটা নোট। তা আবার যেন তেন নোট নয় সিডরে বিধ্বস্ত দুই টাকার নোট! নোট দেখে ভদ্রমহিলাতো ক্ষেপে গেলেন। রাগে ক্ষোভে গজরাতে গজরাতে বললেন-
আরে! আপনাকে এত সুন্দর একটা নতুন নোট দিলাম। অথচ আপনি আমাকে এমন একটা ছেঁড়া ফাটা নোট দিলেন? বদলে ভাল একটা নোট দেন। এটা চলবে না।
দোকানি বলল- কন কী আফা! চলবো। দুই টাহার নোট আবার অচল আছে নাকি? লাম্বারটা আছে কিনা হেইডা খালি দেখবেন।
না না, এটা চলবে না। আমায় টাকা বদলে দিন।
দোকানি আর ভদ্রমহিলা চেচামেচি শুরু করে দিল। ‘চলবে আর চলবে না’ এ কথা নিয়ে শুরু হয়েছে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি। দুজনে ঝগড়া চলছে ফাটাফাটি। এমন সময় এক অতি বুদ্ধিমান মহিলা এসে বললেন- দেখি টাকাটা চলবে কিনা?
দোকানি একটু হালে পানি পেল। ভদ্রমহিলাকে টাকাটা দেখিয়ে বলল- দেহেন তো মেডাম! টাহাডা বোলে চলতো না?
হুম! দেখছি, চলে কী না?
এই বলে ভদ্রমহিলা টাকাটা তার হাতে নিয়ে সবজির ঝুড়িতে ফেলে হাত ইশারা করে বলেন- আসো সোনা, আসো, এদিকে আসো।
ঝুড়িতে পড়ে থাকা টাকা আগের মতই পড়ে রইলো। কোনো নড়াচড়া করলো না। এবার একটু ধমকের সুরে- আয়, আয় বলছি। এদিকে আয়।
এতেও যখন টাকা নড়লো না তখন জোড়ে ধমক দিয়ে বলল- আয়, আয় বলছি। নইলে দেব মার।
যথারীতি রেজাল্ট আগের মতোই। অসুস্থ, ক্লান্ত দেহে নিথর হয়ে পড়ে রইলো দুই টাকার নোটটি। এত ডাকাডাকির পরও যখন টাকাটা ভদ্রমহিলার কথা মতো আসলো না। একটু নড়লোও না। যেখানে রয়েছে সেখানেই পড়ে রইলো। তখন ভদ্রমহিলা দোকানিকে বলল- নাহ! দেখুন ভাই, কত বললাম। টাকাটা চললো না। মনে হয় চলবে না!
ক্রেতা ভদ্রমহিলা ফিক করে হেসে দিল কা- দেখে।
দোকানি নোটটা রেখে দুটি কয়েন ধরিয়ে দিল। দোকানিকে বোকা বানিয়ে গেল। এটা দোকানি বুঝতে পারলেও কিছু যে বলার নেই তাও বুঝতে পারলো। দোকানি অস্ফুট স্বরে বলল, আফা আপনেও নতুন তবে অচল টাকাই দিয়া গেলেন, যেখানে রাখছি সেখানেই পড়ে আছে, নড়েও না চড়েও না!
বোকা বনে কয়েন দিলেও দুই টাকার নোট ছেঁড়া হোক, ফাটা হোক এর কদর যে আছে এটা কেউ অস্বীকার করবে না।
দেশের অবস্থা কী? রাজনীতির অবস্থা কী? অর্থনীতির অবস্থা কী? সামাজিক অবস্থা কী? খেলাধুলার অবস্থা কী? শিক্ষা-সংস্কৃতির অবস্থা কী? বাজারের অবস্থা কী? আয়ের অবস্থা কী? ব্যয়ের অবস্থা কী? সাধারণ মানুষের অবস্থা কী? এভাবে প্রশ্ন করলে প্রশ্নের অভাব হবে না।
এসব প্রশ্নের উত্তরে যদি বলা হয় যে, দুই টাকার নোটের মতো, তবে কি ভুল হবে? সব কিছুরই অবস্থা ছেঁড়া, ফাটা, জোড়াতালি দেয়া, ক্ষয়িষ্ণু তবুও চলছে, চলে এবং চলবে।
আসলে ছেঁড়া দুই টাকার নোট কেন চলে? সাধারণ হিসাব এটা। যখন ভাংতি দেওয়ার জন্য নতুন নোটের চাহিদা মোতাবেক জোগান থাকে না, তখনইতো চলে! দেশে যখন সুস্থ রাজনীতির অভাব, সুস্থ সংস্কৃতির অভাব, সুশাসনের অভাব, হাল ধরার যোগ্য লোকের অভাব দেখা দেয় তখন ছেঁড়া দুই টাকার মতো চাহিদার জোগান হিসেবে চলে আসে অযোগ্য অপশক্তি। তাই দেশে দরকার সুস্থ রাজনীতির ধারা, গণতন্ত্রের ধারা, পরিকল্পিত অর্থনীতির ধারা। নইলে ছেঁড়া ফাটা নোট যেমন ঘুরে ফেরে হাতে হাতে আর শাসনের ভারও চলে যাবে ছেঁড়া ফাটা লোকের হাতে। যার পরিণাম ভালো হবে না।

নগরীর উৎপাত ঃ লিফলেট বিলি
॥ ০১ ॥
রফিক সাহেব ব্যস্ত ব্যবসায়ী। মতিঝিল ব্যাংক পাড়া থেকে কাজ সেরে দ্রুত বেরিয়েছেন মিরপুর যাবেন বলে। মিরপুরগামী বাসের টিকেট কেটে বসেছেন জানালার ধারে। ভয়ংকর সীসা ও কার্বনডাইঅক্সাইড মেশানো ফুরফুরে বাতাস আসছে জানালা দিয়ে। বসে বসে ভাবছেন ব্যবসার কথা। হঠাৎ একটি ভিজিটিং কার্ড সাইজের শক্ত কাগজের টুকরো ক্ষেপণাস্ত্রের গতিতে এসে আঘাত করলো রফিক সাহেবের কপালে। আঁতকে উঠলেন! দ্রুত জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, নেকাবে মুখ ঢাকা বোরকা পরা এক মহিলা। হাতে অনেকগুলো ভিজিটিং কার্ড নিয়ে জানালা দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট লাঞ্চার-এর গতিতে ছুড়ে ছুড়ে মারছে যাত্রীদের দিকে। অনেকেই রফিক সাহেবের মতো আঁতকে উঠে তাকাচ্ছে জানালার দিকে।
জানালা ছেড়ে অতঃপর ছুড়ে মারা কার্ডটির দিকে তাকালেন রফিক সাহেব। দেখেন একটি রুহানী দরবার শরীফ ও দাওয়াখানা’র বিজনেস কার্ড। কার্ডটিতে বড় বড় হরফে লেখা আছে ‘চিশতিয়া রুহানীয়া হুজুরীয়ার ওপেন চ্যালেঞ্জ। সপ্তাহের সব দিন খোলা। চিঠির মাধ্যমেও দাওয়াই দেওয়া হয়। দেশে থাকুন আর বিদেশে থাকুন আমাদের ওপেন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন। বিফলে মূল্য ফেরত পাবেন। সফল হলে আশপাশের আরো দু’একজন রোগী পাঠাবেন ইনশাল্লা। আমরা অত্যন্ত যতেœর সাথে চিকিৎসা দিয়ে থাকি। যে যে রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়- প্রেমে ব্যর্থতা, ব্যবসায় উন্নতি হয়না, পার্টনারের সাথে মনোমালিণ্য, স্ত্রীর সাথে অমিল, স্ত্রী অন্যের পরকীয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে, স্বামীকে বস করতে চান (গাধা বানাতে চান), বিদেশ যাত্রায় বাধা, পাওনা টাকা নিয়ে টালবাহানা, রাজনীতিতে ব্যর্থতা, পুরাতন হাঁপানি, গ্যাষ্ট্রিক, আলসার, পড়াশুনায় অমনোযোগ। যেকোনো সমস্যার জন্য চলে আসুন।
কার্ডটি পড়ে রফিক সাহেব নিজের অজান্তেই হেসে ফেললেন। লোকে বলে সব সম্ভবের দেশ আমার সোনার বাংলাদেশ! তাইতো মনে হচ্ছে এদের কথায়! কী না পারে এরা? আমাদের এত সমস্যা! আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা হিমশিম খাচ্ছে। কর্মকর্তা কর্মচারীরা দিনরাত খেটে যাচ্ছে। সমাজ কর্মীরা বিভিন্ন ফরমুলায় সমাজকে বদলাতে চাইছেন। চিকিৎসকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন রোগ-শোক সারানোর জন্য। অথচ এদের যদি আমরা নিয়োগ করে আমাদের সমস্যাগুলো তাদের হাতে ধরিয়ে দেই তবে কত সহজেই তারা সমাধান করে দিতে পারতো!! এতে সময়ও বাঁচবে আবার অর্থও বাঁচবে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা, আমাদের বিশাল জনশক্তি অন্যকাজে সময় দিতে পারবে! রফিক সাহেব কথাগুলো ভাবে আর মনে মনে হাসে। আহ্ কী বিচিত্র এই দেশ!

॥ ০২ ॥
মহসিন সাহেব মেয়েকে নিয়ে মতিঝিল এসেছিলেন। থাকেন নারায়নগঞ্জে। মেয়ে একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেবেন। ইন্টারভিউ শেষে নারায়নগঞ্জের বাসে রওয়ানা দিয়েছেন বাসায় যাবেন বলে। বাসে বসে মেয়ের কাছ থেকে ইন্টারভিউ সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছেন।
বাস যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা মোড়ে ট্যাফিক সিগনালে থামার সাথে সাথে বাসের জানালা দিয়ে মেয়ের কোলে এসে পড়ল একটি রঙিন ফোল্ডিং লিফলেট। তাকাতেই দেখা গেল লিফলেটের উপরে একটি রঙিন ছবি যাতে এক যুবক এক যুবতিকে আলিঙ্গন করে আছে। তাকিয়ে বাবা ও মেয়ে দুজনই বিব্রত। লিফলেটটি একটি ইউনানি দাওয়াখানার।
এই লিফলেটেও একই ধরনের লেখা। যেখানে লেখা আছে- যৌন চিকিৎসাসহ সকল রোগের চিকিৎসা ১০০% নিশ্চয়তার সাথে করা হয়। হেপাটাইটিস এ-বি-সি-ডি থেকে জেড পর্যন্ত, ডায়াবটিস, ক্যান্সার, এইচআইভি-এইডসসহ সকল রোগ। তারা ছবি দেখেও রোগ নির্ণয় করে ঔষধ দিতে পারে। আবার বিদেশ থেকে নির্ধারিত ফি পাঠিয়ে দিলে তারা ডাকযোগে ঔষধ পাঠিয়ে দেয়। ভালো হওয়ার বিষয়ে কোনো চিন্তা করার প্রয়োজন নেই! ১০০% নিশ্চয়তাতো আছেই।
রফিক সাহেব বা মহসিন সাহেবের মতো বিব্রতকর অযাচিত বিড়ম্বনায় আমরা সকলেই পরি। এটা বর্তমানে একটি নগরের উৎপাতে পরিণত হয়েছে। নগরীর যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, মতিঝিল, গুলিস্থান, শাহবাগ, প্রেসক্লাব, ফার্মগেট, মহাখালীসহ অটো ট্র্যাফিক সিগন্যালের অথবা যে কোনো বাস স্টপেজের কথাই বলুন না কেন এ উৎপাত আপনাকে সহ্য করতেই হবে।
এক শ্রেণির ইউনানি দাওয়াখানা ও ঝারফুকদাতা ভ- হুজুরগন এসব বিজ্ঞাপন প্রচার করে সহজসরল মানুষকে আকৃষ্ট করে। এসব দাওয়াখানা ও দরবার শরীফগুলোতে সাধারণত যৌন রোগকেই প্রাধান্য দেওয়া হয় বেশি। এছাড়া সংসারে অমিল, প্রেমে ব্যর্থতা, বিদেশ যাত্রায় বাধা, শত্রুকে বধ করা, ক্যান্সার, গ্যাসট্রিক, আলসার, হেপাটাইটিস বিসহ সকল রোগের ব্যাপারে ১০০% নিশ্চয়তার সাথে কাজ করার প্রলোভন দেখায়।
এই প্রচার কার্ড বা লিফলেটগুলো বিলি করার কাজে এক শ্রেণির হত দরিদ্র মহিলা ও যুবকদের ব্যবহার করা হয়। সামান্য পারিশ্রমিক দিয়ে এদের কাজ করানো হয়। এই কাজে নিয়োজিত যুবক ও মহিলারা অনেক সময় পকেট মারার কাজেও ব্যস্ত থাকে।
আপনি বাসে উঠছেন, সুযোগ বুঝে দক্ষ হাতে পকেট থেকে কখন যে মানিব্যাগটা নিয়ে নিয়েছে আপনি তা টেরও পাবেন না। আবার জানালার পাশে মোবাইলে কথা বলছেন। হঠাৎ মোবাইল টান মেরে উধাও!! আপনি শত চেঁচামেচি করেও আর মোবাইল ফিরে পাবেন না। শশুরবাড়ি থেকে নতুন ঘড়ি উপহার পেয়েছেন! হাতে দিয়ে ঢাকায় এসেছেন। বাসে উঠে আনমনে বসে আছেন জানালার কাছে হাত দিয়ে। দেখবেন কেউ খুলে নিয়ে গেছে। ধরার কোনো সুযোগই পাবেন না। শুধু হাত থেকে মোবাইল বা ঘড়িই নয়, কান থেকে দুল কানসহ ছিঁড়ে নিয়ে দৌড় মারে এসব দৌড়বিদেরা!!!! আপাত দৃষ্টিতে দেখতে লিফলেট বিলিকারী মনে হলেও এরা সময়-সুযোগ মতো হয়ে যায় ছিনতাইকারী, পকেটমার।
এ বিষয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপরে গবেষণা করেন এমন কয়েক বন্ধুর সাথে আলাপ করলে তারা বলেন, এ সকল ভ- চিকিৎসক, ফকির, হুজুর, কবিরাজ আমাদের দেশের কোমলমতি মানুষের মনের স্পর্শকাতর বিষয়ে আঘাত করে তাদের উদ্দেশ্য সফল করে। অজ্ঞতার কারণে স্পর্শকাতর বিষয়ে কাউকে বলতে পারে না সাধারণ লোকজন। গোপন সমস্যা বা গোপন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকদের সাথে অনেকেই কথা বলতে চায়না এবং লজ্জা বোধ করেন। অনেক শিক্ষিত লোকও তার সমস্যা নিয়ে সবসময় যথাযথ বিশেষজ্ঞর সাথে আলাপ করেন না, লজ্জাবোধের কারণে। ফলে ঐসব ভুয়া লোকের চটকদার কথায় সাধারণ মানুষ পটে যায়।
চিকিৎসকরা বলেন, দেশের সাধারণ মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করার জন্য এসব চটকদার বিজ্ঞাপন বিলি করা হয়। অশিক্ষা ও অজ্ঞতার জন্য সাধারণ মানুষ এদের কাছে গিয়ে প্রতারিত হয় প্রতিনিয়ত। তারা যে ঔষধ দেয় তাতে কোনো রোগ ভালোতো হয়ই না বরং অনেক সময় বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নিজেদের সমস্যার কথা তো বলতেই পারে না আবার প্রতারিত হওয়ার কথাও বলতে পারে না। এসকল প্রতারকদের হাত থেকে দূরে থাকাই ভালো। শিক্ষাই পারে এ সকল প্রতারণার হাত থেকে আমাদের রক্ষা করতে। আর প্রশাসন একটু হস্তক্ষেপ করলেই বিব্রতকর এসব লিফলেট বিলিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে পারি, সাধারণ মানুষও প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে পারে।
ভাল ঋণ-মন্দ ঋণ ॥ ব্যাংকার ও আইনজীবীর দায়

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান পণ্য হলো ঋণ। আপনি, আমি বিশ্বাসের সাথে টাকা জমা রাখি ব্যাংকে বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে। আমাদের জমানো সেই আমানতের বিনিময়ে সুদ বা মুনাফা যে নামেই ডাকি না কেন পেয়ে থাকি। সেই সুদ বা মুনাফাটা দেওয়া হয় কোথা থেকে? আমাদের আমানতের টাকা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে। বিনিয়োগ থেকে আসা লভ্যাংশ বা সুদ বা মুনাফার একটা অংশ আমাদের দেওয়া হয়। আর বাকিটা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটায়। যেহেতু আমানতের টাকা বিনিয়োগ করে মানে ঋণ দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে ব্যাংক ঝুঁকি নেয়। এই ঝুঁকির প্রক্রিয়ায় কে কে জড়িত, কার কতটুকু দায় সেটাই বিবেচ্য বিষয়।
ঋণের সাথে জড়িত জামানত, জামানত হিসাবে সবচেয়ে ভালো বস্তু জমি, জমির সঠিকতা যাচাইয়ে দরকার আইন জানা লোক মানে আইনজীবী, আর সেই কাজটা করেন ব্যাংকের মনোনীত প্যানেল আইনজীবী বা আইন উপদেষ্টা। আমি যেহেতু একজন আইনজীবী, সাথে বিভিন্ন ব্যাংকের মনোনীত প্যানেল আইনজীবী বা আইন উপদেষ্টা, তাই ভালো ঋণ-মন্দ ঋণের বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু মতামত সকলের সাথে শেয়ার করতে চাই।
ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পণ্য ঋণ বা লোন। আর ঋণ বিক্রি অন্য সকল পণ্য বিক্রির মতো নয়। অন্য সকল পণ্য ক্রেতাকে দিতে বা গছিয়ে দিতে পারলেই বিক্রেতার দায়িত্ব অনেকাংশে শেষ। কিন্তু ঋণ এমন পণ্য যা বিক্রয়ের পরে বিক্রয়োত্তর সেবা-শুশ্রƒষা করতে হয়। ঋণ গ্রহীতা বা লোনের ক্রেতা ভালো থাকলে ঋণ ভালো। ঋণের ক্রেতা যদি ভাল না থাকে তবে ঋণ ভালো থাকবে না মন্দ ঋণে বা ক্লাসিফাইড লোন হয়ে যাবে।
একটি ঋণ বা লোন বিক্রয় করার পূর্বে ক্রেতা সম্পর্কে অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা সম্পর্কে ব্যাংকের ভালো ধারণা থাকতে হবে। ব্যাংক অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তি সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে একটা সুন্দর মধুর সম্পর্ক তৈরি করে। ঋণ নিতে আগ্রহী ব্যক্তির একটি হিসাব খুলে লেনদেন করতে বলা বা পূর্বের খোলা হিসাবের হিসাব বিবরণী (স্টেটমেন্ট) বা লেনদেন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা। আমার বন্ধু বিশিষ্ট ব্যাংকার মোঃ কামরুজ্জামান মিন্টু সবসময় বলতেন, একটি ভালো ঋণ হলো সুখী মানুষের জামার মতো। সারা রাজ্য ঘুরে যেমন সহজে সুখী মানুষের জামা মেলে না। তেমনি ভালো ঋণ গ্রহীতাও মেলা ভার। বন্ধু সবসময় বলতো, লেনদেন প্রতিবেদন দেখে ব্যাংক সন্তুষ্ট হলে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তির (৫ সি) (১) ঈযধৎধপঃবৎ, (২) ঈধঢ়রঃধষ, (৩) ঈড়হফরঃরড়হ, (৪) ঈড়ষষধঃবৎধষ ও (৫) ঈধঢ়ধপরঃু অর্থাৎ ১) চরিত্র, ২) মূলধন, ৩) অবস্থা, ৪) জামানত ও ৫) সক্ষমতা এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করা খুবই জরুরি। একটা মানুষ চরিত্রবান না হলে তার বাকি পাঁচটি গুণ থেকেও লাভ নেই। আর ঋণগ্রহীতার মূলধন কেমন আছে, তার বর্তমান অবস্থা কেমন, ঋণ গ্রহণ করে সে তা সুদাসলে ফেরত দিতে পারবে কিনা, তার জামানত কেমন, তার সক্ষমতা আছে কিনা এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা শেষে যদি মনে হয় ভালো হবে তবেই ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে জামানত হিসাবে বন্ধক রাখার জন্য মূল্যবান জমির কাগজপত্র সংগ্রহ করে ব্যাংক মনোনীত একজন প্যানেল আইনজীবীকে দেন। প্যানেল আইনজীবী কাগজপত্র ভালোভাবে দেখে চেইন ডকুমেন্টস (জেনোলজি) মিলিয়ে জমির মালিকানা স্বত্ব নির্ধারণ করে একটি আইনগত মতামত প্রস্তুত করে ব্যাংক বরাবর প্রেরণ করেন। এ পর্যায়ে আইনজীবী সাহেবের প্রাথমিক কাজ শেষ। এরপর ব্যাংক আইনজীবী সাহেবের দেওয়া মতামতের কাগজ নিয়ে নিজেরা এবং থার্ড পার্টি (কোনো সার্ভে প্রতিষ্ঠান) দিয়ে জমির মূল্যায়ন (ভ্যালুয়েশন) করেন। অনেক ব্যাংক একজন প্রকৌশলী দ্বারা মূল্যায়ন করে থাকেন। জমির মূল্য নির্ধারণ করে দুই ভাবে। একটি হলো জমির বাজার মূল্য ও জমির তাৎক্ষণিক বিক্রয় মূল্যমান (ফোর্স সেল ভ্যালু) নির্ধারণ করা। অর্থাৎ জমির স্বাভাবিক বাজার মূল্য কত এবং তৎক্ষণাৎ ভাবে বিক্রি করতে চাইলে কত টাকা বিক্রি করা যাবে তা নির্ধারণ করা। তক্ষণাৎ বিক্রয় মূল্যমান (ফোর্স সেল ভ্যালু) যা নির্ধারণ করা হয় তা থেকে অনেক কম অর্থাৎ নিরাপদ দূরত্বে থেকে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তিকে ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকেন।
গ্রাহক-এর নিকট থেকে সংগৃহীত কাগজপত্র ব্যাংক আইনজীবীর কাছে সরবরাহ করে, সেই সরবরাহকৃত কাগজপত্র পর্যালোচনা করেই একজন আইনজীবী তার আইনগত মতামত দিয়ে থাকেন। গ্রাহক যে কাগজপত্র সরবরাহ করল (যেমন-বিভিন্ন খতিয়ানের পর্চা, মূল দলিল, মূল দলিল না থাকলে সইমোহরকৃত দলিল, খাজনার দাখিলা, ডিসিআর এর কপি, নির্দায় সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, আয়কর সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ওয়ারিশ সনদ ইত্যাদি) সেই কাগজপত্র সঠিক আছে কিনা বা জাল কিনা তা যাচাই-বাছাই করার জন্য ব্যাংকের লোনস এন্ড এডভান্স এর অফিসার ভেটিং ও সার্চিং এর কাজ সম্পন্ন করে। ভেটিং ও সার্চিংয়ের কাজ ব্যাংক নিজেই তার অফিসার দিয়ে বা কোনো থার্ড পার্টি দিয়ে বা আইনজীবীর মাধ্যমে বা অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে করতে পারেন বা করেন। সার্চিংয়ের কাজটি করার জন্য জেলা রেকর্ড শাখা, জেলা রেজিষ্ট্রার অফিস, সাব-রেজিষ্ট্রার অফিস, সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস, স্থানীয় ভূমি অফিস, ইউনিয়ন বা পৌরসভা, আয়কর অফিস, নির্বাচন অফিসসহ সংশ্লিষ্ট অফিস সমূহে যোগাযোগ করে তল্লাশির মাধ্যমে নিজ চোখে দেখে মূল্যায়ন ও দলিলপত্রের সঠিকতা যাচাই করে থাকেন।
ব্যাংকে অনেকেই জাল টাকা নিয়ে আসেন, ব্যাংকাররা সেই জাল নোট অনেক সময় ধরতে পারেন না, দিন শেষে হয় টাকা বান্ডিলে ঢুকে গ্রাহকের কাছে চলে যায় আর ধরা পরলে জমা দিতে আসা ব্যক্তির কাঁধে বা পরে ধরা পরলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ঘাড়ে দায় চাপে। ঠিক তেমনি, দলিল সঠিক না জাল, মিউটেশন ঠিক আছে কী নাই, খতিয়ানের পর্চা সঠিক না টেম্পারিং করা, খাজনা দাখিলা, ডিসিআর কপি, নির্দায় সনদ, ওয়ারিশ সনদ ইত্যাদি ইত্যাদি কাগজপত্র যাচাই করার জন্য বেশিরভাগ সময়ই আইনজীবীর পক্ষে তহশিল অফিস, এসিল্যান্ড অফিস, জেলা রেজিষ্ট্রার অফিস বা সাব-রেজিষ্ট্রার অফিস, ইউনিয়ন বা পৌরসভা কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়না এবং যাওয়ার কথাও না।
একটা আইনগত মতামতের জন্য আইনজীবীকে ব্যাংক (লোন গ্রহীতার কাছ থেকে নিয়ে) দুইশত টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকে। এই সামান্য টাকার বিনিময়ে আইনজীবীকে পাঁচ থেকে দশ পাতার (ক্ষেত্র বিশেষ আরো বেশি) একটি আইনগত মতামত দিতে হয়। এই সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আইনগত মতামতের সাথে সার্চিং ও ভেটিং কেউ আশা করে না এবং কেউ দেয়ও না। সার্চিং ও ভেটিং-এর কাজ আইনগত মতামতের সাথে সংযুক্ত নয়। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
একটা ঋণের ক্ষেত্রে একজন গ্রাহক ব্যাংকে এলেন, কাগজপত্র দিলেন, আইনজীবী আইনগত মতামত দিয়ে দিলেন আর ব্যাংক গ্রাহককে শত কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দিল এমনটা নয়। ঋণ গ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তি ঐ ব্যাংকে হিসাব খোলেন, লেনদেন করেন, লেনদেনের মাধ্যমে তার বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ব্যাংক। তার নৈতিক চরিত্র, তার ব্যবহার, তার ব্যবসা, তার প্রয়োজন, তার লেনদেন তার ঋণ ধারণ ও পরিশোধের ক্ষমতা ইত্যাদি নানান বিষয় ব্যাংক পরীক্ষা করে তাকে ঋণ দেওয়ার কথা চিন্তা করে গ্রাহকের নিকট থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। দীর্ঘ লেনদেন করার পরেও যে ব্যাংকার প্রতারক গ্রাহককে চিনতে পারলো না সেই গ্রাহককে কয়েকটি কাগজ দিয়ে কীভাবে চিনবে আইনজীবী? একটি নকল দলিল তো আসল ষ্ট্যাম্পে তৈরি করে, একটা নকল মিউটেশন তো আসল সিল মোহর দিয়েই তৈরি করে। হাজার হাজার কর্মকর্তার স্বাক্ষর কি আইনজীবী সাহেবের চেনা? আর কাগজ জাল হোক আর আসল হোক উকিলের কাজ চেইন ডকুমেন্টস মিলিয়ে দেখা। কাগজের সঠিকতা প্রমাণ করবে যার উপর সার্চিং ও ভেটিং-এর দায়িত্ব সেই কর্মকর্তার বা ব্যক্তির।
এবার বলি ঋণ কীভাবে খারাপ হয় সে বিষয়ে আমার ধারনা। আমার সামান্য অভিজ্ঞতায় দেখেছি গ্রহীতাকে ঋণ দিয়ে অনেক ব্যাংক আর কোনো খবর রাখে না। ঋণ পাশ হওয়ার পর সেই ঋণ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে সে নিয়মিত লেনদেন করবে, কিন্তু অর্থঋণ মামলা করার সময় ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখেছি ঋণ পাশ হওয়ার পর চেকের এক পাতা খরচ করে পুরো টাকা তুলে নিয়ে আর কোনো যোগাযোগ করেনি এবং লেনদেনও করেনি। ঋণ দেওয়ার পর ঋণের কোনো পরিচর্যা করেনি। পরিচর্যা ছাড়া কোনো কিছু কি ভাল হয়? পরিচর্যা ছাড়া কি কোনো ভালো ফল পাওয়া যায়? পরিচর্যা ছাড়া বাগানে তো আগাছাই জন্মাবে তাই না? গ্রাহক কেন ব্যাংকে আসছে না, কেন লেনদেন করছে না, সেকি নিঃশেষ হয়ে গেছে? গেলে তাকে কীভাবে সহযোগীতা করে আবার দাঁড় করিয়ে টাকাটা আদায় করা যায়? সেই বিষয়ে ব্যাংকের অনেক দায়িত্ব আছে যা ব্যাংকারগণ করেন না। তারাতো অনেক ক্ষেত্রে ঋণ দিয়েই খালাস!!! ফলে ঋণ আর আদায় হয় না, ব্যাংকের গুনতে হয় শতকোটি টাকার লোকসান।
অনেকে ব্যাংকের সেই লোকসানের দায় দিতে চান আইনজীবীর উপর যে কিনা মাত্র দুইশত পঞ্চাশ টাকা থেকে তিন হাজার টাকার বিনিময়ে আইনগত মতামত দিয়েছেন। মাসে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে যে ব্যাংকারদের রাখা হয়েছে তদারকির জন্য তারা কি দায়ী নয় এই লোকসানের জন্য? কেন একজন বাজে লোককে ঋণ দেওয়া হলো? কেন ঋণ দেওয়ার পর তদারকি করা হলো না? ঋণের বন্ধকি দলিলে ও অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নী দলিলে তো লিখে নিলেন আইনজীবীর মাধ্যমে যে, যে কোনো সময় তদারকির জন্য ব্যাংককে তার ব্যবসা বাণিজ্য, গোডাউন, প্রকল্প পরিদর্শন করতে দিতে বাধ্য থাকিবেন। আইনজীবী শত টাকার পারিশ্রমিক নিয়ে শত কোটি টাকার দায় কীভাবে নেবে? আসলে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
আবার অনাদায়ী ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক অর্থঋণ আদালতে মামলার মাধ্যমে পদক্ষেপ নেয়। অনেকে মনে করেন, আইনজীবী মামলায় সময় নিয়ে ঘুরায় এবং সময় ক্ষেপণ করেন। আসলে কথাটা সত্যি নয়। আমি বেশ কিছু মামলা পরিচালনা করেছি এবং এখনও করছি। আমার যে ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তা থেকে বলছি, প্রত্যেক ব্যাংকই আইনজীবীকে ব্যাংকের নির্ধারিত সিডিউল দেখে বিল প্রদান করেন। একটা মামলার জন্য বিভিন্ন বিষয় মিলে একটা বিল হয়। উদাহরণ হিসাবে বলি, একটা মামলা পরিচালনার জন্য একশত টাকা বিল হলো। পঁচিশ টাকা মামলাটা দায়ের করার পর আইনজীবীকে দেওয়া হবে। এর পর চূড়ান্ত শুনানির আগে আরো পঁচিশ টাকা দিবে। বাকি পঞ্চাশ টাকা দিবে রায় পাওয়ার পর। এই মামলাটা যদি দশটা তারিখ ঘুরে নিষ্পত্তি হয় তাতে আইনজীবীকে ঐ একশত টাকাই দেবে দশটা টাকাও বেশি দেওয়া হবে না আর যদি একশতটা তারিখ ঘুরে মামলাটি নিষ্পত্তি হয় তাতেও দশটা টাকা বাড়াবে বা কমাবে না। টাইম পিটিশন বা হাজিরার জন্য কোনো ফি ধার্য নাই। মামলা দায়েরের সময়ই বিলের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়। দশ দিনে মামলা শেষ হলে ঐ একশত টাকা আবার দশ বছর ঘুরে নিস্পত্তি হলেও ঐ একশত টাকা। তাই মামলাটা ঘুরিয়ে আইনজীবীর কোনো লাভ নাই বরং লস, দ্রুত নিস্পত্তি করতে পারলে পকেটে অবশিষ্ট টাকাটা আসবে, নিস্পত্তি যত দেরিতে বিল তত দেরিতে। আর নিষ্পত্তি হলে বরং জারি মোকদ্দমার উদ্ভব হবে, আইনজীবী আবার নির্ধারিত ফি পাবে, নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জারি মোকদ্দমার উদ্ভব হবে না। এবার বুঝুন এখানে আইনজীবীর কি কোনো লাভ আছে? তাই অহেতুক দোষারোপ করে আইনজীবীকে হেয় করে কী লাভ?
আমি কিছু ব্যাংকের ঋণের বিষয় জানি। ব্যাংকিং ব্যবসায় প্রধান প্রোডাক্ট কী, সবাই জানে ঋণ বা লোন, যা আগেও আলোচনা করেছি। ব্যাংক লোন সেল করে। এক সময় কিছু ব্যাংকের লোন সেল করতো ব্যাংকটির একটি ব্রাঞ্চের সামনের কয়েকজন দোকানদার। কারো দুই লাখ টাকা ঋণ চাই, দোকানদার বলল, দুই লাখ নিবি কিরে! তোকে দশ লাখ তুলে দেই!! ব্যবসায়ী দুই লাখ খরচ করে দশ লাখ টাকা ব্যাংকের কাছ থেকে কিনে নিল!! সেই যে গেল আর ফিরে এলো না!! ব্যবসায়ীর কথা, কে টাকা ফেরত দেব? আমিতো লোন কিনছি? কিন্তু তার ঐ অনৈতিক কথা কি আইন শুনবে? পরবর্তীতে কী হলো, সেই বিক্রয়কৃত ঋণের গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে মামলা হলো। অতঃপর জমি বিক্রয় করে, জেল খেটে বিভিন্ন ভাবে ঋণ পরিশোধ করলো, আবারও সহযোগীতা করলো সেই আইনজীবী!!
আইনজীবীদের কাজের উপর মহামান্য হাইকোর্ট বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। আইনজীবীগণ যেহেতু প্রদত্ত কাগজের উপর মূল্যায়ন করেন তাই একজন আইন উপদেষ্টা তার আইনগত অভিমতের জন্য দায়ী নয়।
এ প্রসঙ্গে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হক এবং বিচারপতি মোঃ নুরুল ইসলাম কর্তৃক আব্দুস সামাদ বনাম রাষ্ট মামলার [ইখঈ (১৯৯৬) ঢ়ধমব ৬৩] জাজমেন্টে বলেছেন, “অ খবমধষ অফারংবৎ পধহহড়ঃ নব সধফব ষরধনষব ভড়ৎ ঃযব ড়ভভবহপব ড়ভ ভড়ৎমবৎু ধহফ পৎরসরহধষ নৎবধপয ড়ভ ঃৎঁংঃ ভড়ৎ মরারহম যরং ষবমধষ ড়ঢ়রহরড়হ.”
অনেক তো বললাম, এবার বাস্তবতায় আসি। বাস্তবকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারো নেই, আমারতো নেই-ই। বাস্তব ঘটনা হলো ভালো মন্দ সব জায়গায়ই আছে। ভালো ব্যাংকার যেমন আছে তেমনি ভালো আইনজীবীও আছে। খারাপ ব্যাংকার যেমন আছে তেমনি খারাপ আইনজীবীও আছে। ভালো ঋণগ্রহীতা যেমন আছে, তেমনি ঋণগ্রহীতা খারাপও আছে। সবাই সমান নয়, ভালো-মন্দ সবজায়গায়ই বিরাজমান। আইনগত মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে, বন্ধকনামা দলিল, অপ্রত্যাহারযোগ্য পাওয়ার অব অ্যাটর্নী দলিলসহ বিভিন্ন দলিল পত্র মুসাবিদা ও প্রস্তুতের ক্ষেত্রে আইনজীবীকে সততার তপ্ত কড়াইয়ের উপর বসে বরফ শীতল ঠান্ডা মাথায় যেমন কাজগুলো করা উচিত তেমনি ব্যাংকারদের উচিত সঠিক গ্রাহক বাছাই করা, গ্রাহককে যথাযথ পরিচর্যা করা, গ্রাহক কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্য, উপাত্ত, দলিল দস্তাবেজ ভালোভাবে যাচাই বাছাই করা এবং সত্যিকারের ব্যবসায়ী-গ্রাহককে ঋণ দিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও দেশের অর্থনীতিকে সবল রাখা।
আমার এই লেখা কোনো সাফাই গাওয়ার জন্য নয়। ব্যাংকার ও গ্রাহকদের মনে কষ্ট দেওয়ার জন্যও নয়। বাস্তবতার আলোকে আমার পর্যবেক্ষণ পাঠকের সাথে শেয়ার করলাম মাত্র। আমার লেখায় কেউ মনে কষ্ট পেলে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

কুকুর-বিড়াল-বৃদ্ধ-মহিলা-শিশু-গরু-গ-মূর্খ দেখলে সাবধান!

যারা গাড়ি চালান অর্থাৎ বাই সাইকেল থেকে শুরু করে ভারী যানবাহন (রেল গাড়ি ছাড়া!) তারা সবসময় কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকেন। নিজে তো সতর্ক থাকেনই শুভাকাঙ্খীদের, পরিচিত জনদেরও সর্বদা সতর্ক করেন। সবসময় বলেন, সাবধানে গাড়ি চালিও! যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে! সতর্ক দৃষ্টি রাখবা গাড়ি চালানোর সময়! রাস্তা দেখে শুনে চলবা! হঠাৎ কোনো কিছু সামনে চলে আসতে পারে বা পিছন থেকে ধাক্কা দিতে পারে তাই দেখে শুনে চলবা।
কুকুর, বিড়াল থেকে সাবধান! যে কোনো সময় গাড়ির সামনে কুকুর, বিড়াল চলে আসবে। কুকুর, বিড়ালের লোমের কারণে সহজে গাড়ির চাকা তাদের উপর দিয়ে উঠে না। আর যদি উঠে যায় তবে চাকা পিছলে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তাই সাবধান থাকা জরুরি। গরু, ছাগল কিন্তু আৎকা দৌড় মারে! গরু, ছাগল রাস্তায় চলার সময় ডান-বাম দেখে না। চিন্তাভাবনার ক্ষমতা যেহেতু তাদের নাই তাইতো তাদের বলদ বলে। সেই গরু, ছাগল দেখে শুনে চলবা। বুড়া মানুষ কিন্তু কানে কম শোনে! বৃদ্ধ মানুষ কানে কম শোনে। শারীরিক অক্ষমতার কারণে সে দ্রুত রাস্তা পারাপার হতে পারে না। চোখেও ঝাপসা দেখে। নানা সমস্যার কারণে বৃদ্ধ মানুষকে সম্মান দেখিয়ে সাবধানে গাড়ি চালাতে হবে। শিশুরা কিন্তু হঠাৎ দৌড় দেয়! শিশুরা তো কোমল। তাদের সাত-পাঁচ ভাবার সময় কই! রাস্তা-ঘাটে শিশুরা মনে যা চায় তাই করে। যে কোনো সময় অভিভাবকের হাত থেকে ছুটে দৌড় মারতে পারে। একা একাই রাস্তায় এসে পড়তে পারে। আর মহিলারাও রাস্তা পারাপারের সময় একটু বেখায়ালী হয়। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই পথ চলবা। পাগলের কিন্তু মাথা ঠিক নাই! পাগল তো পাগলই! পাগলের মাথা ঠিক থাকলে কি সে পাগল হতো? কথায় বলে না? ছাগলে কী না খায়, পাগলে কী না করে? তাই পাগল দেখলে সাবধান! পাগল যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কিছু করে বসতে পারে। তাই সাবধানে গাড়ি চালাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার অভিজ্ঞতায় নতুন একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে সেটা হচ্ছে গরু-ছাগলের মতোই একটা প্রাণি আছে তা হলো গ-মূর্খ। গ-মূর্খ হতেও সাবধান হতে হবে।
ঈদুল ফিতরের আগের রাতে আমি মটরসাইকেল চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছি। গাড়ি থেকে পড়ে দুই হাটু ছুলে গেছে। দুই হাতের বিভিন্ন স্থানে ছুলে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমার বাম চোখের কোনায়। বাম চোখের ভ্রুর উপরে এবং বাম চোখের কোনায় পিচ ঢালা রাস্তার ঘষায় ত্বক উঠে গেছে। মারাত্মক যন্ত্রণায় স্থানীয় কিছু বিবেকবান মানুষ আমাকে তুলে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালের জরুরী বিভাগের কর্মীরা আমার ক্ষত জায়গাগুলো ধুয়েমুছে ঔষধ লাগিয়ে দিয়েছে। বন্ধু ডাক্তার মাহবুবুল হক আমায় হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসে ঔষধ কিনে বাসায় পৌছে দেয়। আস্তে আস্তে শুরু হয় ব্যথা। চোখ ফুলে ঢোল! ফুলার চোটে চোখের সাটার বন্ধ হয়ে গেল! এক চোখ দিয়ে দেখার যে কী যন্ত্রণা তা অনুভব করলাম। দুই দিন লাগলো চোখের ফুলা কমতে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে এখন দুচোখেই দুনিয়া দেখি। ঘা এখনও শুকায়নি। ঘা শুকাতে অন্তত মাস খানেক লাগবে। ত্বক আগের অবস্থায় ফিরবে কিনা আমি জানি না। ত্বকের সৌন্দর্য ফেরা নিয়ে আমার তেমন কোনো দুশ্চিন্তাও নেই। এই কালো মুখের (পোড়া মুখের নয়!) কালো ত্বক আর নতুন করে কি সুন্দর হবে?
এবার আসি আমার দুর্ঘটনার কথায়। ঈদুল ফিতরের আগের রাত সাড়ে দশটার দিকে আমি আর আমার বন্ধু ডাক্তার মাহাবুবুল হক কোর্ট এলাকা থেকে চা সেবা করে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। ডাক্তারকে হাসপাতালের সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। চৌরঙ্গীর মোড় থেকে কিছুদূর আসার পর দূর থেকে দেখলাম ইটালী প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি ভ্যানে করে চটপটি-ফুচকা বিক্রি করছে। ফুচকাওয়ালার চারপাশে ছয়-সাতটি কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। আমি এগিয়ে আসছি আর দেখছি দৃশ্যটা। আমি যখন ফুচকাওয়ালার কাছাকাছি আসি ঠিক তখনই ফুচকাওয়ালা একটা লাঠি হাতে নিয়ে কুকুরগুলোকে কুকুরের মতো তাড়া দেয়! জ্ঞানশূন্য কুকুরগুলো ভয়ে দিগবিদিক ছোটে জীবনের ভয়ে। কথায় বলে না, মাইরেরে ভয় পায় পাগলেও! একটা সুঠামদেহী কুকুর দৌড়ে এসে আমার মোটরসাইকেলের সামনের চাকায় এসে ধাক্কা খায়! ব্যস! অমনি আমার গাড়ি বাম দিকে কাত হয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। আমি হলাম ভারী যানবাহনের মতো! মোটা মানুষ! তাই কিছুদূর ছেচড়ে গিয়ে অত:পর ঘর্ষণজনিত কারণে গতি থেমে যায়! ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেল। আমার বাম পা গাড়ির নিচে। দেহ জাগিয়ে সহযোগীতার জন্য অপেক্ষা করছি কারণ নিজে উঠার শক্তি পাচ্ছি না। বেকুব ফুচকাওয়ালা আমাকে টেনে তোলার জন্য এগিয়ে না এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে! আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম, বেটা তোল আমাকে। এরপর সে আমার কাছে এগিয়ে আসলো। ফুচকাওয়ালা আসতে আসতে আশপাশের দোকান থেকে দুর্ঘটনার শব্দ পেয়ে লোকজন ছুটে আসলো। আমাকে প্রথমে রাস্তা থেকে তুলে পাশের একটা দোকানের সিঁড়িতে বসালো। আমার গাড়িটা রাস্তা থেকে তুলে এনে দোকানের সামনে লক করে গাড়ির চাবিটা একজনের হেফাজতে রেখে আমাকে জানালো যে চাবি তাদের কাছে আছে। আমি কপালের বাম দিকে যন্ত্রণা অনুভব করে হাত দিয়ে ধরে দেখি হাত রক্তে লাল হয়ে গেছে। মাথাটা ডানে ঘুরলো না বামে ঘুরলো জানিনা, অনুভব করলাম মাথা ঘুরাচ্ছে! হাত গড়িয়ে এবং কপালের রক্ত কপাল বেয়ে পড়া দেখে দোকানদার ভাই এক মুঠো টিসু পেপার এনে দিলে আমি টিসু পেপারগুলো একসাথে চেপে ধরলাম কপালের ক্ষতস্থানে। চৌত্র মাসে মাঠের শুষ্ক মাটি যেমন পানি পেলে শুষে নেয়, মুহূর্তের মধ্যে টিসু পেপার ভিজে চপচপা হয়ে গেল। আমার উদ্ধারকারীরা রিকশা ডাকাডাকি করছে আমি শুনতে পাচ্ছি। এরই মাঝে একটা রিকশা পাওয়া গেল। উদ্ধারকারীদের একজন আমাকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে তার ভাগিনাকে ফোনে বলল একটু দোকানে গিয়া বয় আমি ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। রিকশায় বসে সে আমাকে ধরে রাখছে, এরই মধ্যে আমি আমার ফোন বের করে ডাক্তার বন্ধুকে ফোন দিলাম। বলে রাখা ভালো, আমার ডাক্তার বন্ধু দশবার ফোন দিলে একবার ধরে, মাঝে মাঝে ধরেও না! আমার ভাগ্য ভালো, ফোন দেওয়ার সাথেসাথেই ফোন রিসিভ করলো এবং আমি তাকে বিষয়টি জানালাম। ডাক্তার মাহবুব-এর বাড়ি হাসপাতালের পাশেই। সে দ্রুত হাসপাতালে আসলো। আমাকে রিকশা থেকে ধরে নামিয়ে রিকশার ভাড়া সেই পরিশোধ করে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে গেল। আমাকে ডাক্তার বন্ধুর কাছে দিয়ে সাথে আসা আগন্তুক বন্ধু চলে গেল। তার সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা নাই। ধন্যবাদ বন্ধু। ডাক্তার বন্ধু আমাকে জরুরী বিভাগের বেডে বসিয়ে দিয়ে লোক ডাকলো এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিল। জরুরী বিভাগে দায়িত্বরত ডাক্তার ছিল সুমন পোদ্দার। ঈদের কারণে সকল ডাক্তার ছুটিতে যাওয়ায় টানা তিন দিন তার উপরই জরুরী বিভাগের দায়িত্ব পড়েছে বলে সে কথার ফাঁকে জানালো। এরপর একে একে আমার রক্তাক্ত স্থানগুলো প্রথমে পরিষ্কার পানি দিয়ে মুছে দিল এবং পরে ক্ষতস্থানগুলোতে তরল ঔষধ লাগিয়ে দিল। ঔষধ এক এক স্থানে দেয় আর সেই স্থানে একেকটা কামড়ের মতো যন্ত্রণা অনুভূত হয়! ছোট হলে চিৎকার দিতাম কিন্তু বয়স বিবেচনায় চিৎকার দিতেও পারছি না, পাছে লোকে যদি হাসে। ডাক্তার সুমন পোদ্দার বন্ধু মাহবুবকে জিজ্ঞাস করলো, স্যার ব্যথানাশক ইনজেকশন দিয়ে দেব? কথাটা শুনে আমার মনে হলো, যদি দেয় তবে দুর্ঘটনার থেকেও বেশি আহত হবো! আমি তাদের কথপোকথন শুনে বললাম, ইনজেকশন নেব না, খাওয়ার ঔষধ যা লাগে দিতে পারো! শুনে দুজনেই হাসলো। বন্ধু মাহবুব সুমন পোদ্দারকে বলল, ইনজেকশনকে ভয় পায় এ কারণে আমি হাজার বার বলার পরেও আজ পর্যন্ত সে জন্ডিসের টিকা দিতে পারেনি, বলে দুজনেই হাসলো। বন্ধু মাহবুব আমায় জিজ্ঞাস করলো আর কোথাও ব্যথা অনুভব হচ্ছে কিনা, কেমন লাগছে, কোনো অস্বাভাবিকতা অনুভব হচ্ছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম একটু জ্বলে! একটু ব্যথাও করে। শুনে বন্ধু বলল, ওটা কিছু না, ঠিক হয়ে যাবে। কয়েকদিন সময় লাগবে। আমি বাড়িতে ফোন দিয়ে জানাতে যাব তখন বন্ধু বলল ফোন দেওয়ার দরকার নাই, তুই যথেষ্ট ভালো আছিস। ফোন দিলে সবাই চিন্তা করবে, শুধু শুধু ফোন দিয়ে তাদের চিন্তা বাড়িয়ে কী লাভ! ভাল আছি কথাটা শুনে একটু সাহস বাড়লো। ডাক্তার যেহেতু দেখে বলছে ভাল আছিস তাহলে আর খারাপ থাকি ক্যামনে!! পরে বেড থেকে নামিয়ে আমাকে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয় ঔষধ কিনল। এরপর একটা রিকশা ডেকে দুজনে গেলাম দুর্ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখি গাড়ি লক করাই আছে। রিকশা থেকে নেমে আমি গাড়ি চালু করে দেখি গাড়ির কোনো ক্ষতি হয়নি, চলছে। বন্ধু বলল, চালাতে পারবি? আমি বললাম, পারবো। বন্ধু রিকশাটা না ছেড়ে আমায় বলল, তুই আস্তে আস্তে চালিয়ে যা আমি রিকশা নিয়ে তোর পিছন পিছন আসি। আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে বন্ধু রিকশাটা নিয়ে চলে গেল, এই না হলো বন্ধু। এখানে বলে রাখা ভালো, আমার জীবনে দুর্ঘটনা জাতীয় সকল সময় এবং সকল অসুস্থ্যতার সময় আমার বন্ধু আমার পাশে থেকেছে একারণে তার প্রতি কৃতজ্ঞতাটাও আমার আকাশ সীমা পর্যন্ত।
নিজের কথাতো অনেক বললাম! এই ঘটনায় আমার অভিজ্ঞতার কথাটা এবার বলে শেষ করি। সবাই বলে কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল, পাগল, শিশু, বৃদ্ধ হতে সাবধান! আমি মনে করি, গরু, ছাগলের মতো গ-মূর্খ হতেও সাবধান থাকা দরকার। কারণ, ফুচকাওয়ালা কুকুরগুলোকে এমন সময় তাড়া না দিলেও পারতো! তার বিবেক বিবেচনা থাকলে বোঝা উচিত ছিল, তাড়া খেয়ে কুকুরগুলো ছুটে গিয়ে আমার মোটর সাইকেলে ধাক্কা খাবে, আমি যদি না থাকতাম, যদি একজন পথচারী থাকতো তবে কুকুরগুলো পথচারীর সাথে ধাক্কা খেয়ে তার পায়ে কামড় বসিয়ে দিতে পারতো। যদি বড় গাড়ি এসে পড়তো তবে কুকুর বড় গাড়ির চাকার নিচে গেলে চাকা পিছলে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে পারতো! তাই কুকুর তাড়া দেওয়ার সময় তার আশেপাশের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখা উচিত ছিল। এখন আমার কাছে কুকুরের বিবেচনা আর ফুচকাওয়ালার বিবেচনা একই মনে হলো। তাই গরুর সাথে গ-মূর্খ হতেও সাবধান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি! সমস্যা হলো দেখে তো আর গ-মূর্খ চেনা যায় না!
আমার মায়ের ডাক ও মুখ

মা… মা… মা…। পৃথিবীতে যত কিছু আছে মায়ের সাথে কোনো কিছুরই তুলনা করা যায় না। পৃথিবীতে যত কথা, যত শব্দ আছে মা শব্দের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো শব্দ খুঁজে পাইনি। এত মধুর, এত সুরেলা, এত মমতা মাখা, এত আবেগী একটা শব্দ যে মা ডাকাতেই তার স্বাদ পাওয়া যায়। অন্য কোনো ডাকে বা অন্য কোনো শব্দ উচ্চারণে এত প্রশান্তি লাভ করা সম্ভব নয়।
আমার মা নেই। বিগত ৩০ মার্চ ২০১২ তারিখে আমার মা আমাদের চির বিদায় দিয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেছে। কোনো সান্তনাই মায়ের অভাব পূরণ করতে পারেনি। কোনো ডাকেই মায়ের মমতা মাখা আবেগ পূর্ণ করতে পারেনি। কোনো কিছুতেই মন শান্ত হয় না, আজও শান্ত হয়নি, আর হবেও না জানি। কারণ মা তো আর ফিরে আসবে না। মায়ের কাছে শত আবদার করেছি ফেরায়নি কোনো আবদারই। কত অভিমান করেছি মা মনে রাখেনি। শত রাগের পরেও খাবার সময় ঠিকই রাগ ভেঙে ডাক দিয়েছে। বাড়িতে ফিরতে দেরি হলে খোঁজ নিয়েছে। মুখ ভারি দেখলে সান্তনা দিয়েছে। ভিতরে হিংসা দেখলে উপদেশ দিয়েছে। এমন উদার গর্ভধারিণী জননী ছাড়া আর কে হতে পারে? এমন নির্লোভ ভালোবাসা মা ছাড়া আর কে দিতে পারে? সবই উপলব্ধি করতে পারছি এখন যখন মা আর কাছে নেই। মায়ের জন্য কিছুই করতে পারিনি-অপরাধবোধ কাজ করে প্রতিনিয়ত। কিন্তু মার কোনোদিন কোনো চাওয়া ছিল না আমার কাছে। কোনোদিন কিছু চায়ওনি। আর মায়েরা কোনোদিন কিছু চায়ও না, শুধুই দেয়। দিতে দিতে নিঃশেষ হয়ে যায় তবুও দেওয়া ফুরায় না। মাকে আর কিই বা দিব, কিই বা দেওয়ার আছে আমাদের। মায়ের মুখের মধুর ডাক এখনও কানে বাজে। আমার মা আমাকে বাবা বলেই ডাকতো। কী মধুর সে ডাক। এখন আর ডাকে না কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনি বাজে কানে। এখনও সমাধির পাশ দিয়ে যাওয়া-আসার সময়, নীরবে-নিভৃতে থাকার সময়, একলা পথ চলার সময় শুনি সেই মধুর বাবা ডাক। আমার মা আমাকে এতটাই বাবা ডেকেছে যে মায়ের মৃত্যুতে আমার কাছে মনে হয়েছে আমি মা হারাইনি আমার আদরের সন্তান হারিয়েছি। মা হারিয়ে প্রথমে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি দেখে অনেকেই সান্তনা দিয়েছে। আস্তে আস্তে ডুকরে কাঁদা থেমে গেছে। এখনও কাঁদি। তবে নীরবে-নিভৃতে। বুকের ভিতর মা হারানোর ব্যথা যে কত কষ্টের তা পরিমাপের কোনো যন্ত্র নেই, প্রকাশের কোনো ভাষা নেই। এখন আর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে না। মুখ ফ্যাকাশে হয় না। কিন্তু বুকের ভিতর চিনচিন ব্যথা হয়, কথা জড়িয়ে যায়, অনুভব করি তখন গর্ভধারিণী মা আর নেই, আর আসবে না। সব ব্যথা ভুলে যাওয়া যায় না। আঘাতের ব্যথা সেরে যায়, বন্ধুদের দেওয়া কষ্ট মুছে যায়, মা হারানোর ব্যথা শত চেষ্টায়ও ভুলে থাকা যায় না। ভুলবই বা কী করে? মায়ের যে অবদান, মায়ের যে আত্মত্যাগ, মায়ের যে ভালোবাসা, মায়ের যে উদারতা, মায়ের যে মমতা তার সাথে তো কোনো কিছুরই তুলনা করা যায় না! তাই মা হারানোর ব্যথা কখনো যায় না, যাবেও না। এখন দুঃখ পেলে মায়ের দেওয়া সান্তনাগুলো কানে বাজে, এখনো কষ্ট পেলে মায়ের কথাগুলো মনে পরে, এখনও মনে হিংসা-ক্রোধ দানা বাঁধলে মায়ের উপদেশগুলো কানে বাজে, শান্ত হয়ে যাই, উদার হতে চেষ্টা করি। একজন মা এতটা উদার, মমতাময়ী কী করে হয় ভেবে পাই না। তাই মনে মনে ভাবি, মা ছিল, মা থাকবে। লোকচক্ষুর আড়ালে গেলেও মায়ের অস্তিত্ব টের পাই, দেখানো পথে হাঁটতে চেষ্টা করি। চিরদিন যেন মায়ের দেখানো পথে হাঁটতে পারি আল্লাহ্র কাছে সেটাই চাই। মায়ের দোয়াতেই তো আজকের আমি, আমার অবস্থান, আমার সবকিছু।
দেখতে দেখতে অনেকটা বছর কেটে গেল। আমিও বাবা হলাম আবার। গত ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ আমি বাবা হয়েছি। আল্লাহ্র কাছে আমি একটা মা’ই চেয়েছিলাম। মহান আল্লাহ্ আমার মনের কথা শুনেছেন। আমাকে একটা কন্যা সন্তান দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। আমার মায়ের বিদায়ে আমি কেঁদেছি। আবারও কাঁদলাম আমার নতুন মায়ের কান্নার শব্দে, নতুন মাকে কোলে নিয়ে। আমার কন্যার নামও রেখেছি মায়ের নামের সাথে মিল রেখে। আমার মায়ের নাম ছিল রওশনারা বেগম। আমার কন্যার নাম রওশন আসাদ প্রিয়ন্তী। প্রিয়ন্তী একটু একটু করে বড় হচ্ছে। সে আস্তে আস্তে বিভিন্ন শব্দ করতে শিখছে। বুঝে কোনো শব্দ করে না জানি। কিন্তু প্রিয়ন্তীর মুখে প্রথমেই সেই মায়ের ডাক। আমার মা আমাকে সবসময় বাবা বলেই ডাকতো। প্রিয়ন্তী মুখ দিয়ে আব্বু আব্বু শব্দ উচ্চারণ করে! সকল শিশুই শুরুতে দাদা, দাদি, বু শব্দ উচ্চারণ করে। আমার কন্যা স্পষ্টই আব্বু শব্দ উচ্চারণ করে! আমি অভিভূত হই, অবাক হই না। আল্লাহ আমার মাকে নিয়ে আবার আমাকে মা দিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের অভাব বোঝেন। তাই আমার কন্যা আমাকেই ডাকছে। কন্যার মুখে আব্বু শব্দ শুনে আমি মহান ¯্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার মায়ের গায়ের রং ছিল কালো কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জন্মেছিল। তার জ্ঞান গরিমায় তাকে মরহুম ফজলুর রহমান কোতোয়ালের মেয়ে না বলে অনেকে ছেলে বলতো!! আমার মায়ের গায়ের রং আমি পেয়েছি। আমার কন্যার গায়ের রং তার মায়ের মতো। কিন্তু প্রিয়ন্তী মুখের গড়ন পেয়েছে আমার মায়ের মতো। আমার মায়ের মুখ গোলাকার, সর্বদা হাসি মাখা। রাগলেও কখনো ধরা দিত না। শত কষ্ট, অভাব-অনটন আমার মায়ের মুখে ছাপ ফেলতে পারেনি। গোলাকার হাসিমাখা মায়ের সে মুখ আমি ভুলতে পারি না। সর্বদা আমার চোখের সামনে ভাসে। আমার মেয়ের গোলাকার হাসিমাখা মুখ দেখে আমি মায়ের মুখের সাথে মিলিয়ে ফেলি। প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকালে আমি আমার মায়ের কথা মনে করি। তাই প্রিয়ন্তীকে আমার নাম ধরে ডাকা হয়না। আমি মা বলেই ডাকি। আমি বাড়ি ফিরলে যেমন আমার মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে যেত। কন্যার মুখেও তেমনি আমি বাড়ি ফিরলে হাসি ঝরে পরে। আমার বাড়ি ফেরার পর সে ঘুমে থাকলেও জেগে ওঠে।
আমার মায়ের অনেক আচরণই আমি আমার কন্যার মধ্যে খুঁজে ফিরি। কিছু কিছু মিলে যায়। আমি দেখে আনন্দ পাই। আমি সবসময় বলি, আমার কন্যা যেন আমার মায়ের মতো বুদ্ধি পায়, মেধা, মননে যেন মায়ের মতো হয়। সে যেন আমার মায়ের মতো উদার, মমতাময়ী হয়। সে যেন সকলের প্রশংসা কুড়ায়। আমি আমার কন্যার ভিতর আমার মায়ের মুখ ও ডাক ফিরে পেয়েছি। সেই ডাক ও মুখ ফিরে পাই, কখনো বেশি পাই। কিন্তু মাকে ভুলতে পারি না, পারবোও না। ভাল থাকুক আমার নতুন মা, শান্তিতে থাকুক আমার মা………….।

সাগরে ভাসছে মানবতা ঃ কোথায় এখন মানবাধিকার?

সম্প্রতি সময়ে দেশে সবচেয়ে আলোচিত খবর অবৈধ ভাবে মানব পাচার। জীবিকার তাগিদে ছোট নৌকাযোগে উত্তাল সাগর পারি দিয়ে কর্মের সন্ধানে ছোটা মানুষগুলো পড়ছে বিপদে। অতঃপর গ্রেফতার, মৃত্যু, গণকবর! ভূখা নাঙ্গা হাড্ডিসার কিছু মানুষের প্রতিচ্ছবি বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এই ঘটনা যখন চরম অবস্থায় পৌঁছেছে তখন সরকারসহ বিশ্ব বিবেকের গায়ে সামান্য সুড়সুড়ি লাগছে। আসলে এমন কেন হচ্ছে?
আজ থেকে দশ-পনেরো বৎসর আগেও লোক মুখে শুনেছি, মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছি মানুষ ইটালী যাচ্ছে মাছের ফ্রিজিং গাড়িতে করে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌছাতে না পারলে মানুষ হিমায়িত অবস্থায় গিয়ে পৌছায়। হিমায়িত মাছের মূল্য আছে কিন্তু হিমায়িত মানুষের মূল্য নাই দুই পয়সাও! আবার দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে, বন-জঙ্গল পার হয়ে বরফের চাদরের উপর দিয়ে হেঁটে যায়, স্থানীয়ভাবে তাকে বলে ডাংকিমারি!! প্রকৃত শব্দটা কী হবে আমি নিজেও জানি না। ভুক্তভোগীদের জিজ্ঞেস করলে বলে ঐ এলাকায় বরফের খাল, নদী পায়ে হেঁটে পার হওয়াকে ডাংকিমারি বলে।
সেই সময়কার ডাংকিমারি করে যারা দেশে খালি হাতে শুধু জীবন নিয়ে ফিরে আসছে তাদের অনেকের সাথে আমার কথা হয়েছে পেশার কারণে। একসময় আমি সাংবাদিক ছিলাম। প্রথম আলো, কালেরকন্ঠ পত্রিকায় কাজ করেছি দীর্ঘদিন। পেশার কারণে মানুষের সাথে কথা বলেছি, মিশেছি, তাদের হৃদয় ভাঙার গল্প শুনেছি। এই ঘটনায় আমার পরিচিতজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবও ছিল। আমার এক বিয়াই এভাবে অবৈধ পথে ইটালী যাওয়ার চেষ্টা করে জীবন নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। দেশ থেকে পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে প্রথমেই পড়ে মাফিয়াদের হাতে। সেখানে মাফিয়ারা আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ দিয়ে আবার পাড়ি দেয়। বরফের নদী পার হয়ে যখন আলোর সন্ধান পাবে সেই মুহূর্তে গ্রেফতার। অতঃপর দেশে ফেরত।
আরেক পরিচিতজন এভাবেই দিন-রাত বরফের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে এক স্টেশনে পৌঁছার পর দেখে পায়ে আর জোর নেই। পা’টাই যেন বরফ হয়ে গেছে। আগুনে ছ্যাঁকার জন্য পা রাখে আগুনের উপর। আস্তে আস্তে পা একটু গরম হয় ঠিকই কিন্তু আগুনের তীব্রতা অনুভব করতে পারে না। অনুভবের সেই বোধ শক্তি হারিয়ে গেছে। পরবর্তীতে দেখা গেল তার পায়ে পচন ধরেছে। যতটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় পা গরম করা উচিত ছিল ততটা দ্রুত পা গরম করায় তার পায়ে পচন ধরে। পরবর্তীতে তাকে দেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হলো। চিকিৎসা শেষে তার দুই পায়ের অর্ধেকটা করে কেটে ফেলতে হলো। জীবন, জীবিকার টানে সুস্থ্য অবস্থায় বিদেশের পথে পাড়ি জমালেও পঙ্গু হয়ে গেল সে। এখন আর স্বাভাবিক অন্য দশজনের মতো হাঁটতে পারে না, পছন্দ মতো জুতা পড়তে পারে না। এভাবেই মানুষগুলো পণ্যের মতো বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে কেউ জীবন নিয়ে পালায় আবার কেউ জীবন দেয়। পিছনে ফেলে যায় অনেক স্মৃতি, পরিবার, ভালোবাসার মানুষগুলো আর একরাশ স্বপ্ন।
আমাদের সকলের মনে একটাই প্রশ্ন, কেন মানুষগুলো এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে? বন-জঙ্গল-বরফের উপর দিয়ে জীবনকে সংকটে ফেলছে? এর অনেক কারণ আছে যা বোদ্ধারা ভাল বলতে পারবেন। তবে আমার কাছে যে কারণগুলো মনে হয় তা আমি আপনাদের সাথে একটু শেয়ার করে নিতে পারি।
অশিক্ষাঃ যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র, বন-জঙ্গল পাড়ি দিচ্ছে তাদের বেশির ভাগ মানুষই অত্যন্ত অশিক্ষিত। অশিক্ষিত মানুষগুলো দেশে তেমন ভালো কোনো কাজ করতে পারে না। তাদের ধারণা দেশে যেহেতু কিছু করতে পারলাম না তাই বিদেশ গিয়ে নিজের ভাগ্যটা পরিবর্তন করে ফেলবো দ্রুত সময়ে। বিদেশে গিয়ে যে কোনো কাজই করবো কেউ দেখবে না। বিদেশের ঐ কাজই দেশে করলে একটু শরম লাগে!! তাই বিদেশে গিয়ে নিম্নমানের কাজই হোক আর উচ্চমানের কাজই হোক করে মোটা টাকা নিয়ে দেশে এসে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকব!!
অজ্ঞতাঃ অশিক্ষিত এই মানুষগুলো জ্ঞান-গরিমায়ও ছোট, কাজের অভিজ্ঞতাও কম, অনেকেই একদম অযোগ্য। বিদেশ-বিভূঁইয়ে কী করতে পারবো, কী করতে হবে, কীভাবে যাওয়া যায়, কোন পথ বৈধ কিছুই জানা নেই। আর অজ্ঞ-অনভিজ্ঞ এই মানুষগুলো বিদেশ পাড়ি দিয়ে বিপদে পরে নিজে, বিপদে ফেলে পরিবারকে, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেশ ও জাতিকে।
কাজের অভাবঃ দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে কাজের অভাব। এক্ষেত্রে সরকারের বিশাল গাফিলতি আছে নিঃসন্দেহে। সরকার উদ্যোগী হয়ে নাগরিকদের পর্যাপ্ত কাজের ক্ষেত্র, সুযোগ করে দিতে ব্যর্থ হওয়ায় মানুষগুলো পিপিলিকার মতো দল বেঁধে বিপদের মুখে ঝাঁপ দিচ্ছে।
উচ্চাভিলাষী মনঃ আমাদের দেশের সাধারণ মানুষগুলোর উচ্চাভিলাষী মন আজকের এই পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ী। দেশে কাজ করতে মন চায় না। দেশের কাজকে ছোট করে দেখে। একই কাজ ক্ষেত্রবিশেষ নিম্নমানের কাজ বিদেশে করতে মন্দ লাগে না। দেশে নিজের উদ্যোগে, নিজের মেধা খাটিয়ে, অল্প পুঁজি দিয়ে কাজ করতে উদ্যোগী হয়না এই মানুষগুলো। সবসময় চেয়ে থাকে উঁচুতলার মানুষের দিকে। তাকিয়ে তাকিয়ে মনের ভিতরে হিংসা পয়দা করে আর বলে আমারও এমন বাড়ি হতে হবে, আমারও এমন গাড়ি থাকতে হবে, আমিও দুহাত খুলে টাকা খরচ করবো! কিন্তু সবসময় যদি উপর দিকে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকাই তবে আজকের পরিস্থিতির মতো হোচট খাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো না। দ্রুত বড়লোক হওয়া যায় না। আস্তে আস্তে হলে সেটা মজবুত হয় এবং বেশিদিন টিকে থাকে। অন্যের অর্থবিত্তের দিকে না তাকিয়ে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী চলার মানসিকতা থাকলে কেউ বিপদে ঝাঁপ দিত না। তাই উচ্চাভিলাষী মনকে সংযত করতে হবে।
সরকারের ব্যর্থতাঃ সবচেয়ে বড় সমস্যা সরকারের উদাসীনতা ও ব্যর্থতা। সরকারের কাজ প্রতিটি নাগরিকের জীবন, জীবিকার খেয়াল রাখা। প্রতিটি নাগরিককে যথাযথভাবে শিক্ষিত করে, কর্মদক্ষ করে গড়ে তোলা। শিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের পর যার যার যোগ্যতা অনুযায় কাজের ব্যবস্থা করা। আমাদের সরকার কি সেটা নিশ্চিত করতে পেরেছে? আমাদের সরকার কখনোই সেটা করতে পারেনি। পারলে আজকের এ দৃশ্য দেখতে হতো না। লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার পড়ে আছে, কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। লাখ লাখ বেকার কর্মী পরে আছে কাজে লাগছে না। কাজের সুযোগ করে দিলে এভাবে কেউ বিপথগামী হতো না। সরকারের উদাসীনতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ঘুষ, দুর্নীতি এমন রূপ ধারণ করেছে যার কারণে রাতের আঁধারে, দিনের আলোয় মানুষ ছোট্ট নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিতে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তর থেকে অবৈধভাবে মানুষ বাইরে যাবে আর বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকবে এটা কী করে সম্ভব হয়? তা’হলে দেশে নিরাপত্তার জন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন পোষা হয়? দেশের ভিতর প্রতারক চক্র ঘুরে ঘুরে মুরগি কেনার মতো করে বোকা-অজ্ঞ মানুষগুলোকে কীভাবে বিদেশে পাচার করে? দালালরা কীভাবে পার পেয়ে যায়। দালালদের টাকার ভাগ কি প্রশাসনের লোকজন পায় না? না পেলে কেনই বা তাদের বাধা দেয় না? সাধারণ মানুষ তার শেষ সম্বল ভিটে-মাটি বিক্রি করে, স্থানীয় এনজিওর কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। প্রতারিত হয়ে কি শুধু অর্থ বিত্তই হারায়, হারায় তার স্বপ্নও। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে চোখে শরষে ফুল দেখে গৃহকত্রী। পিতা-ভাই হারিয়ে নিঃস্ব হয় সন্তান-স্বজন। সামান্য রোজগারের জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়ে কত মায়ের বুক খালি হলো, কত স্ত্রী স্বামীহারা হলো, কত সন্তান পিতাহারা হলো, গভীর সমুদ্রে মাছের খাবারে পরিণত হলো আপনজন।
ঝুঁকিপূর্ণ বিদেশ পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধুকি পুরুষই, নারী-শিশুরাও সামিল হয়েছে। নারীরা হয়ে যাচ্ছে ভোগের পণ্য। নির্যাতন স্বীকার করে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় ছুটে যাচ্ছে সমুদ্র পাড়ি দিতে। ভবিষ্যতের উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তেই। দালালের ক্ষপ্পরে পড়ে জিম্মি হয়ে দেশে কিছু থাকলে তা বিক্রি করে টাকা তুলে দিচ্ছে মাফিয়ার হাতে। সেই টাকাও যাচ্ছে অবৈধ পথে। দীর্ঘদিন যাবৎ এমনটা হচ্ছে সরকার কি কিছুই জানে না? আর কত না জানার ভান করে থাকবে সরকার। আর কত?
দেশে একজন মানুষ ক্রসফায়ার হলে বা অবহেলায় মৃত্যু হলে বা অপঘাতে মৃত্যু হলে আমরা জেগে উঠি। জেগে ওঠাই স্বাভাবিক। আমাদের সাথে বিশ্ব বিবেকও জেগে ওঠে। আজ হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, গণকবর আবিষ্কার হচ্ছে, সমুদ্রে অনাহারে থাকা মানুষগুলোকে তীরে ভিরতে দিচ্ছে না।
কেন এখন বিশ্ব বিবেক জেগে উঠছে না। কেন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হচ্ছে না? সাগরে ভাসমান মানুষগুলো হোক বাংলাদেশ বা মিয়ানমারের। তারাওতো মানুষ। বিশ্ব বিবেক কেন প্রচ- চাপ সৃষ্টি করছে না আজ। এক পৃষ্ঠা প্রেস রিলিজ বা একটু চোখ রাঙ্গানি দিয়েই কি তাদের দায়িত্ব শেষ? হাড্ডিসার কঙ্কালের মতো মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকালে বড় মায়া হয়। এই মানুষগুলো যেখানে যেতে চাইছিল সেখানে গিয়েও কোনো কাজ করতে পারবে বলে আমার মনে হয়না। আর এ মানুষগুলো দেশে এসেও কোনো কাজ করতে পারবে কিনা আমি জানি না। বেশিরভাগ অভিযাত্রীই যেখানে যাবে সেখানের বা ফেরত আসলে দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এই জনগণ আর জনশক্তি থাকবে না।
অসহায় মানুষগুলো দেখে বড় মায়া হয়। নিজের বিবেকের কাছে কেন যেন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কোথায় আজ মানবতা? মানুষ হিসাবে আমাদের কি এ ঘটনা চেয়ে চেয়ে দেখতেই হবে? কিছুই কি করার নেই? ঠুটো জগন্নাথরা কি বিবৃতি দিয়ে পেয়ালায় পেয়ালায় চিয়ার্স করবে? দালালরা কি বহাল তবিয়তেই তাদের কাজ চালিয়ে যাবে আর আমাদের রাষ্ট্রীয় জানোয়াররা কি দালালদের টাকায় শরীরের মেদ বাড়াবে?

নেতাভক্তির নমুনা!

আমাদের দেশে নেতার প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি দিন দিন যেন উঠেই যাচ্ছে! তবে সাধারণ মানুষের নেতার প্রতি ভক্তি উঠে গেলেও অসাধারণ মানুষের যেন নেতার প্রতি ভক্তির শেষ নেই। রাজনীতির মাঠে সাধারণ জনগণ নেতাকে যে দৃষ্টিতেই দেখুকনা কেন অসাধারণ জনগণ মানে এক শ্রেণির কর্মীর কাছে নেতারা পিতার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধাভাজন!
আমাদের দেশে নেতাকে কেউ গুরু বলে, কেউ ওস্তাত বা ওস্তাদ বলে, কেউ দাদা বলে আবার কেউ ভাই বলে, কেউ কেউ ভাইয়াও বলে, কেউ বস বলে, কেউ লিডার বলে, কেউ কেউ হুজুরও বলে থাকে। দেখা গেছে, বাপেও বলে দাদা আবার ছেলেও বলে দাদা। নাতি বড় হয়েছে, সেও বলে দাদা। দাদা যেন ঐ নেতার নাম হয়ে গেছে! কেউ কেউ একইভাবে ভাই বলে, কেউ কেউ একটু বেশি আদর করে বলে ভাইয়া! বাপে-পুতে একসাথে এমন ভক্তিভরে সম্বোধন অন্য কোনো সম্পর্কে দেখা যায় বলে মনে হয়না! নির্বোধ নেতাদের এমন পাম দেয় চতুর কর্মীরা যা নেতা বুঝতে পারেনা এবং নির্বোধ কর্মীদের এমন বাঁশ দেয় নেতারা যা কর্মীরা বুঝতে পারে না! সবই ঐ তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্ক!
নেতার পিছু একজন তথাকথিত কর্মী যে সময় ব্যয় করে তা নিজের কর্মের বা ধর্মের পিছনেও ব্যয় করে না। তাইতো এক নেতার মুখে বলতে শুনেছি যে, আমি আমার নেতার নাম যতবার জপেছি ততবার যদি মহান আল্লাহ্কে ডাকতাম তবে আজ আমি অনেক বড় অলিআল্লাহ্ হতাম। এই হলো সেই মহান নেতার বাণী। সেই নেতার পিছনেও দেখেছি শত শত কর্মী দিন-রাত ঘুরে বেড়াতো!
নেতা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন সে তার নেতার নাম জপে কোনো কিছুই হতে পারেনি। তারপরও তিনি যখন নেতার আসনে তখন তিনি একবারও তার কর্মীদের বলেননি যে, তোমরা আমার পিছু পিছু এভাবে ঘুরোনা, আমার নাম এত জপে লাভ নেই, আমার পেছনে এত সময় না দিয়ে নিজের কাজের পিছনে সময় দাও, আমার পিছনে সময় দেওয়া মানে নিজের পিছনে বাঁশ নেওয়া, আর নিজের পিছনে সময় দেওয়া মানে বাঁশ বেয়ে সাফল্যের চূড়ায় ওঠা!
ওকথা বলবেনা কোনোদিনও। কারণ তথাকথিত কর্মীদের বিমোহিত করে রাখে নেতারা নানান আশার বাবল ফুলিয়ে।
সম্প্রতি এক দৃশ্য নেতার প্রতি ভক্তির এক অপূর্ব নিদর্শন বলেই আমার কাছে মনে হয়েছে। একটি ভবনের টয়লেটে নিজে মূত্র বিসর্জন করে এসে বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়েছি মাত্র। হঠাৎ সুনামীর জলের মতো অথবা মৌচাকের মতো যেভাবেই বলেননা কেন, ঐ ভবনের বিভিন্ন দরজা দিয়ে মানুষ ঢুকছে। তাকিয়ে একটু অবাক হলাম। ভাবলাম বাইরে কি পুলিশ লাঠিচার্জ করছে? এভাবে মানুষ কেন দল বেঁধে এদিকে আসছে? সাথে সাথেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি এক নেতা ঢুকছে ঐ ভবনে। নেতা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ভীষণ বেগে-প্রবল আবেগে আমার পাশ কাটিয়ে ঢুকে গেল টয়লেটে। কিন্তু কর্মীদের পথ চলা থামছে না। একে অপরের উপর যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে! এরপর নেতার কাছের এক ভাই (দ্বিতীয় কাতারের নেতা) বলে উঠলো, এই তোরা থাম! ভাই প্র¯্রাব করবে! আরেকজন বলে উঠলো, দাঁড়া, দাঁড়া, …ভাই মোত্তে যায়! এবার কথাটা প্রতিধ্বনির মতো পিছনের দিকে যেতে শুরু করলো…ভাই মোত্তে যায়… ভাই মোত্তে যায়… ভাই মোত্তে যায়… ভাই মোত্তে যায়…।
এরপর কর্মীরা থেমে গেল। থামতে গিয়ে কেউ কেউ একে অপরের উপর ধাক্কাও খেল। কিছুক্ষণ পর ঐ নেতা টয়লেট থেকে বের হলো! সবাই করিডোরের দুই পাশে সাড়িবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল! নেতা এবার পূর্বের চেয়ে কিছুটা মন্থর গতিতে হেঁটে চললো। নেতার চোখে-মুখে ত্যাগের প্রশান্তির ছাপ! ভোগে নয়, ত্যাগেই শান্তি তা নেতার মুখের প্রশান্তির ছাপ বলে দিচ্ছে! নেতার পিছু নিল আবার কর্মীরা। কী নেতা ভক্তি! এই দেশে নেতাদের মুক্তি নাই! মোত্তেও যেতে পারবে না কর্মীদের ছাড়া!
পরে বিষয়টা বন্ধুদের জানালে কেউ কেউ মন্তব্য করলো ঘটনার চেয়েও মজার কথা! এক বন্ধু বলল, আমাদের দেশের কর্মীরা নেতাদের এতটাই ভালোবাসে যে, নেতার মূত্র বিসর্জনের সময় যদি নেতার মূত্র নল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো! প্রিয় নেতা মূত্র বিসর্জন করে যেমন শান্তি পেত তেমনি কর্মী স্বর্গীয় সুখ অনুভব করতো এবং নিজেকে ধন্য মনে করতো ঐ কর্মী। কিন্তু নেতা তো ওটা ধরতে দিতে পারে না, তাই না?

কেন এমন হয়! এই দেশেতে মৃত্যু ভাগ্য তাদের কেন নয়?

নিচে আমার প্রিয় লেখক ডি এল রায় বা দ্বিজেন্দ্র লাল রায়-এর একটা অতি পরিচিত কবিতা বলুন আর গানই বলুন তার একটি লাইন দিলাম। লেখাটার শেষে পুরো গানের কথাগুলো দিব বন্ধুদের পড়ার জন্য। নিচের কথাগুলো গানের সুরে না হোক একটু পড়ে দেখুন কী সুন্দর কথা। প্রতিটি শব্দ হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
‘‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’’
গানের এই লাইনটায় আমার কিছু কথা! ‘আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।’ আসলে সবার কপালে কি এই সৌভাগ্য হয়? এই দেশেতে জন্ম নেওয়ার ভাগ্য অনেকেরই হয়। প্রতি বছর জ্যামিতিক হারে বাড়ে মানুষ। তারা আর কিছু পাক বা না পাক সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা এই সোনার দেশে জন্ম নেওয়ার ভাগ্য যে পেয়েছে সেটা নিশ্চিত। কিন্তু এই দেশেতে মরার সুযোগ কি পায়? আমার দেশের অনেক বড়বড়, ছোটছোট, ছোট-বড় লোক এই দেশেতে জন্মে এই দেশেতে মরতে পারে না। আমার কথাটা বিশ্বাস না হলে একটু মিলিয়ে দেখুন। আমাদের দেশের অনেক লোক কখনো ভারতে গিয়ে, কখনো হংকংয়ে গিয়ে, কখনো সিঙ্গাপুর গিয়ে, কখনো থাইল্যান্ড গিয়ে, কেউ কেউ আমেরিকা-লন্ডন-সুইজারল্যান্ডসহ নানা দেশে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে!! দেশেই মারা যেতে পারতো। কিন্তু শেষ সময়ে চিকিৎসার ছুতোয় চলে যায় বিদেশে! সেখানে গিয়ে আর ফেরত আসেনা। পরে জোর করে লাশ নিয়ে আসা হয়! আমি মৃত্যু নিয়ে কোনো রসিকতা করছি না বা যারা বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান তাদের হেয় করছি না। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় তাদের ভাগ্য বিধাতা এই বঙ্গ মাতার কোলে শান্তিতে মরতে দিতে চায় না। তাই ছল-ছুতোয় দেশের বাইরে নিয়ে যায়। যদিও জোর-জবরদস্তি করে আবার দেশে আনা হয়। কিন্তু এই দেশেতে মরিবার সাধ মিটে না।
কেন এমন হয়?
আধুনিক ফতোয়াঃ আসলে এমনও তো হতে পারে! দেশের সাথে তারা এমন কিছু কাজ করেছে যার শাস্তি হিসাবে বিধাতা তাদের এদেশে মৃত্যুভাগ্য হরণ করেছেন। কোটি কোটি মানুষ এই দেশের ডাক্তার, এই দেশের কবিরাজ, এই দেশের ফকির, এই দেশের ঝাড়ফুক নিয়ে বাঁচার আশায় বুক বাঁধে। যারা আমাদেরকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, অন্ন, বস্ত্র, নিরাপত্তা দিবে তারা কি তা দেয় ঠিকমত? নিজের স্বাস্থ্যের চেকআপ করার জন্য দেশের বাইরে চলে যায়, নিজেদের আখের গোছাতে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা সৃষ্টি করে নিজের সন্তানকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেন। লাখো মানুষের বাসস্থান থাকুক বা না থাকুক, নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের তাদের থাকে একাধিক আলিশান বাড়ি, ফ্ল্যাট। আবার অনেকে দেশের গ-ি পেরিয়ে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সেকেন্ড হোমল্যান্ড হিসাবে বেছে নেয় বিদেশ, বিদেশে গড়ে স্বপ্নের বাড়ি। ছেঁড়া কাপড়ে লজ্জা ঢাকতে পারেনা হাজারো মা। যারা নিশ্চিত করবে তাদের ছেলে-মেয়ে-বউ দেশি কোনো পোষাকই গায়ে চড়াতে চায় না। প্রতিদিন হাজারো শিশু কাঁদে খিদের জালায়। তাদের মুখে অন্ন নিশ্চিত করার কথা যাদের তাদের বাবুটা কিছুই খেতে চায় না কিন্তু ফাষ্টফুডের দোকানে ঢুকলে হাজার হাজার টাকা বিল হয়, না খেয়ে সেই শুকিয়ে যাওয়া বার-পনেরো বছরের বাবুটার ওজন নব্বই থেকে একশত পাঁচ কেজি।
আমাদের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব থাকে যে নেতার কাছে, যে অফিসারের কাছে, যে ব্যবসায়ীর কাছে, যে শিক্ষকের কাছে, যে সমাজসেবকের কাছে সে তার দায়িত্ব পালন না করে দেশের সাথে বেঈমানি করেছে বলেই আমার মনে হয়, তাদের এই দেশে মৃত্যুভাগ্য হয় না! যারা আমাদের সাধারণ মানুষের ও দেশের হক নষ্ট করে। এই অপরাধ আমরা আপাত দৃষ্টিতে দেখিনা বা বুঝতে পারি না কিন্তু বিধাতা তো ঠিকই দেখেন! সৃষ্টিকর্তা তো এক মহান বিচারক, সে ঠিকই বিচার করে! ফলে দেশের মাটিতে তার আর মরা হয় না। মরার পর দেশে আসে। তাই আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়,
কেন এমন হয়! এই দেশেতে মৃত্যু ভাগ্য তাদের কেন নয়?
ধনধান্যে পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।।
পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখি কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ
ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।।

চোখের বালি…

করিম সাহেব সরকারী চাকুরী করেন। বাড়ি তার জেলা সদরের বাইরে। উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। এতে তার লাভ দুইটা। এক তিনি তার নিজের বাড়িতে থাকায় পরিবার পরিজনকে কাছ থেকে দেখভাল করেন, নিজের বাড়ি পরিচর্যা করেন, ফসল ফলান, সবজি ফলান, হাঁস-মুরগি পালন করেন, তাজা খাবার খান, গ্রামের ফুরফুরে কার্বনবিহীন পরিষ্কার অক্সিজেন সেবন করে সুস্থ্য থাকেন, আর দুই শহর এলাকায় থাকতে গেলে যে মোটা অঙ্কের বাড়ি ভাড়া লাগে তা বেঁচে যায়। স্বল্প বেতনের চাকুরী, উপরি কামাইয়ের দিকে নজর নেই। সৎ জীবনযাপনের চেষ্টা করেন। ভাড়া বাড়িতে থাকতে গেলে যে টাকা খরচ যেত তা দিয়েই তার গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত, দুপুরে আধপেটা খাবার খাওয়া, চা-নাস্তার খরচ করে অনেকটাই বেঁচে যায়। বেঁচে যাওয়া টাকায় তিনি এক প্রকার রাজার হালেই গ্রামের বাড়িতে সংসার চালান। করিম সাহেব একটি মোটরসাইকেল কিনে নিয়েছেন সাধ্যের মধ্যে দাম দিয়ে। সেই মোটরসাইকেলটি চালিয়েই প্রতিদিন যাতায়াত করেন। নিয়মের প্রতি করিম সাহেব খুব যতœবান। তিনি আইন মান্য করে চলতে চেষ্টা করেন সর্বদা। ড্রাইভিং লাইসেন্স করে নিয়েছেন। কখনো হেলমেট ছাড়া গাড়ি চালান না। গাড়িতে একটি রেইন কোট রেখে দেন সবসময়। প্রতিদিনের মতো তিনি বাড়ি থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। পথিমধ্যে তার সামনে পড়লো একটি নসিমন। নসিমনটি তার যোগ্যতার চেয়ে বেশি বালু ভরাট করে প্লেনের গতিতে ছুটছে। চৈত্র মাস, প্রচ- খরতাপ। শুষ্ক বালু বাতাসের তোড়ে উড়ছে সেদিকে নসিমন ড্রাইভারদের কোনো খেয়াল নেই। হেলমেট মাথায় দিলেও সব সময় সামনের গ্লাসটা নামিয়ে রাখতে ভালো লাগে না। এমনিতে প্রচ- গরম। হেলমেট মাথায় দিয়ে চোখের সামনের গ্লাসটা উপরের দিকে উঠিয়ে রেখেছে যাতে একটু বাতাস পায় সেই চিন্তায়। দ্রুত গতির নসিমন, কাউকে সাইড দিতে অভ্যস্ত নয় তারা। করিম সাহেবকেও তারা সাইড দিচ্ছে না, আর করিম সাহেবও অতটা দ্রুত মোটরবাইক চালাতে অভ্যস্ত না। তিনি নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থেকে সবসময় গাড়ি চালান। দ্রুত গতির নসিমনের পিছনে পিছনে চলছেন করিম সাহেব। হঠাৎ এক দমকা হাওয়া এসে লাগলো নসিমনের গায়ে। শুষ্ক বালু উড়ে এসে করিম সাহেবের দুচোখ ভরে গেল। করিম সাহেব দুচোখে শুধু অন্ধকার দেখছেন। কোন মতে গাড়ি থামিয়ে দিলেন রাস্তার ধারে। চোখ খুলতে পারছেন না করিম সাহেব। আস্তে আস্তে তিনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। তারপর পাশের বাড়িতে গিয়ে একটি টিউবয়েলের নিচে মুখ দিয়ে চোখে পানির ঝাটকা দিলেন। ভালোভাবে চোখ ধোয়ার পরেও চোখের ভিতর বালুর ক্ষুদ্র কণা রয়ে গেছে। ভালভাবে তাকাতে পারছেন না। তার চোখ আস্তে আস্তে লাল হয়ে গেল। বাসায় যাওয়ার পর রাতে দেখা গেল করিম সাহেবের চোখ ফুলে ঢোল। চোখ অতি সুক্ষè আবরণ দিয়ে তৈরি, সামান্য বালু কণায় টিসু কাটা ছেঁড়া হয়ে যায়। করিম সাহেবেরও তাই হলো।
আফসার সাহেব একজন সিনিয়র সিটিজেন। বিকাল হলে একটু হাঁটাহাঁটি করেন নিজেকে সচল রাখার জন্য। এমনিতে বয়স হয়েছে, তার উপর ডায়াবেটিকসের নানা উপসর্গ দেখা দিয়েছে। তাই প্রতিদিনের ন্যায় ফুটপাত দিয়ে হাঁটাহাঁটি করেন আফসার সাহেব। বিকেল বেলা হাঁটতে হাঁটতে প্রধান সড়কে আসার পর হঠাৎ একটা ইটের সুরকি ভর্তি ট্রাক তাকে পাস কাটিয়ে চলে গেল ঝড়ের গতিতে। বাতাসের কারণে গাড়িতে রাখা সুরকি থেকে লাল রংয়ের ধুলি ঝড় বয়ে চলেছে সেদিকে তাদের কোনো খেয়ালই নেই। আফসার সাহেবের চোখে মুখে এসে লাগলো ধুলি ঝড়ের একাংশ। পরিষ্কার চেহারার মানুষটা মুহূর্তের মধ্যে হলি খেলার নায়ক হয়ে গেলেন। সারাটা মুখ তার সুড়কির লাল ছাইয়ে ভরে গেল। চোখ মেলতে পারছেন না। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। হাত দিয়ে মুখটা ঝেড়ে লাল ধুলা পরিষ্কার করলেও ধুলার সাথে কিছু কণাও তার চোখে ঢুকে গেছে। চোখ ডলা দিলে তিনি অনুভব করছেন চোখের ভিতর বড় বড় সুরকি যেন ঘুরছে। রাস্তার পাশের এক চায়ের দোকানে গিয়ে মুখটা ধুয়ে নিলেন। মুখটা পরিষ্কার হলেও তার চোখে পৃথিবী এখন লাল পৃথিবী। চোখের ভিতর সুরকির লাল বালু কণা ঢুকে আছে। প্রচ- যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেকক্ষণ পানির ঝাপটা দেওয়ার পর একটু স্বাভাবিক হলেও চোখের ভিতর কুটকুট করছে, চুলকাচ্ছে। মনে হচ্ছে চোখের ভিতর কয়েকটা ইট ঢুকে আছে বের হচ্ছে না।
করিম সাহেব আর আফসার সাহেবের মতোই আরেক ভুক্তভোগী রহমান দম্পত্তি। রিকশা করে বেরিয়েছেন শপিং করতে। নতুন দম্পতি। হুড খোলা রিকশায় বাতাস খেতে খেতে আর গল্প করতে করতে সস্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছেন শপিংয়ে। ফুরফুরে মেজাজ। হঠাৎ পাশ দিয়ে বিশালাকার আজরাইলের মতো ট্রাক গর্জন করতে করতে চলে গেল। ট্রাকের উপর কালো কালো পাথরের টুকরো দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো ভাঙ্গা পাথরের টুকরো। বড় কোনো ভবন বা পিচ ঢালা রাস্তা তৈরিতে ব্যবহারের জন্য কোনো ঠিকাদার আমদানি করেছে। বাতাসে খোলা ট্রাক থেকে পাথরের গুঁড়া উড়ে উড়ে আসছে। চোখ-মুখ ঢাকার আগেই তাদের কর্ম সারা। দুজনেরই চোখে ঢুকে গেল ভাঙ্গা পাথরের গুঁড়া। রহমান দম্পতি অনুভব করলেন চোখের ভিতর পাথরের বোল্ডার। চোখ ডলতে ডলতে দুজনের চোখই লাল। যে কেউ দেখলেই ভাববে টাল হয়ে এসেছে শপিংয়ে।
উপরের গল্পগুলো বাস্তবতার আলোকে কাল্পনিক ঘটনা। আসলে এমনটা কেন হয়? আমাদের দেশে ময়লার উদাম গাড়ি রাজপথ দিয়ে সাঁই সাঁই করে ঘুরে বেড়ায়। পুতি গন্ধে নাগরিকরা নাক ঢাকে। যাদের সহ্য ক্ষমতা কম তারা রিকশা-গাড়িতে বসেই বমি করে। ফুটপাতের মানুষগুলো বসে পড়ে বমি করতে করতে। নসিমন, ট্রলি, ট্রাক উন্মুক্ত অবস্থায় ইট, বালু, সুড়কি পরিবহন করে। বাতাসে মানুষের চোখে-মুখে লাগে সেই বালু কণা। একটু ঢেকে নিলেই হয়। কিন্তু ঢেকে নেওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনা এসব পরিবহনের ড্রাইভাররা। তাদের শিক্ষার জোর কম, সামাজিক দায়বদ্ধতা কী সেটা তাদের জানার কথাও না। ড্রাইভার-শ্রমিকরা তারা তাদের যে দায়িত্বগুলো জানে না, সে দায়িত্বগুলো কি তারা কোনদিনই জানবে না? তাদের তো জানানো উচিত!। যারা মালের মালিক তাদেরও তো দায়িত্ব আছে। তার মাল পরিবহনে অন্যের যাতে ক্ষতি না হয় সেই বিষয়টা কি কখনো আমরা তাদের মনে করিয়ে দেই? আর প্রশাসনের কথা যদি বলি, তবে প্রশাসনের কি এ বিষয়ে কোন দায়িত্ব নেই? ক্ষতিকর পণ্য পরিবহনে সতর্কতামূলক কিছু দায়িত্ব থাকে। আমাদের রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ভাইয়েরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে কাজ করে। তারা কি কখনো কোন ট্রাক, নসিমন থামিয়ে বলে, যে তোমরা এভাবে পরিবহন করো না। একটা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে নাও, বা পলিথিন দিয়ে ঢেকে পরিবহন করো। অবৈধ অনেক পরিবহন চলাচল করে রাস্তায়। অবৈধ পরিবহনকে বৈধতা দেওয়া হয় আরেক অবৈধ উপায়ে। পরিবহনের সুবিধার জন্য যদি কিছু পরিবহনকে ছাড় দিয়েও থাকে তবে কিছুটা সামাজিক দায়িত্ববোধের শিক্ষা কি তাদের দেওয়া যায় না? রাস্তায় চলতে গিয়ে এভাবে ইট, বালু, সুরকির ধুলায় কেন নাকাল হতে হবে আমাদের। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কী দায়িত্ব রাস্তায়? শুধু কি অবৈধ গাড়ি ধরা, রাস্তার জানজট পরিস্কার রাখাই তাদের কাজ হবে? বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণ, সুশৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালানো, ক্ষতিকর পণ্য পরিবহনে সতর্কতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তারা যদি একটু নজরদারি বাড়াতো তবে রাস্তায় এমন ভোগান্তির শিকার হতে হতো না আমাদের।
আমারা যারা আমজনতা আমাদের পক্ষে এটা নিয়ন্ত্রণ বা তাদের ছবক শেখানো সম্ভব নয়। ট্রাফিক ভাইরা যদি এসব পরিবহন আটকে তাদের কিছু বিধি নিষেধ দিয়ে দেয় তবেই তারা কথা শুনবে। রাস্তায় বেরিয়ে আমরা কেউ চোখ ডলতে চাইনা, ধুলি কণার কারণে চোখের অপূরণীয় ক্ষতি করতে চাই না। ইট, বালু, সুরকি পরিবহণের সময় অবশ্যই ঢেকে নিয়ে পরিবহন করবে এটাই প্রত্যাশা করি পরিবহন শ্রমিক ভাইদের কাছে। আর প্রশাসনের কাছে প্রত্যাশা করি তারা এটা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন এবং করতে বাধ্য করবেন। তবেই ধুলিকণাবিহীন একটা সমাজে আমরা বসবাস করতে পারবো, যে সমাজে বসবাস করেন ঐ পরিবহন শ্রমিকরা, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী প্রশাসনের কর্তা-কর্মীরাও। নগরীর আরেক উৎপাত যত্র তত্র ইট, বালু, সুরকি, রড রাখা। সকলেই রাস্তার একটা অংশ জুড়ে এসব নির্মাণ সামগ্রী রাখতে অভ্যস্ত। এর ফলে রাস্তায় সবসময় ধুলা লেগেই থাকে। একটু বাতাসে বা দ্রুত গতিতে গাড়ি চললে চাকার ঘর্ষণে ধুলা উড়ে। রাস্তার উপর নির্মাণ সামগ্রী রেখে রাস্তা অপরিষ্কার করে এবং রাস্তাকে সংকুচিত করার কারণে যান চলাচল এবং পায়ে হাঁটা মানুষের ভোগান্তি লেগেই থাকে। এ থেকেও পরিত্রাণ প্রয়োজন। আর চোখের বালি পরিষ্কার করার দায়িত্ব যাদের তাদের একটু মনযোগ প্রয়োজন।

পাগল নিয়ে পাগলামি

অনেক দিন আগে একটা কথা শুনেছিলাম। শুদ্ধভাবে হয়তো বলতে পারবো না। তবে যতটুকু মনে পড়ে তা হলো এমন- ‘পাগল পাগল পাগলরে ভাই, পাগল সারা দেশটায়, পাগল ছাড়া ভালো মানুষ পাবে নাকো চেষ্টায়।’ অনেক দিন পরে হলেও আমার মনে হচ্ছে কথাটা সত্যিই ছিল। আমরা কোনো না কোনো কারণে কোনো না কোনো বয়সে পাগল ছিলাম, পাগল আছি, পাগল হবো।
তবে কিছু পাগল আছে তাদের পাগলামির সাথে আমার এ লেখার কোনো সম্পর্ক নেই। যারা মানসিক ভারসাম্যহীন তারা তো সত্যিকারের পাগল। তাদের জন্য আমার সমবেদনা আছে। মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের মানুষ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েও কেন মানসিক ভারসাম্যতা কেড়ে নিয়েছেন তা তিনি নিজেই ভালো জানেন। তবে আমার মনে হয়েছে মানুষ একেক বয়সে একেক রকম পাগল। এই পাগল মানেই মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ নয়। সম্পূর্ণ রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে, মানসিক ভারসাম্য থাকা স্বত্বেও যে ধরনের পাগলামি করে আমি সেসব পাগলের পাগলামি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
ছোট শিশু। কিছুই বুঝে না। কোলে, বিছানায় মল-মূত্র ত্যগ করে, বলতেও পারে না। খিদে লাগলেও বলতে পারে না। তবে কিছু না বুঝলেও খিদের জ্বালা বোঝে। কিছু বলতে না পারলেও খিদের কথা বলতে পারে তার নিজস্ব প্রকাশ ভঙ্গি দিয়ে। যখনই একটা শিশুর খিদে পায় তখনই সে কেঁদে উঠে। শিশুটি বুঝে না কানলে মায়ও দুধ দেয় না, তাই ক্ষুধা অনুভব করলেই কান্না শুরু করে। কান্না তখনই থামে যখন তার মুখে খাবার তুলে দেয়। শিশুর খাবার হলো দুধ। তাই মুখে দুধ দিলেই সে শান্ত হয়ে যায়। আসলে সে দুধের পাগল।
দুধের পাগল সন্তানটা যখন একটু বড় হয় তখন তাকে নিয়ে বাবা মায়ের কত চিন্তা। পড়াশুনা করাতে হবে, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে, বড় হয়ে জজ, ব্যারিস্টার হতে হবে। কোনো পিতা-মাতা অবশ্য ছোট থাকতে কখনো ভাবে না আমার সন্তান বড় হয়ে রাজনীতিবিদ হবে! তাই কোথায় ভর্তি করা যায়, কাকে টিউটর রাখলে রেজাল্ট ভালো হবে এ নিয়ে অভিভাবকের চিন্তার শেষ নেই। অবশেষে তাকে ভর্তি করা হলো স্কুলে। এতদিন ভালোই কেটেছিল জীবন। খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, দুষ্টুমি করেই সময় চলে গেছে। ক্লান্ত হয়ে পড়লেই ঘুম। এক স্বর্গীয় জীবন শিশুকাল, যদিও শিশুরা সেটা বোঝে না, বড় হওয়ার পর যেমনটা আমরা বুঝতে পারছি। শিশুটির পড়াশুনা শুরু করার পরই হলো বিপত্তি। একগাদা বইপত্রের পাহাড় পিঠে বয়ে নিয়ে স্কুলে যাওয়া, ক্লাস শেষে বাসায় এসে টিউটরের কাছে পড়া, সুযোগ পেলে একটু খেলা। এরপরে সন্ধ্যা হলেই পিতা-মাতার হাকডাক, পড়তে বসো! পড়তে বসলেই ঘুম আসে। হয়ে গেল ঘুমের পাগল।
শিক্ষা জীবন শেষ হলো। এবার কিছু করতে হবে। প্রবল ইচ্ছা সত্বেও পছন্দের কোনো কাজ করতে পারছে না। শিক্ষার জোর নেই, উদ্ভাবনী চিন্তা নেই সে কথা বলে না! তাই বলে বেড়ায়, মামুর জোর নেই, টাকার জোর নেই ইত্যাদি। মাথায় সবসময় চিন্তা কিছু একটা করতে হবে, কিছু একটা করতে হবে। যোগ্যতার ফাইলপত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কাজের সন্ধানে। এখন সে কাজের পাগল।
যেভাবেই হোক কাজ একটা জুটে গেছে। গৎবাঁধা জীবন এখন। চাকুরী হলে ঘড়ি ধরা সময়ের বাইরে যেতে পারবে না। শ্রম দিলে, নিয়োগকর্তার কড়া নজরদারি। নির্দিষ্ট কাজটা শেষ করতেই হবে। এখন আর কাজ ভালো লাগে না। মন চায় একটু ঘুরে বেরাতে, একটু এদিকওদিক উঁকিঝুকি দিতে। কিন্তু সে সুযোগ কই? এখন সে ফাঁকির পাগল। কখন কাজে ফাঁকি দেওয়া যায়, কখন মুক্ত হওয়া যায় সেই আশায় তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকে, সুযোগ খোঁজে। অবশেষে সে এখন কাজ ফাঁকির পাগল।
জীবনে বেঁচে থাকার নিয়ামক হলো খাবার। আমরা এক বেলা, দু’বেলা না খেয়ে থাকতে পারি। কখনো কখনো তিন বেলাও খাওয়া হয়না। খুব বীরত্ব দেখাই যে, না খেয়ে ছিলাম। কিন্তু এর চেয়ে বেশি অভুক্ত থাকলে জীবন যায় যায়। একজন অভুক্ত মানুষ তখন খাবার পাগল হয়ে যায়। তাই মানুষ কখনো কখনো খাবার পাগল। ক্ষুধার জ্বালায় তখন মানুষ কী না করে? যা পায় তাই খায়।
জীবন, জীবিকার সাথে আছে টাকার সম্পর্ক। মানুষ তার প্রয়োজন মিটাতে কোনো না কোনোভাবে টাকার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। টাকা ছাড়া জীবন চলে না। কথায় বলে, মহিলাদের বল তার স্বামী আর পুরুষের স্বামী টাকা। প্রতিটা মানুষ স্বপ্ন দেখে তার অনেক টাকা থাকবে। যার শত টাকা আছে সে ভাবে কবে হাজার টাকা হবে, যার হাজার টাকা আছে সে ভাবে কবে লাখ টাকা হবে আর যার লাখ টাকা আছে সে ভাবে কবে কোটি টাকা হবে। আর কোটিপতির কথা বলে লাভ নেই। সেও ভাবে, কবে কোটি কোটি টাকা হবে। যে করেই হোক টাকা রোজগার করতে হবে। আর এ চিন্তা থেকে মানুষ যে কোনো পথ মানাতে পারে। বৈধ-অবৈধ সকল পথই বেছে নেয়। সাদা হোক আর কালো হোক টাকাটাই চায়। এক পর্যায়ে মানুষ টাকার পাগলও হয়ে যায়। তবে অর্থ অনর্থের মূল কথাটা মনে রাখতে হবে। কিন্তু টাকার পাগল সে কথাটা বেমালুম ভুলে যায়।
শ্রমে-ঘামে, সুপথে-কুপথে টাকাতো অনেক হলো। টাকা যে মানুষকে শান্তি দিতে পারে না সেটাও বুঝা গেল। এখন একটু হাত খুলে খরচ করতে মন চায়। দান-খয়রাত দিয়ে, মানুষের পিছনে খরচ করে একটু যদি নাম ফুটানো যায়! টাকা খরচ করে অনেকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। কেউ কেউ টাকা দিয়ে লেখক ভাড়া করে লিখিয়ে নিজের নামে তা ছেপে নাম ফুটায়। আবার কেউ কেউ টাকা খরচ করে দানবীর হিসাবে পরিচিতি পেতে ব্যস্ত থাকে। আসলে টাকাওয়ালা এবার নামের পাগল হয়ে যায়। যেভাবেই হোক টাকার বিনিময়ে নাম কামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
নানান ধরনের মানুষ আছে আমাদের এই সমাজে। কেউ টাকার পাগল, কেউ কাজের পাগল, কেউ খাবার পাগল। এছাড়া কেউ কেউ আছে ভাবের পাগল। তার নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা থাকুক বা না থাকুক তবুও ভাব নেয়। পকেটে ফুটো কড়ি নেই তবুও ভাব নেয় সে ধনী মানুষ। মাথায় জ্ঞান নেই, ভাব নেয় সে খুব জ্ঞানী প-িত। ছ্যাবলা-বাচাল ব্যক্তি কিন্তু ভাব নিবে সে খুব ব্যক্তিত্ববান মানুষ। এগুলো আসলে ভাবের পাগল। তবে সত্যিকারের ভাবের পাগল আবার অন্য জিনিস। যেমন কেউ লালন ভক্ত, সে লালনের ভাব শিষ্য। সে লালনের ভাবের পাগল। এধরনের ভাবের পাগলের বিষয়ে আমার শ্রদ্ধা-ভক্তি আছে। তাদের বিষয়ে আমার কোন বিদ্বেষ নাই।
জন্মের পর বাবা মা চায়নি কিন্তু জীবনের বাকে এসে ইচ্ছে হয় নেতা-নেত্রী হবো। অমনি নাম লিখিয়ে ফেলি রাজনীতির খাতায়। কেউ কেউ নৈতিক দাবি আদায়ের লক্ষে কথা বলতে বলতে রাজনীতিতে নিজের অবস্থান করে নেয়, তাদের বিষয়ে আমার কথা নেই। তবে অনেকে টাকার জোরে বা বাহুর জোরে নেতা হয়, কেউবা উপরওয়ালার পা চেটে চেটে নেতা হয়ে যান। তবে যেভাবেই হন না কেন রাজনীতিকদের একটাই চাহিদা থাকে তাহলো গদির চাহিদা। যে করেই হোক, পদ-পজিশন ধরতে হবে, আর বড় নেতা-নেত্রীদের গদির দিকে। তাই নেতা-নেত্রীরা গদির পাগল হয়ে থাকেন।
শিক্ষা জীবন হোক আর সাধারণ জীবন একটা সময় মানুষ প্রেমিক হয়। কেউ বইয়ের প্রেমিক, কেউ সিনেমার প্রেমিক, আবার ঘরের বউ, টিভির প্রেমিক। প্রেমিক পুরুষ প্রেমিকার জন্য পাগল, প্রেমিকা প্রেমিক পুরুষের জন্য পাগল। কেউ প্রেমের জন্য এতটাই পাগল হয় শেষ পর্যন্ত টিকতে না পারলে বলে, একসাথে বাঁচতে যদি না পারি, চলো একসাথে মরতে তো পারবো! আবার যাদের মরার সাহসও নেই তারা চুল, দাড়ি রেখে দেবদাস হয়ে যায়, তাদের আমরা প্রেমের পাগলও বলি। অনেক ভালো ভালো বিষয় আছে যার প্রতি আসক্তির কারণে ঐ বিষয়ে পাগল বললেও সেসব পাগল মন্দ নয়।
পুত্র শুয়ে আছে পাশের রুমে। মাঝ রাতে ঠুক ঠাক শব্দে পিতা মাতার ঘুম ভেঙে যায়। পিতা-মাতা গিয়ে দেখে পোলা খাট কুপিয়ে কাটছে। জিজ্ঞেস করে, কিরে খাট কাটিস কেন? ছেলে উত্তর দেয়, এত বড় খাট লাগে নাকি। তাই কেটে ফেলছি। পিতা-মাতার বুঝতে বাকি থাকে না ছেলেকে বিয়ে করাতে হবে। জোয়ান পোলা বিয়ার পাগল! মেয়েরাও কম যায় না। তবে নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদের বিষয়ে কিছু বললাম না।
দেখতে কুৎসিত। গায়ের রং কালো। তবুও চেষ্টার কমতি নেই। বোটানিক এ্যারোমা থেকে শুরু করে ফেয়ার এন্ড লাভলী পর্যন্ত কী না ব্যবহার করেছে? কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সৃষ্টিকর্তা যে রূপ লাবণ্য দিয়ে পাঠিয়েছেন ঘষে মেজে তার চেয়ে ভালো হওয়া কখনোই সম্ভব হয় না জেনেও চেষ্টার ত্রুটি রাখে না। তারা আসলে রূপের পাগল। বাহ্যিক রূপটাকে প্রাধান্য দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায়। রূপের পাগল ছেলেদের থেকে মেয়েরা একটু বেশিই হয়ে থাকে।
অনেকের অনেক রকম নেশা আছে। কারো বই পড়ার নেশা, কারো স্কুল পালানো নেশা, কারো কাজের নেশা, কারো ঘুমের নেশা, কারো রাত জাগার নেশা, কারো মদের নেশা, কারো গাঁজার নেশা, কারো টাকার নেশা, কারো চুরির নেশা, কারো লুচ্চামির নেশা। তবে এখন নতুন এক নেশায় আসক্ত আমরা, সেটা হলো ফেসবুকের নেশা, মোবাইলের নেশা। গাঁজাখোরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে গাঁজার নেশা ধরে, তখন সে পাগলের মতো হয়ে যায়। নেশার জন্য চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে অবলীলায়। মদখোর মদের জন্য পাগল। সময় হলেই পাগলামি শুরু করে দেয়।
কেউ কেউ আছেন সংসারের পাগল। সবসময় সে তার সংসার নিয়ে ভাবেন। সংসার ছাড়া কিছু বোঝেন না। পরিবারের সবাইকে খুশি রাখতে তাদের প্রাণপণ চেষ্টা। তবে সংসারের পাগল ভালো পাগলই বলতে হয়। এই পাগলামিতে কারো কোনো ক্ষতি হয় না। একজন সংসার পাগল মানুষ পরিবারের সবাইকে আষ্টেপিষ্টে রাখতে পারেন।
অনেকেই আছে গান পছন্দ করে। গান শুনতে দূর-দূরান্তে চলে যায়। আমাদের দেশে শীতের দিনে পালা গানের আসর বসে। সারারাত গান চলে। শীতের দিনেই এই আয়োজনটা বেশি হয়। বিভিন্ন তরিকার পীর ফকির আছে যাদের আখড়ায় বাৎসরিক উরস উপলক্ষে গানের আসর বসায়। গ্রামের মাঠে প্রচ- শীত সহ্য করে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে আউশ ধানের নারার উপর বসে রাত ভর গান শোনে। কোথাও গানের আয়োজন হয়েছে শুনলেই পাগলের মতো ছুটে যায় গান শুনতে। এমন পাগলকে আমরা গানের পাগলই বলে থাকি।
কেউ কেউ আছে নাচের পাগল। অবশ্য অনেকে নাচের চেয়ে নাচাতে ভালোবাসে। আবার কেউ কেউ নাচতে ভালোবাসে। নাচাতে বা নাচতে যাই করুক না কেন তাদের নাচের পাগল বলা চলে।
একটু সময় পেলেই অনেকে বেড়িয়ে পড়ে। দেশে কিংবা বিদেশে সুযোগ পেলেই ঘুরতে চলে যায়। বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বারবার ঘুরতে যায়। এমন ভ্রমণ পিপাসুদের ভ্রমণ পাগল বলা যেতে পারে।
অনেকে ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি চালাতে পারে। বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানোর পরেও কোনো ক্লান্তি আসে না। গাড়ির আরোহীরা ক্লান্ত হয় কিন্তু চালক পাগল হয় না। এমন পাগলও আছে নেহায়েত কম নয়।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো। তবে অনেকেই আছে পীর-মুরশিদের পাগল। এমন পাগলের সংখ্যা আমাদের দেশে বেশি দেখা যায়। নানান নামে চতুর কিছু লোকজন আখড়া খুলে বসে। ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষগুলো তাদের টার্গেট। কিছু নীতিকথা শুনিয়ে এমনভাবে মগজ ধোলাই করে যে বাবা-মাকে ভাত দেয় না কিন্তু বছরের বিশেষ দিনে পীরের বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে বিবি বাচ্চাদের বছরে একদিন ভালো ভাবে গোস্ত খাওয়াতে পারে না। কিন্তু পীর বাবার জন্য টাকা জমিয়ে গরু কিনে নিয়ে যায় গাড়ি ভরে। বাবারাও কম চতুর না! আমি এমন এক পীর বাবাকে চিনি যে কিনা ওরসের তিন দিন আমিষ খায় না। গরু, ছাড়ল, হাঁস, মোরগ রাখার জন্য বাবার আলাদা আলাদা খোয়াড় আছে। সেই খোয়াড়ে প্রচুর পশু জমা পড়েছে। কিন্তু ওরসের তিন দিন পশু জবাই করে না। জানতে চাইলে বাবা বলেন, তিন দিন আমরা নিরামিষ খাই। পরে চিন্তা করে দেখলাম, তিন দিন নিরামিষ খাওয়ার কারণ কী। আসলে গরিব মুরিদরা পশু আনতে পারে না। তারা আনে নিজের ক্ষেতের ফসল, গাছের লাউ, কুমড়া, মুলা, গাজর, আলু, পিঁয়াজ। এগুলো হলো পচনশীল দ্রব্য। বেশি দিন রাখা যাবে না। তাই বুদ্ধি করে পচনশীল পণ্যগুলো তিন দিনের ওরসে চালিয়ে দেন। ওরস মাহফিল শেষে পশুগুলো বিক্রি করে ঢাকায় চলে যায় আরাম আয়েশ করতে।
অনেকে আছে স্মৃতির পাগল। তারা পুরাতন জিনিসপত্র ফেলতে চায় না। তাদের মায়া-মমতা বেশি। সব কিছুই আকড়ে ধরে রাখতে পছন্দ করে। তারা স্মৃতির পাগল। এধরনের পাগলা খারাপ না।
অনেকে আছে খেলাধুলার পাগল। আমি অবশ্য অন্য খেলার কথা বলছি না। জুয়া খেলার কথাই বলছি। জুয়া যারা খেলে তারা সর্বস্ব বাজি রেখে খেলতে পারে। শত চেষ্টায়ও জুয়ার পাগল ভালো করা যায় না। আজ পুলিশে ধরবে, ছাড়া পেয়ে কালই বসে পড়বে। সহায় সম্পদ বিক্রি করে হলেও জুয়া খেলবে এই পাগল। পয়সা না থাকলে জুয়ার কোটে আরেক জুয়াড়ির পাশে বসবে, পরামর্শ দিবে, তবুও বসতে হবে। এক মা তার ছেলেকে বলল, বাবা জুয়া খেলা ভালো না, আজ জিতলে কাল হারতে হয়। ছেলে বলল, মা, আমি তাহলে একদিন পর পর খেলবো! তবে আসল জুয়ার পাগলরা প্রতিদিনই বসতে পছন্দ করে।
অনেকে আছে খেলাধুলার পাগল। ছাত্র জীবনে সকাল-বিকাল নেই। সবসময়ই খেলার মাঠে থাকতে পছন্দ করে। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই খেলা আর খেলা। পত্রিকা পড়লে খেলার পাতা, টিভি দেখলে খেলার চ্যানেল। গায়ে দিবে পছন্দের খেলোয়ারের জার্সি। খেলতে খেলতে অনেকেই ভালো খেলোয়ার হয়ে যায়। আবার পড়া রেখে খেলতে খেলতে ভালো খেলোয়ার না হতে পেরে জীবনের বাঁকে হারিয়েও যায়।
কেউ কেউ আছে বউয়ের পাগল। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা অটুট থাক এটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু কেউ কেউ আছে বউয়ের প্রতি এতটাই আসক্ত যে পিতা-মাতা-ভাই-বোন, সংসারের সবাইকে ফেলে বউয়ের কথায় উঠে, বসে। বউ দিন বললে দিন, রাত বললে রাত। নিজের উপর নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমাদের দেশে বউ পাগলের অভাব নেই।
কেউ চুল বড় রাখতে পছন্দ করে, কেউ দাড়ি বড় রাখতে পছন্দ করে। অনেকে ধর্মীয় কারণে চুল দাড়ি বড় রাখে তাদের বিষয়টা আলাদা। কেউ নখ বড় রাখে। এটা মেয়েদের ক্ষেত্রেই বেশি ঘটে। চুল দাড়ি না কেটে, নখ বড় রেখে অনেক ভালো মানুষ, সুস্থ্য মস্তিষ্কের মানুষ পাগল পাগল ভাব নেয়।
পুরান পাগলে ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানি। কথাটা আমরা মাঝে মাঝেই বলে থাকি। সমাজে অনেক পাগল আছে যাদের আমরা পুরান পাগল হিসেবেই চিহ্নিত করি। যখন নতুন কোনো বিষয়ের নতুন কোনো পাগলের আবির্ভাব হয় তখনই বলে উঠি পুরান পাগল ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানি।
তবে সত্যিকারের পাগল হিসাবে আমরা যাদের চিহ্নিত করি তারা হলো মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ। কোনো কোনো মানুষের মুদ্রাদোষ কিংবা ছোটখাট পাগলামি থাকে। কোনো কোনো মানুষের চরিত্রের ব্যক্তিত্বে এমন কোনো ঘাটতি বা খুঁত ছিল, যার কারণে মানুষজন তাকে সিরিয়াসলি নেয় না। তখন ‘পাগলে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়’ বলে তার কথা উড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে মানসিক ভারসাম্যহীন পাগলের মধ্যে নানান রকম পাগল আছে। কেউ হার্মলেস পাগল, কেউ উদ্দাম পাগল, খিঁচুনি লাগা পাগল, মারধোর করা পাগল ইত্যাদি। তবে পাগল কথাটার মানে কী, আর পাগলামিই বা কী বস্তু? ওটা কি কোনো রোগ না বিকার? পাগলামি কি ভালো হয় এমন নানা প্রশ্ন আছে আমাদের মনে।
মেয়ে বা ছেলের জন্য বর-কনে খুঁজতে গিয়ে আগের আমলে লোকে খোঁজ করত, বংশে কোনো ‘সুইসাইড’ বা পাগল আছে কিনা। যেন পাগলামিটা বংশগত! যদি অভিনয় কিংবা গানের গলা বংশগত না হয়, তবে পাগলামিই বা বংশগত হতে যাবে কেন? আসলে একটা মানুষ তার পারিপার্শ্বিকের আর পাঁচটা মানুষের মতো ব্যবহার না করে, আচার-আচরণ না করে, একটু উদ্ভট ব্যবহার, আচার-আচরণ করছে। সেই উদ্ভট আচার-আচরণ বুঝতে গেলে তার ব্যক্তিগত ইতিহাস, আশা-আকাক্সক্ষা, আশাভঙ্গ ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হয়। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের বড় একটি অংশ মানসিক রোগীদের প্রতি এখনো সহানুভূতিশীল হয় না। তারা মানসিক রোগীদের ‘পাগল’ বলে অভিহিত করেন। মানসিক রোগীকে পাগল বলা সামাজিক অপরাধ হিসাবে গণ্য হওয়া উচিত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ২০১১ সালে একটা জরিপ হয়েছিল। তাতে দেখা গেছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের মধ্যে শতকরা ১৮.১ ভাগ এবং ১৮ বছরের উপরে যাদের বয়স তাদের মধ্যে ১৬.১ ভাগ কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগী। মোট জনসংখ্যার সাড়ে তিন কোটিরও বেশি মানসিক রোগী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, সারা বিশ্বের প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে একজন মানসিক অসুস্থতায় ভোগেন। তবে গুরুতর মানসিক রোগ যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে তা মোট জনসংখ্যার শতকরা ৭ ভাগ। আশার কথা হলো যে কোনো মানসিক রোগীই চিকিৎসা পেলে পুরোপুরি সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। কিন্তু আমি উপরে যে পাগলের কথা বলেছি তারা সাধারণত ভালো হয় কম।
মানসিক রোগের অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে চিকিৎসকদের মতে বাংলাদেশে যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হন, তাদের একটি অংশ আক্রান্ত হন বায়োলজিক্যাল এবং জেনেটিক কারণে। কিন্তু বড় একটি অংশ আক্রান্ত হন পারিবারিক এবং সামাজিক কারণে। নানা চাপ, দারিদ্র্য, সামাজিক এবং পারিবারিক অসঙ্গতি এর অন্যতম কারণ। বলাবাহুল্য, মানসিক রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঔষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং ও সঠিক সেবা যতœ জরুরী। সামাজিকভাবে মানসিক রোগীদের হেয় করে দেখা হয় এটা ঠিক নয়।
বাংলাদেশে সাড়ে তিন কোটির বেশি মানসিক রোগী আছে। দরিদ্রতা, পারিবারিক অশান্তি, কর্মসংস্থান ও ধর্মীয় শাসনের অভাবের মতো আরো বিষয়কে মনের অসুখ হওয়ার নানা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই বিশ্বের সবাই নাকি পাগল, কেউ কম আর কেউ বেশি। পারিবারিক সচেতনতার অভাবেই মানসিক রোগের শুরু। পরিবারে মা-বাবারা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে শিশুদের সামনে ঝগড়া বিবাদ করে। অহেতুক গালাগাল, দোষারোপ, দুর্ব্যবহার করে, যা শিশুদের ছোট মনে ছোট ছোট বিষন্নতার জন্ম দেয়, আর শিশুরা বড় হবার সাথে সাথে এই বিষন্নতা ধীরে ধীরে মানসিক চাপে পরিণত হয়। এই মানসিক চাপ কেউ সহ্য করতে পারে আর কেউ না পেরে হয়ে যায় রোগী।
তবে শেষ কথা হলো সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ যখন পাগলামি করে তাদের পাগল বলা ঠিক কী বেঠিক সেটা পাঠক নির্ধারণ করবে। কিন্তু প্রকৃতভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে পাগল না বলাই ভালো। প্রকৃত পাগলের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন, তাদের মানসিক সাহস দিন, ভালো আচরণ করুন। তারাও সমাজের কেউ। চাইলেও আমরা তাদের ফেলে দিতে পারবো না। তারা আমাদেরই সন্তান, ভাই, বোন, পিতা, মাতা, আত্মীয়।

আপা নিয়ে চাপাচাপি

কয়েকদিন যাবৎ আপা নিয়ে বেশ চাপাচাপি চলছে দেশে। এক সাংবাদিক ভাই এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আপা সম্বোধন করে কথা বলেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তাতে আতে ঘা লেগেছে। সে উত্তেজিত হয়ে গেছে এবং বলেই ফেলেছে, আপা বললেন কেন, আপনি ইউএনওর সাথে কী বলে কথা বলতে হয় জানেন না, স্যার অথবা ম্যাডাম বলবেন।
সাংবাদিক সাহেব তাকে আপা বলে কি খুব অপরাধ করে ফেলেছেন? আপা বলাটা কি তাকে যথাযথ সম্মান দেখানো হয় নি? উপজেলা নির্বাহী অফিসার কে বা কী? একজন মানুষ তার শিক্ষাজীবন শেষ করে একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে প্রশাসনের ক্যাডার হয়েছেন। সহকারী কমিশনার উপাধি নিয়ে কর্মজীবন শুরু করে আস্তে আস্তে এ দপ্তর, ও দপ্তর পার হয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হয়েছেন। পরে তার কর্মের বিভিন্ন ধাপে সে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে আসীন হয়েছেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অনেক ঘাত-প্রতিঘাত দেখেছেন। কাজের ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম মেনেছেন, অনেক অনিয়মও করেছেন। বাস্তবে আসলে তিনি কী? সাধারণ মানুষের কাছে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নয়। তিনি হয়তো একটু বড় মাপের কর্মচারী, পিয়ন হয়তো ছোট মাপের কর্মচারী। এর বাইরে তো কিছু না। দুজনেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী আর জনগণ প্রজাতন্ত্রের মালিক। প্রজাতন্ত্রের মালিক তাকে আপা বলেইতো অনেক সম্মান করে ফেলেছে, স্যার তো তারই বলা উচিত ছিল।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিজের মধ্যে একটা অহংকারবোধ লালন করছেন। তিনি বেতন পান প্রজাতন্ত্রের আমজনতার দেওয়া করের টাকায় সেটা তার খেয়াল ছিল না। তিনি আপা বলায় এতটা ক্ষেপে যাবেন সেটা ভাবা যায়? তিনি তো কারো না কারো সন্তান, কারো না কারো বোন। তাকে আপা বলায় এতটা অপমানিত হওয়ার কিছু ছিল না। তবুও তিনি অপমানিত বোধ করলেন। জোর করে কি সম্মান পাওয়া যায়? আপা মনে হচ্ছে জোর করে সম্মান আদায় করতে চান। কিন্তু সম্মান ভূমি কর বা কোনো ফি নয় যে আদায় করবেন। সম্মান আসে হৃদয়ের গহীন থেকে, কাজের মূল্যায়ন থেকে। এমন কী করে ফেলেছেন যে আপনাকে সম্মান করতেই হবে?
একজন উপজেলা নির্বাহীর কাজ কী? তার কাজ তো উপজেলার জনগণের কাছ থেকে স্যার-ম্যাডাম শোনা না। উপজেলার সাধারণ জনগণের প্রশাসনিক কার্যকলাপ সমাধান করা, অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করা, শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সিটিজেন চার্টার অনুযায় জনগণকে সেবা দেওয়া। আর কাজগুলো করবে জনগণের জন্য। সেই জনগণ কেউ এসে যদি মা বলে, কেউ যদি বোন বলে, কেউ আপা বলে তাতে ক্ষতি কী? একজন লোক কতটা আপন জেনে তাকে আপা বলেছে সেই দিকটা বিবেচনায় কি নেয়া উচিত ছিল না? কজন অফিসার সাধারণ মানুষের আপন হতে পারে! অনেক অফিসার আছেন যারা বদলি হলে মানুষ কাঁদে। যাওয়ার সময় মানুষের কান্নাটাই আসল প্রাপ্তি, ঘুষ-দুর্নীতির টাকাটা কোনো প্রাপ্তি নয়।
একজন সাংবাদিক তাকে আপা বলেছে, এতে তিনি অপমানিত বোধ করেছেন। সাংবাদিকের অবস্থান কী সেটা হয়তো তার জানা নেই। অবশ্য এখন সমাজে অপসাংবাদিকতার ছড়াছড়ি চলছে। কোথাও গেলেই সেখানকার মানসিক ভাবে দুর্বল, অপরাধপ্রবণ মানুষ, ঘুষখোর, সুবিধাবাদীদের কাছ থেকে তেলের টাকা চয়। হাত পেতে দেয়, চাটুকারী করে অনেক সাংবাদিক। ঘরে কন্যা আত্মহত্যা করেছে, পিতাকে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখায়, নিউজ করার কথা বলে টাকা হাতায় এমন সাংবাদিকও আছে যাদের আমরা হলুদ সাংবাদিক বলি। হলুদ সাংবাদিকদের প্রতি আমার ঘৃণা আছে। তবে নির্ভীক সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমারই নয় সবারই আছে, থাকবে। আর সেই নির্ভীক সাংবাদ কর্মীরা আছে বলেই সমাজটা টিকে আছে। তারা সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ কাজ করে যাচ্ছে।
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বীকৃত চারটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম। এ জন্য রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদ মাধ্যমকে বিবেচনা করা হয় গুরুত্বের সাথে।
গণমাধ্যম শক্তিশালী হলে রাষ্ট্রযন্ত্র সঠিকভাবে পরিচালিত হতে বাধ্য হয়। সংবাদ মাধ্যম জনগণের প্রত্যাশা, অর্জন, চাহিদা, জনমত সৃষ্টি ও সমাজের ভালোমন্দ তুলে ধরে। তাইতো সাংবাদ মাধ্যমকে সমাজের দর্পণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। গণমাধ্যমকে উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের প্রতিনিধিও বলা চলে। মানবজীবন ও সমাজ উন্নয়নের একমাত্র মাধ্যম হলো গণমাধ্যম। গণমাধ্যম দ্বারা সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন সাংবাদিক।
আর তৃণমূল পর্যায়ে একজন সংবাদকর্মীর চোখ থাকে সমাজের ঘটে যাওয়া ছোট থেকে বড়, ভালোমন্দ, সমস্যা-সম্ভাবনা সবকিছুতে। একজন ভালো সাংবাদিক নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে রাতদিন জীবনের সোনালি সময় ব্যয় করে গণমানুষের সমস্যা ও সম্ভাবনার খোঁজে কান পেতে থাকেন।
একজন নির্ভীক সংবাদকর্মী হলেন সমাজের নির্মাতা। সে গণমানুষের চাহিদা ও স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তার লেখনির মাধ্যমে। সংবাদকর্মীর লেখালিখি সরকারের নজরে আসে, অতঃপর সরকার সেই আশা, আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করে। একটি অবহেলিত জনপদের খরব লেখনির মাধ্যমে সভ্যতার উচ্চতায় নিতে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকার বিকল্প নেই। নিজের স্বার্থ না দেখে গণমানুষের জন্য নিঃস্বার্থে কাজ করাই একজন নির্ভীক সংবাদকর্মীর কাজ। গণমাধ্যম সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে। সুবিধাবঞ্চিত জনপদের নাগরিকদের অধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ মানুষে পরিণত করে। একমাত্র গণমাধ্যম পারে মানুষকে নতুন নতুন চিন্তা, ধারণা ও পদ্ধতি সম্পর্কে প্রতিনিয়ত তথ্য সরবরাহ করে উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে ভূমিকা রাখে।
আজকের যুগে গণমাধ্যম শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, লাইফ স্টাইল, রেসিপি, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, আইসিটি, চাষাবাদ, ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে নাগরিক জীবনের প্রয়োজনীয় সব চাহিদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে। নানা সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি সত্বেও গণমাধ্যম সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করছে। সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যমের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমরা সবাই জানি-যে দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন-শক্তিশালী সে দেশে গণতন্ত্র উন্নত এবং শক্তিশালী।
এ ছাড়াও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির স্বর্ণযুগে গণমাধ্যমের কল্যাণে এসিড সন্ত্রাস, ইভটিজিং, নারী ও শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, ভেজালের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিনিয়ত সচেতন করে যাচ্ছে গণমাধ্যম। আর এর মাধ্যমে দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে সমাজ দেহে যে বোধের জায়গা তৈরি হচ্ছে এর পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকাই প্রধান। গণমাধ্যম সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করে থাকে। গণমাধ্যম ছাড়া কোনোভাবেই সরকার ও জনগণের মধ্যে জনগণ আর সরকার কি করছে তা প্রকাশ পাওয়া সম্ভব না।
গণমাধ্যম সমাজের জন্য এত কিছু করে বলেই তাদের অবস্থানটা একটু ভিন্নধর্মী। সমাজ তাদের সমীহ করে ব্যক্তি হিসাবে নয় তাদের কাজের কারণে। রাজধানীতে যারা সংবাদকর্মী হিসাবে কাজ করে, বিশেষ করে সম্পাদক থেকে প্রতিবেদক সবাইকে সকল সেক্টরের কর্তাব্যক্তিরা সমীহ করে তাদের কাজের কারণে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মহিলা, বিরোধী দলীয় নেত্রী মহিলা। সংবাদকর্মীরা তাদের আপা সংম্বোধন করে কথা বললে তারা তো কিছু মনে করে না। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যেখানে তাদের ম্যাডাম ম্যাডাম বলে মুখে ফেনা তোলেন সেখানে সংবাদকর্মীরা আপা বলে কথা বলছে। তাদের যদি আতে ঘা না লাগে তাহলে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমন কী হয়ে গেছেন যে তাকে স্যার বা ম্যাডাম বলতে হবে।
একসময় আমাদের দেশ তথা গোটা ভারত বর্ষ ব্রিটিশদের শাসন কায়েম ছিল। তখন ব্রিটিশ কর্তাব্যক্তিদের সমীহ করে চলতে হতো। ইউর এক্সিল্যান্সি, ইউর এক্সিল্যান্সি বলে মুখে ফেনা তুলতে হতো। শাসনের নামে তারা আমাদের যে শোষণ করেছে তা আজও জাতি ভুলে নাই, হাজার বছর পার হলেও কোনো প্রজন্মই ভুলবে না। তাদের এ অঞ্চল থেকে বিতারিত করা হয়েছিল, সম্মানের সাথে যায়নি। কথাটা নিশ্চই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যারা তাদের অজানা নয়। বর্তমানেও যদি কেউ মনে করে তিনি বড় কর্মকর্তা, তাকে ইউর এক্সিল্যান্সি, ইউর এক্সিল্যান্সি করতে হবে তাহলে ভুল করবে। বর্তমান কর্তাব্যক্তিদের তো আর বিতারিত করার প্রয়োজন হবে না, কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে থাকতে পারবে না। তাদের জন্য বিপ্লবীদের প্রয়োজন নেই, জাগ্রত সংবাদকর্মীরাই যথেষ্ট।
একটি গল্প বলি। একদা এক রাষ্ট্রপতি এক সম্পাদককে বলেছিল রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের একটা স্তর তৈরি করতে। সম্পাদক মহোদয় রাষ্ট্রপতিকে প্রথম অবস্থানে রেখে বাকি পদের নাম অবস্থান অনুযায়ী লিখে রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি তালিকায় সম্পাদকের অবস্থান দেখতে না পেয়ে সম্পাদক মহোদয়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার অবস্থান কোথায় লিখেননি কেন? প্রশ্নের জবাবে সম্পাদক মহোদয় বলেছিলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আমার অবস্থান যদি লিখতে হয় তবে লিখতে হবে অনড়াব চৎবংরফবহঃ! তাই আমি আমার অবস্থানটা নিজ হাতে লিখিনি।
আমি সিনেমার ভক্ত। সুযোগ পেলেই সিনেমা দেখি। সিনেমার ম্যাডাম নিয়ে আরেকটা গল্প মনে পড়ে গেল। হঠাৎ বৃষ্টি চলচ্চিত্রটা হলে মুক্তি না পেয়ে টেলিভিশনে মুক্তি পায়। ছবিটা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেখানে অমল বোসের একটা চরিত্র ছিল। অমল বোসের মিষ্টির দোকান যার নাম ছিল ভোলার মিষ্টান্ন ভান্ডার! দোকানে একটা টেলিফোন সেট ছিল। আশেপাশের সকলের কল আসতো, অনেকে কল করতো। ভোলা বাবুর দোকানে মালামাল ছিল কম। তিনি তার টেলিফোন সেটটাকে পূজো দিয়ে বেচাকেনা শুরু করতেন। একদিন একজন এসে তাকে ভোলাদা বলে ডাক দেয়ায় তিনি বেশ অপমানিত বোধ করেছিলেন। তখন ভোলা বাবু বলেছিলেন, আমাকে স্যের অথবা মেডাম বলতে পারিস না! ভোলা বাবুরও ইচ্ছে হয় স্যার অথবা মেডম ডাক শোনার। কিন্তু ইচ্ছে হলেই কি এমন মধুর ডাক শোনা যায়?
দাদুর নির্বাচনি গল্প

দাদুর কাছে নাতি-নাতনিদের আবদার খুব একটা বেশি নয়। আগে গ্রাম-গঞ্জে দুই মাথা বাঁকা অনেকটা ইংরেজি এস অক্ষরের মতো দেখতে বিস্কুট পাওয়া যেত যার নাম ছিল কুকিজ। তখনকার দিনে ছোট দোকানগুলোতে বয়ামে ভরে চানাচুর, নাবিস্কোর লজেন্স, সুপার বিস্কুট, বাতাশা বিক্রি করতো। নাতি নাতনিদের আবদারের মধ্যে দাদুর কাছে ঐ কুকিজ, চানাচুর বা লজেন্সই ছিল। আর ছিল গল্প যাকে গ্রামে কিচ্ছা বলে তা শোনার আবদার।
একদিন দাদুকে নাতি-নাতনিরা জোর ধরা ধরেছে, দাদু কিচ্ছা শুনবো, কিচ্ছা বলো।
দাদুও নাতি-নাতনিদের প্রচ- ভালোবাসে। ওদের আবদার ফেলার ইচ্ছা তার কখনোই মনে আসেনি। আজও ফেলবে না চিন্তা করে শুরু করলেন-
-তবে শোন, সে অনেক কাল আগের কথা। তোমাদের বাবারা ছিল তখন অনেক ছোট। তখন আমাদের হাটে একটা সমিতি ছিল।
ছোটদের সৎগুণ আর বদগুণ যা-ই বলিনা কেন একটা গুণ আছে সেটা হলো প্রশ্ন করার গুণ। অমনি প্রশ্ন শুরু হয়ে গেল। একজন বলল-
-দাদু কোন হাটে?
দাদুরও ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে বেশ ভালোই লাগে। এতে একটা সুবিধা হলো কিচ্ছাটা দীর্ঘায়িত করা যায় এবং বেশি সময় ওদের ব্যস্ত রাখা যায়।
ওদের প্রশ্নের উত্তরে দাদু তখন বললেন-
-আমাদের গ্রামের পাশে একটা খাল আছে না?
অমনি প্রশ্ন শুরু হলো-
-কোন খাল দাদু?
-আরে ঐ যে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ডান দিকে যে সরু নদীটা আছে না? ঐ রাস্তা ধরে কিছুদূর গেলে একটা ছোট্ট সাঁকো পার হই না আমরা? সরু নদী থেকে একটা চিকন খাল বাম দিকে বেরিয়ে গেছে যার উপর সাঁকোটা। ঐ সরু খাল যাকে দামরার খাল বলে। ঐ খাল পার হয়ে কিছুদূর গেলেইতো হাট। কতবার নিয়ে গেছি তোদের মনে নাই?
নাতি-নাতনিদের উত্তর-
-হ্যাঁ দাদু মনে পরেছে, মনে পরেছে। ঐ হাটে হারান দাদুর দোকান থেকে খাজুর আর রসগোল্লা কিনে দাও আমাদের ঐ হাট না?
দাদু বলল,
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঐ হাটই। ঐ হাটে একটা সমিতি আছে। সমিতির নাম।
-নাম বলা লাগবে না দাদু, পরে কী তা বলো।
-পরে ঐ সমিতি চালাতে হলে কমিটি গঠন করতে হয়। আর কমিটি গঠন করতে হলে সমিতির সদস্যদের ভোটে কমিটি নির্বাচিত হয়। সমিতির নির্বাচন হয় তিন বছর পরপর। তো, ঐ সমিতির একজন সদস্য আছে যে কিনা প্রতি নির্বাচনেই সম্পাদক পদে নির্বাচন করতো আর ফেল করতো।
-তার নাম কী দাদু?
-বলছি, দাঁড়া। তো একবার হলো কী, সবাই দয়াপরবশ হয়ে তাকে সাপোর্ট দিল। কিন্তু বাদ সাধলো অন্য এক প্রার্থী, তার মনোনয়ন উঠাইলো না। মনোনয়ন বোঝো তো? মনোনয়ন হলো নির্বাচনে দাঁড়াতে হলে একটা ফরম আছে তা ফিলাপ করে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা লোক যাদের নির্বাচন কমিশনার বলে, তাদের কাছে জমা দিতে হয়। যদি কোনো পদে একাধিক প্রার্থী না থাকে তাহলে ঐ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়ে যায় আর যদি মনোনয়ন না উঠায় তাহলে ঐ পদে ভোট গ্রহণ ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
-দাদু, মনোনয়ন না উঠালে সমস্যা কী? ভোট হলেই বা সমস্যা কী? আর বারবার নির্বাচনে দাঁড়ানোর লোকটার নাম বললা নাতো দাদু?
-সমস্যা আছে, সবাই যাকে দাঁড় করিয়েছে সেই প্রার্থী ছিল মাথাফুলা। তার নাম ছিল জহরি লাল কুন্ডু। মাথাফুলা বোঝো? একটু আবাল কিসিমের আরকি। আমাদের গাবুর মোকলেছ আছে না? ওর মতো মাথাফুলা। সবাই তাকে মাথাফুলা জহরি বলে ডাকতো।
-পরে কী হলো দাদু?
-আর কী হবে? গোপনে ভোটাভুটি হলে জহরি লাল কুন্ডু যে পাশ করবে না তা সবাই বুঝে গেছে। জহরি লাল কুন্ডুর হাটুর বয়সী প্রার্থীর সাথে প্রতিদ্বন্দিতা করেও চিন্তায় সবার মাথার ঘাম পায়ে পড়া শুরু হয়ে গেছে। তাই উপায়ন্ত না দেখে গায়ের জোরে সেই মাথাফুলারে প্রকাশ্যে ভোট দিয়া পাশ করান লাগছে।
-তারপর দাদু।
-তারপর আবার একবার নির্বাচনে সেই মাথাফুলায় দাঁড়াইছে।
-সেইবারওকি প্রকাশ্যে ভোট দেওয়া লাগছে দাদু?
-না, সেইবার প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী ছিল বেশ জনপ্রিয় প্রার্থী। সারা মাস জহরি লাল ভোটারদের সাথে কথা বলে আর গুনে দেখে সে বিশাল ব্যবধানে পাশ করবে। কিন্তু ভোটের দিন ভোট গণনার পর দেখা গেল সেই প্রার্থীর সাথে মাথাফুলায় হেরে গেছে। পরেরবারও যখন ভোট এলো আবার দাঁড়ালো। আবারও মাথাফুলা জহরি ফেল করলো!
-বলো কী দাদু? বারবার ফেল করার পর দাঁড়ায় কেন, লজ্জা নাই?
-লজ্জা? লজ্জা বলতে একটা জিনিস আছে সেটা জহরি জানেই না। আবার নিয়ম মতো নির্বাচন এলো। সেই নির্বাচনেও দাঁড়িয়ে গেল। নির্বাচন এলেই জহরির পায়ের নিচে খোটায় তাই দাঁড়িয়ে যায় নির্বাচনে।
-সেবার কি পাশ করেছে? প্রকাশ্যে ভোট নেওয়া লাগছে দাদু?
-আরে না, প্রত্যেকবার কি এক পদ্ধতিতে আকাম করা যায়? এইবার ভিন্ন পদ্ধতি খাটান লাগছে।
-ভিন্ন পদ্ধতিটা কী দাদু?
-এইবার নির্বাচনের কাজে যারা দায়িত্বে ছিল তাদেরকে হাত করে ব্যালট পেপার আগেই কয়েকটা সরাইয়া রাখছে। পরে সেগুলায় সিল মাইরা বাক্সে ভরছে। সেইবার ছল চাতুরি করে জয়লাভ করে নির্বাচন কমিশনারদের দিয়ে তড়িঘড়ি করে ব্যালট পুরিয়ে ফেলছে।
-তারপর দাদু?
-তারপর আবার নির্বাচন আইছে। সেইবারও মাথাফুলা জহরি লাল কুন্ডু দাঁড়াইছে। আগেরবারের চালাকি এইবার আর করতে না পাইরা ফেল করছে।
-প্রতিবারই নির্বাচনে দাঁড়ায় আর ফেল করে, মাত্র দুইবার পাস করলো তাও ছলচাতুরি করে, তাহলে দাঁড়ায় কেন নির্বাচনে? তারপরে কী হলো দাদু?
-এইবার ফেল কইরা মনে হয় একটু শরম লজ্জা জ্বালাইছে। পরেরবার নির্বাচনে আর দাঁড়াইতে গিয়া গিড়ায় বল পায়নাই। আগেরবার যার কাছে হারছে এইবারের নির্বাচনে তারে নিয়া মাঠে নামছে।
-বলো কী দাদু? আগের নির্বাচনে যার কাছে হারলো পরের নির্বাচনে তাকে নিয়েই মাঠে নামলো। কীভাবে সম্ভব এটা?
-সম্ভব রে দাদুরা সম্ভব। আগেরবার প্রতারণা করে জিতছে। পরেরবার প্রতারণা করতে ব্যার্থ হয়ে ফেল করায় চিন্তা করছে, যার কাছে হারলাম সে মনে হয় অনেক জনপ্রিয়। জনপ্রিয় লোকটা নিশ্চয়ই এবারও জিতবে। তাই জিতা পার্টির সাথে থেকে কিছু টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা আরকি! মাথাফুলা জহরি লাল কুন্ডুর কিছু বদ অভ্যাস ছিল।
-কী বদ অভ্যাস দাদু?
-একটু পাগলা পানির অভ্যাস ছিল। বাদ দে, ওটা তোরা বুঝবি না।
-তারপর দাদু?
-তারপর আর কী? নির্বাচন শুরু হলো। সহজসরল বেটার কাছ থেকে টাকা নেয় আর পাগলা পানি খাইয়া উল্টাপাল্টা কথা বলে। রাস্তা দিয়া হাঁটে আর সরল মানুষটাকে বুঝায়। সাহস দিয়ে বলে-‘বা…কাটতে কুড়াল লাগে নাকি।’ আবার কতক্ষণ বলে, ‘রাখ বেটা, কুড়াল কাটতে বা…… লাগে নাকি?’
-দাদু বা… কী?
-ওটা তোদের না জানলেও চলবে। ওটুকু সেন্সর করে দিলাম। বড় হলে একদিন বুঝবি কথাটার মানে কী? তো একদিন বাজারে ভোটারদের দাওয়াত দিয়ে নির্বাচনি মিটিং করলো। মিটিংয়ে পাগলা পানি খেয়ে জহরি লাল কুন্ডু বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলো, ‘আপনারা জানেন, পাগলা পানি ভালো না। অথচ খোঁজ নিলে দেখবেন আমাদের প্রতিপক্ষের লোকজন পাগলা পানি খাচ্ছে। ওরা ভালো না। (মনে মনে বলে, আমি এত অপকৌশল করি তার পরেও এবারের প্রার্থীর সাথে জিততে পারি না। দুইবার জিতছি তাও নানান অপকৌশল করে, পীর বাবার হাত পা ধরে।) ভাইসব, এবার আমরা একটা জবাব দিয়ে দেবো। কী বলেন আপনারা? সবাই ভদ্রতার খাতিরে তার সাথে সায় দিল। কিন্তু মনে মনে ভোটের ব্যাপারে দিবে কচু!
-তারপর কী হলো দাদু?
-সেবার জহরি লাল কুন্ডুর সমর্থকের বিরুদ্ধে যে প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছিল সে ভোটারদের সবসময় খেয়াল রাখতো। সারা বছর ভোটারদের সুখ-দুঃখের খোঁজ-খবর রাখায় তার প্রতি ভোটারদের ভালোবাসাটাও ছিল গভীর। আর সেই প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী ভোটের রাজনীতি করে সারা বছর। ভোটারদের সুখ-দুঃখে ছুটে যেত যখনতখন। ভোটারদের আপন ভাইয়ের মতো ¯েœহ করতো, ভালোবাসতো। তা দেখে জহরি লাল কুন্ডুদের গা জ্বলতো। আর মাথাফুলা জহরি লাল কুন্ডু ও তার লোকজন ভোটারদের খোঁজখবর নিতো শুধু নির্বাচনের এক মাস আগে থেকে। ফলে তাকে কেউ মন থেকে ভোট দিতো না। ভোট নিতো জোর করে প্রকাশ্যে, অপকৌশলে।
-তারপর দাদু?
-আগের বার যার কাছে হারলো এবার তাকে নিয়ে নানা অপকৌশল করেও আর জিততে পারলো না। ব্যালট পেপার নিয়ে অপকৌশল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, পীরবাবার দয়াও পায়নি। পীরবাবা বুঝে গেছে, মাথাফুলা আবালের জন্য নিজের ইমেজটাতো আর নষ্ট করা যায় না! আমাকে সবাই ভালোবাসে, মাথাফুলার জন্য কেন আমি সকলের কাছে ঘৃণার পাত্র হবো। তাই পীরবাবা এবার কোনো সাপোর্ট না দিল না। ফলে বিশাল ব্যবধানে হেরে গেল।
-বলো কী দাদু?
-হ্যাঁরে, বিশাল ব্যবধানে জহরি লালের দল হেরে গেল। হেরেই ক্ষ্যান্ত দিল না। এবার শুরু করলো আরেক ভ-ামি।
-নির্বাচনে হেরেছে। এরপর আর কোনো ভ-ামি বাকি রাখলো, লজ্জা-শরম কি ধুইয়া খাইছে দাদু?
-বাকি ছিলরে, বাকি ছিল। নির্বাচনের পর হেরে গেলে বিজয়ী কমিটির হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে হয়। কিন্তু এবার দায়িত্ব দিচ্ছে না। হারার পরে নতুন ধুয়া তুলছে, নির্বাচন ঠিক মতো হয় নাই, মামলা করুম, দায়িত্ব দিমু না, সংবিধান ঠিক করতে হবে, টাকা খাইয়া ভোটাররা ভোট দিছে, আমাদের যারা ভোট দিছে তারা ভালো, ওদের যারা ভোট দিছে তারা হাজী হলেও পাজি, সব বিক্রি হয়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। জহরি লাল কুন্ডু নিজে যে টাকা খাইছে তা ভুলেই গেছে!
-বলো কী দাদু? ঝামেলা থাকলে নির্বাচনে গেল কেন? মনোনয়ন দেওয়ার আগে ঝামেলা আছে সেটা কি বুঝতে পারে নাই? আর হারার পরেই বা এমন আবোল-তাবোল বকছে কেন?
-কারণ আছে রে দাদুরা। তবে শোন। জহরি লাল কুন্ডু যাকে নিয়ে নির্বাচনে নেমেছে তার কিছুটা স্বচ্ছতা ছিল, জনপ্রিয়তাও ছিল। আগেরবার যেই লোকটা তার নির্বাচন করেছে তার সাথে বেইমানি করে আগেরবারের প্রতিদ্বন্ধীর সাথে আতাত করে নির্বাচন করেছে। আর জহরি লাল ওর সাথে যোগ দিয়েছে কেন জানিস? সেই লোকটাকে ভোটারদের কাছে স্থায়ীভাবে খারাপ বানাতে পারলে জহরি লাল কুন্ডুর লাভ হয়। সরল লোকটার পাছায় সিরা ভরাইয়া দিল। সিরা ভরান নিয়া আজ আর কোনো প্রশ্ন করবি না, আরেক দিন সিরা ভরানির কিচ্ছা বলবো। জহরি লাল কুন্ডু ভবিষ্যতে যাতে চান্স নিতে পারে সেই অপকৌশল করে লোকটাকে পচানোর ধান্ধা শুরু করলো। আর ক্ষমতার লোভ হয়তো পেয়ে বসেছিল ভালো লোকটাকে। তাই সেও ঐ উপদেষ্টাদের কথায় নাচতে শুরু করলো।
-উপদেষ্টাদের মানে? জহরি লাল কুন্ডু ছাড়াও কি আরো উপদেষ্টা ছিল সরল লোকটার সাথে?
-হ্যাঁ, ছিল, এমন অনেক উপদেষ্টা ছিল যারা নিজের দোকানে বসে গল্প করে না কারণ আলো জ্বালালে তেল খরচ হবে, চা-পান খাওয়ানো লাগবে সেই খরচের ভয়ে। অন্যের দোকানে বসে গল্প চাটামি করতো। কারো মুখে কোনোদিন চা-পান না দিলেও নির্বাচন এলে একটা পুরান কট কাপড়ের প্যান্ট পড়ে মুখে একটা পান পুরে দাঁত দিয়ে সুপারি কাটতে কাটতে ভোট চাইতে, পরে যখন ভোটাররা তার ভ-ামি বুঝে ফেলেছে তখন সেই উপদেষ্টা আস্তের উপর সরে পড়েছে! এমন চাটা, কৃপণ অনেক আছে ঐ হাটে।
-আরও আছে এমন উপদেষ্টা দাদু?
-হ্যাঁ, আছে তো। এক উপদেষ্টা আছে এমন কৃপণ যে আশি টাকা হাতে এলে বিশ টাকা ধার করে একশ টাকা বানিয়ে রেখে দিতো। ধার্মিক ভাব নিয়ে চলতো কিন্তু কুটনার হদ্দ ছিল। আরেক উপদেষ্টা গজিয়েছে তাকে হালিম চাটা বলেই সবাই ডাকতো। জাতীয় ছাত্রলীগ বললেই সবাই চিনে। কথা শুরু করলেই গল্প শুরু করে দিতে সে জাতীয় ছাত্রলীগ করা নেতা, অমুক করেছে, তমুক করেছে। গ্রামের থেকে উঠে আসা ফহিন্নির পুত, ভাব ধরেছে জমিদারের। সব বাইনচোদের দল। বড় হলে ওদের সম্পর্কে জানতে পারবি, এখন কিচ্ছা শোন।
-তারপর দাদু?
-তারপর আর কী? ভালো লোকটাকে গুয়ের মতো পচিয়ে ছেড়ে দিল। নিয়ম অনুসারে ক্ষমতা তো আর না দিয়ে পারলো না। কয়েকদিন ঘুরিয়ে পেচিয়ে পরে ক্ষমতা দিতে বাধ্য হলো।
-তাহলে ঐ খারাপ জহরি লাল কুন্ডুদের কথা লোকটা শুনলো কেন দাদু?
-শোন, ভালো মানুষও মাঝে মাঝে শয়তানের ফাঁদে পা দেয়। লোভে পড়ে ভালো মানুষটা হয়তো শয়তানগুলোর ফাঁদে পা দিয়েছে। গল্পের ভিতরেই আরেকটা গল্প বলি শোন। এই গল্পে একটা শিক্ষনীয় বিষয় আছে। ধরতে পারলে তোদের কুকিজ কিনে খাওয়াবো, সাথে লজেন্সও দেব।
-বল দাদু, দেখি ধরতে পারি কী না?
-এক দেশে জহরি লাল কুন্ডুর মতো এক মাতাল ছিল। সেই মাতাল পাগলা পানি একটু বেশিই পছন্দ করতো। একদিন পাগলা পানি খেতে খেতে একটু বেশিই মাতাল হয়ে পড়েছে। অন্ধকার রাতে, টলতে টলতে বাড়ি যাচ্ছিলো। হাতে ছিল একটা বোতল। বাড়িতে গিয়ে আবারও খাওয়ার জন্য বোতলে করে কিছুটা পাগলা পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। হঠাৎ হাত থেকে পাগলা পানির বোতল পড়ে গেল। এখন অন্ধকারের মধ্যে বোতলতো খুঁজে পাচ্ছে না। তখন নিরুপায় হয়ে মা কালির সাহায্য চাইলো। বলল, মা কালি, তুমি যদি আমার বোতলটা খুঁজে দাও তবে তোমার নামে জোড়া পাঠা বলি দেব। মা কালি জহরি লাল কুন্ডুর কথায় প্রসন্ন হলেন। খুশি হয়ে মা কালি বোতলটা পায়ের একদম কাছে এনে বুড়ো আঙ্গুলে ছোয়ালেন। এবার মাতাল হাত দিয়ে বোতলটা তুললো। পরের দিন জোড়া পাঠা বলি না দেয়ায় মা কালি স্বপ্নে আবির্ভূত হলো। এসে বলল, কিরে জোড়া পাঠা দিবি বললি কই? তখন ঘুম থেকে উঠে জহরি বলল, মা হাতের অবস্থা ভালো না, দুইটা পাঠা দিতে পারবো না, যাও, একটা পাঠা দিব। পরের দিন সেই একটা পাঠা দিবে বলে তাও দিলো না। মা কালি এসে আবার বলল, কিরে একটা দিবি বললি দিলি নাতো। এবার বলল, মা, সত্যিই হাতের অবস্থা ভালো না, পাঠার যা দাম দিতে পারবো না, যাও, একটা মোরগ দিব। পরের দিন সেই মোড়গও দিলো না জহরি। মা কালি এসে বলল, কিরে মোরগ কই? এবার জহরি বলল, মা হাতের অবস্থা খুবই খারাপ, মোরগ কেনার পয়সাও নেই, পাগলা পানি খাওয়ার পয়সা জোটানোই দায় হয়ে পড়েছে মোরগ কিনবো কেমনে? যাও, একটা চড়–ই পাখি দিব। পরের দিন চড়–ই পাখি না দেওয়ায় মা কালি এসে বলল, কিরে আর কত ঘুরাবি, কথা তো রাখলি না, চড়–ই পাখি কই? এবার বলল, মা বিশ্বাস করো, আমার হাতের অবস্থাতো ফিরছেই না, চড়–ই পাখি ধরতেও পারছি না, যাও, একটা ফরিং বলি দিবো, এবার কথার আর নড়চড় হবে না। পরের দিন সেই ফরিংও দিলো না। এবার মা কালি এসে বলল, কিরে ফরিং কই? তখন জহরি বলল, মা তুমি কি পাগল হইছো? তুমি একটা মাতালের কথাও বিশ্বাস করো? আর কত ফরিং ঘাসের আগায় উড়াউড়ি করে, একটা ধইরা খাইলেই পারো, এইটার জন্য আবার আসা লাগে?
-এবার বল, কী শিখলি?
দাদু, আসলে মাতালের কথা বিশ্বাস করতে নাই!
-একদম ঠিক কথা। ধরতে পেরেছিস। আমি কিন্তু আমার কথা রাখবো। আর যা বলেছি তাই হবে, কুকিজ আর লজেন্স সবই পাবি। বোনাস হিসাবে পাবি হাটের হারাধন দা’র দোকান থেকে খাজুর আর রসগোল্লা।

শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়ক ও হরমুজ মিয়ার শেষ ইচ্ছা!

॥ ১ ॥
শরীয়তপুরের হরমুজ মিয়া। বর্ণাঢ্য জীবন কাহিনি তার। হরমুজ মিয়া, তার আবার বর্ণাঢ্য জীবন! কিন্তু শুনলে আপনিও পুলকিত হবেন। রাস্তা নিয়ে তার আছে বিস্তর জীবনগাঁথা। রাস্তায় উঠে যেমন জীবনযাপনের রোজগার শুরু করেছিল, বিয়ে করে রাস্তা দিয়ে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে, রাস্তায় দেখেছে সন্তানের মুখ আর রাস্তাই তাকে পথে বসিয়েছে।
সুস্থ্য সবল হরমুজ মিয়া ভ্যান চালাতো। হাট থেকে মালামাল নিয়ে মানুষের আবদার মতো গন্তব্যে পৌছে দিত। হরমুজের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার চাঁদপুর-শরীয়তপুর সড়কের ‘মাঝামাঝি কান্দি’ নামক গ্রামে। ‘লোয়ার মতো হাত, ইডাইল্যা শইল আমার’ বলে হরমুজ একদিন গর্ভ করতো! জীবিকার টানে একদিন আটার বস্তা নিয়ে হরিনাঘাট থেকে ভেদরগঞ্জ বাজারের দিকে রওয়ানা দিয়েছে। ভাঙ্গাচোরা রাস্তা। পথে ভ্যান উল্টে পড়ে গেল। ঘটনা চক্রে আটার বস্তা এসে পড়লো হরমুজের পায়ে। ব্যাস, পা ভেঙ্গে গেল। অকেজো হয়ে গেল মুহুর্তের মধ্যে। কয়েক মাস বিছানায় কাটিয়ে যখন সেরে উঠলো তখন টের পেল, সেই ইডাইল্যা শরীর আর নাই। এখন আর হরমুজ ভ্যান টানতে পারে না। কী করা যায় চিন্তায় পরে গেল হরমুজ।

॥ ২॥
ভ্যান দুর্ঘটনার পর হরমুজকে ভ্যান চালানো ছেড়েই দিতে হলো। কিছু একটাতো করতে হবে! অনেক চিন্তা ভাবনা করে হরমুজ গরু পালন শুরু করলো। প্রতিদিন গরু নিয়ে মাঠে যায়। ঘাস খাওয়ায়, কিছু ঘাস কেটে নিয়ে আসে রাতে খাওয়ানোর জন্য। হরমুজ তখনও বিয়ে করেনি। গরু লালনপালন করে, দুধ বিক্রি করে ভালই আয় রোজগার হচ্ছিল।
হরমুজের গরুটা গাভি হয়েছে। আগের মতো এখন আর দুধ দেয় না, দুধ একদম কমে গেছে। যা দুধ হয় তা বিক্রি করার মতো না। বাছুরটাও বড় হয়ে চালাক হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই দুধ খেয়ে ফেলে। সিয়ানা বাছুর, মুহুর্তের মধ্যে ওলান খালি করে ফেলে। তাতে হরমুজের মনে কষ্ট নেই। আরতো কয়েকটা মাস কষ্টে মিষ্টে চালিয়ে দিলেই হবে। আবার যখন বাচ্চা দিবে তখন দুধ হবে, দুধ বিক্রি করে সংসার ভালোই চলবে!
কিন্তু সময় কারোরই সমান যায় না। হরমুজের সময় এখন ভালো যাচ্ছে না। গরুটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলো। হরমুজ একটা ভ্যানচালককে খবর দিল। ভ্যানে করে গঞ্জের হাটে মজিদ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। মজিদ ডাক্তার হাটের সবচেয়ে বড় পশুর ডাক্তার! পশু হাসপাতালে চাকরি করে অবসরের পর গঞ্জের হাটে দোকান দিয়ে বসেছে। সবাই তাকে ডাক্তারই ডাকে।
ভ্যানে করে হরমুজ তার গর্ভবতী গরুটাকে গঞ্জের হাটে নিয়ে গেল। মজিদ ডাক্তারকে দেখিয়ে ঔষধ কিনে বাড়ি ফিরছিল। রাস্তার ঝাঁকুনিতে গরুর বেহাল দশা। পরের রাতেই গরুর গর্ভপাত হয়ে গেল। আর মাত্র কয়েক মাস পরে বাচ্চা দিবে। অনাকাক্সিক্ষত সময়ে গরুটা মরে হরমুজের মাথায় বিনা মেঘে বাজ পড়লো। হরমুজ মনে মনে বলল, ‘খোদা, ঠাডা হালানের আর মানুষ পাইলা না! গরুটা আমার একমাত্র সম্বল তার উপরেই বিপদ দিলা!
হরমুজ চিন্তা করলো সময় এমনিতে ঘুরবে না। তার চেয়ে একটা বিয়া কইরা ফালাই। দুইজনের কপালের জোরে যদি ভাগ্যটা একটু খোলে! সাত পাঁচ ভেবে পাশের গ্রামের আরজিনা বেগমকে বিয়ে করে ফেললো হরমুজ মিয়া। বিয়ে করে নিরুপায় হয়ে শরীয়তপুর-চাঁদপুর রাস্তা দিয়েই বাড়ি ফিরতে হলো!

॥ ৩ ॥
হরমুজ মিয়া বিয়ে করেছে। বিয়ের পর হরমুজ মিয়া সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো! একদিন হরমুজ মিয়া বাজারে গিয়ে মিষ্টি বিলাচ্ছিল। অনেক পরিচিত-অপরিচিত লোক সেই মিষ্টি খেয়ে বেশ খুশি। হরমুজের স্ত্রী আরজিনা বেগমকে পাশের বাড়ির মর্জিনা ভাবি এসে জিজ্ঞেস করলো
-কিলো, কী হইছে তোগো? তোর সোয়ামি দেহি বাজারে মিষ্টি বিলাইতাছে! আমারে কিছু কলি না যে!
-আর কইওনা বইন, কাইল রাইতে আলুভত্তা আর হোরা ভত্তা দিয়া কাজির ভাত খাইছিলাম। হজম হয়নাই ঠিকমত তাই সকালে ওকাল করছি। হেইয়া দেইখ্যা গোলামে খুশিতে নাচতাছে আর মিষ্টি বিলাইতাছে!
-ওহ! ওই কতা? আমার সোয়ামি তো আইসা আমারে সুখবরটা দিল, কইলো, হরমুজের বউ পোয়াতি হইছে! আমি আরো বেজার হইছি যে, ভাবি আমারে খবরটা কইলো না, সোয়ামির কাছ থেকে খবরটা শোনতে হইলো!
কয়েক মাস পর ঠিকই আরজিনা বেগম পোয়াতি হইছে! এবার হোরা ভত্তা আর কাজির ভাতের গুণে না সত্যিকারের বমি ভাব শুরু হয়েছে আরজিনার। এ অবস্থায় আরজিনাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। কিন্তু হরমুজের আবার ডাক্তারদের প্রতি বেদম গোস্বা। ডাক্তাররা তার দু’চোখের বিষ। ডাক্তার দেখলেই সে দেখে ছুরি, চাপাতি নিয়া কষাই আসতেছে। আর হাসপাতাল ও ক্লিনিক তার কাছে কষাইখানা ছাড়া আর কিছুই নয়!
যাহোক, হরমুজের স্ত্রীর দিন ঘনিয়ে আসতেছে। না, মৃত্যুর নয়, ডেলিভারির দিন ঘনিয়ে আসতেছে। হরমুজ চিন্তা করলো, যে করেই হোক নরমাল ডেলিভারি করাতে হবে! ব্যথা উঠলে যদি বাড়িতে রাখে তবে দাই বেটি কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে কমিশন খাওয়ার লোভে হাসপাতালে নিয়া যাবে! হাসপাতালে নিলেও নরমাল হবে না, পরে হাসপাতাল থেকে পাঠাবে ক্লিনিকে। ক্লিনিকে নেওয়ার পর কাটাকাটি করে ডেলিভারি করবে আর হরমুজের কাছ থেকে মোটা টাকা খসাবে। হরমুজ এটা হতে দিতে পারে না!
এদিকে ডেলিভারির দিন ঘনিয়ে আসছে। প্রস্তুতি হিসাবে হরমুজ একটা ইজিবাইক ঠিক করে রাখলো। চালককে বলে রাখলো, ডাক দিলেই যেন ইজিবাইক চলে আসে। কী করতে বা কোথায় যেতে হবে তা পরে বলে দিবে।
এমনি এক সকালে হরমুজের স্ত্রীর পেট ব্যথা শুরু হয়েছে। সাথে সাথে হরমুজ ইজিবাইক চালককে ডাক দিল। ইজিবাইক চালক এমন বিপদের সময় দ্রুত হরমুজের বাড়ি চলে আসলো। জিজ্ঞেস করলো,
-হরমুজ ভাই, কই নিবেন চিন্তা ভাবনা করছেন? হাসপাতালে না ক্লিনিকে?
হরমুজের সোজাসাপটা উত্তর,
-আমারে কী পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে যে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিমু? তুই ধর, গাড়িতে তোল, আমিও ধরতাছি।
হরমুজ বাইক চালকের সহায়তায় স্ত্রীকে বাইকে তুললো। পাশের বাড়ির দাই চাচি ঘরে আরজিনা বেগমের পাশেই ছিল। তাকে ডাক দিয়ে সাথে নিল। কয়েকটা কাপড়ও সাথে নিয়ে নিল। এবার বাইক চালককে বলল,
-চাঁদপুরের রাস্তায় ল!
-কন কী হরমুজ ভাই? ঐ রাস্তার যা অবস্থা তাতে ওই দিকে কই নিয়া যাইবেন?
-কতা কম ক, যেমনে বলি তেমনে কাজ করতে থাক।
হরমুজ বাইকের দরজার অংশ কাপড় পেঁচিয়ে ঢেকে দিল আর স্ত্রীর পাশে দাই চাচিকে বসিয়ে দিল। চালকের পাশে বসে হরমুজ চালককে বলল,
-এইবার চালাইতে থাক কাইশ্যা।
কাইশ্যা বাইক চালাতে শুরু করলো। আধা কিলোমিটার যেতে হলো না। আরজিনা বেগমের নরমাল ডেলিভারি হয়ে গেল! ফুটফুটে পুত্র সন্তান হয়েছে হরমুজের বউর। দাই চাচি তো তাজ্জব, তাজ্জব বাইক চালক কাইশ্যাও!
হরমুজ বাইক চালককে এবার বলল,
-বাইত্তে চল কাইশ্যা। এবার বুঝতে পারলি কেন এই রাস্তায় আইছি! সিজার, অপারেশন কিছুরই দরকার নাই, এই রাস্তায় চললে, নাড়িভুঁড়িসহ পেটের ভাতও বাইরে চইলা আসে, বাচ্চা-কাচ্চাতো আরো চেঙ্গর! ওরা ভিতরে থাকবো না হেইডা আমি জানি!

॥ ৪ ॥
হরমুজের বিপদ যেন কাটছেই না। বিয়ে করলে বিপদ কাটবে চিন্তা করেছিল, কিন্তু কই? বিপদ যে সঙ্গী হয়ে আছে। হাতে কোনো কাজ-কর্ম নাই, টাকা-পয়সাও নাই। এভাবে অভাব-অনটনের মধ্যে আর ভালো লাগে না। অগত্যা কোনো কাজ-কর্ম না পেয়ে হরমুজ চুরি-চামারি শুরু করলো।
একদিন পাশের এলাকার কিনাই মিয়ার বাড়িতে চুরি করতে ঢুকছে। মালপত্র নিয়া বের হবে এমন সময় কিনাই মিয়া টের পেয়ে গেল! চোর চোর বলে চিৎকার দিতেই হরমুজ মিয়া দিল দৌড়। হরমুজ দৌড়ায় মালামাল নিয়ে আর কিনাই মিয়া দৌড়ায় হরমুজের পিছন পিছন। দৌড়াতে দৌড়াতে হরমুজ উঠলো শরীয়তপুর-চাঁদপুর সড়কে। সড়ক দিয়ে দৌড়ানোর সময় কিনাই মিয়া ভাঙ্গা রাস্তার খাদে পড়ে চরমভাবে জখম হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করলো। কিনাই মিয়ার স্বজনরা হরমুজের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করলো। নিয়তির নির্মম পরিহাস, দীর্ঘ শুনানি শেষে হরমুজ মিয়ার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে হরমুজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো,
হরমুজ, তোমার শেষ ইচ্ছে কী?
হরমুজ বলল, আমাকে শরীয়তপুর-চাঁদপুর রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে আনা হোক!
উপস্থিত কর্তা ব্যক্তিরা জানতে চাইলো,
-হরমুজ, ঐ রাস্তায় কি তোমার অনেক স্মৃতি? শেষবারের মতো কি তুমি ঐ রাস্তা দিয়ে ঘুরতে চাও?
শান্ত গলায় হরমুজের উত্তর,
-না, ঐ রাস্তা দিয়ে চললে এমনিতেই মইরা যাইতে ইচ্ছা করে! এতই খারাপ রাস্তা, হয় এ্যাকসিডেন্টে মইরা যাব যেমনটি মরছে কিনাই মিয়া! যার কারণে আমি আজ ফাঁসিতে ঝুলুম, নয়তো এমন বাজে রাস্তায় চলার কারণে নিজেরই ইচ্ছে হইবো মইরা যাইতে! তাতে মৃত্যুটা একটু সহজ হইবো আরকি!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here