সরল মানুষ - সহজ কথা
-সমকালীন ভাবনা -হৃদয়ে শব্দ ক্ষরণ -যেমন আছি লন্ডনে মুল বই পেতে হলেসমকালীন ভাবনা
আসাদুজ্জামান জুয়েল
সমকালীন ভাবনা
লেখক আসাদুজ্জামান জুয়েল
প্রকাশক বৈশাখী প্রকাশ
৩৮, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
মোবাইল : ০১৭১২৮১৮৩০৩, ০১৭৩৪৯০১১৩৯
প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০১৯
গ্রন্থস্বত্ব লেখক
প্রচ্ছদ মোঃ ফরিদ হোসেন
বর্ণবিন্যাস স্বদেশ কম্পিউটার সিস্টেম
মুদ্রণ রাবেয়া প্রিন্টার্স
মূল্য ৩০০ টাকা মাত্র
উ। ৎ। স। র্গ
আমার প্রয়াত মা রওশনারা বেগম
ও
পিতা আবদুর রশিদ খান
যাদের জন্য আজ আমার লেখালিখি।
কিছু কথা
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাথায় যে চিন্তা ভর করে, সেই চিন্তাগুলো অক্ষরে লিপিবদ্ধ করে বিভিন্ন মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করি। প্রকাশের পর পাঠকের যে সাড়া পেয়েছি তাতে আরো বেশি লিখার তাগিদ অনুভব করি। আমি কোনো কলামিস্ট নই। আমার লেখাগুলো বরেণ্য সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের পত্রিকায় আমার এক শ্রদ্ধেয় ভাই মীর নাসিমুল ইসলাম প্রকাশের সুযোগ করে দেয়ার পর পরিচিতির জায়গায় দেখি কলামিস্ট জুড়ে দিয়েছেন। সেই থেকে লেখার গতি গেল বেড়ে। লিখতে লিখতে দেখি প্রকাশযোগ্য কিছু লেখা জমে গেছে। আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করেছি মাত্র, কোনো সাহিত্য রচনা করিনি। আমার নিজস্ব মতামতগুলো পড়ে যদি কেউ আনন্দ পায়, ভালো লাগে সেটাই আমার স্বার্থকতা।
আমি কৃতার্থ আমার বন্ধু আইনজীবী ভাইদের কাছে যারা আমার লেখা গ্রহণ করে আরো লিখতে উৎসাহিত করেছেন। আমি কৃতার্থ আমার সহধর্মিণী মুনমুন সুলতানা লুনার কাছে যে আমাকে লিখতে সর্বদা উৎসাহ দিয়েছে। বিশেষ করে যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই দায় শেষ হয় না তারা হলেন, বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাহবুবুল হক, জাপানের সিমানী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত ভূতত্ববিদ শামীম আজিজ, প্রফেশনাল প্রচ্ছদ শিল্পী না হয়েও আমার বইগুলোর সুন্দর সুন্দর প্রচ্ছদ একেছেন সেই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিষ্টার মোঃ ফরিদ হোসেন, শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির বারবার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোঃ আবু সাঈদ, খালাতো ভাইয়ের চেয়েও বেশি বন্ধু আমির হোসেন নয়ন, বন্ধু মোস্তাফিজুর রহমান নয়ন, শামীম সরদার, আমার বোন কোহিনুর আক্তার শিখা।
আগেও বলেছি, আমি কোনো লেখক বা কলামিস্ট নই। তাই আমার লেখায় শব্দ গঠনে, বানানে অনেক ভুল থাকে। আমি আমার অযোগ্যতাকে লুকাতে চাই না। অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো আমার অজ্ঞতা, অযোগ্যতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ছাড়া আর কিছুই না। তাই আমার ভুলগুলো বন্ধুরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে লেখাটা গ্রহণ করবেন বলেই আমার আশা। সবাই ভালো থাকবেন।
আসাদুজ্জামান জুয়েল
আইনজীবী
শরীয়তপুর।
সূচিপত্র
মাদক নিয়ে মাতামাতি ক্রস ফায়ারে হাতাহাতি!-৬৯
কষ্ট করে ধরা আসামি বিচারক ছাড়ে আইনজীবী ছাড়ায়!-৭৪
বিচার বহির্ভূত হত্যা ॥ প্রেস রিলিজের বিষয় হতে পারেন আপনিও!-৭৭
বাবার কষ্ট ও বাবা হওয়ার তৃপ্তি ॥ বাবা সেকালে ও একালে-৮৫
বিচার বিভাগ ও চিকিৎসা দু’ই আস্থার জায়গা ॥ বিতর্ক করলেই ক্ষতি-৮৮
তেঁতুল, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে স্বাদ বদলায়-৯৩
গু এবং গাডির মধ্যে পার্থক্য বুঝা কঠিন!-৯৫
সাংবাদিক ৫০৬ ধারায় অভিযুক্ত! আসুন, চতুর্থ স্তম্ভের প্রতি সহনশীল হই-৯৭
বৃক্ষের রক্তক্ষরণ বন্ধে আইন হোক-১০০
ধর্ষণ নিয়ে ধস্তাধস্তি-১০৩
অতি উৎসাহে কাটতে কাটতে তাল উঠে গিয়েছিল-১০৬
মহিলার হাতে রিক্সাচালক নির্যাতন ও ভাইরাল ভাবনা-১০৯
মা ইলিশ নিধন নয় চলছে হত্যাযজ্ঞ-১১১
মাদক নিয়ে মাতামাতি ক্রস ফায়ারে হাতাহাতি!
চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে। স্লোগানটা দারুন! এমন স্লোগান সবসময় আসে না। সম্প্রতি স্লোগানটি আমাদের সামনে এসেছে। মাদকের বিরুদ্ধে দেরিতে হলেও সরকার বাহাদুর চরম ক্ষেপেছে। এবার মাদক নির্মূল করেই ছাড়বে। খুবই ভালো কথা। নির্মূল অভিযানের সহজ পথ নির্ধারণ করেছে ক্রস ফায়ারে মাদক ব্যবসায়ী হত্যা। এই নির্মূল কৌশল আর বিচার বহির্ভূত হত্যা নিয়ে চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড়। কেউ সমর্থন দিচ্ছে নির্লজ্জ ভাবে, কেউবা আড়ালে আবডালে। আবার কেউ সমালোচনা করছে খোলামেলা, কেউবা কৌশলে। কেউ দোষ দিচ্ছে বিচার বিভাগকে, কেউ দোষ দিচ্ছে আইনজীবীদের, কেউ দোষ দেয় সরকারের, কেউ প্রশাসনকে, কেউ কেউ সমাজ ব্যবস্থাকে। আসলে এর জন্য কে প্রকৃত দায়ী? মাদক সমাজের জন্য এক ভয়াবহ ক্যান্সারসম। কেনইবা এমন একটি ক্যান্সার নির্মূল পদ্ধতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে?
শুরুতেই একটু ঝালাই করে নেই মাদক দ্রব্য এবং মাদকাসক্তি কী? মাদক দ্রব্য হলো একটি রাসায়নিক দ্রব্য যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব পড়ে এবং যা আসক্তি সৃষ্টি করে। মাদক দ্রব্যে বেদনানাশক কর্মের সাথে যুক্ত থাকে তন্দ্রাচ্ছন্নতা, মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক আচ্ছন্নতা, রক্তচাপ পরিবর্তন ইত্যাদি। মাদক দ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং মাদক দ্রব্যের উপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে ব্যক্তির এই অবস্থাকে বলে মাদকাসক্তি এবং যে গ্রহণ করে তাকে বলে মাদকাসক্ত।
বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্যঃ মাদক দ্রব্য আসলে কী কী সেটার নির্দিষ্ট সংখ্যা বা নাম বলা সম্ভব নয়। মানুষ নেশার জন্য যা যা ব্যবহার করে তাই মাদক দ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা অন্য যে কোনো মাধ্যম।
বিভিন্ন ধরণের মাদক দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে হিরোইন, কোকেন, সাম্প্রতিককালের ইয়াবা, আফিম, মারিজুয়ানা, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিয়ার, কেটামিন, স্পিড, বিভিন্ন রকমের ঘুমের ওষুধ থেকে শুরু করে জুতায় ব্যবহৃত আঠা পর্যন্ত। অনেকে বিভিন্ন ধরণের এনার্জি ড্রিংকসের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে নেশা করে থাকে। সাধারণ এনার্জি ড্রিংকস আর সাধারণ থাকে না যখন তার সাথে কিছু মিশিয়ে নেশা করা হয়। বিভিন্ন ধরণের মাদক গ্রহণের ফলে মানুষের শরীর ও মনের বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন হয়।
মাদক দেহে ও মস্তিষ্কে কীভাবে কাজ করে? নিওরো কেমিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাদক সেবনের পরপরই ব্যক্তির মস্কিষ্কের কিছু কিছু জায়গায় অতি দ্রুত এবং বেশি পরিমাণে ডোপামিন নামক নিওরোট্রান্সমিটার বৃদ্ধি পায়, যা একজন ব্যক্তিকে মাদকের আনন্দ দেয় এবং পরবর্তী কালে ব্যবহারে উৎসাহিত করে। কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে মাদকে আসক্ত তাদের বেলায় আবার উল্টোটা দেখা যায়। অর্থাৎ দীর্ঘদিন মাদক নেওয়ার ফলে যে ডোপামিন একজন মানুষকে নেশার আনন্দ দিত তা আস্তে আস্তে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যাচ্ছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি আসলে একটা সময়ে আর আনন্দের জন্য নেশা নিচ্ছে না। এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয় এবং এটা থেকে একসময় বের হয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রথম পর্যায়ে মাদক মানুষকে এমন একটি আনন্দ দেয় যার কাছে মজাদার জিনিসগুলো যেমন খাদ্য, পানীয় এবং যৌন মিলনের আনন্দের মতো আনন্দের জিনিসগুলো ম্লান হয়ে পড়ে। কারণ এই ছোট ছোট আনন্দগুলো মানুষ একই নিওরোট্রান্সমিটার অর্থাৎ ডোপামিন-এর মাধ্যমে পেয়ে থাকে। মাদকের আনন্দের সাথে পাল্লা দিয়ে এই আনন্দগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে এবং মাদকই হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তির একমাত্র চিন্তা চেতনা। দীর্ঘদিন মাদক ব্যবহারকারীদের ডোপামিন এর কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে মস্তিষ্কের যে সমস্ত জায়গা ডোপামিন এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে সেই জায়গাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
মাদক গ্রহণের পরিমাণের ভিন্নতার কারণে দেহে ও মস্তিষ্কে এর প্রভাব ভিন্ন হয়। খুব অল্প পরিমাণে মাদক উদ্দীপক বস্তু হিসেবে কাজ করে। বেশি পরিমাণে মাদক গ্রহণ করা হলে তা যন্ত্রণাদায়ক হিসেবে কাজ করে। বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা হলে শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে যার পরিণতি হয় মৃত্যু।
কিছু কিছু মাদক দ্রব্য সরাসরি মনকে আক্রমণ করে। এতে করে মাদক গ্রহণকারী তার চারপাশে কী ঘটছে তার উপলব্ধি হারিয়ে ফেলে। মাদক একজন ব্যক্তির সকল ইন্দ্রিয় চেতনাকে সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করে দেয়। যার ফলে ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারেনা। তার চিন্তাধারা নেতিবাচক হয়ে পড়ে।
মাদক সম্পর্কে সংক্ষেপে দেওয়া তথ্যই বলে দেয় এর প্রভাব ও ক্ষতিকর দিক। তাহলে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা অনিবার্য বটে। কিন্তু পদ্ধতির কারণে এবং পদক্ষেপ গ্রহণের হঠাৎ আগ্রহের কারনেই আজকের এই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া। মাদক নেওয়া শুরু করলে কাজ করে আস্তে আস্তে। একপর্যায়ে আর কোনো কাজই করে না শুধু একটা কাজই করে তা হলো মাদক নিতে হবে এই চেতনাটা জাগ্রত থাকে। দেশে মাদকের প্রভাবের মতো একদিনে মাদক বিস্তার ঘটেনি। আস্তে আস্তে ঘটেছে এবং আজকের এই পর্যায়ে এসেছে। হঠাৎ করে যেমন মাদক ত্যাগ করা যায় না। তেমনি হঠাৎ করে রাত শেষে মাদক নির্মূল হয়ে গেছে সেই ঘোষণাও দেয়া যায় না। তাই নির্মূল পদ্ধতিটা এত দেরিতে শুরু করাটাই হয়েছে প্রথম ও প্রধান প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া।
বাংলাদেশে র্যাব সৃষ্টির পিছনে রয়েছে সুবিশাল ইতিহাস যা আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে। একসময় দেশে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি এমন হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল যে মদদ দাতা, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাই বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। সন্ত্রাস যখন ঘারের উপর নিঃশ্বাস ছাড়তে শুরু করে তখনই সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করেছিল আমাদের নীতিনির্ধারক কর্তাব্যক্তিরা। এরপর সবই ইতিহাস।
র্যাব কালো পোষাক পরে মাথায় কালো কাপড় বেঁধে কালো চশমায় চোখ আবৃত করে নেমে পড়ে সন্ত্রাস দমনে। প্রথম প্রথম নামিদামি দাগি সন্ত্রাসী ধরা শুরু করে এবং কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যাযজ্ঞ চালায়। হত্যার পর একটা নির্দিষ্ট ফরমেটে প্রেস রিলিজ দিয়ে জানান দেয় যে, অমুক সন্ত্রাসীকে ধরার পর কখনো ক্যাম্পে আনার সময় আবার কখনো অস্ত্র উদ্ধারের সময় তার সহযোগীরা বা প্রতিপক্ষরা হামলা চালায় এবং সন্ত্রাসীকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করে বা সন্ত্রাসী পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। পরে সন্ত্রাসীদের গুলিতেই সন্ত্রাসী নিহত হয়। নিহত হওয়ার সময় তার পাশেই পাওয়া যায় কখনো কেজো কখনোবা অকেজো দেশীয় বা বিদেশি অস্ত্র ও কিছু গুলি। সন্ত্রাসী নিহত হওয়ার সময় কখনো কখনো দুএকজন র্যাব সদস্য আহত হয়।
র্যাব বাহিনী যখন সন্ত্রাসী মারতে শুরু করে তখনও অনেকেই বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল আবার অনেকে অসন্তোষ প্রকাশ করে। ঘটনাটা যেহেতু বিচার বহির্ভূত হত্যা তাই বেশিরভাগ মানুষই সেই হত্যাযজ্ঞ মেনে নিতে পারেনি। তবে ফলাফল যা হয়েছে তা হলো, দেশে নামি দামি সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ কমেছে, শান্তি ফিরেছে অনেকাংশে। আজ আর সেই কালা জাহাঙ্গীর, মুরগি মিলন, হাতকাটা মফিজ, গালকাটা কুদ্দুছ নাই। আর নতুন কোনো পিচ্চি হান্নান, কষাই খালেক, বিচ্ছু বাহিনী সৃষ্টি হয়নি।
সন্ত্রাসী নির্মূল করতে করতে একসময় র্যাব খেয়াল হারিয়ে ফেলে। সন্ত্রাসী নিধনের নামে নেমে পড়ে দমন নিপীড়নের দিকে। টাকার বিনিময়ে শুরু করে সাধারণ মানুষ হত্যা করে সন্ত্রাসী বলে চালিয়ে দেওয়া এবং সেই একই প্রেসরিলিজ দেওয়া। এরপর লাগাম টেনে ধরার জন্য সমাজের বিবেক আওয়াজ তুলতে থাকে। তারপর সরকারও র্যাবের লাগাম টানতে বাধ্য হয়। কোনো কিছুই বেশি বাড়াবাড়ি ভালো নয়। সন্ত্রাসের বাড়াবাড়ি যেমন ভালো নয় তেমনি সন্ত্রাস নিধনের নামে সাধারণ নিরপরাধ মানুষ মারাও ভালো নয়।
দেশে মাদক ব্যবসা ও ব্যবহার বেড়েছে ভয়াবহ হারে। দীর্ঘ ডালপালা বৃদ্ধির পর মানুষ যখন অতিষ্ট তখনই রাষ্ট্রযন্ত্র নড়েচড়ে বসেছে। ঘোষণা করেছে যুদ্ধ। সপ্তাহের মধ্যে যখন অর্ধশত মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয় তার সাথে দু একজন নিরপরাধ মানুষ মারা পরে তখন সবাই আবার নড়েচড়ে বসছেন। সভা সেমিনার করে প্রতিবাদ করছে এই হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে। আজকের এই মাদক বিরোধী অভিযান কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে অনেক অসহায় পরিবারের কান্নার কারণ। যেভাবে সন্ত্রাস দমন অভিযান হয়েছিল অনেক সাধারণ মানুষের কান্নার কারণ। তাই মানবাধিকার কর্মী, বিরোধী মতের মানুষ সকলের কাছে এতটা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের মাদক বিরোধী অভিযান। শুরু হয়েছে মাদক নিয়ে মাতামাতি আর ধরপাকড়ের সময়, ক্রসফায়ারের সময় হাতাহাতি!
মাদক ব্যবসায়ী হত্যার কারণে আরো একটা প্রশ্ন উঠে এসেছে তা হলো, এভাবে ব্যবসায়ী নিধণ করলে মূল হোতাদের ধরা যাবে না। এসব ব্যবসায়ীদের যদি বাঁচিয়ে রেখে তাদের কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে মাদক ব্যবসার মূলে পৌছানো যেতো তবেই মূল উৎঘাটন সম্ভব হতো। প্রমাণ না থাকলেও আমরা যাদের প্রভাবশালী মাদক স¤্রাট বলে জানি তাদের তো ধরা সম্ভব হচ্ছে না বা হবেও না। তারা তো পৌঁছে গেছে সমাজ হতে সংসদে! তারা কেউ সিআইপি, কেউ ভি ভিআইপি, কেউ নেতা, কেউ অভিনেতা, কেউ পরিচালক, কেউ প্রযোজক। মাদক ব্যবসায়ী ধরার পর আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উঁচু সারির কর্তা ব্যক্তিদের ফোনে ছেড়ে দেয়ার কথাও আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি কিন্তু এর তো কোনো প্রমাণ নেই। অনেক পুলিশের সদস্য মাদক পাচারের কাজ করে, প্রশাসনের অনেক লোক মাদক সেবন ও কেনা-বেচার সাথে জড়িত, পুলিশ মাদক বিক্রেতাদের কাছ থেকে বখড়া তোলে এসবের কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণের অভাবে কর্তাদের যেমন ধরা যায় না তেমনি প্রমাণের অভাবে কিছু লোক ধরার পরও তাদের আটক রাখা যায় না। প্রমাণ না থাকলেই কি তাদের অপরাধকে অস্বীকার করা যায়? তখন দোষ দেওয়া হয় বিচার বিভাগকে, আর বিচার বিভাগসহ অন্যরা দোষ দেয় আইনজীবীদের। অথচ এমন ঘটনাও আছে যে, ইয়াবা তো দূরের কথা যে বৃদ্ধ পরিবার পরিকল্পনায় ব্যবহৃত মায়া বড়ি চিনে না তাকেও পুলিশ ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়। এমন দোকানদার আছে যে কিনা মাদকের সাথে জড়িত নয় কিন্তু মামাতো ভাইয়ের সাথে তার মায়ের পৈত্রিক ওয়ারিশ হিসাবে পাওয়া জমি নিয়ে বিরোধের কারণে ডিবিকে ত্রিশ হাজার টাকা দিয়ে ঐ যুবকের দোকানে ইয়াবা রেখে ধরার চেষ্টা করে এবং ধরিয়ে দেয়। এমন নিরপরাধ ব্যক্তির জন্য যদি সমাজের বিবেকবান মানুষ এবং আইনজীবীরা না দাঁড়ায় তবে কারা দাঁড়াবে? আর আইনজীবীরা তো আইনের চর্চা করে। কোনো অপরাধির পক্ষে দাঁড়ানো যাবে না এমন তো কোনো বিধান নেই। অপরাধি যাতে তার অপরাধের বেশি শাস্তি না পায় সেই চেষ্টাই আইনজীবী করেন। সেখানে রাষ্ট্র প্রণিত আইনের মধ্যে থেকেই আইনজীবী কাজটা করে থাকেন। প্রসিকিউশন কেন বার বার অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হন সেই কথা কেউ বলেন না।
সব শেষে একটা কথা বলেই শেষ করবো তা হলো, মাদক নির্মূল যুদ্ধ ঘোষণা করে শেষ করা যাবে না। জনসচেতনতা, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিকতার ও সংস্কৃতির চর্চা, খেলাধুলার চর্চা, পাঠভ্যাস গড়ে তোলা, প্রসিকিউশনের যথাযথ পদক্ষেপ, পুলিশের সঠিক তদন্তপূর্বক অপরাধের প্রতিবেদন তৈরি, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ ও আন্তরিক নজরদারীই পারে মাদক মুক্ত সমাজ গড়তে।
কষ্ট করে ধরা আসামি বিচারক ছাড়ে আইনজীবী ছাড়ায়!
পুলিশ কত কষ্ট করে মাদক সেবী ও মাদক ব্যবসায়ী ধরে। আর আদালতে সোপর্দ করার পর বিজ্ঞ বিচারক ছেড়ে দেয়-জামিন দিয়ে দেয় আর আইনজীবী ছাড়িয়ে আনে-জামিনে মুক্ত করে। পুলিশের এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের! শুধু যে পুলিশের তা কিন্তু নয়! অনেক সময় সাধারণ মানুষেরও! আর বিচার বিভাগও মাঝেমাঝে মনে করে আইনজীবীরা ছাড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা কোথায় সেটা কেউ বিচার বিবেচনা করে না।
আমি একজন আইনজীবী। অনেকেই হয়তো ভাববেন আমিতো আইনজীবীদের পক্ষেই যুক্তি দেব। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা শরীয়তপুর জেলা শাখার একজন প্যানেল আইনজীবী হিসাবে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করার কারণে কয়েকটা মাদক মামলা পরিচালনা করেছি। সবগুলো মামলাই গরিব দুঃখীর মামলা। মামলা করতে যেয়ে মোয়াক্কেলের কাছ থেকে কোন টাকা পাইনি, উপরন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যে ফি দেয়া হয় তা তুলতেও চেষ্টা করিনি। তোলার ক্ষেত্রে মুলার চেয়ে ধেড়া বেশি মনে হয় তাই বিল করিনি। কয়েকটা কেস স্টাডি দেই। পড়ে বিবেচনা করবেন আসলে আইনজীবীদের দায় কতটুকু?
কেস স্টাডি-১॥ দুই মাদকসেবী কাম ব্যবসায়ী ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। একজন পুরুষ আরেকজন নারী। একে অপরের স্বামী-স্ত্রী তারা। এ দুজন থাকে সরকারের আনুকূল্যে গড়া গুচ্ছগ্রামে। স্বামী-স্ত্রী একসাথে গাঁজা খায় এবং বিক্রি করে। হতদরিদ্র পরিবার। ধরা খাওয়ার পর নিজেদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করে জামিন চাওয়া সম্ভব হয়নি। জেল কর্তৃপক্ষ বসিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে ক্লান্ত। তার উপর জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি কারাগার পরিদর্শন করতে গেলে কান্নাকাটি করে। জেল কর্তৃপক্ষ মামলা লিগ্যাল এইডে পাঠালে মামলার আইনজীবী নিয়োগ করলো আমাকে। আমি জামিন চাইলাম। বিজ্ঞ বিচারক জামিন দিলেন। জামিন পাওয়ার পর হাজিরা দিতে আসলে বিজ্ঞ বিচারক জানতে চাইলেন, গাঁজা খান কেন? উত্তরে গাঁজাখোর দম্পতি জানালো, স্যার, ক্যানভাচারের কাম করি। খাইতে খাইতে নেশা হইয়া গেছে। এখন আর ছাড়তে পারি না। খাইতে খাইতে টুকটাক বিক্রিও করি। কথা শুনে বিজ্ঞ বিচারক শাষিয়ে দিলেন, আর খাবেন না এবং বিক্রির অপরাধও করবেন না। দম্পতি মাথা নেড়ে সায় জানালো। কিন্তু কে শোনে কার কথা? কদিন পরে আবার ধরা খেলো। কষ্টে ধরা আসামি গাঁজা খাওয়ার অপরাধে আর কদিনই বা জেলে রাখা যায়? ছেড়ে দিতে হলো!
কেস স্টাডি-২॥ গাঁজাখোর দম্পতির মতো আরেক গাঁজাখোরকে পুলিশ ধরে আনলো। একই পদ্ধতিতে মামলাটা আমার কাছে আসে। এবারের আসামির বিশেষত্ব হলো সে কানা। একজন অন্ধ মানুষ গাঁজা খায় ভাবা যায়? তাকেও জামিনে মুক্ত করলাম। জামিন শুনানির সময় বিজ্ঞ বিচারক জিজ্ঞেস করলেন, গাঁজা খান কেন? সহজ সরল উত্তর দিল, স্যার, একটু গান-বাজনা করিতো। গাঁজা না খাইলে গান গাইতে পারি না। অন্ধ গাঁজাখোর ছিল বয়াতি টাইপের লোক। বিজ্ঞ বিচারক বললেন, গাজা খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে। উত্তরে আসামি বলে, স্যার তাইলে গান-বাজনা ছাইড়া দিতে হইবো। অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু গানও ছাড়তে পারি না গাঁজাও ছাড়তে পারি না। সেই অন্ধ গাঁজাখোরও একাধিকবার ধরা খেয়েছে। হাজতে রেখে জেল কর্তৃপক্ষও বিরক্ত। এবারও পুলিশের কষ্টে ধরা আসামি ছাড়া পেয়ে গেল।
কেস স্টাডি-৩॥ সরকারি চাকুরী করে এমন এক গাঁজাখোর ধরা পরলো। ছোট পদের চাকুরিজীবী। সারাদিন অফিসে কাজ-কর্ম করে। বিকালে, ছুটির দিনে ছুটে যায় গাঁজার টানে। একা একা খায় না। তার গাঁজার সঙ্গী পুলিশের এক পুত্র। একদিন পুলিশ পুত্রের সাথে গাঁজা খেয়ে ফিরছিল। মটরসাইকেল ড্রাইভ করছে পুলিশ পুত্র। পিছনে সঙ্গী গাঁজাখোর। টহল পুলিশ গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি করলো। গাঁজা পাওয়া গেল কয়েক পুরিয়া। আর পুলিশ পুত্রকে বাদ দিয়ে সেই ছোট সরকারি কর্মচারীকে দিল জেলে পুড়িয়া! কয়েকদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এলো। বেরিয়ে আবার সেই পুলিশ পুত্র বন্ধুটির সাথে গাঁজা খাওয়া। দুই গাঁজাখোরকে কষ্ট করে ধরে একজনকে দিল জেলে!
কেস স্টাডি-৪॥ ছোট্ট একটা ফটোকপির দোকান করে জীবিকা নির্বাহ করে এক যুবক। হঠাৎ এক দুপুরে ডিবি পুলিশের একটি টিম এসে দোকানের সামনের দিকে রাখা একটা নির্দিষ্ট ফাইল চাইলো। দোকানি বলল এই ফাইল বিক্রির জন্য নয়। একজন রেখে গেছে। ডিবির চৌকষ দল অন্য কোনো ফাইল নয় ঐ ফাইলই চাইলো। এর পর ফাইল খুলে পাওয়া গেল কয়েক পিস ইয়াবা ট্যাবলেট। ধরে নিয়ে যাবে ছেলেটিকে। স্থানীয় লোকজন ডিবির টিমকে আটকালো। জানতে চাইলো ঘটনা কী। অবশেষে বেরিয়ে এলো প্রকৃত ঘটনা। ছেলেটির মামাতো ভাইর সাথে ফরায়েজের জমি নিয়ে বিরোধ। ত্রিশ হাজার টাকায় দফারফা করে ঘটনার নকশা আঁকা হয়। যে ফাইলটি রেখেছিল সেই ছেলেটি বাইরে ডিবির এক কনস্টেবলের সাথে কথা বলছে দেখে স্থানীয় লোকজন তাকে ধরে আনলো। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায় ঘটনা বেরিয়ে এলে ডিবি পরিত্যাক্ত অবস্থায় ইয়াবাগুলো উদ্ধার দেখিয়ে ছেলেটিকে রেখে চলে যেতে বাধ্য হলো। কষ্ট করে ধরা আসামি আর নেওয়া হলো না আদালত পর্যন্ত!
কেস স্টাডি-৫॥ এই মামলাটা আমার নয়। জজ কোর্টে এক আসামির জামিন শুনানি চলছিল। এক বৃদ্ধকে ডিবি পুলিশ ইয়াবা সহ আটক করে আইনের হাতে সোপর্দ করেছে। এমন বৃদ্ধ যে ঘটনা জানার জন্য বিজ্ঞ বিচারক তাকে নানাভাবে প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন প্রকৃত ঘটনা কী? বৃদ্ধের কথা শুনে বিজ্ঞ বিচারক সন্তুষ্ট হয়ে জামিন মঞ্জুর করে পুলিশকে ভৎসনা দিল। আসামি এমনই বৃদ্ধ এবং সহজসরল গ্রাম্য লোক যে কিনা মায়া বড়িও চিনে না, জীবনে একটা সিগারেটেও টান দেয়নি। অথচ এমন এক বৃদ্ধকে প্রতিপক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইয়াবা দিয়ে চালান দিয়েছে। এবারও পুলিশের কষ্টে ধরা আসামি ছাড়া পেয়ে গেল!
একবার আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সদস্য পদে নির্বাচিত হয়ে শপথ নেওয়ার জন্য অনুষ্ঠানে বসে আছি। নির্বাচন পরবর্তী নবগঠিত কমিটিকে শপথ পাঠ করার বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান জেলার জজশীপের অন্য বিচারকগণ, জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি, পুলিশ সুপার সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। উক্ত অনুষ্ঠানে স্বঘোষিত কবি এবং পুলিশ সুপার উপস্থিত হয়ে তার ভাষণে বিজ্ঞ বিচারকদের অনুরোধ করলেন মাদক ব্যবসায়ীদের জামিন না দিতে এবং আইনজীবীদের অনুরোধ করলেন মাদকের আসামি ধরা পরার পর অন্তত তিন মাস জামিন না চাওয়ার জন্য। তিনি বললেন, এত কষ্ট করে পুলিশ মাদকের আসামিদের ধরে আনে আর বিচারকরা যদি জামিন দিয়ে দেন এবং আইনজীবীরা যদি জামিন চান তবে তাদের কষ্ট বৃথা যায়!
তার কথামত যদি জামিন না চাই তবে যাদের সাথে অবিচারগুলো হয় তাদের কী অবস্থা হবে? পুলিশের ধারণা দেখে মনে হয় মাদক বিস্তারে যেন আইনজীবীরাই বড় নিয়ামক এবং মাদক বিস্তার রোধে আইনজীবীরাই বড় বাধা! অথচ কোথায় কোথায় মাদক বিক্রি হয়, কারা কারা মাদক সেবন ও বিক্রির সাথে জড়িত তা সমাজের সবাই জানে শুধু জানে না পুলিশ!
মাদক নির্মূলে পুলিশের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার কাছে মনে হয়। ক্রসফায়ার দিয়ে বা জামিন না দিয়েই মাদক প্রতিরোধ করা যাবে না। আসুন মাদক প্রতিরোধে স্বচ্ছতার সাথে আন্তরিক হয়ে চেষ্টা করি।
বিচার বহির্ভূত হত্যা ॥ প্রেস রিলিজের বিষয় হতে পারেন আপনিও!
বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- যুগে যুগে সংঘটিত হয়ে আসছে। এ ধরনের হত্যাকা- আজ নতুন কিছু নয়। তবে আগে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- নিয়ে মানুষ এত মাতামাতি করতো না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ার কারণে মানুষের হাতের মুঠোয় মূহুর্তের মধ্যেই চলে যায় তথ্য। আবেগী মন সেই তথ্য ঘাটাঘাটি করে, সমালোচনা করে, আলোচনা করে, বিশ্বাস করে, কেউবা অবিশ্বাস করে, করে তথ্যের পোষ্টমর্টেম। মানুষ এখন আগের থেকে অনেক বেশি সচেতন এবং শিক্ষিত। ইচ্ছে করলেই যা-তা খাওয়ানো যায় না।
আমরা সবাই জানি, বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- হচ্ছে এক প্রকার বেআইনী হত্যাকা- যা সাধারণত রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, সামাজিক ব্যক্তিত্ব, বা অপরাধীকে রাষ্ট্রপ্রদত্ত আইনত বিচারের পূর্বেই হত্যা করা হয়। কিন্তু আমাদের সংবিধান এধরনের হত্যাকা- কখনোই অনুমোদন দেয়নি। সংবিধানের কিছু বিষয় বুঝতে রকেট সাইন্স বুঝার মত জ্ঞান প্রয়োজন নেই। সাধারণ কথাগুলো সাধারণভাবেই বুঝা যায়। কিন্তু সরকার কেন যে বুঝতে চায় না সেটাই মাথায় ধরে না। মৌলিক অধিকার পরিপন্থি আরো অনেক কাজ’ই সরকার করে থাকে সেটা যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যখন সরকারের আসনে বসে তখন জনগণকে তুচ্ছ মনে করে কাজগুলো করে থাকে। আর অন্যান্য দল বিরোধী আসনে বসে নীতি-নৈতিকতার বুলি ছোড়ে গোলার মতো। তখন তাদের পূর্বের কৃতকর্মের কথা মনে থাকে না।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- একটা মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কাজ। সংবিধানে মৌলিক অধিকার কী তা এখন গুগলে সার্চ দিলেই চলে আসে হাতের মুঠোয়। সংবিধানে মৌলিক অধিকারের কিছু বিষয় তুলে ধরছি যা আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে উল্লেখ আছে মৌলিক অধিকার সম্পর্কেঃ
আইনের দৃষ্টিতে সমতাঃ ২৭। সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
আইনের আশ্রয়-লাভের অধিকারঃ ৩১। আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষণঃ ৩২। আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচঃ ৩৩। (১) গ্রেপ্তারকৃত কোনো ব্যক্তিকে যথাসম্ভব শীঘ্র গ্রেপ্তারের কারণ জ্ঞাপন না করিয়া প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না এবং উক্ত ব্যক্তিকে তাঁহার মনোনীত আইনজীবীর সহিত পরামর্শের ও তাঁহার দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।
২) গ্রেপ্তারকৃত ও প্রহরায় আটক প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে গ্রেপ্তারের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের স্থান হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় ব্যতিরেকে হাজির করা হইবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ব্যতীত তাঁহাকে তদতিরিক্তকাল প্রহরায় আটক রাখা যাইবে না।
৩) এই অনুচ্ছেদের (১) ও (২) দফার কোনো কিছুই সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে না,
ক) যিনি বর্তমান সময়ের জন্য বিদেশী শত্রু, অথবা
খ) যাঁহাকে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোনো আইনের অধীন গ্রেপ্তার করা হইয়াছে বা আটক করা হইয়াছে।
৪) নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোনো আইন কোনো ব্যক্তিকে ছয় মাসের অধিককাল আটক রাখিবার ক্ষমতা প্রদান করিবে না যদি সুপ্রীম কোর্টের বিচারক রহিয়াছেন বা ছিলেন কিংবা সুপ্রীম কোর্টের বিচারকপদে নিয়োগলাভের যোগ্যতা রাখেন, এইরূপ দুইজন এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত একজন প্রবীণ কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত কোনো উপদেষ্টা-পর্ষদ উক্ত ছয় মাস অতিবাহিত হইবার পূর্বে তাঁহাকে উপস্থিত হইয়া বক্তব্য পেশ করিবার সুযোগদানের পর রিপোর্ট প্রদান না করিয়া থাকেন যে, পর্ষদের মতে উক্ত ব্যক্তিকে তদতিরিক্তকাল আটক রাখিবার পর্যাপ্ত কারণ রহিয়াছে।
৫) নির্বতনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোনো আইনের অধীন প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে আটক করা হইলে আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে যথাসম্ভব শীঘ্র আদেশদানের কারণ জ্ঞাপন করিবেন এবং উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে বক্তব্য-প্রকাশের জন্য তাঁহাকে যত সত্বর সম্ভব সুযোগদান করিবেনঃ তবে শর্ত থাকে যে, আদেশদানকারী কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় তথ্যাদি-প্রকাশ জনস্বার্থবিরোধী বলিয়া মনে হইলে অনুরূপ কর্তৃপক্ষ তাহা প্রকাশে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।
৬) উপদেষ্টা-পর্ষদ কর্তৃক এই অনুচ্ছেদের (৪) দফার অধীন তদন্তের জন্য অনুসরণীয় পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নির্ধারণ করিতে পারিবেন।
বিচার ও দ- সম্পর্কে রক্ষণঃ ৩৫। (১) অপরাধের দায়যুক্ত কার্যসংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না এবং অপরাধ-সংঘটনকালে বলবৎ সেই আইনবলে যে দ- দেওয়া যাইতে পারিত, তাঁহাকে তাহার অধিক বা তাহা হইতে ভিন্ন দ- দেওয়া যাইবে না।
(২) এক অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারীতে সোপর্দ ও দ-িত করা যাইবে না।
(৩) ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হইবেন।
(৪) কোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাইবে না।
(৫) কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দ- দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।
(৬) প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট কোনো দ- বা বিচারপদ্ধতি সম্পর্কিত কোনো বিধানের প্রয়োগকে এই অনুচ্ছেদের (৩) বা (৫) দফার কোনো কিছুই প্রভাবিত করিবে না।
সমাবেশের স্বাধীনতাঃ ৩৭। জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতাঃ ৩৯। (১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।
২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং
(খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।
আমাদের সংবিধান আমাদের কতটা অধিকার দিয়েছে তা উপরের লেখাগুলো পড়লেই বুঝা যায়। অথচ আমাদের মৌলিক অধিকার এখন এক যৌগিক অধিকারে পরিণত হয়েছে বা করেছে সরকার বাহাদুর। ১৯৭৫ সালে যখন বিচার বহির্ভূত হত্যা হতো তখন যে ফরমেটে প্রেস রিলিজ দেওয়া হতো এখনও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। সেই পূর্বের ছাপাকৃত ফরমেই মনে হয় প্রেস রিলিজ দেওয়া হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ৩ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এমনই এক প্রেস রিলিজ ছাপা হয়েছিল।
শরীয়তপুরের এক সোনার ছেলে সিরাজ সিকদার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সিরাজ সিকদার ছিলেন অকুতোভয় এক মুক্তিযোদ্ধা। বুদ্ধিদীপ্ত এ গেরিলা যোদ্ধার অসাধারণ ভূমিকা তাঁকে অমর ও অনুসরণীয় করে রেখেছে। বিপ্লব পাগল এ বীর গেরিলা যেমন যুদ্ধের মাঠে ছিলেন ভয়হীন, তেমনি রাজনৈতিক তত্ত্ব অধ্যয়ন-গবেষণা পরিচালনা করা, শ্রমিক-কৃষকের মাঝে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলা এবং তাতে নেতৃত্ব দেওয়া খুব অল্প বয়সেই তিনি রপ্ত করেছিলেন। সেই সিরাজ সিকদার ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার হন এবং পরদিন ২ জানুয়ারি গভীর রাতে তাঁকে হত্যা করা হয়। যদিও হত্যাকা-ের ১৭ বছর পর ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন এই বিষয়ে আদালতে মামলা করা হয়। সেই মামলা এখনো বিচারাধীন। কিন্তু হত্যার পর প্রেস রিলিজে যা লেখা ছিল তা দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশ পায়। দৈনিক ইত্তেফাকের সেই নিউজটি পড়লেই দেখবেন আজকের প্রেস রিলিজের সাথে কোনো পার্থক্য নেই। “গ্রেফতারের পর পলায়নকালে পুলিশের গুলিতে সিরাজ সিকদার নিহত
গতকাল (বৃহস্পতিবার) শেষ রাত্রিতে প্রাপ্ত পুলিশের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, ‘পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি’ নামে পরিচিত একটি গুপ্ত চরমপন্থী দলের প্রধান সিরাজুল হক সিকদার ওরফে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার করেন। একই দিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাহাকে ঢাকা পাঠানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক এক বিবৃতি দেন এবং তাহার পার্টি কর্মীদের কয়েকটি গোপন আস্তানা এবং তাহাদের বেআইনি অস্ত্র ও গোলাবারুদ রাখার স্থানে পুলিশকে লইয়া যাইতে রাজি হন। সেইভাবে ২রা জানুয়ারি রাত্রে একটি পুলিশ ভ্যানে করিয়া তাহাকে ওইসব আস্তানার দিকে পুলিশ দল কর্তৃক লইয়া যাইবার সময় তিনি সাভারের কাছে ভ্যান হইতে লাফাইয়া পড়িয়া পলায়ন করিতে চেষ্টা করেন। তাহার পলায়ন রোধ করার জন্য পুলিশ দল গুলিবর্ষণ করিলে তৎক্ষণাত ঘটনাস্থলেই তাহার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে সাভারে একটি মামলা দায়ের করা হইয়াছে। ‘এখানে উল্লেখ করা যায় যে, সিরাজ সিকদার তাহার গুপ্ত দলে একদল দুর্বৃত্ত সংগ্রহ করিয়া তাহাদের সাহায্যে হিং¯্র কার্যকলাপ, গুপ্তহত্যা, থানার উপর হামলা, বন অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ইত্যাদির উপর হামলা, ব্যাংক, হাটবাজার লুট, লঞ্চ ট্রেন ডাকাতি, রেল লাইন তুলিয়া ফেলার দরুণ গুরুতর ট্রেন দুর্ঘটনা, লোকজনের কাছ হইতে জোর করিয়া অর্থ আদায়ের মতো কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘিœত করিয়া আসিতেছিলেন।’
আমাদের দেশে বিগত প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু’ শব্দটি পরিচিতি লাভ করেছে। প্রতিটি ক্রসফায়ারে মৃত্যু পরবর্তী শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা থেকে একই ধরণের বক্তব্য দেওয়া হয়। আর বক্তব্যটি হলো আটক পরবর্তী পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলির কারণে মৃত্যু ঘটেছে অথবা আটক ব্যক্তিকে নিয়ে তার দেখানো মতে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে তার অনুগত বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া পরবর্তী আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়লে মৃত্যু হয়েছে। এ নাটকের একটাই কাহিনী শুধু কুশিলবের পরিবর্তন ঘটে থাকে। এ ধরণের মৃত্যুকে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বলা হয় এবং যে কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের জন্য এ ধরণের হত্যাকা- চালানো বিচার বহির্ভূত এবং আইনবিরুদ্ধ। নরহত্যা গুরুতর ও নিকৃষ্ট ধরণের অপরাধ। দেশভেদে নরহত্যার সাজা মৃত্যুদ- অথবা যাবজ্জীবন কারাদ-। মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে কোনো কার্য দ্বারা মৃত্যু ঘটানোকে দন্ডার্হ (ঈঁষঢ়ধনষব ঐড়সরপরফব) নরহত্যা বলা হয়। দন্ডার্হ নরহত্যাকে খুন হিসেবে গণ্য করা হয়। বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- আইন দ্বারা স্বীকৃত নয় বিধায় এটি দন্ডার্হ নরহত্যা অথবা খুন।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস জন্মানো না যাবে যে, মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে হত্যাকা- সংগঠিত হয়নি ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করার সঙ্গত কারণ থাকে যে, প্রকৃতই হত্যাকা-টি মৃত্যু ঘটানোর অভিপ্রায়ে সংগঠিত হয়েছে। আমাদের দেশে কমিউনিষ্ট নেতা সিরাজ শিকদার পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়ার পরের দিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় আটকাবস্থা থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গুলি করা হলে তার মৃত্যু ঘটে। সে সময়কার পুলিশের বক্তব্যটি দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, যদিও তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী সিরাজ শিকদারের মৃত্যু পরবর্তী জাতীয় সংসদে দম্ভভরে বলেছিলেন-‘কোথায় সিরাজ শিকদার?’ সিরাজ শিকদার বা তার বাহিনী কর্তৃক হত্যাকা- বা অপরাধ সংগঠিত হয়ে থাকলেও এ জন্য বিচার বহির্ভূতভাবে তাকে হত্যা আইনের শাসনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট ক্ষমতসীন হলে কোনো এক অজানা কারণে শৃঙ্খলা বাহিনীর অর্ন্তভূক্ত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ওই অভিযানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং কথিত সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত এমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়। এ হত্যা পরবর্তী অপারেশন ক্লিন হার্ট কার্যক্রমকে দায়মোচন দেওয়া হয় যেমন দায়মোচন দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ হত্যাকা- সংগঠন পরবর্তী।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধ্যাদেশ, ১৯৭৯ তে সংশোধনীর মাধ্যমে ২০০৩ সালে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গঠন করা হয়। র্যাবে পুলিশ, সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। র্যাবকে অপরাধ তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হলেও মামলা রুজু ও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দ্বারস্থ হতে হয়। তাছাড়া সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইনে যে বিধান রয়েছে সে বিধান অনুযায়ী র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর কোনোরূপ কালক্ষেপণ না করে অপরাধীকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করাই সংবিধান ও প্রচলিত আইন। কিন্তু কয়টি ক্ষেত্রে হস্তান্তর করা হয় সে বিষয়ে দেশবাসী সন্ধিহান। ক্রসফায়ারে মৃত্যু ঘটানোর ব্যাপারে র্যাবের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ অনুরূপ অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধেও রয়েছে।
আমরা আগেই জেনেছি সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৬১ তে সুষ্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, গ্রেপ্তারকৃত একজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে যাত্রার সময় ব্যতিরেকে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির করতে হবে। কিন্তু র্যাব বা পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তার পরবর্তী যে সব ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে নিহত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় সংবিধানের ৩৩(২) অনুচ্ছেদ এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৬১ এর বাধ্যবাধকতা অনুসরণ না করেই অপরাধীদের এ দু’টি বাহিনী গ্রেপ্তারের সঠিক দিন-তারিখ গোপন রেখে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনা সংগঠনের প্রয়াস নিয়েছে।
পুলিশ, র্যাব, শৃঙ্খলা বাহিনী অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যে কোনো সদস্য কোনো অপরাধী বা তার অনুগত বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার্থে কতটুকু শক্তি বা বল প্রয়োগ করতে পারবে তাও আইন দ্বারা নির্ধারিত। এ বিষয়ে দ-বিধির ধারা ৯৭-এ মনুষ্য দেহ ক্ষুন্নকারী যে কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে তার স্বীয় দেহ ও অন্য যে কোনো ব্যক্তির দেহের প্রতিরক্ষার অধিকার দেওয়া থাকলেও সে অধিকারের ব্যাপ্তি এতটুকু বিস্তৃত নয় যে, এ যাবৎকাল ক্রসফায়ারের নামে যে অসংখ্য হত্যাকা- সংগঠিত হয়েছে তাতে একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তিতে ক্রসফায়ারের যৌক্তিকতা ও গ্রহণযোগ্যতার সৃষ্টি হয়। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত এবং এ তিনটি বাহিনী ব্যতীত অন্য কোনো বাহিনীকে আইনী ঘোষণার মাধ্যমে শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত করা হলে সে বাহিনীটিও আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী হবে। অপরদিকে বিভিন্ন আইনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলতে পুলিশ বাহিনী, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, আনসার বাহিনী, ব্যাটালিয়ন আনসার, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, কোস্ট গার্ড বাহিনী ও শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহকে বুঝানো হয়েছে। উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে দেখা যায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অন্তর্ভূক্ত সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর সদস্যরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অন্তর্ভূক্ত হলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে অপরাপর বাহিনী যতক্ষণ পর্যন্ত আইন দ্বারা শৃঙ্খলা বাহিনী হিসেবে ঘোষিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ সকল বাহিনী বা এর কোনো একটি শৃঙ্খলা বাহিনী নয়।
আমাদের দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের ব্যাপারে দেশের সচেতন নাগরিকসহ সুশীল সমাজ দীর্ঘদিন যাবৎ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজ বক্তব্য তুলে ধরছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাসমূহের অবস্থান একই। বিগত বছরগুলোর ক্রসফায়ারের ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায় একই ধরণের ঘটনা বিএনপি, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় সংগঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এ দু’টি দল বিরোধী দলে থাকাবস্থায় একে অপরের শাসনামলে সংগঠিত ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ব্যাপারে সোচ্চার থাকলেও ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় এরা কেউ এ ধরণের ঘটনা থেকে নিজেদের নিবৃত্ত রাখতে পারেনি।
দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকা- নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশের ওপর ন্যস্ত। পুলিশ ব্যর্থ হলে অন্যান্য বাহিনীর সহায়তা নেওয়ার বিধান থাকলেও তা কখনও পুলিশের মামলা রুজু ও অভিযোগপত্র দায়েরের ক্ষমতাকে খর্ব করে না। পুলিশ বাহিনীর সদস্যের মতো শৃঙ্খলা বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বাহিনীসমূহের প্রতিটি সদস্যের নিজ সম্পাদিত যে কোনো কর্মের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা রয়েছে। সরকারের প্রশ্রয়ে জবাবদিহিতায় শিথিলতার কারণে একই ব্যাখ্যার পুনরাবৃত্তিতে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে চলছে। এতে করে সরকারে থাকাকালীন বিরোধীদের দমন করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হলেও তাতে কি পূর্ণ সফলতা পাওয়া যায়? আর সে প্রশ্নে না গিয়ে বরং প্রশ্ন হতে পারে কেন এ বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-? তাছাড়া এখনকার সরকারী দল ও দলের নেতাকর্মী ক্ষমতা থেকে বিদায় পরবর্তী একই ঘটনার শিকার যে হবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়? বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বিনা বিচারে হত্যাকা-ের সাথে তুল্য।
পোশাকধারী বা পোশাকবিহীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য কর্তৃক বাড়ি অথবা যে কোনো স্থান থেকে তুলে নিয়ে হত্যা ও গুমের ঘটনা সাম্প্রতিককালে ক্রসফায়ারের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে। এ ধরণের হত্যাকা-ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের অন্তর্ভূক্ত। ক্রসফায়ারের সাথে এ হত্যাকা-ের পার্থক্য হলো ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন লাশটি ফিরে পেয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করতে পারে যেটি গুমের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। এমনকি তুলে নেওয়া পরবর্তী লাশ ফেরত না পাওয়া গেলে নিহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনদের দীর্ঘকাল এ ধারণাটি বদ্ধমূল থাকে যে, হয়তোবা তুলে নেওয়া ব্যক্তি জীবিত রয়েছে। এ ধরণের ঘটনা যে কতটুকু বেদনাদায়ক তা ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য ছাড়া কেউই অনুভব করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হেফাজতে থাকাকালীন মৃত্যু হলে এই মৃত্যুর সন্তোষজনক কারণ দেখাতে হবে এবং তার না পারলে তার দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সদস্য বা সদস্যদের উপরই বর্তাবে।
বিচার বহির্ভূত হত্যাকা-ের দায় থেকে অব্যাহতি পেতে অপারেশন ক্লিন হার্ট কার্যক্রমকে দায়মোচন দেওয়া হয় যেমন দায়মোচন দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ হত্যাকা- সংগঠন পরবর্তী। দীর্ঘদিন পর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে সেই দায়মোচন ভেদ করে হত্যাকারীদের আইনের আওতায় এনে ঠিকই বিচার করেছিলেন। বিচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হত্যাকারীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জঘন্য কর্মের শাস্তি দেওয়া হয় যা সকলের কাছে একটি প্রশংসনীয় কাজ বলে বিবেচিত হয়েছে। আমরা কে বলতে পারি যে আজকের বিচার বিভাগীয় হত্যার বিচার একদিন নিহতের সন্তান বা প্রজন্ম করবে না? বিচার বহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ ও জবাবদিহিতার আওতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আনতে না পারলে একদিন আপনিও হতে পারেন প্রেস রিলিজের অংশ। আজ আপনি ক্ষমতাবান কাল নাও থাকতে পারেন। তাই সংবিধানের মৌলিক অধিকার পরিপন্থি কাজ বন্ধ না করলে একদিন আফসোস করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না আজকের ক্ষমতাবানদের। তাইতো ভয় হয়, কখন যে কে প্রেসরিলিজ হয়ে যাবেন তা কেউ জানি না।
বাবার কষ্ট ও বাবা হওয়ার তৃপ্তি ॥ বাবা সেকালে ও একালে
আজ বাবা দিবস। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে এসব দিবস পালনে যদিও বিশ্বাসী নাই। তবুও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিবসের মাতামাতিতে কিছু লিখতে মন চাইলো। বাবা হওয়া অনেক তৃপ্তির, পাশাপাশি বাবা হওয়া অনেক কষ্টেরও। বাবা সেকালে ও বাবা একালে কেমন অনুভূতি তাই শেয়ার করতে আজকের এ লেখা। বাবাকে ভালোবাসুন। বাবা আপনার আরেক সন্তান।
বাবার আভিধানিক সংজ্ঞা খুঁজলে যা পাওয়া যায় তা হলো, পিতা একজন পুরুষ অভিভাবক হিসেবে যে কোনো ধরণের সন্তানের জনক হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকেন। তিনি যে কোনো সন্তানের পুরুষ জন্মদাতা। মাতা-পিতার বিপরীত লিঙ্গ। পিতার বিভিন্ন প্রতিশব্দ হলো- জনক, আব্বা, আব্বু, বাবা, বাজান, জন্মদাতা ইত্যাদি। হাল আমলে ড্যাডি থেকে ড্যাড হয়ে গেছে পিতা। তিনি সন্তানের জন্মদানের লক্ষ্যে এক্স (স্ত্রীলিঙ্গ) অথবা ওয়াই (পুংলিঙ্গ) ক্রোমোজোম ধারণকারী বীর্য স্বীয় স্ত্রীর জননতন্ত্রে প্রবেশ করান।
সংজ্ঞায় যাই থাকুক না কেন বাবা হওয়া সহজ কাজ না। স্ত্রীর প্রজননতন্ত্রে বীর্য প্রবেশ না ঘটিয়েও অনেকে বাবা হয় আবার ডজন খানেক সন্তান জন্ম দিয়ে কেউ কেউ বাবা হতে পারেন না। একজন বাবা বা অভিভাবক কোনো কোনো সময় হয়ে ওঠে সন্তানদের বাবা, কখনো সমাজের বাবা, কখনো রাষ্ট্রের বাবা, কখনোবা সারা জাহানের। প্রকৃত বাবা হতে মাথার ঘাম পায়েই শুধু নয় হাজার ত্যাগের বিনিময়ে হতে হয় বাবা। সন্তানের সুখের জন্য, নিñিদ্র নিরাপত্তার জন্য যুগে যুগে বাবারা নিজ নিজ সাধ, আহ্লাদ ত্যাগ করে নিজের সর্বস্ব দিয়ে হয়ে ওঠেন বাবা। তাইতো বাবাদের তুলনা শুধু বাবাই। বাবারা সর্বদা নীরবে নিভৃতে কাজ করে যায়। বাবাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশটা এতই কম যে আমরা বাবা না হওয়া পর্যন্ত সেটা অনুভব করতে পারি না। যখন অনুভব করি তখন হয়তো অনেকের বাবাই আর থাকে না। আমরা তখনই বাবার অবদানের কথা বুঝতে পারি যখন নিজে বাবা হয়ে যাই।
একজন বাবা যখন সমাজকে একটি সুসন্তান উপহার দেয় তখনই বাবার তৃপ্তি আসে। কুসন্তানের জন্য বাবার চেষ্টার ত্রুটি থাকে না কিন্তু বেপরোয়া সন্তান কখনো কখনো কুসন্তানে পরিণত হয়, তখন তৃপ্তির পরিবর্তে বাবাকে কষ্টের গ্লানি ভোগ করতে হয়। একটা প্রবাদ শুনেছিলাম, পৃথিবীতে অনেক খারাপ পুরুষ পাওয়া যায় কিন্তু কখনো খারাপ বাবা পাওয়া যায় না। আর যদি পাওয়া যায় তবে সে কখনো বাবাই হয়নি বা ছিলনা। একজন বাবা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে বাড়ি ফিরে তা কখনো প্রকাশ করে না। তাইতো যুগে যুগে সন্তানরা বাবার হাতটাকে শক্ত করে ধরে রাখে অবলম্বন হিসাবে।
প্রতিটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়ার পরপরই বাবা হিসাবে আবির্ভূত হয়। পিতা পরম আদরে সন্তানকে বাবা বলেই ডাকে। বাবা কত প্রিয় ডাক, কতটা আদরের ডাক তা বাবার মুখে বাবা ডাক শুনলেই অনুভব করা যায়। পরম আদরে পরিবারের রাখা নামটা বাবার কাছে শুধু কাগজেই থেকে যায়, পুত্রসন্তানটিকে বাবা বলেই ডাক দেয় পিতা। যখনই বাইরে থেকে আসবে সন্তান দৌড়ে যায় বাবার কাছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে কোলে তুলে নেয়, বাবা বাবা বলে, খোঁজ নেয় খেয়েছে কিনা, নেয়েছে কিনা, খেলেছে কিনা এমন হাজারো প্রশ্ন। কখনো দেখে না সন্তানের গায়ে ময়লা আছে কিনা। আস্তে আস্তে সেই সন্তান বড় করার লড়াই করে একাই। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তুু টাকার যোগান দিতে হিমশিম খায় তবুও অপারগতা প্রকাশের চেষ্টা পারতপক্ষে করে না। বাবার আনন্দ মিশে যায় সন্তানের আনন্দের মাঝে। এভাবেই বাবা হয়ে ওঠে বাবা।
সন্তান বড় হয়ে বিয়ে করে, সংসারী হয়। তখনো বাবার চিন্তা কমে না। এরপর সন্তানও একদিন সন্তানের বাবা হয়। এবার সন্তান বাবার মর্ম বুঝতে শিখে। বাবা বৃদ্ধ হলেও সন্তানের জন্য চিন্তা কমে না। কখন সন্তান বাড়ি ফিরলো, বাইরে বাইরে ঘোরে, কাজ করে ঠিকমত খেয়েছে কিনা, শরীরের প্রতি যতœ নিচ্ছে কিনা সেই খোঁজ নেয়। সন্তান যত বড়ই হোক বাবার কাছে সে যেন ছোটই। বাবা হওয়ার পর মৃত্যু পর্যন্ত বাবার চেষ্টা, বাবার চিন্তা, বাবার ভালোবাসা, বাবার দোয়া কখনো পরিবর্তন হয় না। তাইতো বাবারা বাবা।
কষ্ট হয় যখন দেখি বাবারা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। কষ্ট হয় যখন বাবারা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় দু’চোখের কোন বেয়ে অশ্রু ফোঁটা ঝরে পড়ে। কষ্ট হয় যখন বাবারা সন্তানের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। বাবা তো তাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করেছেন সন্তানের জন্য। কিন্তু সন্তান বড় হয়ে কেন বাবা হতে পারলো না এ প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরপাক খায়। জন্মের পর থেকে যে সন্তানকে বাবা বাবা ডাকে বৃদ্ধ বয়সে সে সন্তান কেন বাবার জন্য বাবা হয়ে উঠতে পারে না তা মাথায় ধরে না।
বাবাকে ভালোবাসুন। বাবাকে ভালোবাসার প্রতিদান আপনার সন্তান দেবে নিশ্চিত থাকুন। নিজ সন্তানকে ভালোবেসে আজ বাবা ডাকছেন, ভালোবাসছেন, আদর, যতœ, ¯েœহ করছেন। আপনিও যখন ছোট ছিলেন আপনার বাবাও আপনাকে বাবা ডেকেছেন, ভালোবাসেছেন, আদর, যতœ, ¯েœহ করেছেন। তাই তুচ্ছ বিষয়কে বড় করে দেখে বাবার প্রতি অবহেলা করা কোনো মানব সন্তানের ঠিক হবে না। মানুষ বৃদ্ধ হলে শিশুর মতো হয়ে যায় একথা আমরা সকলেই বলি এবং বিশ্বাস করি। তাহলে আপনার সন্তানকে ভালোবাসার সাথে সাথে বৃদ্ধ সন্তানটাকে অবহেলা করবেন কেন? সন্তান হারালে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সন্তান পাবেন কিন্তু বাবা হারালে জীবনে আর বাবা পাবেন না। তাই বাবা দিবসে সকল সন্তানের প্রতি আকুল আবেদন, বাবাকে ভালোবাসুন। বাবাকে বুঝান, বাবা আমি তোমার পাশে আছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমার বাবা, তুমি আমার আরেক সন্তান।
বিচার বিভাগ ও চিকিৎসা দু’ই আস্থার জায়গা ॥ বিতর্ক করলেই ক্ষতি
গত ৩০ জুন ২০১৮ তারিখে দেশের জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম একটি সংবাদ প্রচার করে যার শিরোনাম ‘চট্টগ্রামে ভুল চিকিৎসায় শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ’। সংবাদটি প্রকাশের আগেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকটা ভাইরাল হয়ে যায়। একটি মাসুম শিশুর সাথে তার বাবার ছবি এবং পরবর্তীতে বাবার কোলে কাফনে মোড়া সেই মাসুম শিশু, কী হৃদয় বিদারক চিত্র সেটা ভাবা যায়? প্রবাদেই আছে, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ।’ তাই ছবি দেখে সকলেরই হৃদয় ভেঙে চৌচির। এ মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ, মানব বন্ধন, চিকিৎসক আটক করে কী হয়েছে? শুধু আস্থার জায়গায় ভাঙ্গন ধরেছে মাত্র। আস্থার জায়গা নিয়ে বিতর্ক করলে ক্ষতি হবে আমাদেরই।
বিচার বিভাগ ও চিকিৎসা সেবা দুটি স্পর্শকাতর বিষয়। দুটির উপরই আমাদের আস্থা রাখতে হয়। আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজে-কর্মে যদি ক্ষুব্ধ হই, ক্ষতিগ্রস্থ হই তবে ছুটে যাই বিচার বিভাগের কাছে। আদালতে গিয়ে মামলা করি, বিচার চাই এবং বিচার পাই। বিচার কখনো কখনো কারো পছন্দ হয় আবার কারো পছন্দ হয় না। যার পক্ষে যায় বা পছন্দ হয় সে বলে ন্যায় বিচার পেয়েছি আর যার বিপক্ষে যায় বা পছন্দ হয় না সে বলে আমি ন্যায় বিচার পাইনি। ন্যায় বিচার পাইনি মনে হলে আবার সেই বিচারকের দাড়ে কড়া নাড়ি, উচ্চ আদালতে যাই, আপীল করি, রিভিশন করি, রিভিউ করি। আস্থার জায়গা বলেই না বারবার যাই, বারবার যেতে হয়।
অপর দিকে আমরা শারীরিক কোনো সমস্যা হলেই চিকিৎসকের কাছে ছুটে যাই। চিকিৎসকরা আমাদের চিকিৎসা করেন, কখনো ভালো হই, কখনো হই না। ভালো না হলে আমরা আরো অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসকরা তাদের মেধা, জ্ঞান উজার করে দিয়েই আমাদের জন্য লড়েন। কোনো চিকিৎসকই চান না তার রোগী ‘ভালো না হোক’। এটাও আমাদের একটা আস্থার জায়গা। আমাদের এই আস্থার জায়গাগুলোতে বারবার যেতে হয়। আস্থা হারালে আর কারো ক্ষতি না হলেও ক্ষতি হবে আমাদেরই। তাই আস্থার জায়গাগুলোকে ঢালাওভাবে কালিমা লেপন করে নষ্ট করা ঠিক না।
সংবাদটিতে লেখা ছিল-‘চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় আড়াই বছর বয়েসী এক শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ম্যাক্স হাসপাতালে শুক্রবার গভীর রাতে শিশুটি মারা যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সকে পুলিশ ধরে থানায় নিলেও পরে ছেড়ে দেয়। শিশুটির মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। মারা যাওয়া শিশু রাইফা দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুবেল খানের মেয়ে।
রুবেল খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ঠা-া লেগে গলা ব্যথা করায় রাইফা খাওয়া বন্ধ করে দিলে বৃহস্পতিবার বিকালে ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাকে। ওই রাতে রাইফাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে সে অস্বস্তি বোধ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা শিশু বিশেষজ্ঞকে কল দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর শিশু বিশেষজ্ঞ বিধান বড়ুয়াও একই ধরণের ওষুধ দেন জানিয়ে রুবেল বলেন, রাতে ওই ওষুধ দেওয়ার পর থেকে রাইফার খিঁচুনি শুরু হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসককে জানালে তিনি ডা. বিধান বড়ুয়ার সাথে কথা বলে ‘সেডিল’ ইনজেকশন পুশ করেন। এরপর রাইফা নিস্তেজ হয়ে যায়।
রুবেল খানের মেয়ের মারা যাওয়ার খবর পেয়ে রাতেই ম্যক্স হাসপাতালে ছুটে যান সাংবাদিকরা। তাদের প্রতিবাদের মুখে পুলিশ গিয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে রাতে কয়েকজন সহযোগী নিয়ে থানায় উপস্থিত হন চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ’র চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল ইকবাল। এরপর ভোরে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর আটক চিকিৎসক ও নার্সকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে জানান চকবাজার থানার ওসি আবুল কালাম।
চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়েনের (সিইউজে) সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সাংবাদিক, বিএমএ ও পুলিশের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের পর একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে প্রধান করে গঠিত কমিটিতে বিএমএ প্রতিনিধি, সিইউজে প্রতিনিধি, বিএমএ ও সিইউজে’র পক্ষ থেকে একজন করে শিশু বিশেষজ্ঞ থাকবেন। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে জানিয়ে হাসান ফেরদৌস বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শিশুটির মৃত্যুর বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এই ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন করে তদন্তের মাধ্যমে ‘দোষী’ ব্যক্তিদের শাস্তি চেয়েছে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারা। বিএমএ নেতা ফয়সাল ইকবালের আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন তারা।
আমার পরিবারে সাড়ে তিন বছরের একটি কন্যা শিশু আছে। ও আমার অত্যন্ত আদরের সন্তান। আমি জানি সন্তানের প্রতি প্রতিটি মানুষের মমত্ববোধ ও ভালোবাসা কতটা গভীর হয়। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হোক আর সাংবাদিক রুবেলের সন্তান, চিকিৎসকের সন্তান হোক আর দিন মজুরের সন্তান, আইনজীবীর সন্তান হোক আর বিচারকের সন্তান, সকল পিতা-মাতার কাছেই যারযার সন্তানের গুরুত্ব সমান। যে কোনো মানুষ মারা গেলেই মানুষের হৃদয় কাঁদে, তা যদি হয় ফুটফুটে শিশু তাহলে তো কথাই নেই। তাই সাংবাদিক রুবেলের কন্যা রাইফার মৃত্যু সকলকে কাঁদিয়েছে। সাংবাদিক রুবেলের কন্যার মৃত্যুতে আমাদের সমবেদনা আছে। কিন্তু সাংবাদিক রুবেলের কন্যা কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় মারা যায়নি। সে কোনো সন্ত্রাসীর গুলিতে মারা যায়নি অথবা মারা যায়নি কোনো দুর্ঘটনায়। সে মারা গেছে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। আর পৃথিবীর কোনো চিকিৎসকই চায় না তার রোগী মারা যাক। চিকিৎসাবস্থায় রোগীর মৃত্যু হতেই পারে। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ আনাটা কতটুকু যৌক্তিক হয়েছে আমার বোধগম্য নয়।
আমি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত ছিলাম। দেশের প্রধান দুইটি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও কালের কন্ঠ পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সাংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা পত্রিকা কর্তৃপক্ষ বারবার শিখিয়েছে। কোনো কাজকে ভুল বলতে চাইলে ঐ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েই একমাত্র বলা যাবে যে কাজটা ভুল হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক রুবেলের কন্যা একজন শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন, ঐ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা পদ্ধতি ভুল ছিল এমন মতামত ঐ চিকিৎসকের চেয়ে বড় কোনো বিশেষজ্ঞর মন্তব্য সংবাদে সন্নিবেশ করা হয়নি যা সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতার সাথে বেমানান।
‘রুবেল খান বলেছেন, ঠা-া লেগে গলা ব্যথা করায় রাইফা খাওয়া বন্ধ করে দিলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ওই রাতে রাইফাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হলে সে অস্বস্তি বোধ করে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা শিশু বিশেষজ্ঞকে কল দেওয়ার পরামর্শ দেন। এরপর শিশু বিশেষজ্ঞ বিধান বড়ুয়াও একই ধরনের ওষুধ দেন জানিয়ে রুবেল বলেন, রাতে ওই ঔষধ দেওয়ার পর থেকে রাইফার খিঁচুনি শুরু হয়। দায়িত্বরত চিকিৎসককে জানালে তিনি ডা. বিধান বড়ুয়ার সাথে কথা বলে ‘সেডিল’ ইনজেকশন পুশ করেন। এরপর রাইফা নিস্তেজ হয়ে যায়।’
ঠা-াজনিত সমস্যার কারণে তাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া এবং সেডিল ইনজেকশন দেওয়া ঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে সেটা সাংবাদিক বা উকিলের বা ব্যবসায়ীর পক্ষে কি নিরুপন করা সম্ভব? এটা ভুল না সঠিক তা বলার মতো একমাত্র অথরিটি আরেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া আর কেউ হতে পারে কি?
একটা ব্যক্তিগত বিষয় একটু শেয়ার করি। আমার বন্ধু শিশু বিশেষজ্ঞ। আমার মেয়ে জন্ম নেয়ার পূর্ব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার কথার বাইরে একফোঁটা পানিও না খাওয়াতে চেষ্টা করি। কাল মেয়ের কানের ব্যথার কারণে তাকে ফোন দিলে আমাকে একটা অ্যান্টিবায়োটিক আর নাকের ড্রপ নেওয়ার পরামর্শ দেন আর যদি ব্যথা বেশি মাত্রায় হয় তবে ব্যথার সাপোজিটরি নিয়ে রাখতে বলল।
আমরা সাধারণভাবে জানি, সর্দির কারণে নাক যদি বন্ধ হয়ে যায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয় তবে নাকে ড্রপ দিতে হয়। আর ঠা-াজনিত জ্বর হলে যদি নাপা খাওয়ানোর পরেও সুস্থ না হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। আমার মেয়ের হয়েছে কানের ব্যথা। তাকে যে ঔষধ দেওয়া হয়েছে আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে বাজার থেকে কিনে নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করছি এবং যথাযথ ফল পেয়েছি। নাকের ড্রপ দেওয়ার পরপরই মেয়েতো উপর্যুপরি বমি এবং কান্না করা শুরু করে দিয়েছে। এখন আমি কি আমার ডাক্তারকে বলবো যে সে ভুল চিকিৎসা দিয়েছে? কানে ব্যথা হয়েছে, কানের তো কোনো ঔষধ দিল না! সর্দি হয় নাই, নাক বন্ধ হয় নাই অথচ নাকের ড্রপ দিল কেন? আমাদের পক্ষে কি জানা সম্ভব যে চিকিৎসাটা ভুল না সঠিক? এটা হলো আস্থার জায়গা। ডাক্তারের উপর আস্থা রাখতে হবে, রেখেছি, রাখি এবং রাখবো।
চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএর চট্রোগ্রামের এক নেতা নাকি হুমকি দিয়েছে যে ‘সাংবাদিকদের এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের চিকিৎসা করবেন না’। পরবর্তীতে ঐ চিকিৎসকের ফেসবুক থেকে জেনেছি যে তিনি ঐ কথা বলেনি। তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম সে বলেছে। যদি বলে থাকে তবে কী দাঁড়ালো? আস্থার জায়গায় চির ধরানো হলো। এখন সাংবাদিকরা কোথায় যাবে? তারা কি উকিলদের কাছে চিকিৎসার জন্য যাবে না সাংবাদিকদের কাছে, তারা কি ব্যাংকারদের কাছে যাবে না ব্যবসায়ীদের কাছে? আমাদের চিকিৎসকদের কাছেই যেতে হবে। তদন্ত কমিটি হয়েছে, সেখানেও সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে শিশু বিশেষজ্ঞ দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। তাহলে বিষয়টা কী হলো? সেই চিকিৎসকেরই স্মরনাপন্ন হতে হলো। তাই আস্থার জায়গা নষ্ট করতে নেই।
রুবেলের প্রতি গভীর সমবেদনা ও রাইফার জন্য ভালোবাসা জানিয়েই একটা কথা বলছি। প্রতিদিন কতইনা শিশু মারা যাচ্ছে। কয়টা শিশু মৃত্যু নিয়ে সাংবাদিকগণ মানববন্ধন করেন? কয়টা শিশু মৃত্যুর জন্য হাসপাতাল ঘেরাও করে চিকিৎসক আটক করান? কয়টা শিশু মৃত্যুর জন্য প্রতিবাদ সমাবেশ, মানব বন্ধন, মামলা হামলা, তদন্ত কমিটি গঠনে চাপ প্রয়োগ করেন? নিজ পেশার স্বজন মারা যাওয়ায় এসব করে আস্থার জায়গা নষ্ট করা কি ঠিক হবে? আমাদের কিন্তু ঐ জায়গাগুলোতেই যেতে হবে বারবার, তাই আস্থার জায়গাগুলো নষ্ট করা ঠিক হবে না।
তেঁতুল, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে স্বাদ বদলায়
তেঁতুল বা তিন্তিড়ীর বৈজ্ঞানিক নামঃ ঞধসধৎরহফঁং রহফরপধ, ইংরেজি নামঃ গবষধহবংরধহ ঢ়ধঢ়বফধ এটি ঋধনধপবধব পরিবারের ঞধসধৎরহফঁং গণের অন্তর্ভূক্ত টক স্বাদযুক্ত ফলের গাছ। এটি এক প্রকার টক ফল বিশেষ। আলঙ্কারিক অর্থে পাজি, দুষ্ট, বদমাশ মানুষকে তেঁতুলে লোক বলা হয়ে থাকে।
তেঁতুলে টারটারিক এসিড থাকায় খাবার হজমে সহায়তা করে। পেটের বায়ুু, হাত-পা জ্বালায় তেঁতুলের শরবত খুব উপকারী। রক্তে কোলস্টেরল কমানোর কাজে আধুনিককালে তেঁতুল ব্যবহার হচ্ছে। জ্বরে ভোগা রোগীর জ্বর কমানোর জন্য এ ফল ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও স্কেলিটাল ফ্রুরোসিস(ংশবষবঃধষ ভষঁড়ৎড়ংরং) রোগের প্রকোপ হ্রাস করতেও এটি ব্যবহৃত হয়। পাকা তেঁতুল ভিজিয়ে রেখে সকালে শুধু পানি খেলে হাত-পায়ের জ্বালা কমে। তেঁতুল দেখলে শুধু ছেলেদেরই নয়, মেয়েদেরও লালা ঝরে। চটপটি, ফুচকায় মেয়েদের পছন্দের তালিকায় তেঁতুল গোলা টকই পছন্দের শীর্ষে। তেঁতুলের ফলই শুধু উপকারী নয়, তেঁতুল গাছেরও আছে অনেক ব্যবহার। মাংস কাটাকুটিতে কসাইরা, কোরবানীর সময় আম জনতা তেঁতুল গাছের ছোট ছোট টুকরা ব্যবহার করে। তবে তেঁতুল গাছের মুগুর মানুষকে শায়েস্তা করতে বেশ ওস্তাদ। তাই তেঁতুলের মুগুর হতে সাবধান থাকতে হবে।
কিন্তু আমাদের দেশে গোত্র ভেদে তেঁতুলের স্বাদ বদলায়। তেঁতুল যদি শত্রুর ঘাড়ে ওঠে তবে তা টক আর নিজের ঘরে ওঠে তবে তা অতিশয় মিঠা হয়ে থাকে। আমাদের রাজনীতিতে তেঁতুলের অবস্থান বেশ মজবুত।
দেশে তেঁতুল ফলের সাথে আরেকটি নামও বেশ পরিচিত। তা হলো তেঁতুল হুজুর। এক হুজুর মেয়েদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করেছিলেন। মেয়েরা নাকি তেঁতুলের মতো, দেখলে লালা ঝরে! সেই তেঁতুল হুজুর যখন ১৩ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামেন তখন অনেকেই সমর্থন দিয়েছিলেন, অনেকে করেছিলেন বিরোধীতা।
যখন তেঁতুল হুজুর আন্দোলনে ব্যস্ত তখন এক নেত্রী সমাবেশে বলেছিলেন, “আলেমরা দাবি-দাওয়া নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মহানবী (সা.) এর বিরুদ্ধে যারা বাজে কথা বলেছেন, তাদের শাস্তির দাবিতে আলেম-উলামারা এই আন্দোলন করছেন। তার জন্য আমি তাদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাই।” তিনি আরো বলেন, “দেশের আলেম-উলামারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিয়েছেন। আমরা মনে করি, গণতান্ত্রিক দেশে সবারই গণতান্ত্রিক কর্মসূচি করার অধিকার রয়েছে। সরকারকে বলব, তাদের কর্মসূচিতে বাঁধার সৃষ্টি করবেন না।”
আর অপর নেত্রী তখন তেঁতুল হুজুর সম্পর্কে বলেছিলেন “মহিলাদের সম্পর্কে এই যে নোংরা কথা বলা- উনি কি মায়ের পেট থেকে জন্মান নাই? তো মায়ের সম্মানটুকু উনি রাখবেন না? ওঁনার কি বোন নেই? নিজের স্ত্রী নেই? তাঁদের সম্মান রাখবেন না? এরকম নোংরা জঘন্য কথা বলবেন!”
২০১৩ সালের ৫ মে অনুষ্ঠিত ঢাকা অবরোধে অনেক নেতা পানি, জুস, রুটি, হালুয়া নিয়ে সেবা করেছিলেন হুজুরদের। কেউ কেউ এই অবরোধ অয়েকদিন চালিয়ে সরকার পতনের খোয়াবও দেখেছিলেন। আবার অনেক নেতা হুজুরের বিষদগার করতেও ছাড়েননি। তারা হুজুরের বিভিন্ন দফা নিয়ে চুল চেরা বিশ্লেষণ করে কীভাবে ঘায়েল করা যায় সেই পথে হেঁটেছেন।
এরপর জিভের পানি গড়িয়ে অনেক দূর চলে গেছে। আস্তে আস্তে কিছু দাবি দাওয়া মানার পর তেঁতুল হুজুরের সাথে অনেকের সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে। এখন তেঁতুল বড় মিঠা। আর যারা এতদিন তেঁতুলের মুগুর দিয়ে পিটিয়ে সরকার পতনের খোয়াব দেখেছেন, তাদের কাছে আজ তেঁতুল বড়ই টক। তাই স্থান, কাল, পাত্র ভেদে তেঁতুলের স্বাদ নির্ভর করে।
তবে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তেঁতুল গাছে ফল ধরে অনেক বেশি, কিন্তু পাকা পর্যন্ত টিকে কম। তেঁতুল গাছে ইদুরের আক্রমণ হয়। ইদুরে কাচা তেঁতুল কেটে ফেলে। তাই অনেক ফলসহ তেঁতুল গাছ নিজ ভূমিতে আবাদ করলেও খেয়াল রাখতে হবে যেন ইদুরে কেটে বিনাশ না করে। তবেই তেঁতুলের স্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন।
গু এবং গাডির মধ্যে পার্থক্য বুঝা কঠিন!
গু এবং রান্না করা গাডি (কচুর মুখি) দেখতে অনেকটা একই রকম। কিন্তু দুটির পার্থক্য বিস্তর। গাডি হজম হওয়ার পর যা থাকে তা গু হয়ে যায় কিন্তু গু কখনো পাতে তোলার যোগ্য নয়। গু গু’ই। ওটা দেখতে যতই গাডির মত হোক না কেন যদি কেউ ভুল করে তবে পস্তানো ছাড়া কিছু করার থাকে না। তাই গু থেকে সাবধান হওয়া উচিত।
গাডি অনেকের কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে। স্থান, কাল ভেদে প্রতিটি বস্তুর নামের কিছু পার্থক্য থাকে। কচুরমুখি বা ছড়া একটি উৎকৃষ্টমানের খাদ্য আমাদের তথা সারাদেশের মানুষের কাছে। কেউ মাছের সাথে ঝোল করে, কেউ কেউ মাংসের সাথেও রান্না করে খায়। তবে ভর্তা করে অনেকেই খেতে পছন্দ করেন যেমন আমি করি। সেই কচুরমুখিকে আমাদের এলাকায় গাডি নামেই চেনেন সবাই। তবে আমার লেখার যে গাডি সেটা এই আধুনিক সমাজের গাডি বা কচুরমুখি নয়। আমাদের দেশে আগে চলাচলের জন্য সবই ছিল কাঁচা রাস্তা আর রাস্তার পাশে ছিল খাল। শীতের মৌসুমে রাস্তার পাশের খাল শুকিয়ে যেত। রাস্তার পাশে প্রচুর কচু জন্মাতো। শীতের সময় সেই কচু গাছগুলো মরে শুকিয়ে যেত। গ্রামের লোকজন রাস্তার পাশের সেই কচুর গোড়া কোদাল দিয়ে খুড়ে মোথা বা কচুর মুখি বের করে আনতো। এইগুলোকে আমাদের এলাকায় গাডি নামেই চেনে। মুল থেকে যে মুখিগুলো হতো তাকে বলা হতো আডাগাডি। তবে বাজারে যে কচুরমুখি পাওয়া যায় সেই গাডিকে আমাদের এলাকায় কুরোইত্তা গাডি নামেও ডাকে। রাস্তার ধারে জন্মানো সেই গাডিগুলোকে সংগ্রহ করার পর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে সিদ্ধ করে আবরণ ছাড়িয়ে তার পর পানি, লবণ, হলুদ, মরিচ দিয়ে জ্বাল দিলে একদম ঘন করে রান্না ডালের মত দেখতে হতো। এই গাডি খেলে প্রচুর গলা চুলকায় তাই কাচা তেঁতুল দেওয়া হতো চুলকানি কমানোর জন্য। রান্না করা গাডি ভাতের সাথে, মুড়ির সাথে, রুটির সাথে খেতে বেশ সুস্বাদু লাগতো। গাডির রয়েছে প্রচুর পুষ্টিগুণ। গাডিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ এবং লৌহ থাকে। গ্রামের এমন কোনো বাড়ি পাওয়া যেতো না যে বাড়িতে শীতকালে গাডি রান্না হতো না। রান্না করা গাড়ি দেখতে অনেকটা অল্প পাতলা গুয়ের মতোই ছিল।
গু কারো কাছেই অপরিচিত নয়। গু বা মল বা বিষ্ঠা হলো কোনো প্রাণির পরিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট বর্জ্য পদার্থ যা পায়ুপথে দেহ থেকে নিস্ক্রান্ত হয়। এই নিস্ক্রমণ প্রক্রিয়াকে মলত্যাগ বলা হয়। জীবন ধারণের জন্য প্রাণি খাদ্যগ্রহণ করে যা পরিপাক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শরীরে হজম হয়। যে অংশ হজম হয় না তা মল বা বিষ্ঠা হিসাবে শরীর থেকে বর্জিত হয়। তবে উন্মুক্ত পরিবেশে প্রাণির মল দীর্ঘ সময় থাকলে তাতে ব্যকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটে এবং পঁচন শুরু হয় ফলে বিভিন্ন গ্যাস ও দুর্গন্ধের কারণে পরিবেশের দূষণ ঘটে। প্রাণির মল পানিতে মিশলে পানিকে দূষিত করে ঐ পানি পানে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিভিন্ন রোগ হতে পারে। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগ, যেমন কলেরা, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগের জীবাণু মলের সাথে দেহের বাইরে বের হয়। পান্ডুরোগ বা জন্ডিসের অন্যতম কারণ জন্ডিস রোগীর মল শুষ্ক হয়ে বাতাসে মিশে মুখপথে মানুষের শরীরে প্রবেশ। মল বা বিষ্ঠার রয়েছে আরো নানান ক্ষতিকর দিক। আমাদের গ্রাম্য ভাষায় এটাকে বলে গু।
আমাদের সমাজে অনেকেই আছে গুয়ের মতো। দেখতে অনেকটা গাডির রূপ নিয়ে সমাজে চলে। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ দেখলেই অনুমেয় যে সেটা কী। সমাজে এরা রংচোরা স্বভাবের হয়। কথা ও কাজ দেখে কেউ বুঝতে পারবে না এরা কতটা ভ-। নিজের স্বার্থের জন্য এরা সব ত্যাগ করতে পারে। এরাই আসল ত্যাগী। নিজের প্রয়োজনে সব কিছু ত্যাগ করে শুধু নীতি আর আদর্শ ছাড়া, কারণ নীতি আর আদর্শ তাদের কখনোই ছিল না তাই ত্যাগের প্রশ্নই আসে না। নিজের স্বার্থের কারণে কাউকে চোর বানায়, কাউকে বুকে টেনে নেয় আবার কাউকে দূরে ঠেলে দেয়। তার স্বার্থটাকেই সে বড় করে দেখে। নিজেরটা ষোল আনা বুঝে না পাওয়া পর্যন্ত এরা নীতিবাগীশ। যেমন গু-এর বর্ণ একেক সময় একেক রকম। টাটকা অবস্থায় এক রূপ, শুকনা অবস্থায় আরেক রূপ। তাইতো মানুষ বলে গুয়ের কোনো পিঠই ভালো নয়, সেটা শুকনা পিঠ হোক বা কাঁচা পিঠ। স্বার্থবাদী মানুষগুলো কখনোই ভালো মানুষ হতে পারে না। একান্ত আত্মকেন্দ্রিক হওয়ায় তারা মানুষের আত্মসম্মানবোধকে মূল্য দিতে জানে না, শ্রদ্ধা-ভালোবাসাকে দুর্বলতা ভাবে, নিজের জন্য কর্মীদেরকে জলাঞ্জলি দিতে সিদ্ধহস্ত।
তাই সর্বোপরি বলবো, আসুন আমরা গু আর গাডির মধ্যে পার্থক্যটা অনুধাবন করি। গু কখনো মানুষের আপন হতে পারে না। গাডির মত দেখতে হলেই সেটা গাডি হবে এমন কোনো কথা নয়। দেখে, শুনে, বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গু আর গাডির মধ্যে বিস্তর ফারাক, সেটা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সাংবাদিক ৫০৬ ধারায় অভিযুক্ত! আসুন, চতুর্থ স্তম্ভের প্রতি সহনশীল হই
সাংবাদিকতা একটা মহৎ পেশা। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। আর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ যদি হয় স্বাধীন সংবাদমাধ্যম তবে একেকজন সাংবাদিক ঐ স্তম্ভের নিচের একেকটা খুটি যারা স্তম্ভকে আগলে রাখে। অন্য তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে- জাতীয় সংসদ, নির্বাহী বিভাগ তথা প্রশাসন এবং বিচার বিভাগ। বাকী তিনটি বিভাগের পাহারায় সাংবাদিকগণ অতন্ত্র প্রহরী হিসাবে কাজ করে। এতেই অনুধাবন করা যায় গণমাধ্যমের ও গণমাধ্যমকর্মীদের গুরুত্ব কত অসীম।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন বিশ্বের বড়বড় গুণিজনরা। যেমন থমাস জেফারসন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচনাটিও তিনি করেছিলেন। জেফারসন ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাদপুরুষ। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে, তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব।’ জেফারসন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদপত্রের কথাই বলেছিলেন। ঠিক তাঁর প্রায় ৫০ বছর পর ফরাসি স¤্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সংবাদপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চেয়েও ক্ষতিকর।’ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, ‘কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না।’ যুগে যুগে মানুষ সংবাদ, সংবাদপত্র, স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, আবার এটিও উপলব্ধি করেছে যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা না হয় অথবা সংবাদমাধ্যম যদি কোনো দুরভিসন্ধি নিয়ে অসত্য বা অর্ধসত্য সংবাদ প্রচার করে, তা দেশ, জাতি ও সমাজের ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনটা যে হয় না তা কিন্তু নয়। নামসর্বস্ব সংবাদমাধ্যম ও তাদের কর্মীরা যেমন ক্ষতিকর তেমনি নামজাদা সংবাদমাধ্যম ও তাদের কর্মীরা সমাজের জন্য এইচআইভির মতই ক্ষতিকর। যে আশংকাটা করেছিলেন এবং বুঝেছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
এত কথা যে কারণে এবার সেটা বলি। আমার অত্যন্ত ঘনিষ্টজন নির্ভীক সাংবাদিক কাজী নজরুল ইসলাম। একদিন হঠাৎ রাতের বেলায় ফোনে জানালো তার কাছে একটি সমন গেছে। তার বিরুদ্ধে একটি ননজিআর মামলা হয়েছে। অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। তাকে দ-বিধির ৫০৬ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগঃ এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার কাছে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়েছিলেন। পুকুর চুরিতে সিদ্ধহস্ত সেই পদস্থ কর্মকর্তা তাকে সাক্ষাতকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি নাকি তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন এবং তার রাজ কাজে বাধা দিয়েছেন এবং জীবন নাশের হুমকি দিয়েছেন! আর সেই সাক্ষাৎ চাওয়ার অপরাধে এবং হুমকির-খারাপ ব্যবহারের অভিযোগে কর্মকর্তা থানায় জিডি করেন। জিডি তদন্ত করে কর্মকর্তার অধিনস্ত কর্মচারী ও কতিপয় ঠিকাদারের জবানবন্দী গ্রহণ করে কাজী নজরুল ইসলাম ভাইর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে যা একজন সাংবাদিককে হয়রানি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
যেহেতু দ-বিধির ৫০৬ ধারার প্রসঙ্গ উঠেছে তাই আইনটি সম্পর্কে কিছু তথ্য দেই যাদের এই ধারাটার গুণাগুণ জানা আছে কিন্তু ভুলে গেছেন। দ-বিধি (১৮৬০ সালের ৬ অক্টোবর এর ৪৫ নং আইন) আইনটির নাম ছিল ভারতীয় দ-বিধি। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর তদানিন্তন পাকিস্তান-এর জন্য নাম হয় পাকিস্তান দ-বিধি। ভারত ও পাকিস্তানে ওভাবেই নামটি রাখা আছে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শিরোনামটি ৩০ জুন ১৯৭৩ তারিখের ৮ নং আইন দ্বারা সংশোধন করে পাকিস্তান শব্দটি বাদ দিয়ে পেনাল কোড নামে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকারিতা দেখানো হয়েছে। দন্ডবিধির ৫০৬ ধারায় কি বলা আছে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ধারাঃ ৫০৬-অপরাধজনক ভীতি প্রদর্শনের শাস্তিঃ যদি কোনো ব্যক্তি অপরাধজনক ভীতি প্রদর্শনের অপরাধ করে, তাহা হইলে- সেই ব্যক্তি দুই বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ-ে, কিংবা অর্থদ-ে, কিংবা এতদুভয় দ-েই দ-িত হইবে; এবং যদি হুমকিটি মৃত্যু বা গুরুতর আঘাত ঘটাইবার, কিংবা অগ্নি সংযোগে কোনো সম্পত্তি ধ্বংস করিবার কিংবা মৃত্যুদ-ে বা যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-নীয় কোনো অপরাধ সংঘটনের কিংবা সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদ-ে দ-নীয় অপরাধ সংঘটনের কিংবা কোনো স্ত্রীলোকের সতীত্ব নষ্ট হইয়াছে বলিয়া দুর্নাম আরোপের হুমকি হয়, সেই ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদ-ে অর্থদ-ে কিংবা এতদুভয় দ-েই দ-িত হইবেন। উক্ত ধারার বিচার প্রকৃয়াঃ আমল অযোগ্য-জামিনযোগ্য-মীমাংসারযোগ্য-যে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট, গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচার্য। মৃত্যু বা মারাত্মক জখমের ভীতি প্রদর্শন হইলে মিমাংসার অযোগ্য এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বিচার্য।
একজন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য যখন কোনো কর্মকর্তার কাছে যান তখন ঐ কর্মকর্তার যদি সৎসাহস থাকে তবে সাংবাদিককে স্বাগত জানিয়ে এক কাপ লাল চা খাইয়ে তথ্য ও বক্তব্য দিয়ে বিদায় করেন। কিন্তু যদি তার সে সৎসাহস না থাকে তবে তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন এবং তার সাথে মন্দ আচরণ করেন, এটা আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা। আমাদের দেশেই নয় সারা বিশ্বে সাংবাদিকরা (প্রকৃত সাংবাদিক) জীবন বাজী রেখে অন্যায়-অবিচারের স্বীকার হয়ে কাজ করেন। কখনো কখনো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়। আর চাঁদাবাজী, মানহানি, হুমকি-ধামকির মামলাতো হরহামেশাই খেয়েই থাকে সাংবাদিকরা। আমাদের এই সোনার দেশে জনপ্রতিনিধির উন্নয়নের নামে বরাদ্দকৃত টাকা পোষা চাটুকার নেতা-কর্মীদের ভাগবাটোয়ারা করে দেয়া, অধিগ্রহণের নামে কিছু মৃত-অর্ধমৃত পাটকাঠির মত গাছের মূল্য কোটি টাকা দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ, জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত পুকুর নেতার বাড়িতে কাটা, স্কুলের জমি নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ, ভূমি অধিগ্রহণের সময় দো’চালা ছনের ঘর দোতালা বানিয়ে টাকা তসরুপ, গৃহহীন মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত ঘর নির্মাণের নামে টাকা পকেটস্থ করার খবর কাজী নজরুল ইসলামদের মতো সাংবাদিকরা হাটে-মাঠে ঘুরে তুলে আনেন বলেই আমরা তা জানতে পারি এবং কোনো কোনো সময় সেই আত্মসাৎকারী লোভীদের বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয় সরকারের। এই তালিকা লিখে আসলে শেষ করা যাবে না। চতুর্থ স্তম্ভের নিচের খুটিগুলো অপর তিনটি স্তম্ভকে সর্বদা সোজা পথে চলতে বাধ্য করে এই সাংবাদিকরাই। তবে এই দুর্নীতির তালিকা যেমন কাজী নজরুল ইসলামদের মতো সাংবাদিকরা তুলে এনে দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দেয় আবার অনেক কাজী নজরুল ইসলাম আছে যারা সেই সুযোগে দুর্নীতিবাজদের রুটি হালুয়ায় ভাগ বসিয়ে, উচ্ছিষ্ট খেয়ে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের চিন্তার কারণ হয়।
সর্বপরি যা বলতে এই লেখাটা লিখার তাগিদ অনুভব করলাম তা হলো-পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে সাংবাদিকদের প্রতি বিরাগভাজন হওয়া, মামলা-হামলা করে হয়রানি, হুমকি ধামকি দিয়ে তাদের কলম বন্ধ করার চেষ্টা থেকে আমাদের বিরত হতে হবে। নয়তো একদিন এই সোনার দেশ শ্মশানে পরিণত হবে। আপনার আমার কারোরই বাসযোগ্য থাকবে না।
বৃক্ষের রক্তক্ষরণ বন্ধে আইন হোক
প্রয়োজনে বৃক্ষকে ব্যবহার করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু আমরা অপ্রয়োজনেও বৃক্ষকে এমনভাবে ব্যবহার করি যা উচিত নয় বলেই মনে হয়। বৃক্ষ আমাদের পরম বন্ধু এটা সামান্য জ্ঞানসম্পন্ন মানুষও স্বীকার করবে। কিন্তু আমরা অপ্রয়োজনে বৃক্ষর উপর যে অত্যাচার করি তা বন্ধ করা উচিত। বিশেষ করে বৃক্ষের সাথে পেরেক মেরে, দড়ি বেধে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে বৃক্ষের যে রক্তক্ষরণ করি তা বন্ধ করা উচিত। আর এই অন্যায় বন্ধে প্রয়োজনে আইন হতে পারে।
প্রথমেই বৃক্ষ নিয়ে কিছু তথ্য দেই। বৃক্ষ বহুবর্ষজীবী কাষ্ঠবহুল উদ্ভিদ। বৃক্ষকে এভাবে সঙ্গায়িত করা হয়ঃ কাষ্ঠবহুল উদ্ভিদ যার মাটি থেকে সুস্পষ্ট শীর্ষ প্রকটতা বিশিষ্ট একটি একক প্রধান কা- অথবা গুঁড়ি থেকে বহুধাবিভক্ত অপ্রধান শাখা বিকশিত হয়। কিছু লেখকের মতে পূর্ণ বিকশিত অবস্থায় বৃক্ষের ন্যূনতম উচ্চতা ৩ মিটার থেকে ৬ মিটার হওয়া উচিত। আবার কিছু লেখক গাছের কা-ের ন্যূনতম ব্যস নির্ধারণ করেছেন ১০ সেমি। অন্যান্য কাষ্ঠবহুল বৃক্ষ, যারা এই শর্তগুলো পূরণ করতে পারে না, যেমন শাখান্বিত প্রধান কা- অথবা ছোট আকৃতির গাছকে গুল্ম বলা হয়। অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় বৃক্ষ দীর্ঘজীবী হয়, কোনো কোনো গাছ হাজার বছরও বেঁচে থাকে এবং ১১৫ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। বৃক্ষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কারণ এরা ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং এদের পত্রপল্লবের নিচে আবহাওয়া-সুরক্ষিত বাস্তসংস্থান তৈরি করে। বৃক্ষ অক্সিজেন তৈরি ও বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড দূরীকরণ এবং ভূমির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা ল্যান্ডস্কেপিং ও কৃষির উপাদানও বটে, যার কারণ হলো তাদের সৌন্দর্যগত আবেদন ও বিভিন্ন ধরণের ফল। বৃক্ষ থেকে প্রাপ্ত কাঠ ঘরবাড়ি তৈরিসহ নানান কাঠামো তৈরিতে এবং জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রায় ৪,০০০ কোটি গাছ ছিল, প্রতি মানুষে প্রায় ৬১ টি।
উপরে বৃক্ষ সম্পর্কে সামান্য কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। বৃক্ষ নিয়ে একটা গবেষণাপত্র লিখলেও লিখে শেষ করা যাবে না। আর বৃক্ষের গুণাগুণ বর্ণনা করার মতো জ্ঞানও আমার নেই। তবে বৃক্ষ নিয়ে যা বলতে লিখাটা শুরু করেছি সেটাই বলি। আমাদের দেশে এখন কেউ গাছে না উঠতে পারলে নেতা হয় না। ছোট বড় সাইজের ফেস্টুন, বিজ্ঞাপন গাছের সাথে পেরেক-গজাল দিয়ে সেটে দিয়ে নিজেকে প্রচার করে। দলের মূল নেতা-নেত্রীদের পাসপোর্ট সাইজের ছবি দিয়ে আর নিজের বিশাল সাইজের ছবি ব্যবহার করে ফেস্টুন, বিলবোর্ড প্রিন্ট করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। এছাড়া কোচিং সেন্টার, শ্রীপুরের বড়ি, সান্ডার তেল, কলিকাতা হারবাল, তান্ত্রিক হাকিম, ডাক্তার, দোকানদার কেউ এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই। সবাই বৃক্ষকে প্রচার প্রচারণার একমাত্র দেয়াল হিসাবে ব্যবহার করে। শুধুযে পেরেক-গজাল দিয়ে তা কিন্তু নয়। অনেকে গাছের সাথে নাইলনের মোটা-চিকন দড়ি দিয়ে নিজেদের ব্যানার বেধে রেখে আত্মপ্রকাশ করে। প্রচার প্রচারণার কাজটা শেষ হলে কেউই দড়িটা খুলে নেয় না, যেমন নেয় না পেরেক-গজালে যুক্ত বিজ্ঞাপনগুলো।
আমরা সেই কবেই জেনেছি বৃক্ষেরও প্রাণ আছে। তাহলে বৃক্ষের গলায় রশি দিয়ে বেধে দিলে কি তাদের দম আটকায় না? বৃক্ষের গায়ে পেরেক-গজাল বিদ্ধ করলে কি রক্তক্ষরণ হয় না? হয়তো এভাবে কেউ ভাবে না বা নিজের অপ-প্রয়োজনে ভাবতে চায় না। তাই বৃক্ষের এ দূরবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি কঠিন আইন প্রণয়ন করা জরুরী বলে মনে হয়। বৃক্ষ আমরা ব্যবহারের জন্য, প্রয়োজনে কাটবো, ভাঙ্গবো কিন্তু এভাবে নির্যাতন বন্ধ করা উচিত। আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। দেশের সুশীল সমাজ কখনো কখনো গাছ কাটার বিরোধিতা করতে গিয়ে গাছ জড়িয়ে ধরে আন্দোলন করে, কাদে। দেশের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য সরকারের যখন গাছ কাটার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখন আমাদের চেতনা জাগ্রত হয়। কিন্তু গাছকে আমরা তিলেতিলে খুচিয়ে খুচিয়ে মারলে কোনো টু-শব্দটি করি না যা অনৈতিক বলেই মনে হয়।
গাছের জীবন নিয়ে একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। আমাদের প্রিয় মহানবীও গাছপালা ভালোবাসতেন। গাছেরও জীবন আছে, গাছও কষ্ট পায়। অকারণে গাছ কাটা কিংবা গাছের পাতা ছেঁড়া মহানবী একেবারেই পছন্দ করতেন না। অবশ্য মহানবী কারণ ছাড়া কোনো কাজ নিজেও করতেন না, অন্যকেও করতে দিতেন না। তিনি বলতেন, ‘এ পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা মানুষের উপকারে লাগবে। অপ্রয়োজনে তাই কোনো কিছু নষ্ট করতে নেই। নিয়মমতো সবকিছু ব্যবহার করা উচিত। তাই প্রয়োজনে গাছ কাটতে হয়। কিন্তু অকারণে গাছের একটি পাতাও ছেঁড়া উচিত নয়।
একদিন মহানবী তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে যাচ্ছিলেন এক সফরে। ক্লান্ত হয়ে তাঁরা বিশ্রাম নিতে বসলেন মাঝপথে। এমন সময় দেখেন দূরে গাছের তলায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে কয়েকজন লোক। কিন্তু ওদের মধ্যে একজন আপন খুশিতে পাতা ছিঁড়ছে। বাতাসে ভাসিয়ে দিচ্ছে সেই পত্রগুচ্ছ। ব্যাপারটা দেখে মহানবী খুব দুঃখ পেলেন। এগিয়ে গেলেন লোকটার কাছে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন তুমি অযথা গাছের পাতাগুলো ছিঁড়ছ?
লোকটি বলে-‘ছিড়লে ক্ষতি কী? ভালো লাগছে তাই ছিঁড়ছি।’
মহানবী তখন লোকটির আরো কাছে গেলেন। চুল টেনে ধরলেন তার। লোকটি উহ্ আহ্ করে উঠতেই মহানবী বললেন, ‘এত অল্পতেই তুমি ব্যথা পাচ্ছ? যদি তোমার চুল টেনে উপড়ে ফেলতাম তবে কেমন লাগত?’
লোকটি বলল, ‘আমার চুল টানলে ব্যথা তো পাবই। গাছের পাতা ছিঁড়লে গাছ কেন ব্যথা পাবে?’
মহানবী তখন লোকটির কাছে জানতে চাইলেন, ‘গাছ যে বুড়ো হয়ে মারা যায় তা কি তুমি দেখেছ?’
লোকটি মাথা নাড়ল। সে দেখেছে।
তাহলে গাছের পাতা ছিঁড়লে গাছও দুঃখ পায়। গাছেরও জীবন আছে।
লোকটি মাথা নামিয়ে রাখল। সে মেনে নিল মহানবীর কথা।
পরে মহানবী বললেন, ‘অকারণে গাছের পাতা ছেঁড়া ঠিক নয়। যদি তোমার প্রয়োজন হয় তবে পুরো গাছটাই তুমি কেটে ফেল। তাতে কোনো ক্ষতি নেই।’ আমাদেরও মহানবীর দেয়া শিক্ষা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।
ধর্ষণ নিয়ে ধস্তাধস্তি
ধর্ষণ রুচিহীন মানুষের বিকৃত রুচির পরিচয়। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা বিশ্বে বিকৃত রুচির যৌনাচার চলমান। বিভিন্ন ছল-ছুতায় এক শ্রেণীর পশু মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষরূপী জানোয়ার এ রুচির পরিচয় দেয়। আসলে জানোয়াররা এমন কর্ম করে কিনা জানিনা, মানুষ করে এটা নিশ্চিত। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন পরবর্তী ৩০ ডিসেম্বর রাতে নোয়াখালির সুবর্ণচরে এমনই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে যায়। পরিবারের সদস্যদের বেঁধে রেখে আওয়ামীলীগ সমর্থক কিছু পশু মনোবৃত্তি সম্পন্ন জানোয়ার ঘটনাটি ঘটায়। যেমনটি ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচন পরবর্তী ৮ অক্টোবর রাতে বিএনপি-জামায়াতের পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল সিরাজগঞ্জের ১৪ বছরের মেয়ে পূর্ণিমা। দুটি ঘটনার মধ্যে পার্থক্য শুধু ধর্মের আর দলের। সভ্য দেশের কোনো সভ্য মানুষই এমন ঘটনাকে সমর্থন দেবে না। সেটা যে দলের সমর্থকই হোক না কেন।
ধর্ষণ আসলে কী? ধর্ষণ এক ধরনের যৌন আক্রমণ। সাধারণত একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরেকে তার সঙ্গে যৌনসঙ্গম বা অন্য কোনো ধরনের যৌন অনুপ্রবেশ ঘটানোকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণ শারীরিক বলপ্রয়োগ, অন্যভাবে চাপ প্রদান কিংবা কর্তৃত্বের অপব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে। অনুমতি প্রদানে অক্ষম যেমন- কোনো অজ্ঞান, বিকলাঙ্গ, মানসিক প্রতিবন্ধী কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি এরকম কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়াও ধর্ষণের আওতাভুক্ত। ধর্ষণ শব্দটির প্রতিশব্দ হিসেবে কখনো কখনো ‘যৌন আক্রমণ’ শব্দগুচ্ছটিও ব্যবহৃত হয়। বিচারব্যবস্থায় ‘ধর্ষণ’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘যৌন আক্রমণ’ কিংবা ‘অপরাধমূলক যৌন আচরণ’ শব্দগুচ্ছকে ব্যবহার করা হয়। অপরিচিত ব্যক্তিদের চেয়ে পরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা অনেক বেশি। আর্ন্তজাতিক সংঘাত বা যুদ্ধের সময়ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও ব্যাপক হারে ধর্ষণ (যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা ও যৌন দাসত্ব) ঘটে থাকে। এ ধরনের ঘটনাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ধর্ষণ গণহত্যার একটি উপাদান হিসেবেও স্বীকৃত। যে কোনো লিঙ্গ, বয়স, জাতি, সংস্কৃতি বা ধর্মের ব্যক্তি ধর্ষণের শিকার হতে পারে। ধর্ষণকে বেশ কয়েকটি ধরণে ভাগ করা হয়, যেমন- গণধর্ষণ, বৈবাহিক ধর্ষণ, অজাচার ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, কারাগারে ধর্ষণ এবং যুদ্ধকালীন ধর্ষণ। গণধর্ষণ হচ্ছে একদল লোক কর্তৃক একজন একক ব্যক্তিকে ধর্ষণ। দুই বা ততোধিক ব্যক্তি (সাধারণত কমপক্ষে তিনজন) কর্তৃক ধর্ষণ সারা বিশ্বে প্রচুর ঘটে থাকে। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মদ এবং নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রভাবে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে, দিনের তুলনায় রাতে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে, এক্ষেত্রে অধিকাংশ ভুক্তভোগী নিষ্ঠুর যৌন আক্রমণের শিকার হয়। একক ব্যক্তির দ্বারা ধর্ষণের চেয়ে গণধর্ষণ বেশি হিং¯্র হয়। গণধর্ষণকে কখনো কখনো ‘দলগত ধর্ষণ’ও বলা হয়ে থাকে।
কিছু ঘটনা মানুষ চাইলেও ভুলতে পারে না। যেমন ২০০১ সালের সিরাজগঞ্জের ঘটনা। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার দেলুয়া গ্রামের অনিল কুমার শীলের কিশোরী কন্যা পূর্ণিমা রানী শীল। অষ্টম সংসদ নির্বাচনের সময়টাতে ছিলেন হামিদা পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। নির্বাচনের দিন দেলুয়া হাইস্কুল কেন্দ্রে যান তিনি। সেখানে তাঁর গৃহশিক্ষক সাধন পোলিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিলেন। পূর্ণিমাকে দেখে সাধন অনুরোধ করে বলেন, ‘তিনি বাসায় খেতে যাবেন। তাই তিনি ফিরে আসার আগ পর্যন্ত যেন পূর্ণিমা একটু বসেন।’ পরে সাধন ফিরে আসলে পূর্ণিমা বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন। পথে বিএনপি-জামায়াত কর্মী ও সমর্থকরা তাকে শাসায়। সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই সেই শাসানোকে বাস্তবে রূপ দেয় বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীরা। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী অক্টোবর মাসের ৮ তারিখ রাতে পূর্ণিমার ওপর চালানো হয় বর্বরতম অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন। রাতে জোরপূর্বক বাড়িতে ঢুকে পুরো পরিবারের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের চালায় বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীরা। এক পর্যায়ে অনিল শীলের ছোট মেয়ে পূর্ণিমাকে গণধর্ষণ করে তারা। এত মানুষ দেখে পূর্নিমার মা সেদিন বলেছিলেন, ‘বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট তোমরা একজন একজন করে এসো, নয়তো মেয়েটি মরে যাবে।’ পূর্ণিমার মায়ের সেদিনের আকুতি মানুষ কোনোদিনই ভুলবে না, আমরাও ভুলিনি।
যেমনটি মানুষ ভুলবে না ২০১৮ সালের নির্বাচন পরবর্তী নোয়াখালীর ‘স্বামী-সন্তানকে বেঁধে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণ’ এর ঘটনা। সুবর্ণ চরের ধর্ষিতা নারীর জবানবন্দিতে উঠে এসেছে সেই বর্বরতার করুণ কাহিনী। তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেছিল, কিন্তু আমি তাদের কথা না শুনে ধানের শীষে ভোট দিয়েছি। মধ্যরাতে ১০ থেকে ১২ জন লোক হাতে লাঠিসোটা নিয়ে বেড়া কেটে তার বাড়িতে ঢুকে। তারপর তারা তার স্বামী ও চার সন্তানকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর তারা আমাকে বাইরে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এ বিষয়ে মুখ খুললে তার স্বামী ও সন্তানদের মেরে ফেলা হবে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়ে যায় ধর্ষণকারীরা।’
ধর্ষিতার স্বামী বলেন, ‘তার স্ত্রী গত রবিবার সকাল ১১ টায় চর জুবিলী প্রাথমিকে বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে যান। সেখানে তিনি সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে বুথে যেতে চান। ওই সময় আওয়ামী লীগের কর্মী রুহুল আমীন তাকে নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য জোর করেন। কিন্তু, তাকে (রুহুল আমীন) যখন বলা হয় যে ধানের শীষে ভোট দেওয়া হয়েছে, তখন তিনি ব্যালট পেপারটি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, এরমধ্যেই তার স্ত্রী ব্যালটটি বাক্সে ঢুকিয়ে দেন। এতেই রুহুল ক্ষেপে যান এবং দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।’
কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা তাদের কর্মীদের বলেন না এমন জঘন্য ঘটনা ঘটাও। অতি উৎসাহী একদল কর্মী যারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বা হীন চিন্তা-চেতনার বাস্তব রূপ দিতে এমনটা ঘটায়। তারা চিন্তা করে তাদের পিছনে রাজনৈতিক হাতের ছায়া আছে। এধরণের কর্মীদের বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দলেরই সতর্ক হওয়া উচিত। এধরণের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং কঠোর হস্তে দমন করা না গেলে ভবিষ্যতে পূনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। ধর্ষণসহ প্রতিটি অপরাধকেই দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা উচিত নয়। আমাদের দেশে দলীয় পরিচয় পাওয়ার পর সরকার একটু হলেও নমনীয় হয়ে উঠে যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই নমনীয়তা ত্যাগ করে অপরাধীকে অপরাধী হিসাবে বিবেচনা করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে একটি বাসযোগ্য দেশ গঠন করতে হবে। একজন ধর্ষিতার শরীর থেকে যতটা রক্তক্ষরণ হয় তার চেয়ে অনেক বেশি রক্তক্ষরণ হয় দেশবাসীর হৃদয় থেকে। এই রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। শাস্তি নিশ্চিত করলে রাজনৈতিক শক্তির ভরসায় কেউ আর অপরাধ করতে সাহস পাবে না। ২০০১ সালে সংঘটিত ধর্ষণের বিচার সম্পন্ন হয়েছে ২০১১ সালে। দীর্ঘ দশ বছর সময় লাগাটা উচিত হয়নি। এধরণের অপরাধের বিচার যথাযথ দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করতে হবে। এমন ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সরকার দলীয় ও বিরোধী মতের সকল রাজনৈতিক শীর্ষ নেতাদের ছুটে যেতে হবে, নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়াতে হবে, সাহস জোগাতে হবে, অভয় দিতে হবে এবং অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীল হওয়া উচিত। ক্ষমতার লোভে ও মোহে পড়ে এমন সব কর্ম করে এবং প্রশ্রয় দেয় যা জাতির জন্য কলঙ্কময় অধ্যায় রচনা করে। সকলের বোধদয় হোক। মানুষ মানুষের জন্য। বিবেক জাগ্রত হোক। বিবেক জাগ্রত হোক। বিবেক জাগ্রত হোক।
অতি উৎসাহে কাটতে কাটতে তাল উঠে গিয়েছিল
কাটতে কাটতে অনেক সময় তাল উঠে যায়। কিভাবে তাল উঠে যায় সেই গল্প শেষে বলছি। আগে কিছু প-িতসুলভ কথা বলি। প্রসঙ্গ আর কিছুই নয়, এবারের নির্বাচন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটাভুটির বিষয় সবারই জানা আছে। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ অভাবনীয় আসনের মালিক হয়েছে। আসন পেয়েছে জোটের অন্য শরীকরাও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। যাদের কিছুটা পাওয়ার কথা ছিল তারা অভাবনীয় কম পেয়েছে। এর পেছনে কারণ বিশ্লেষণ করলে এত কালিও পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে না কাগজও। কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জয় পাওয়াটা অপ্রত্যাশিত ছিল বলে আমার মনে হয় না, যদিও অনেকেই মানবে না কথাটা। আর তারাই মানবে না যারা ষোল কোটি মানুষকেই তাদের দলের ভাবে, এমনকি আওয়ামীলীগের সভানেত্রীকেও! আওয়ামীলীগের জয় পাওয়াটা কতটা যৌক্তিক তা ইভিএমের ভোট দেখলেই বুঝা যায়। নির্বাচন যতটুকু প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে তা কেবলই অতিউৎসাহী কর্মীদের কারণে। অতি উৎসাহী কর্মীদের তাল উঠে গিয়েছিল বলেই আমার কাছে মনে হয়।
দীর্ঘ দশ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা অস্বীকার করা যাবে না। আমরা সাধারণ মানুষ যারা অর্থনীতি বুঝি না, জিডিপি বুঝি না, সূচক বুঝি না, তারা এটা নিশ্চয়ই বুঝি যে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে, জীবন মানের উন্নয়ন ঘটেছে, রাস্তা-ঘাট-ব্রিজ-কালভার্ট হয়েছে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতে ব্যপক পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় বিশ টাকা রোজে কামলা পাওয়া যেতো, এখন পাঁচশত টাকায় অগ্রিম বুকিং দিয়েও কামলা মিলে না। একসময় খুদের-কুড়ার বিনিময়ে ধান ভানার লোক পাওয়া যেতো, ভাতের ফ্যানের বিনিময়ে কাজের বুয়া মিলতো, এখন মিলে না। একটা বাই সাইকেলের জন্য বাবার কাছে ধরনা ধরতো এখন অনায়াসেই একটা মটরবাইক পায়। এতেই বুঝা যায় মানুষের হাতে এখন টাকা আছে। আর এই সার্বিক উন্নয়নের কারণেই মানুষের আওয়ামী জোটের প্রতি সমর্থন ছিল বলেই মনে হয়, যে সুবিধাটা পেয়েছে জোট। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী জোট যথারীতি ছিল ভোটের মাঠে। দিনে রাতে মাঠ চষে বেড়িয়েছে প্রার্থীরা, সেই চষার কারণেই উর্বর মাঠে ভালো ফসল এসেছে। পক্ষান্তরে বিরোধী গ্রুপটা ছিল অটো পরিবর্তনের প্রত্যাশায় ও আন্দোলনের দিকে। তারা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া, প্রচার প্রচারণা করা, সভা-সমাবেশ করা, পোষ্টার টাঙ্গানোসহ নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হামলা-মামলাসহ নানান ছলছুতায় মাঠে নামেনি। একটা ঐশ্বরিক পরিবর্তনের আশায় চাতক পাখির মত চেয়ে ছিল। ধারণা ছিল একটানা ক্ষমতায় থেকে বিভিন্ন বিষয়ে যে বদনাম কামিয়েছে সেই কারণে পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাদের মনোভাব কী ছিল তা উঠে এসেছে বিরোধী নেতাদের ফোনালাপের মধ্য দিয়েও। মাঠ না চষে ফসলের আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। আন্দোলন, সংগ্রাম, পরিশ্রম ছাড়া কোনো দিন কোনো কিছুই পায়নি জাতি। যেমনটি পায়নি এবারের নির্বাচনেও। ভোট গ্রহণের অনিয়মের অভিযোগ তুলে পরাজয়ের যে কথা বলে তা ইভিএমে ভোট প্রদানের হার ও রেজাল্ট দেখলেই বুঝা যায়।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়া হয়। দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৬ টিতে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ করা হয়। ইভিএম আসনগুলোতে গড় ভোট পড়েছে ৪৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। এসব আসনে মোট ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৪টি ভোটের মধ্যে মোট ভোট পড়েছে ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৪৫৫টি। ইভিএম আসনের ফলাফলে দেখা যায়ঃ রংপুর-৩ আসনে মহাজোটের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১ লাখ ৪২ হাজার ৯২৬ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক পেয়েছে ৫৩ হাজার ৮৯। মোট ভোটের ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ ভোট পড়েছে এ আসনে। ঢাকা-৬ আসনে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ৯৩ হাজার ৫৫২টি ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ধানের শীষ প্রতীকের সুব্রত চৌধুরী ২৩ হাজার ৬৯০ ভোট। মোট ভোটের ৪৫ দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। চট্টগ্রাম-৯ আসনে আওয়ামী লীগের মহিবুল হাসান চৌধুরী ২ লাখ ২৩ হাজার ৬১৪টি ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী হলেন ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী শাহাদাত হোসেন ১৭ হাজার ৬৪২টি ভোট পান। মোট ভোটের ৩২ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোট পড়ে। সাতক্ষীরা-৩ আসনে আওয়ামীলীগের মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬১১ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী মোহাম্মদ আবদুল খালেক ২৭ হাজার ৭১১ ভোট পান। মোট ভোটের ৫২ দশমিক ৮২ শতাংশ ভোট পড়ে। খুলনা-২ আওয়ামী লীগের শেখ সালাহ উদ্দিন ১ লাখ ১২ হাজার ১০০ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু ২৭ হাজার ৩৭৯টি ভোট। মোট ভোটের ৪৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট পড়ে। ঢাকা-১৩ আওয়ামী লীগের মোঃ সাদেক খান ১ লাখ ৩ হাজার ১৬৩ ভোট, নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী আবদুস সালাম পেয়েছেন ৪৭ হাজার ২৩২ ভোট। মোট ভোটের ৪৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ভোট পড়ে আসনটিতে।
ব্যালট পেপারের ভোট নিয়ে নানা প্রশ্ন করছেন বিরোধী গ্রুপ। কতটুকু সত্যি আর কতটুকু মিথ্যা সেটা আমার চেয়ে সবাই ভালো জানেন। কিন্তু ইভিএমের পরিসংখ্যান দেখলেই বুঝা যায় এখানে ব্যালট নিয়ে ভোট বিপ্লব করা যায়নি। যদি করা যেত তবে ব্যালটের কেন্দ্রের মতই ফলাফল হতো, ভোট পড়তো নিশ্চই ৮০-৯০ ভাগ। ইভিএম দিয়ে করা আসনগুলোতেও বিরোধী জোটের ভোটের হার বলে দেয় তাদের জনপ্রিয়তার কথা, তাদের হাত গুটিয়ে থাকার কথা, নিষ্ক্রিয়তার কথা। আর অন্য কেন্দ্রগুলোর ভোটের ব্যাপারে বিরোধী গ্রুপ বলেন, জোর করে নিয়েছে, এজেন্ট বের করে দিয়েছে, পুলিশ জোটের, জওয়ান জোটের, অফিসাররা জোটের তাই বিরোধীদের জোর করে হারিয়েছে। একটা গল্প মনে পড়লো, এক গৃহস্থ মাঠে ধান নিড়ানোর জন্য কামলা নিয়েছিল যাদের মধ্যে একজন ছিল অন্ধ। দুপুরে যখন তদারকি করতে মাঠে গেছে তখন গিয়ে দেখে কোন ঘোপের নিড়ানিই ভালো হয়নি। গৃহস্থ রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এই ঘোপ কে করছে? সবাই উত্তর দিল কানায়, ঐ ঘোপ কে করছে, যথারীতি সবাই বলল কানায়। তখন গৃহস্থ বলল, সবই যদি কানায় করে তবে তোমরা কী ছিঁড়ছো? এজেন্ট আওয়ামী জোটের, পুলিশ আওয়ামী জোটের, জওয়ান আওয়ামী জোটের, কর্মকর্তারা আওয়ামী জোটের, সবাই যদি আওয়ামী জোটের হয় তবেতো ভোটারও আওয়ামী জোটের, বিরোধী জোটের কী করার আছে! কী নিয়েই বা তারা ভোটের মাঠে আছে? অটো পরিবর্তনের আশায়? সে আশার গুড়ে মোটা দানার বালি ছাড়া আর কিছুই যে নেই তা নির্বাচনের ফলেই দেখা গেছে।
এবার তাল ওঠার গল্পে আসি। আমার ব্যাংকার বন্ধু মোঃ কামরুজ্জামান মিন্টু গল্পটা বলেছিল। গ্রামের মানুষ গোসলে যাওয়ার আগে ছেন-কাচি-কাটাল নিয়ে বের হন। তার চাচাও গোসলের আগে একটা কাচি নিয়ে বের হয়েছে। পুকুড় পাড়ে বিভিন্ন গাছের ডাল পালা ছাটতে গিয়ে সে ডগার পাতা পর্যন্ত কেটে ফেলছে দেখে অপর চাচা বলল, ও করে কী? কাটতে কাটতে তো গাছই মেরে ফেলবে। তখন তার আরেক চাচা বলেন, কাটতে কাটতে ওর তাল উঠে গেছে! অতিউৎসাহীদের যখন তাল উঠে যায় তখন ডগা পর্যন্তও কেটে ফেলে। এমন ভাবে কাটে যে কোনো কোনো সময় গাছ দুর্বল হয়ে যায়, কখনো কখনো গাছ মরেও যায়। গল্পটা যার যার মত ভেবে নিবেন। ধন্যবাদ।
মহিলার হাতে রিক্সা চালক নির্যাতন ও ভাইরাল ভাবনা
ভাইরাল। কথাটার মধ্যেই কেমন যেন একটা ভাইরাস ভাইরাস গন্ধ আছে। ভাইরাস (ঠরৎঁং) সম্পর্কে যদি একটু খোঁজ-খবর নেন তবে জানবেন, ভাইরাস হলো এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব যারা জীবিত কোষের ভিতরেই বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এরা অতি-আণুবীক্ষণিক এবং অকোষীয়। ভাইরাসকে জীব হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত আছে। ভাইরাস মানুষ, পশু-পাখি, উদ্ভিদের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। এমনকি, কিছু ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়ার মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে-এদের ব্যাক্টেরিওফাজ (ইধপঃবৎরড়ঢ়যধমব) বলা হয়। ভাইরাস ল্যাটিন ভাষা হতে গৃহীত একটি শব্দ। এর অর্থ হলো বিষ। আদিকালে রোগ সৃষ্টিকারী যে কোনো বিষাক্ত পদার্থকে ভাইরাস বলা হতো। বর্তমান কালে ভাইরাস বলতে এক প্রকার অতি আণুবীক্ষণিক অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী বস্তুকে বোঝায়। উদ্ভিদ ও প্রাণির বহু রোগ সৃষ্টির কারণ হলো ভাইরাস। ভাইরাসকে জীবাণু না বলে ‘বস্তু’ বলা হয়। কারণ, জীবদেহ কোষ দিয়ে গঠিত , কিন্তু ভাইরাস অকোষীয়। ভাইরাস দ্রুত ছড়াতে সক্ষম।
আর বর্তমানে ফেসবুক ভাইরালও দ্রুত ছড়িয়ে যায়। সম্প্রতি ঢাকায় এক রিক্সা চালককে এক মহিলা দ্রুত রিক্সা চালাতে না পারার অভিযোগে মারধর করে। এক পর্যায়ে পথচারিরা বিতর্কে জড়ালে তাদের সাথেও মহিলা খারাপ আচরণ করে। একজন মহিলার এমন আচরণ আমাদের সবাইকে হতবাক করেছে। একজন মহিলার কাছ থেকে এমন আচরণ কারোরই কাম্য নয়, যেমনটি নয় আমার।
একজন প্রায় স্থুলকায় মহিলাকে রোগা পাতলা রিকশাচালক কতটুকু দ্রুতইবা টেনে নিতে পারে? মহিলার হয়তো জরুরী কোনো কাজ ছিল। কিন্তু জরুরী কাজের জন্য দ্রুত যেতে হলে তাকে অন্য বাহন বেছে নেওয়া উচিত ছিল, রিকশা দিয়ে কি ট্যাক্সির দ্রুততা আশা করা যায়? অথচ মহিলা সেটাই আশা করেছেন। তারচেয়ে বড় কথা হলো একজন ভদ্রমহিলার যে আচরণ থাকার কথা ঐ মহিলার মধ্যে সেই আচরণ দেখা যায়নি। সে যেভাবে রিকশাচালককে মারধর করেছে, উচ্চস্বরে গালাগাল দিয়েছে, প্রতিবাদী পথচারিদের সাথে যে আচরণ করেছে তা দেখলে কেউই মহিলাকে ভদ্রমহিলা সম্বোধন করবে বলে মনে হয় না, তাই আমিও বারবার মহিলাই লিখছি ভদ্রমহিলা লিখলাম না।
ঘটনাটা ঘটার পর ফেসবুকে আসলে মূহুর্তেই হয়ে যায় ভাইরাল। বড় বড় মিডিয়াও ভিডিওসহ সংবাদ প্রচার করতে থাকে। প্রশ্ন উঠে কে এই মহিলা, কী তার পরিচয়, কোন দল করে, শুধুই মহিলা না গণিকা? কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশের জল-হাওয়ায় বেড়ে উঠা ভদ্রমহিলারা এভাবে প্রতিবাদ করতে অভ্যস্ত নয়। প্রতিবাদ করলেই নারীর জাগরণ ঘটেছে বলা যাবে না, প্রতিবাদ হতে হবে যৌক্তিক, শালীন, ভদ্রচিত, মার্জিত, আচরণ হতে হবে রুচিশীল যার ছিটেফোটাও মহিলার মধ্যে আছে বলে মনে হয়নি।
ফেসবুকে প্রচারের সাথে সাথে সুযোগ সন্ধানী মানুষ মহিলার ছবি ব্যবহার করে ফেসবুক আইডি, পেইজ খুলে প্রোফাইলে বিএনপির নেত্রী, আওয়ামীলীগ নেত্রী বানিয়ে ফেলেন। সেই আইডি থেকে পোষ্টও দেওয়া হয়, ‘আমি বিএনপি নেত্রী, বিএনপি নেতার ভাগ্নে,’ ‘আমি আওয়ামীলীগ নেত্রী, আমার বিষয়ে পোষ্ট দিলে মামলা করবো।’ বাস্তবে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় আইডিগুলো সবই ঘটনা প্রচার পাওয়ার পরপরই ওপেন করা হয়ে। যা ভাইরাসের মত ছড়িয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, সে আওয়ামীলীগ করুক বা বিএনপি করুক, মহিলা হোক বা পুরুষ তাতে তার কর্মের সাথে কী সম্পর্ক? একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘আগুন খাইলে অঙ্গার ত্যাগ করতে হয়।’ সে অপকর্ম করেছে, মানুষকে হেয় করেছে, অপমান করেছে তার মানে সে ভদ্রতা শিখেনি। এই কারণে যদি কিছুটা দোষ হয়ে থাকে তবে সেটা তার পিতা-মাতার দোষ। কারণ প্রথমত এমন কন্যা পয়দা করে তারা ভুল করেছে, দ্বিতীয়ত পয়দা করার পর নৈতিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেই আমরা দলকে টেনে আনি। আওয়ামীলীগ-বিএনপি আমাদের দেশের বিশাল দুই দল। এতবড় দলে লুচ্চা, বদমাইশ, পাজি, সুবিধাবাদী যেমন আছে, তেমনি দেশপ্রেমিক, নিবেদিতপ্রাণ, হাজি, ইমাম, শিক্ষাবিদও আছে।
তাই, ভাইরাল ভাবনায় আমরা দলকে না টেনে ব্যক্তি যদি কোনো অপরাধ করে থাকে সেই বিষয়টা বিবেচনায় আনলে মহিলা হয়তো ভবিষ্যতের জন্য সংশোধন হতে পারে।
মা ইলিশ নিধন নয় চলছে হত্যাযজ্ঞ
নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ সুদীর্ঘকাল থেকেই। বলা যায় নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি সৃষ্টির শুরু থেকেই আগ্রহ। আর এই আগ্রহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের বেশি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর। যেমন নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি প্রথম যে লোভ বা আগ্রহটা দেখিয়েছেন তিনি হলেন নারী। বর্তমান সময়ে নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি নারী পুরুষ সমান হারেই আগ্রহী।
একসময় ফেনসিডিল ছিল কাশির ঔষধ। হাসপাতাল থেকে ফাও পাওয়ার পরও অনেকে খেতে চাইতো না। আস্তে আস্তে যখন মানুষ বুঝলো এটা খেলে নেশা হয় তখন বোতল চেটে খাওয়া শুরু করলো। বিষয়টা যখন কর্তাব্যক্তিদের ভাবিয়ে তুললো তখন করা হলো নিষিদ্ধ। অমনি আগ্রহ বেড়ে গেলো সবার।
আমাদের দেশ হলো ইলিশের দেশ। সারা বছরই কম-বেশি ইলিশ মাছ পাওয়া যায় বাজারে। কখনো দাম বেশি কখনো দাম কম। যখন বেশি থাকে তখন সাধারণ মানুষ হয়তো কিনে খেতে পারে না কিন্তু বিত্তবানরা ঠিকই কিনে খেতে পারে। আগে নদীতে মাছ আর পানি প্রায় সমান সমান ছিল বলতো মুরব্বিগণ। তখন বাজারে মাছ বিক্রি করতে না পেরে ফেলেও দিতে হতো। সেই ইলিশ মাছ ধরতে ধরতে যখন তলানিতে এসে পৌচেছে তখনই কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়লো। আগে ধরার কোনো মৌসুম ছিল না। যে যখন জাল ফেলতো তখনই মাছ নিয়ে ফিরতে পারতো। যখন সংকট দেখা দিল তখন প্রজননের মৌসুমে মা ইলিশ ও ঝাটকা ধরা নিষিদ্ধ করলো সরকার।
বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় মা ইলিশ ধরা এবং প্রজনন শেষে একটু বেড়ে উঠা জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করার পর দেখা গেল ইলিশের উৎপাদন বেড়ে গেছে অনেক গুন। একটা সময় গেছে যখন জেলেরা ভরা মৌসুমেও কাঙ্খিত ইলিশ না পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতো। মা ইলিশ ও জাটকা ধরা বন্ধ রাখতে বাধ্য করার পর দেখা গেছে তাদের মুখে হাসির ঝিলিক। কিন্তু ঐযে নিষিদ্ধ ফলের প্রতি আগ্রহটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত বছর মা ইলিশ ও জাটকা ধরা কড়াকড়িভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় এ বছর নদীতে নাকি পানি সমান মা ইলিশ ঘুরছে। জাল ফেলে টেনে তুলতে পারছে না জেলেরা। কিন্তু জেলেরা এটা চিন্তা করছে না, এবার না হয় ধরলো, কিন্তু পরবর্তী মৌসুমে যখন খালি জাল টেনে তুলবে তখন কি তাদের ভালো লাগবে?
সম্প্রতি চাঁদপুরের এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যর বাড়ি থেকে সাড়ে সাতশ মন মানে ত্রিশ হাজার কেজি মা ইলিশ মজুত অবস্থায় উদ্ধার করেছে প্রশাসন। এটাতো একজন মেম্বারের কাহিনী। এমন হাজারো মেম্বার আছে পদ্মা-মেঘনার তীর জুড়ে। আর অভিযোগ আছে, নদীতে ট্রলার নিয়ে যেতে হলে ট্রলার প্রতি টাকা দিয়েই নদীতে নামছে জেলেরা। টাকাটা কাকে দিতে হচ্ছে তা আমি আর প্রকাশ করলাম না, কারণ সবাই জানেন বলেই আমার বিশ্বাস। মা ইলিশ শুধু মেম্বারদের কাছেই না, খুঁজলে পাওয়া যাবে নিধন নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা, নিরাপত্তাকর্মীসহ ক্ষমতাধর সবার বাড়িতে। এমন কোনো বাড়ি পাওয়া যাবে না যার ফ্রিজে খালি জায়গা আছে। যার বাড়িতে মা ইলিশ ঢুকেনি তার বাড়িতে বিবাদ শুরু হয়ে গেছে।
আসলে এবার নিরাপত্তা ও তল্লাশি ব্যবস্থা কিছুটা শিথিল করার কারণে মা ইলিশ নিধন বেড়ে গেছে। যদি পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা কড়াকড়ি হতো তবে নদী থেকে মা ইলিশ ধরেও লাভ হতো না। কারণ ধরে যদি বিক্রিই করতে না পারে তবে এত মাছ দিয়ে কী করবে। কতটাই বা খাওয়া যায়!
এবার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের শিথিলতার সুযোগে মা ইলিশ নিধন নয় চলছে হত্যাযজ্ঞ। এ হত্যাযজ্ঞে জড়িত জেলেরা, পুলিশ, প্রশাসন, আপনার আমার মতো ক্রেতা, মজুতদার। আমরা সবাই জড়িত মা ইলিশ হত্যাযজ্ঞে। এর ফল পাওয়া যাবে আগামী মৌসুমে। বাজারে যখন ইলিশ শূন্যতা দেখা দিবে তখন জেলেদের পড়বে মাথায় হাত, পেটে হাত, চোখের জল, আমাদের পরবে জিভের জল।