কলকাতা ভ্রমণ ॥ জীবনে প্রথম কিছু

আসাদুজ্জামান জুয়েল

বৈশাখী প্রকাশ

কলকাতা ভ্রমণ ॥ জীবনে প্রথম কিছু
লেখক আসাদুজ্জামান জুয়েল
প্রকাশক বৈশাখী প্রকাশ
৩৮, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০
মোবাইল : ০১৭১২৮১৮৩০৩, ০১৭৩৪৯০১১৩৯
প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০১৯
গ্রন্থস্বত্ব লেখক
প্রচ্ছদ: মোঃ ফরিদ হোসেন
বর্ণবিন্যাস স্বদেশ কম্পিউটার সিস্টেম
মুদ্রণ রাবেয়া প্রিন্টার্স

 

 

 

 

 

উ। ৎ। স। র্গ

বাংলাদেশের সাধারণ সহজ-সরল মানুষের উদ্দেশ্যে
যারা ঘুরতে পছন্দ করেন
এবং
আমার প্রয়াত মা রওশনারা বেগম

পিতা আবদুর রশিদ খান

 

 

 

কিছু কথা

ঘুরতে কার না ভাল লাগে। আমার তো বেশ ভাল লাগে। সেটা দেশেই হোক আর বিদেশেই হোক। ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায়, ফুটপাতে, অলিতে, গলিতে, শহরে, বন্দরে যেখানেই যা দেখি তাই আমার হৃদয় কাড়ে। পথে ঘুরতে ঘুরতে যে বিষয় গুলো আমার হৃদয় কাড়ে সেই বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে পছন্দ করি, লিখতে চেষ্টা করি। আর সেই পথের বিষয় নিয়ে লেখাই আমার পথের পদ্য।
জীবনের প্রথম সব কিছুই একটু আলাদা আমেজের। প্রথম পাসপোর্ট, প্রথম বিদেশ ভ্রমণ, প্রথম রেলে চড়া ইত্যাদি সবকিছুতেই নতুনত্বের স্বাদ। আর তাই নিয়েই আমার এই লেখা। প্রথম বিদেশ ভ্রমণে কলকাতা গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ এর বর্ডার লাইন ক্রস করে অপর প্রান্তে ভিন্ন কোন দেশে প্রবেশের স্মৃতি কখনো কি ভোলা যায়? তাই প্রথম ভ্রমণের কিছু স্মৃতি নিজের জন্য এবং আমার পাঠক বন্ধুদের জন্য তুলে ধরেছি। আমি কোন লেখক নই। লেখাটা প্রথমে খন্ড খন্ড আকারে আমার ফেসবুক ওয়ালে পোষ্ট করেছি। লেখাটা ফেসবুকে পোষ্ট করার পর যে সারা পেয়েছি তা কল্পনাতিত। আমি আমার মনের ভাব প্রকাশ করেছি মাত্র, কোন সাহিত্য রচনা করিনি। আমার লেখাটা পড়ে যদি কেউ আনন্দ পায় বা কিছু তথ্য জানতে পারে বা আমার চোখে সে ঘুরতে পারে সেটাই আমার স্বার্থকতা।
লেখায় নানা বিষয়ে সহযোগীতা প্রয়োজন। আমিও নিয়েছি। উন্মুক্ত বিশ্বে এখন তথ্য প্রাপ্তি কোন কঠিন বিষয় নয়। গুগলে সার্চ দিলে কোটি কোটি তথ্য চলে আসে চোখের নিমিষে। আমি তাই গুগলের প্রতি কৃতার্থ। উইকিপিডিয়া, উইকিমিডিয়া, কলকাতার বিভিন্ন ওয়েবসাইট, বিভিন্ন ব্লগারদের ব্লগ ঘেটে আমি অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছি। ঘুরে যেমন অভিজ্ঞতা হয়েছে তেমনি না ঘুরে গুগোল ঘেটে অনেক তথ্য জেনেছি ও স্থানগুলো দেখেছি। আমি কৃতার্থ আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে যারা ফেসবুকে আমার লেখাটা গ্রহণ করেছে এবং আমায় একের পর এক লিখতে উৎসাহ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আমি কৃতার্থ আমার বন্ধু আইনজীবী ভাইদের কাছে যারা আমার ভ্রমনের সহযাত্রী হয়েছে। আমি কৃতার্থ আমার সহধর্মীনি মুনমুন সুলতানা লুনার কাছে যে আমাকে ভ্রমণে উৎসাহ দেয় সর্বদা এবং আমার ঘুরতে যাওয়ায় একাকিত্ব সহ্য করে। বিশেষ করে যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই দায় শেষ হয় না তারা হলেন, বিশিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার মাহবুবুল হক, জাপানের সিমানী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিরত ভূতত্ববিদ শামীম আজিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিষ্ট্রার মোঃ ফরিদ হোসেন, শরীয়তপুর জেলা আইনজীবী সমিতির বার বার নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোঃ আবু সাঈদ, বন্ধু এডভোকেট জামাল ভূইয়া, এডভোকেট মুরাদ হোসেন মুন্সী, শামীম সরদার, আমার বোন কোহিনুর আক্তার শিখা।
আমি আগেই বলেছি, আমি কোন লেখক নই। তাই আমার লেখায় শব্দ গঠনে, বানানে অনেক ভুল থাকে। অনেক তথ্য যেহেতু ধার করা তাই ভুল তথ্যেরও সন্নিবেশ ঘটতে পারে বা ঘটেছে। আমি আমার অযোগ্যতাকে লুকাতে চাই না। অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলো আমার অজ্ঞতা, অযোগ্যতা ছাড়া আর কিছুই না। তাই আমার ভুল গুলো বন্ধুরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে লেখাটা গ্রহণ করবেন বলেই আমার আশা।

আসাদুজ্জামান জুয়েল
আইনজীবী
শরীয়তপুর।

 

 

 

 

 

 

॥ ৬ ॥
হাওড়া ব্রিজ ভ্রমণঃ

বিকালের ভ্রমণ পরিকল্পনার প্রথমেই চিন্তায় এলো হাওড়া ব্রিজ দেখতে যাব। হাওড়া ব্রিজ দুইটা। হুগলী নদীর উপর দুটি একই মডেলের ব্রিজ হয়েছে। ক্যাব ড্রাইভারকে বলে নিলাম যে, আমাদের হাওড়া ব্রিজ ঘুরিয়ে ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামে নামিয়ে দিবেন। ড্রাইভার চলতে শুরু করলো। ফ্লাইওভার দিয়ে যেতে যেতে প্রথমেই হুগলী নদীর উপর নতুন তৈরী হাওড়া ব্রিজ। এই ব্রিজটি নতুন। এর নামকরণ করা হয়েছে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এর নামে।
ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়ালে মাঝে মাঝেই ড্রাইভার হাতের তালুতে কি যেন নিয়ে তার সাথে একটু চুন মিশিয়ে গাজা তৈরীর মত করে ঘষে ঘষে মুখে নেয়। প্রতিটি ড্রাইভারকেই দেখলাম এমনটি করে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করতেই বললো,
-এটাকে খৈনি বলে দাদা, আপনাদের দেশে এটা ব্যবহার করে না দাদা?
আমরা বললাম না। আমাদের দেশে কেউ কেউ গুল ব্যবহার করে, এটা ব্যবহার করে না। ড্রাইভার বললো,
-আমাদের দেশে এটা বেশ চলে দাদা।
নতুন হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ বিদ্যাসাগর ব্রিজ ঘুরে হুগলী নদীর তীর ঘেষে একটা ছোট টং দোকানের কাছে ট্যাক্সি থামালো। বিদ্যাসাগর ব্রিজে উঠতেই ড্রাইভার আমাদের সতর্ক করে দিলো,
-দাদা ছবি তুলবেন না কিন্তু। পুলিশ দেখলে অহেতুক ঝামেলায় পড়বেন। আর সিসি টিভি ক্যামেরাও আছে। তাই দেখুন, ছবি তোলার দরকার নাই।
বিদ্যাসাগর সেতু সম্পর্কে পাঠকদের জন্য সংগ্রহ করা কিছু তথ্য বিনিময় করছি।

বিদ্যাসাগর সেতু :
“বিদ্যাসাগর সেতু” বা “দ্বিতীয় হুগলি সেতু”, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে হুগলি নদীর ওপর অবস্থিত একটি সেতু। এর মাধ্যমে হাওড়া ও কলকাতা শহর দুটির মধ্যে যোগাযোগ রক্ষিত হচ্ছে। সেতুটি সব রকম যানবাহনের ক্ষেত্রেই টোল সেতু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মোট দৈর্ঘ্য ৮২২.৯৬ মিটার। এটি ভারতের দীর্ঘতম ঝুলন্ত (কেবল-স্টেইড) সেতু এবং এশিয়ার দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুগুলির মধ্যে একটি। সেতুটি নির্মাণ করতে মোট ৩৮৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর সেতুটির উদ্বোধন করা হয়। হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশনের অধীনে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে এই সেতুটি নির্মিত হয়েছিল।
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত রবীন্দ্র সেতুর (হাওড়া ব্রিজ) ১২ কিলোমিটার (৭.৫ মাইল) দক্ষিণে অবস্থিত বিদ্যাসাগর সেতু হুগলি নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় সেতু। উনিশ শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এই সেতু কলকাতা-সন্নিকটস্থ গঙ্গাবক্ষে স্থিত অপর দুই সেতু রবীন্দ্র সেতু ও বিবেকানন্দ সেতুর সহযোগী সেতু হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। বিদ্যাসাগর সেতু একটি কেবল-স্টেইড বা ঝুলন্ত সেতু। এর প্রধান বিস্তার ৪৫৭ মিটারের কিছু বেশি এবং ডেকের প্রস্থ ৩৫ মিটার। এই সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সালে এবং সেতুটির উদ্বোধন হয় ১০ অক্টোবর, ১৯৯২, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের প্রয়াণ শতবর্ষে। সেতুর তদারককারী সংস্থা হুগলি রিভার ব্রিজ কমিশন (এইচআরবিসি)। তবে সেতু নির্মাণ করেছিল বিবিজে নামে ব্রেথওয়েট, বার্ন ও জেশপ নামে তিনটি সংস্থার একটি যৌথ গোষ্ঠী।

ইতিহাস :
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দেশের বাণিজ্যিক কার্যকলাপ ও জনসংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। হাওড়া ও কলকাতা শহর দুটির মধ্যে হুগলি নদীর ওপর সেই সময় একটি মাত্র সেতুই ছিল রবীন্দ্র সেতু বা হাওড়া ব্রিজ। এই সেতুর ওপর যানবাহনের চাপ ক্রমাগত বাড়তে থাকলে, নদীর ওপর একটি নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়। এমন একটি সেতুর পরিকল্পনা করা হয়, যে সেতুটি নিকটস্থ জাতীয় সড়কের মাধ্যমে মুম্বই, দিল্লি ও চেন্নাই শহর তিনটিকে সরাসরি সড়কপথে যুক্ত করতে পারবে।
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২০ মে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি এই সেতুর শিলান্যাস করেন। যদিও এই ঝুলন্ত সেতু (সেই সময়ে এই সেতুটি একই ধরনের সেতুগুলির মধ্যে বিশ্বের দীর্ঘতম স্প্যান ব্রিজ ছিল) নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ জুলাই। কলকাতার নদীতীরে একটি কূপ খননের মাধ্যমে। সেতুটি সম্পূর্ণ হতে মোট ২০ বছর (অবশ্য তার মধ্যে সাত বছর কোনো নির্মাণকাজই হয়নি) সময় লেগেছিল। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সভাপতিত্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমহা রাও সেতুটির উদ্বোধন করেন।

বৈশিষ্ট্য :
বিদ্যাসাগর সেতু একটি মাল্টি-কেবল স্টেইড [১৪৪টি (৩৮ী৪) কেবল] সেতু। ১২৭.৬২ মিটার (৪১৮.৭ ফুট) লম্বা দুটি ইস্পাত-নির্মিত পাইলন কেবলগুলিকে ধরে আছে। সেতুটিতে দুটি ইস্পাতের কাঠামোযুক্ত কংক্রিট ডেক রয়েছে। ডেকের দুটি ক্যারেজওয়ের মোট প্রস্থ ৩৫ মিটার (১১৫ ফুট)। সেতুটিতে মোট তিনটি লেন এবং দু-পাশে ১.২ মিটার (৩ ফুট ১১ ইঞ্চি) প্রস্থবিশিষ্ট ফুটপাত রয়েছে। কিন্তু উদ্বোধনের পর থেকেই মানুষের নিরাপত্তার কারণে বিদ্যাসাগর সেতুর ফুটপাত দিয়ে পায়ে হেঁটে যাতায়াত নিষিদ্ধ আছে। রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার্থে কলকাতার দিকে উত্তরের ইস্পাত পাইলনের ধার ঘেঁষে একটি স্বয়ংক্রিয় উন্নায়ক বা লিফট প্রথম থেকেই তৈরি করা হয়েছে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান প্রশাসনিক ভবনের কার্যালয় কলকাতার “মহাকরণ” থেকে হাওড়া শিবপুরের “নবান্ন”তে স্থানান্তরিত হওয়ায় বিদ্যাসাগর সেতুর গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। ডেকটি মূল ৪৫৭.২০ মিটার (১,৫০০.০ ফুট) দীর্ঘ বিস্তার এবং দু-পাশের প্রতিপাশের ১৮২.৮৮ মিটার (৬০০.০ ফুট) বিস্তারের ওপর রয়েছে। এটিকে ধরে আছে সমান্তরাল তারের কেবল। সেতুটির নকশা করেছিল শ্লেইচ বার্গারম্যান অ্যান্ড পার্টনার, নকশা পরীক্ষা করে ফ্রিম্যান ফক্স অ্যান্ড পার্টনার ও বৃহৎ শিল্প নিগম লিমিটেড। সেতুটি নির্মাণ করে গ্যামন ইন্ডিয়া লিমিটেড।
বিদ্যাসাগর সেতু পার হয়ে আমরা হুগলী নদীর তীর ঘেষে চলছি। নদীর তীরে বড় বড় মিল কারখানা। দেখে বুঝা গেলো এখানে বহু পূর্ব কাল থেকেই বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে হুগলী নদীকে ঘিরে। নদীর তীর এতটা সুন্দর করে শাসন করেছে যে ভাঙ্গার উপায় নাই। পুরো তীরটা যেন সান বাধানো ঘাটের মত। পায়ে হাটা পথ, বসার সুবন্দোবস্ত, তীরে বিশালাকায় বটগাছ নিঃস্বার্থ ভাবে ছায়া ও অক্সিজেন দিয়ে যাচ্ছে। তীর ঘেষে যেতে যেতে হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে আমাদের গাড়িতে বসতে বলে বেরিয়ে গেল।
আমরা এক জায়গায় বেশি সময় বসে থাকার লোক না, তাই নেমে পড়লাম। নেমে দেখি ড্রাইভার ছোট একটা দোকান থেকে কিছু কিনছে। আমরাও এগিয়ে গেলাম। অনেক ক্ষণ যাবৎ চা খাওয়া হয় না, তাই ভাবলাম চা খেয়ে নেই। দোকানে গিয়ে দেখি ড্রাইভার কিছু ভাজা-পোড়া কিনছে। আমরা দোকানিকে বললাম আমাদেরও কিছু দেন। দোকানী আমাদের একটা পাতার তৈরী বাটিতে করে কিছু পাকুড়া দিল। ছোট ছোট করে তৈরী পাকুড়া বেশ সুস্বাদু। তার চেয়ে অবাক করা বিষয় পাতার তৈরী বাটিটা দেখে প্রথমে আচ করতে পারিনি যে এটা পাতা দিয়ে তৈরী। পাতা দিয়ে এত সুন্দর করে বাটি তৈরী করা যায় এই প্রথম দেখলাম। দুতিনটা পাতা সলাকা দিয়ে শেলাই করে তার পরে সাচে ফেলে প্রচন্ড প্রেসার দিয়ে বাটিটা তৈরী করা হয়েছে। দেখতে খুবই সুন্দর। পাকুড়া খাওয়ার পর শুরু হলো পাতার বাটির ময়না তদন্ত। বাটিটা পরতে পরতে খুলে দেখলাম কিভাবে তৈরী করেছে। পাকুড়া খেয়ে চা নিলাম। সেই মাটির ভাড়ে চা। মুরাদ মুন্সীর জন্য একটু স্পেশাল! চিনি ছাড়া চা। এখানে চা তৈরী করার সময়ই চিনি দেয়। চা পাতা, চিনি, দুধ, এলাচি, লবঙ্গ, দারুচিনি ভেঙ্গে একসাথে দিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফুটায়। হাতল ওয়ালা সিলভারের পাত্রে চা উননে রেখে বার বার নাড়তে থাকে। মজার ব্যাপার হলো সব দোকানের চা’ই আমার কাছে এক রকম মনে হলো। অনেকটা পায়েসের নিংড়ানো ঝোলের মত স্বাদ!! একটা লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো ছোট দোকানগুলো পাথর কয়লার আগুনে সব করে। কয়লার আগুন বেশ টাটকা। দেখে মনে হয় আগুনের এক একটা খন্ড। চা খেয়ে এর পর উঠে গেলাম ক্যাবে। ড্রাইভার আমাদের পুরাতন হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ রবীন্দ্র সেতু ঘুরিয়ে ইডেন গার্ডেন স্টেডিয়ামের পাশে নেতাজি সুবাস চন্দ্র বসুর নামে তৈরী নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। প্রথম হাওড়া ব্রিজ অর্থাৎ বিদ্যাসাগর ব্রিজের চাইতে শতগুন সুন্দর মূল হাওড়া ব্রিজ বা রবীন্দ্র সেতুটি। ১৯৪৩ সালে কাজ সম্পন্ন হওয়া ব্রিজটা এখনও নতুনের মত লাগছে। পাঠক বন্ধুদের জন্য রবীন্দ্র সেতুর কিছ তথ্য তুলে ধরা হলো। বলে রাখা ভালো, তথ্যগুলো উন্মুক্ত বিশ্বকোষ থেকেই নেয়া হয়েছে।

রবীন্দ্র সেতু :
রবীন্দ্র সেতু (পূর্বনাম হাওড়া ব্রিজ) হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৮৭৪ সালে প্রথম হাওড়া সেতু নির্মিত হয়। পরে ১৯৪৫ সালে পুরনো সেতুটির বদলে বর্তমান ক্যান্টিলিভার সেতুটির উদ্বোধন হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র সেতু রাখা হয়।
রবীন্দ্র সেতু বঙ্গোপসাগরীয় প্রবল ঝড়ঝঞ্জাগুলি সহ্য করতে সক্ষম। এই সেতু দিয়ে দৈনিক ৮০,০০০ যানবাহনও প্রায় ১০ লক্ষ পথচারী চলাচল করে। এই জাতীয় সেতুগুলির মধ্যে রবীন্দ্র সেতু বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম।
হাওড়া ব্রিজ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর উপর অবস্থিত বড় খিলানযুক্ত একটি ঝুলন্ত সেতু। সেতুটি ১৯৪৩ সালে অনুমোদিত হয়। প্রকৃতপক্ষে সেতুটির নামকরণ করা হয় নিউ হাওড়া ব্রিজ হিসাবে, কেননা একইস্থানে অবস্থিত কলকাতা এবং হাওড়া জেলার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী একটি ভাসমান সেতুর পরিবর্তে এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৫ সালে সেতুটির নাম ভারত এবং এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে পুনঃ নামকরণ করা হয়।

ইতিহাস :
১৮৬২ সালে বাংলার সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টার্নবুলকে হুগলি নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উপর পরিক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বলেন। ২৯ এ মার্চ তিনি প্রয়োজনীয় নকশা এবং উপাত্তসমূহ উপস্থাপন করেন। কিন্তু সে সমযয়ে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়নি।
পন্টুন ব্রিজ :
হুগলি নদীর উপর জন-চলাচল বৃদ্ধির ব্যাপকতার উপর লক্ষ্য করে ১৮৫৫-১৮৫৬ সালের মাঝামাঝি পুনরায় নদীটির উপর ব্রিজ নির্মাণকল্পে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

নতুন সেতুর জন্য পরিকল্পনা :
১৯০৬ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর এস হায়েট এবং কলকাতা কর্পোরেশন এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার ডাব্লিউ বি ম্যাকাবে এর নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়োগ করে। চীফ ইঞ্জিনিয়ারদের নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে। সকল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নদীটির উপর একটি ভাসমান সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এ উদ্দেশ্যে ২৩ টি প্রতিষ্ঠান হতে ব্রিজ এর ডিজাইন এবং কনস্ট্রাকশন এর উপর দরপত্র আহ্বান করা হয়। ১৯৩৫ সালে নতুন হাওড়া ব্রিজের আইন সংশোধিত হয় এবং পরের বছর ব্রিজটি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়।
হাওড়া ব্রিজ পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্র সেতু নামেও সুপরিচিত। কলকাতায় হাওড়া ব্রিজ হুগলী নদীর উপর প্রসারিত এবং ব্রিটিশদের একটি বিস্ময়কর প্রযুক্তি কর্ম বলে মনে করা হয়। বিশ্বের ব্যস্ততম প্রসারিত খিলান সেতুর মধ্যে হাওড়া ব্রিজ অন্যতম। হাওড়া ব্রিজ কলকাতা মহানগরী ও হাওড়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে অর্থাৎ কলকাতার অন্যতম হাওড়া রেল স্টেশন থেকে মহত্মা গান্ধী রোড বা এমজি রোড এর সাথে সংযোগ স্থাপন করে অত্র অঞ্চলের মানুষের লাইফ লাইন হিসাবে সমাদৃত। তাই হাওড়া ব্রিজ এই মহানগরীর জীবনরেখা স্বরূপ। হাওড়া ব্রিজ কলকাতার হুগলী নদীর উপর অবস্থিত তিনটি ব্রিজের মধ্যে একটি। বস্তুত এটি ঔপনিবেশিক শহরের সবচেয়ে ভাবপ্রণ বৈশিষ্ট্য এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হিসেবে খ্যাত। হাওড়া সেতু নির্মাণ করতে দীর্ঘ ৭ বছর সময় লেগেছে। হাওড়ার এই প্রসারিত খিলান সেতুর কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৪৩ সালে। কলকাতায় হাওড়া ব্রিজ এই একই বছরের মধ্যে যানবাহন চলাচল এবং জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয়। এই সেতুর নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। হাওড়া ব্রিজ এর পুরো কাঠামোটি রিভেট দ্বারা নির্মিত যেখানে আপনি কোথাও নাট ও বোল্ট এর ব্যবহার দেখতে পাবেন না। বর্তমানে হাওড়া ব্রিজ কলকাতার প্রবেশদ্বার স্বরূপ, যেটি এই শহরকে হাওড়া স্টেশনের সাথে সংযুক্ত করে, যা হল কলকাতার মূল রেলওয়ে স্টেশন ও ভারতের সবথেকে ব্যস্ততম স্টেশন। হাওড়া ব্রিজ ৭০৫ মিটার দীর্ঘ এবং ৯৭ ফুট চওড়া। হাওড়া ব্রিজের পরিকাঠামো ২৬,৫০০ টন প্রসারন সাধ্য ইস্পাত দ্বারা নির্মিত, যা দুটি স্তম্ভ দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত। প্রতিটি স্তম্ভ রাস্তার ঊর্ধ্বভাগে ৯০ মিটার জুড়ে অবস্থিত।

চলাচল :
কলকাতা ও হাওড়া জেলার মধ্যে চলাচলের ক্ষেত্রে হাওড়া ব্রিজ একটি অন্যতম ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন ব্রিজটির উপর দিয়ে প্রায় ১,৫০,০০০ জন পথযাত্রী এবং ১,০০,০০০ গাড়ি চলাচল করে থাকে।

॥ ৭ ॥
নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামঃ

আমরা হুগলী নদী হাওড়া ব্রিজ দিয়ে পার হয়ে ক্যাব থেকে নেমে নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ দ্বার থেকে একটু অদুরে নেতাজীর দাঁড়ানো বিশাল ভাস্কর্য। এমন একটি ভাস্কর্য সামনে পেয়ে ছবি না তুলে পারা যায়? আমরা নেতাজীর ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। ছবি তোলা শেষে এদিক ওদিকটা একটু ঘুরে দেখতে দেখতে স্টেডিয়ামের ভিতর থেকে গানের আওয়াজ কানে ভেষে আসলো। নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামটি বার হাজার আসন বিশিষ্ট সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। গেটের নিরাপত্তা কর্মীকে জিজ্ঞেস করতেই বললো,
-হ্যা গান হচ্ছে। জি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য সা-রে-গা-মা-পা অনুষ্ঠানের সুটিং চলছে। গ্র্যান্ড ফিনালের চিত্রায়ন চলছে আজ।
-প্রবেশাধিকার কি টিকিটের বিনিময়ে? জানতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা বললো,
-না, টিকিট সিস্টেম নয়, আমন্ত্রীতরাই কেবল ঢুকতে পারে।
আমরা দেখতে যেত চাইলে সাফ জানিয়ে দিলো,
-ভিতরে যাওয়া যাবে না।
আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললাম,
-আমরা সবাই আইনজীবী, এডভোকেট, বাংলাদেশ থেকে এসেছি আপনাদের দেশে ঘুরতে।
বাংলাদেশ থেকে এসেছি এবং আইনজীবী কথাটা শুনে নিরাপত্তা কর্মীদের একজনের মন গলে গেল। সে বললো
-এত দূর থেকে এসেছে যখন, যান ভিতরে যান।
অপর নিরাপত্তা কর্মী বললো,
-না না যেতে দেয়া যাবে না, কর্তৃপক্ষের নিষেধ আছে।
তবে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশী হিসাবে আমাদের সম্মান করলো এবং ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিলো। আমরা তিনজন ভিতরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ অনুষ্ঠানের রেকর্ডীং পর্ব দেখলাম। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র ইনডোর স্টেডিয়ামটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বাইরে প্রচন্ড গরমে শরীর সিদ্ধ প্রায়! ভিতরে প্রবেশ করার সাথে সাথে মনে হলো সাইবেরিয়ায় ঢুকে গেছি। তিনজনে দ্বিতীয় সারিতে গিয়ে চেয়ারে বসলাম। গান চলছে। আমরা ভিতরে বসে গানের অনুষ্ঠানের ছবি তুললাম। জামাল ভূইয়া গানটা ভিডিও করে ফেসবুকে ছেড়ে দিলো বিশাল স্টাটাস দিয়ে।
একটা গান শেষ হওয়ার পর পরিচালকের গলা, আমরা আবার যাব, আবার যাব, রেডি হও, এক দুই এক দুই তিন… শুরু হয়ে গেল গান। মন মাঝি রে…. আয় ফিরে আয়…. গানটি গাইলো। দরদ দিয়ে গাওয়া গানটি শুনে অন্যরকম শীতলতা অনুভব করলাম। সা-রে-গা-মা-পা অনুষ্ঠানটি খুব বেশি দেখিনি। বিছানায় শুয়ে টিভি দেখার সময় রিমোট টিপে টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করার সময় অল্প বিস্তর দেখেছি। রেকর্ডীং করা অনুষ্ঠানটা যখন অল্প বিস্তর দেখেছি তখন ভালই লেগেছিলো। আজ লাইভ দেখলাম। সত্যিই ওদের গানের গলা বেশ ভালো। দর্শকদের আগ্রহ আছে অনুষ্ঠানটিতে আর শিল্পীরা গায়ও চমৎকার, তাইতো এই শিল্পীরা নানা চড়াই উৎরাই পার হয়ে এমন একটি প্রতিযোগীতায় গ্রান্ড ফিনালে পর্যন্ত আসতে পেরেছে।
গানটি শেষ হওয়ার পর পরিচালক প্রতিযোগীদের একে একে ডাকলো মঞ্চে। প্রতিযোগীরা কিভাবে আসবে, এসে কি বলবে, কিভাবে সম্ভাষণ জানাবে ইত্যাদি দেখিয়ে দিচ্ছে। স্টেডিয়ামের গ্যালারীতেও প্রচুর দর্শনার্থীদের ভির। ছোট ছোট অনেক ছেলে মেয়ে একই রকম সাজে। মনে হলো, আগে গ্র“প নৃত্য হয়েছে বা হবে। আমরা কিছুক্ষণ ওখানে থেকে বেরিয়ে গেলাম। একজায়গা থেকে বেরোবার আগেই পরিকল্পনা চলতে থাকে, এখান থেকে কোথায় যাওয়া যায়! এবারও আমরা পরিকল্পনা করলাম, এবার গন্তব্য কফি হাউসে।

॥ ৮ ॥
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজও আছেঃ

স্টেডিয়ামের বাইরে এসে ক্যাবের জন্য অপেক্ষা। কয়েকটা ক্যাব পেলাম যারা কফি হাউস চেনে না। আর আমরাও চিনি না কোথায় বা কোন স্ট্রিটে কফি হাউস। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ক্যাব ডাকার সময় দেখি স্মার্ট এক লোক দাঁড়িয়ে আছে ক্যাবের অপেক্ষায়। তার নাম অভিরুপ দেওয়ান। অভিরুপ দেওয়ান ক্যামেলিয়া স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজির ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক। তিনি আমাদের একটি ক্যাব ধরিয়ে দিতে সহযোগীতা করলো। ওখানে ড্রাইভাররা কলস্ট্রিট বললে বেশ ভাল চেনে। কলস্ট্রিট প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সামনে বলে এক ড্রাইভারকে ধরিয়ে দিলো। এবার ড্রাইভার আমাদের নিয়ে ছুটে চললো কলস্ট্রিট ওরফে কলেজ স্ট্রিট এর দিকে। আকা বাকা রাস্তা ধরে পৌছে গেলাম সেই ঐতিহাসিক কফি হাউসের রাস্তায়।
ক্যাব থেকে নেমেই চোখ কপালে উঠে গেল। এত বড় বইয়ের বাজার আমি আগে দেখিনি। রাস্তার দুধার ঘেষে সবই বইয়ের দোকান। বইয়ের জন্য এক সমৃদ্ধ জায়গা বলেই মনে হলো। নতুন বই, পুরাতন বইয়ের গন্ধে এক অপূর্ব মাদকতা। আধুনিক সুন্দরী এক রমনীকে জিজ্ঞেস করতেই আঙ্গুল উচিয়ে দেখিয়ে দিলো কফি হাউস।

কফি হাউস, ইন্ডিয়ান কফি হাউস বা এ্যালবার্ট হল সম্পর্কে কিছু তথ্য না দিলেই নয় :
উত্তর কলকাতার বইপাড়া, কলেজ স্ট্রিট চত্বরে এটি অবস্থিত ও বাঙালির-আড্ডাস্থল, কলকাতার কফি হাউসগুলির মধ্যে সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউ এবং কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস-দুটিই প্রাচীনতম। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায় রাধাপ্রসাদ গুপ্তের দেওয়া স্মৃতিনির্ভর তথ্য অনুযায় ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের উদ্যোগে বাঙালি কফি সেবীদের জন্য সেন্ট্রাল এ্যাভিনিউর কফি হাউস খোলা হয় ১৯৪১-১৯৪২ সাল নাগাদ আর তার কিছুদিন পরেই খোলা হয় কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসটি। পরে, ১৯৫৭ সাল নাগাদ অ্যালবার্ট হল কফি হাউস ইন্ডিয়ান কফি বোর্ডের আওতা থেকে বেরিয়ে এসে শ্রমিক সমবায়ের আওতায় আসে। এই দুই কফি হাউসই ছিল এক কালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রধান আড্ডাস্থল। নিকটতম বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলির ছাত্রছাত্রীদের ভিড় করা ছাড়াও নামিদামী বুদ্ধিজীবী লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনীতিবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকদের আড্ডা দেওয়ার অবারিত জায়গা হিসাবে এটি খ্যাত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরানো বইয়ের বাজার ও নতুন বইয়ের বাজার সামনে আছে বলে হাউসটিতে সব সময়ই ভিড় থাকে। চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, বাঙালি অভিনেতা রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর মত প্রমুখ ব্যক্তিরাও কোননা কোন সময়ে এই কফি হাউসটিতে আড্ডা দিয়ে গেছেন। সংক্ষেপে এই কফি হাউসটি কলেজ স্ট্রিটের মর্মস্থলে অবস্থিত যেখানে প্রখ্যাত সব বুদ্ধিজীবিরা ঘন্টার পর ঘন্টা এক কাপ কফি নিয়ে আড্ডা জমান। পূর্বে অ্যালবার্ট হল নামে পরিচিত এই হলঘর বহু ঐতিহাসিক সভা বা জমায়েতের সাক্ষী।
আর্ন্তজাল ঘেটে পাওয়া যায় কফি হাউসের সেই আড্ডাটা… গানের সৃষ্টি ইতিহাস। ইতিহাস সমতুল্য গানের সৃষ্টির ইতিহাস জানলে পাঠক বন্ধুদেরও ভাল লাগবে।
প্রয়াত কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে’র কথা উঠলেই সবার মাথায় যে গানের সুর গুনগুন করে ওঠে সেটি নিঃসন্দেহে ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আর আর নেই। কফি হাউস গানটি নিয়ে মান্না দে সব সময় নিজের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব দেন গীতিকার সুরকারকে। বিনয়ী মান্ন দে’র মতে… তিনি শুধু গানটা গেয়েছিলেন মাত্র। হেমন্ত গাইলে গানটা সুপারহিট হতো আর শ্যামল মিত্র গাইলে তো হিট। তবে মান্নার কণ্ঠে যে গানটি চিরকালীন পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সেকথা স্বীকার করে নিয়েছেন গানটির সুরকার সুপর্ণকান্তি।
কফি হাউসের সেই আড্ডাটা গানটির গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় সুর দিয়েছিলেন নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষ। মান্না দের মতে, গৌরীবাবু লিখেছিলেন দুর্দান্ত। সুরকার সুপর্ণকান্তি অসাধারণ কাজ করেছিলেন। এই গানটির সৃষ্টিও হয়েছিলো বেশ নাটকীয় ভাবে।
১৯৮৩ সালের কথা, গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার তখন আশা ভোঁসলেকে নিয়ে প্রচুর হিট প্রেমের গান লিখে চলেছেন। কিন্তু পূজার গান মান্না দের জন্য তিনি লিখতে পারছেন না। সবই লিখছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে আক্ষেপ ছিল গৌরী প্রসন্নের মনে। এ সময় একদিন নচিকেতা ঘোষের নিউ আলিপুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন গৌরী প্রসন্ন। উদ্দেশ্য ছিল শক্তি ঠাকুরকে দিয়ে একটি গান তোলা। সেই সময় সেরা জুটি ছিলেন নচিকেতা ও গৌরী প্রসন্ন। সেই সূত্রে নচিকেতা ঘোষের ছেলে সুপর্ণকান্তির সঙ্গেও বেশ ভাল সম্পর্ক। তবে বাড়িতে আসার অনেকক্ষণ পরে সুপর্ণকান্তিকে দেখতে পেয়ে গৌরী প্রসন্ন মজা করেই বলেন, “কী, বাইরে আড্ডা মেরে সময় কাটাচ্ছ?” এর উত্তরে সুপর্ণকান্তি তার গৌরী কাকাকে বলেন, “কী সব গদগদে প্রেমের গান লিখছো। একটা অন্যরকম গান লিখে দেখাও না। এই আড্ডা নিয়েও তো গান লিখতে পারো।”
এবার গৌরী প্রসন্ন বলেন, “তুমি তো অক্সফোর্ডের এমএ হয়ে গিয়েছো। আড্ডা নিয়ে বাংলা গান গাইবে?” সুপর্ণ তখন বলেন, “কেন নয়। কফি হাউসের আড্ডা নিয়েও তো একটা গান লিখতে পারো।” এই তর্কের মাঝেই গৌরী প্রসন্ন মনে মনে দুই লাইন গান সৃষ্টি করে ফেলেন।
এরপরেই সুপর্ণকান্তিকে বললেন, লিখে নাও- ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই/ কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই।” সুপর্ণও সঙ্গে সঙ্গে দুটো লাইনেই সুর দিয়ে শুনিয়ে দেন। উপস্থিত শক্তি ঠাকুর সেবার পূজায় গানটা গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সুপর্ণ রাজি হননি। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে নিয়েছিলেন মান্না দের কথা।
পরদিন সকালেই গৌরী প্রসন্নের স্ত্রী সুপর্ণকান্তিকে ফোন দিলেন। সারা রাত জেগে বহুদিন পরে গান লিখেছেন অসুস্থ গৌরী প্রসন্ন। তখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত। দু’দিন পরে গানটা নিয়ে হাজির। কিন্তু শেষ স্তবক যোগ করার পক্ষপাতী ছিলেন না গৌরী প্রসন্ন। সুপর্ণকান্তি চান যোগ করুন একটি স্তবক। শেষ পর্যন্ত রাজি হন। লেখেন দুর্দান্ত সেই লাইন- ‘সেই সাতজন নেই, তবুও টেবিলটা আজও আছে।’ কিন্তু শেষ তিনটি লাইন তিনি লিখেছিলেন চেন্নাইয়ে চিকিৎসা করাতে যাওয়ার পথে হাওড়া স্টেশনে বসে একটি সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে। এক চেনা লোকের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দেন সুপর্ণকান্তির কাছে। তারপর সুপর্ণকান্তির সুরে মুম্বাইয়ে গানটি রেকর্ড করেন মান্না দে। তৈরি হয়ে যায় একটা ইতিহাস।
“সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই,
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই,
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউসে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,
কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে, কফি হাউসটা শুধু থেকে যায়।”
হাল জামানায় এই কফি হাউসটিকে আরো হৃদয়ের কাছা কাছি নিয়ে আসে প্রখ্যাত সঙ্গিত শিল্পী মান্না দে। তার গাওয়া গান-‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই… আজ আর নেই…………..কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেলগুলো সেই, আজ আর নেই…’ যখন থেকে গান ভাল লাগে তখন থেকেই শুনছি গানটা। গানের সুরে মাদকতাতো আছেই, সেই সাথে আছে ইতিহাস, গল্প। গানের চরিত্র বন্ধু নিখিলেশ সন্যাল, সুজাতা, মইদুল, গোয়ানিস ডি সুজা, অমল, রমা রায় নামের কিংবদন্তিরা আজ আর নেই। মান্না দে’ও চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবরে। গানের অপর এক কিংবদন্তী মইদুল ৭৮ বছর বয়সে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান। ইতিহাসের ঐতিহাসিক ব্যক্তিগণ মারা গেলেও ইতিহাস তো মরে না। এখনো ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই স্বগৌরবে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে মান্না দে’র বিখ্যাত সেই কফি হাউজ।
দোতলায় উঠতে প্রথমে চোখে পড়লো সামনে টানানো ‘কফি হাউজ’ সাইনবোর্ডটা। আর দশটা বাঙালি ধাঁচের হোটেল রেস্টুরেন্টের মতোই কলকাতা কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউজটি। বিশাল পুরাতন এক হল রুম। পঞ্চাশ-ষাটটার মতো টেবিল সারি সারি সাজানো। বিশেসত্ব হলো টেবিল গুলো খুবই ছোট। ছড়ানো ছিটানো চেয়ার। দেয়ালে সারি সারি সাজানো ভারত বর্ষের বিখ্যাত সব শিল্পীর চিত্রকর্ম তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্মটিই মনে হলো সবচেয়ে বড়। ভিতরে ঢুকে এদিক ওদিক দেখে নিলাম। সব টেবিলই পরিপূর্ণ। ডান কোনের দিকে একটি টেবিল খালি পড়ে আছে। আমাদের দেশে এ ধরনের হোটেলে সাধারণত কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়ই থাকে বেশি। সেখানে নবীন-প্রবীণদের মিশ্রণে জমজমাট আড্ডা দেখে বেশ ভালোই লাগলো।
ইন্টারনেট ঘাটনে কফি হাউস সম্পর্কে আরো যে তথ্য পাওয়া যায় তা হলো, বাঙালির প্রাণের এ আড্ডাস্থলটির নাম এক সময় কফি হাউজ ছিল না। অ্যালবার্ট হল ছিল এর পূর্বনাম। ১৮৭৮ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ব্রিটিশ রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী অ্যালবার্টের নামকরণে এটির নাম করণ করা হয়। এরপর কেটে গেছে প্রায় ১৪০ বছর। উপমহাদেশে বৃটিশবিরোধী নানা আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক ইতিহাসে জড়িয়ে আছে কফি হাউজটির কোনায় কোনায়। ব্রিটিশ-ভারত বর্ষে এ অঞ্চলের রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল এ কফি হাউজ। নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের সূত্রপাতও হয়েছিল এ কফি হাউজ থেকেই। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বসু, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, বাঙালি অভিনেতা রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বিখ্যাত ব্যক্তিরা আড্ডা দিয়েছেন এই কফি হাউজে!
সেই বিখ্যাতদের কাতারে ক্ষণিকের জন্য নিজেদেরকে ভেবে কিঞ্চিত পুলকিতও বোধ করলাম। আমিও আজ সেই কফি হাউজে! চোখের সামনেই যেন এক এক করে ভেসে উঠছিল বিখ্যাত মুখগুলো। হাউজটির চারদিকে সাজানো রয়েছে সেই বিখ্যাত মানুষগুলোর চিত্র। চারদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম। বিখ্যাত ব্যক্তি সহ সেই সাত জন নেই আজ টেবিলটা পড়ে আছে সাতটি পেয়ালা আজো খালি নেই। একি সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুড়ি শুধু সেই সেদিনের মালি নেই!!
আমরা তিন বন্ধু ভিতরে ডান দিকের কোনে একটা টেবিলে বসে পড়লাম। হুগলী নদীর তীরে সেই কবে পাকুড়া খেয়েছি তা কি এখনও আছে? হজম হয়ে তা এখন নির্গমনের অপেক্ষায়। চিন্তা করলাম খালি কফিতে হবে না। টেবিলে মাথায় পাগরী পড়া কোন এক নতুন মালি এসে জানতে চাইলো
-কি নেবেন? সাথে ধরিয়ে দিলেন একটা চার্ট।
চার্টের তালিকার উপরের দিকে পড়ে দেখলাম মাটন হাক্কা চাওমিন, চিকেন হাক্কা চাওমিন সহ আরো অনেক কিছু। ভারী খাবার খাব সিদ্ধান্ত নেয়ায় মাটন হাক্কা চাওমিন অর্ডার দিলাম দুই প্লেট সাথে একটি খালি প্লেট। ওয়েটার ঘুরে এসে জানালো
-শেষ, চাওমিন পাওয়া যাবে না।
এবার পাকুরা বা অন্য কিছু আনতে বলায় ওয়েটার কাউন্টার থেকে ফিরে এসে বলছে,
-স্যার, মাটন হাক্কা চাউমিন হবে, করে দিতে পারবো।
আমরা আর অন্য কোন আইটেম না চিন্তা করে অর্ডার ফাইনাল করলাম। কিছুক্ষণ বসে গল্প আর ছবি তোলার ফাকে চার দিকে চোখ বুলাচ্ছিলাম। যাকে দেখি তাকেই মনে হয় কবি কবি চেহারা। কে যে কবি লেখক আর কে যে পাঠক বা আমাদের মত আগন্তুক দর্শক বোঝা বড় দায়। আমাদের টেবিলের সামনে একটা টেবিল পরে তিন জন মেয়ে ও একজন ছেলে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মেয়ে তিনজন দেদারছে সিগারেট টানছে খুব ভাব নিয়ে। ডান পাশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল ছবিটার কাছে বসা মেয়েগুলো সিগারেট টানছে তাতেও কোন দোষ নেই, কিন্তু নাক দিয়ে ধুয়াও ছাড়ছে এটাই যা দোষ! মুরাদ মুন্সী দেখে বলে বসলো,
-দেখেন ভাই মেয়েগুলো করছে কি, সিগারেট টানছিস টান, নাক দিয়ে ধুয়া ছেড়ে রং চো… দরকার কি!
বেশিরভাগ টেবিলেই এক বা একাধিক মেয়ে মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছে আর সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছে। কফি হাউসের পুরো রুমটা ধুয়ায় ঘোলাটে হয়ে গেছে। চোখ জ্বালা করছে। ওয়েটার আমাদের জন্য মাটন হাক্কা চাওমিন আর খালি প্লেট নিয়ে এসে হাজির। জামাল ভূইয়া খালি প্লেটটা টেনে নিয়ে প্রথমে মুরাদ মুন্সীর সামনে দেওয়া প্লেট থেকে কিছুটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। আমি আমার প্লেট থেকে কিছুটা তুলে দিলাম। সাথে অর্ডার দিলাম কফি। ওয়েটার ঠান্ডা কফি নিয়ে এলো। খাবারের ফাকে ফাকে কফি খাচ্ছি। ঠান্ডা কফিতো তাই আমার বন্ধুরা জুসের মত স্ট্র দিয়ে এক টানেই মনে হয় শেষ করে দিয়েছে। আমি বললাম,
-অল্প কফি খেতে হয় আর বেশি সময় কাটাতে হয়! তোমরা তো এক টানেই শেষ করে দিলে।
আমি ঠান্ডা কফি শেষ করে বললাম,
-আমি ধুমায়িত কফি খাব।
ঠান্ডা কফিতে কফি হাউসের আড্ডা জমার কথা নয়। আমার ধুমায়িত কফি চাই। ওয়েটারকে ধুমায়িত কফির জন্য বলা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই টেবিলে চলে এলো এক কাপ ধুমায়িত কফি। জামাল ভূইয়া ও মুরাদ মুন্সী হট কফি নিলো না। অগত্যা আমার ধুমায়িত কফির কাপ হাতে নিয়ে মুরাদ মুন্সী বেশ কয়েকটা ছবি তুললো। জামাল ভূইয়াও বাদ গেলো না।
বেশ কিছুটা সময় কফি হাউসে কাটিয়ে বিল পরিশোধ করে ওয়েটারকে কিছু টিপস দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেরোতে বেরোতে চিন্তা করলাম ‘কফি হাউসের আড্ডাটা আজও আছে, শুধু মানুষ গুলো বদলে গেছে। হাউসটা ঠিকই আছে বদলায়নি, বদলায় মানুষ, আড্ডায়, চরিত্রে, স্বভাবে, রুচিতে, বয়সে…….

॥ ৯ ॥
তুমি হারিয়ে যাওয়ার সময় আমায় সঙ্গে নিও….
মিলন মামার হারিয়ে যাওয়া

কফি হাউস থেকে বেরোলেই রাস্তার অপর পাশে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির গেইট। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যাব ডাকছি কিন্তু খালি ক্যাবগুলি যেতে রাজি হচ্ছে না আবার যাওয়ার মত কোন খালি ক্যাবও পাচ্ছি না। আমরা এখন যাব নিউ মার্কেটে। শরীয়তপুর থেকে বৃহস্পতিবার সকালে রওয়ানা দিয়ে আমি, মুরাদ মুন্সী ও জামাল ভূইয়া আসছি কলকাতা ভ্রমণে। বৃহস্পতিবার রাতের বাসে বেনাপোল এসেছে শরীয়তপুর বারের সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট আসাদ খান মিলন ও এডভোকেট রুহুল আমিন ভাই। সারা রাত বাস জার্নি শেষে সকালে ইমিগ্রেশন পার হয়ে কলকাতায় প্রবেশ করেছে। আসাদ খান মিলন মামা ও রুহুল ভাই শুক্রবার সকালে এসে উঠেছে হোটেল প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল গেষ্ট হাউসে। প্যারাডাইস ইন গেষ্ট হাউস নিউ মার্কেট এলাকার মারকুইজ স্ট্রিটে। তারা শরীয়তপুর বসেই রুম বুক করে এসেছিল। ফলে তাদের আর হোটেল খোজার ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। রুহুল ভাই বিদেশ ভ্রমণে বেশ অভিজ্ঞ, তাই অভিজ্ঞতার একটা দাম আছে না! কফি হাউসে আসার পথে মিলন মামার ফোন।
-মামা, তোমাদের সাথে কি রুহুল আছে?
আমি বললাম, নাতো মামা, কোন সমস্যা? মামা জানালো,
-আরে রুহুল আমায় নিউমার্কেটের রাস্তায় রেখে কোথায় যেন গেছে, এখন আমি হোটেলের নাম ভুলে গেছি, রাস্তাও ভুলে গেছি। রুহুলকে বার বার ফোন করছি ও ফোনও ধরছে না। তুমি একটা ফোন দিয়ে রুহুলকে বলো আমাকে ফোন করতে।
আমি সাথে সাথে রুহুল ভাইকে ফোন দিলাম কিন্তু রুহুল ভাই আমার ফোনও ধরছে না। রুহুল ভাই হোটেলে ওঠার পর আমার ফেসবুকের স্টেটাসে দেওয়া একটা ছবিতে কমেন্টসে গিয়ে লিখেছিলো যে তারা মারকুইজ স্ট্রিটের প্যারাডাইস ইন হোটেলে উঠেছে। যেহেতু মামা হোটেলের নাম ও রাস্তার নাম ভুলে গেছে তাই আমি তাকে ফোন করে বললাম,
-মামা আপনার হোটেলের নাম প্যারাডাইস ইন, এটা মারকুইজ স্ট্রিটে।
নাম বলায় এবার মামার সব মনে পড়ছে। আমাদের জানালো,
-ওকে, ওকে! আমি এবার যেতে পারবো।
আমি মামাকে বললাম, আমরা কফি হাউসে যাচ্ছি। কফি হাউসের কাছাকাছি চলে এসেছি। আপনি যদি সমস্যা মনে করেন তবে একটা ক্যাব নিয়ে ড্রাইভারকে কলেজ স্ট্রিটের কথা বলে কফি হাউসে চলে আসেন। আমরা পরে আপনাকে পৌছে দেব। মামা আমাদের জানালো,
-কোন সমস্যা নাই। আমি যেতে পারবো।
অভিজ্ঞ রুহুল ভাইয়ের এহেন আচরণে মামা ভীষণ ক্ষুব্ধ! মামা রেগে গিয়ে পরদিনের বাস ধরে বাড়ি চলে যাবে সিদ্ধান্ত নিল! পরে অবশ্য মাথা ঠান্ডা হয়েছে! ভ্রমণ শেষেই কলকাতা ছেড়েছে।
কফি হাউসের আড্ডার ফাকে আবার মামাকে ফোন দিলাম,
-মামা কোন সমস্যা? হোটেল খুজে পেয়েছেন? মামা উত্তরে জানালো,
-কোন সমস্যা নেই, আমি হোটেল খুজে পেয়েছি, এখন হোটেলে এসে বিশ্রাম নিচ্ছি, কোন চিন্তা করো না।
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আমরা চিন্তা করলাম, অপরিচিত জায়গায় এসে মামা হয়তো বিপদেই পড়েছে। হয়তো একাকিত্ব বোধ করছে। আমরা বরং মামার হোটেলে যাই, আমরা গেলে তার হয়তো ভাল লাগবে। কিন্তু প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তায় কোন ক্যাব পাচ্ছি না। আমরা একটু হেটে এগিয়ে মোড়ের দিকে গেলাম। মোড়ে শ্রী নিকেতনের বিশাল দুটি শোরুম। সেই মোড় থেকে একটা ক্যাব নিয়ে রওয়ানা দিলাম নিউমার্কেট এলাকায় মারকুইজ স্ট্রিটের প্যারাডাইস হোটেলে। হোটেলে গিয়ে রিসিপশনে গিয়ে খোঁজ নেব এডভোকেট আসাদ খান মিলন সাহেব কত নাম্বার রুমে আছে? এমন সময় হোটেলের দরজায় এসে দাঁড়ালো বিশাল কার্টন হাতে রুহুল ভাই। আমাদের দেখে বললো,
-আসো, আমাদের রুমতো দোতলায়!
আমরা তার সাথে দোতলায় গিয়ে দরজা নক করলাম। কিন্তু দরজা ভিতর থেকে আটকানো অথচ নক করার পরেও খুলছে না। ভাবলাম মামা কি আবার নিচে গেল? অনেক ক্ষণ দরজায় নক করে অবশেষে ফোন দিলাম আমি। ভিতর থেকে ফোন রিসিভ করে মামা বলছে,
-হোটেলের দোতলায় আসো।
আমরা তার কথা দরজার এপাশ থেকে শুনতে পাচ্ছি কিন্তু মামা বলেই যাচ্ছে,
-আমি রুমে আছি, তোমরা দোতলায় চলে আস।
আবার দরজা নক করে বললাম আমরা আপনার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে। মামা এবার বললো,
-ওহ! দাঁড়াও, খুলছি।
আমরা ভিতরে প্রবেশ করে বুঝলাম, ক্লান্ত শরীরে মামার হালকা নিদ্রা ভাব চলে এসেছিল। তাই সে দরজা নকের শব্দ শুনতে পায়নি। আমাদের বসতে দিয়ে মামা পাকা আম দিয়ে আপ্যায়ন করলো। আম খেয়ে পাঁচ জনই বেরিয়ে পড়লাম রাতের খাবার খেতে। মারকুইজ স্ট্রিটের রাস্তায় হাটতে হাটতে রাস্তার শেষের দিকে একটা হোটেলে ঢুকে দোতলায় গিয়ে কোনের সিটে সবাই বসলাম। বেয়ারাকে আমাদের জন্য ভাত, ভর্তা, ভাজি, মাছ অর্ডার দিয়ে মামা নিলো দুটি রুটি ও সবজি। রাতের খাবারটা আমাদের সিনিয়রই খাওয়ালো। আমরা বিল দিতে চাইলে একটা ধমক দিয়ে মামা বিল পরিশোধ করলো। হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা একটি ক্যাব ধরে আবার ফিরে এলাম মউলালী স্ট্রিটে আমাদের হোটেলে। হোটেলের সামনে নেমে ভিতরে না ঢুকে চলে গেলাম পুলিশ বক্সের কাছে। আমাদের রুম যেহেতু চার তলায় তাই একবার হোটেলে উঠলে আর বের হওয়া হবে না। তাই চা খেয়ে উপরে উঠবো সিদ্ধান্ত নিলাম। যেই ভাবা সেই কাজ, আগের সেই দোকানটায় গিয়ে আমি আর জামাল ভূইয়া চা খেয়ে হোটেলে চলে এলাম। মুরাদ অবশ্য চা খেলনা, একে তো চিনি ছাড়া চা দিতে পারবে না তার উপরে চা খায়ও কম। আমাদের আবার অক্সিজেন গ্রহণের মত কিছুক্ষণ পর পর চা’ঠা না হলে হয় না।
হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সবাই লেগে গেলাম ফেসবুকে দিনের কর্মসূচী বর্ণনায়, আগের কর্মসূচীর প্রতিক্রিয়া দেখতে নোটিফিকেশন চেক করায়। আমাদের হোটেলে ছিল ফ্রি ওয়াইফাই সার্ভিস। হোটেলে ঢুকেই আমার নজরে পরেছে বিষয়টা। হোটেলের ম্যানেজারকে বলার সাথে সাথে আমাদের পাসওয়ার্ড বলে দিলো। আমরা যার যার মোবাইলে ওয়াইফাই কানেক্ট করে নিয়েছি। কিছুক্ষণ এক রুমে তিন জন তিনজনের কাজে লেগে গেলাম। এক রুমে থেকেও মনে হলো ভিন্ন ভিন্ন রুমে আমরা! কেউ কারো সাথে কোন কথা নেই! ভ্রমণের আনন্দ, ত্র“টি বিচ্যুতি, সুবিধা, অসুবিধা নানা বিষয় থাকলেও কারো সাথে কোন বিষয় নিয়ে কোন আলোচনা নাই।
কিছুক্ষণ ফেসবুক নিয়ে ঘাটাঘাটি করার পর আগামী সকাল শনিবার নিয়ে আলোচনায় বসলাম। আমার আর মুরাদ মুন্সীর আগ্রহ শান্তি নিকেতনে যাওয়ার, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার। কিন্তু জামাল ভূইয়া বাধ সাধলো। দুরত্ব বিবেচনায় জামাল ভূইয়া বললো, সকালে গিয়ে আমরা বিকালে আসতে পারবো না, তার পর কেনাকাটা আছে, তাই আমি শান্তি নিকেতনে যাওয়ার পক্ষে নাই। জামাল ভূইয়া ভাবির জন্য কেনাকাটা করবে, ছেলে মেয়ের জন্য কেনাকাটা করবেন। গৃহে শান্তি বজায় রাখাটা তার কাছে বেশি গুরুত্ব পেল, শান্তি নিকেতন ভ্রমন নয়। শান্তি নিকেতন শিল্প সাহিত্য প্রেমি বাঙ্গালীর জন্য এক তীর্থ স্থান। কিন্তু জামাল ভূইয়ার কাছে শিল্পর চাইতে শিল্পী বেগমই বেশি আগ্রহের মনে হল!
তিন জন এক সাথে এসেছি, একজন যাবে না দুজন যাবে সেটা হতে পারে না। তাতে ভ্রমণের আনন্দে ব্যত্যয় ঘটবে। অবশেষে শান্তি নিকেতন যাওয়ার পরিকল্পনা বিরস বদনে বাতিল করা হলো। সবকিছু বাদ দিয়ে ঘুমের মধ্যে শান্তি খোজার চেষ্টায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম আমরা।

॥ ১০ ॥
কলকাতা হাইকোর্ট, কলকাতা সিটি বার
ভ্রমণ ও নিউ মার্কেটে কেনাকাটাঃ

শনিবার সকাল। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে পরিকল্পনা শুরু কোথায় যাওয়া যায়। সিদ্ধান্ত হলো আজ প্রথমেই যাব ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে, তারপর ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে, তারপর কলকাতা হইকোর্ট ঘুরে নিউ মার্কেটে কেনাকাটা সারা। কারন, রবিবার সকালে দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব। তাই কোন কাজ বাকি রাখা যাবে না। আজকের দিনটাই শুধু আমাদের হাতে আছে। সকাল থেকে রাত অবধি যা কিছু করার করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ, সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। নিচে নেমে হোটেলের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলাম
-ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে যাব কিভাবে?
ম্যানেজার জানালো, ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গে যেতে পারবেন না। ওটা আর্মি এড়িয়া। সাধারণ কাউকে যেতে দেয়া হয় না। আপনারা যদি আর্মি পারসন হন বা কেউ পরিচিত থাকে তবে ঢুকতে পারবেন। আমরা যেহেতু আর্মি পারসন নই বা আমাদের কোন আর্মি পারসন পরিচিত নেই সেহেতু ফোর্ট ইউলিয়াম দূর্গে যাওয়া হবে না তাই জানতে চাইলাম আর কি কি দর্শনীয় স্থান আছে। আমাদের জানালো কলকাতা মিউজিয়াম দেখতে পারেন। আমাদের পরিকল্পনায় কলকাতা মিউজিয়াম ছিল না। আমরা যেহেতু উকিল মানুষ তাই আমাদের অপর তীর্থস্থান কলকাতা হাইকোর্ট, বার এসোসিয়েশন ঘুরবো। তাই সিদ্ধান্ত হলো আগে নাস্তা করবো। গতকাল সকালের মতই আমরা সেই ফুটপাতের সেই দোকানেই গেলাম। আজ আর বলতে হলো না দাদা একছো না দেড়ছো দেব? আজ দোকানি বেশ সমাদর করে বসতে দিলো এবং বললো,
-দাদা দেড়ছো করে দেই?
আমরা দেড়ছোর সাথে ডিম চাইলাম। আমাদের ডিম অমলেট করে দিলো। অর্ধেকটা নয় পুরোটা ডিমের পুরোটাই খেয়ে আগের দিনের মত পাশের দোকন থেকে পানি কিনে চায়ের দোকানে গেলাম। আমাদের জিজ্ঞেস করলো
-দাদা ছোট না বড়।
আমরা বড় বলায় মাটির তিন পেয়ালা বড় চা দিলো। খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ট্যাক্সির খোজে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। একটু দাড়াতেই একাধিক ক্যাব পেয়ে গেলাম। দরদাম করে রিক্সা ভাড়ার পরিমান টাকার বিনিময়ে ক্যাব নিলাম যাদুঘরে যাওয়ার জন্য। গল্প করতে করতে ক্যাব পৌছে গেল যাদুঘরের সামনে। ভাড়া মিটিয়ে ভারতীয় গংগ্রাহালয়ের সামনে আমরা কিছু ফটো সেসন করে জামাল ভূইয়া গেল প্রবেশের টিকিট কিনতে। গিয়ে দেখে ভারতীয়দের জন্য টিকিট মাত্র পঞ্চাশ টাকা আর ফরেইনারদের জন্য পাঁচশত টাকা অর্থাৎ পাঁচশত রুপি। বিষয়টা আমাদের কাছে একটু বৈষম্য মনে হলো। এতটা গলাকাটা দাম দিতে হবে? আমরা পর্যটক, ভারতীয়দের জন্য যদি টিকিট হয় পঞ্চাশ টাকা তবে আমাদের জন্য হওয়া উচিত ত্রিশ টাকা। আমরা অতিথি, অতিথির সাথে এতটা বৈষম্য দেখে অবাক হলাম। চিন্তা করলাম, একটা মিউজিয়াম প্রদর্শন করতে সারা দিন লেগে যাবে যদি ভাল ভাবে দেখতে চাই। আমাদের যেহেতু অনেক কাজ, আর আজকের দিনটাই হাতে আছে, সেক্ষেত্রে এতটা সময় সংগ্রাহালয়ে দেয়া যাবে না। তাই পনেরশ টাকা খরচ করে মিউজিয়ামে সময় কাটানো ঠিক হবে না। তিনজনই সিদ্ধান্ত নিলাম সংগ্রাহালয় পরিদর্শন বাতিল।
তাহলে এবার পরের প্রজেক্ট! আবার ক্যাব নিলাম কলকাতা হাইকোর্ট যাওয়ার জন্য। কলকাতা হাইকোর্ট যাওয়ার পথে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গের গেটের সামনে সিগনালে আমাদের ক্যাব থামলো। আমরা দূরথেকে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ অনুভব করে ছুটতে থাকলাম কলকাতা হইকোর্টের দিকে। পথিমধ্যে অনেক কিছুর দেখলাম যার ভিতর হৃদয়ে দাগ কাটলো গান্ধীজীর স্বল্প বসনা ভাস্কর্য। গান্ধীজী লাঠি হাতে হাটার ভঙ্গিমায় ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষনীয় বিষয় কোন ভাস্কর্যের পাদদেশ বা স্থাপনার দেয়ালে কোন পোষ্টার লাগানো নেই। আমাদের দেশে হলে প্রতিটা ভাস্কর্যের বা শিল্প কর্মের পাদদেশে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পোষ্টার, নেতাকে তেলিয়ে পাতি নেতার পোষ্টার বা কোন হারবাল চিকিৎসালয়ের রগরগে পোষ্টারে মোড়ানো থাকতো। সান্ডার তেল বিক্রি বা মোটকে চিকন, চিকনকে মোটা, বাকাকে সোজা করার শতভাগ নিশ্চয়তা সহ বিজ্ঞাপনের পোষ্টারে ঢাকা থাকতো। এখানে সেটা চোখে পড়লো না। সারা শহরে কোথাও ব্যানার বা ফেস্টুন দেখলাম না। আমাদের দেশে নেতার ছোট একটি ছবি দিয়ে চামচার বিশাল ছবিওয়ালা ব্যানার ফেস্টুন থাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে। ব্যানারে নেতাকে গুরুত্ব কম দিলেও নেতার তা বোঝার মত জ্ঞান খুব কমই আছে। তাছাড়া গাছে উঠতে না পারলে আমাদের দেশে কেউ নেতা হতে পারে না। পাতি নেতারা গাছের সাথে নিজেকে পেরেক মেরে দেখায় তারা কত বড় যিশু। এখানে হাতে গোনা দু’একটা ব্যানার দেখলাম তাও শুধু মমতা ব্যানার্জীর ছবিওয়ালা। শহরটা গাছে ভরা, কিন্তু কোন গাছে কোন পেরেক মারা নাই, সুতলি দিয়ে কোন ব্যানার টানানো নাই। গাছগুলো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অক্সিজেন ছাড়ছে মানুষের জন্য। দেখতে দেখতে আমরা পৌছে গেলাম কলকাতা হাইকোর্টে।

কলকাতা হাইকোর্ট :
কলকাতা উচ্চাদালত বা কলকাতা হাইকোর্ট ভারতের প্রাচীনতম হাইকোর্ট। ১৮৬১ সালের হাইকোর্ট আইন বলে ১৮৬২ সালের ১ জুলাই কলকাতা হাইকোর্ট স্থাপিত হয়। সেই সময় এই হাইকোর্টের নাম ছিল হাই কোর্ট অফ জুডিকেচার অ্যাট ফোর্ট উইলিয়াম। বর্তমানে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কলকাতা হাইকোর্টের অধিক্ষেত্রের অন্তর্গত। আন্দামান ও নিকোবরের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ারে কলকাতা হাইকোর্টের একটি সার্কিট বেঞ্চ আছে। কলকাতা শহরের সাম্মানিক নাগরিক শেরিফের ঐতিহ্যশালী দপ্তরটি এই আদালতের ভেতরে অবস্থিত।
স্থাপত্য শৈলীঃ হাইকোর্ট ভবনটি ইউরোপীয় গঠন শৈলীর গথিক স্থাপত্যবিশিষ্ট বেলজিয়ামের ইপ্রেস ক্লথ হলের আদলে নির্মিত। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্লথ হল ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেটি পুনর্নিমাণের জন্য ওই শহরের মেয়র কলকাতা থেকে এক সেট প্ল্যান চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। ১৮৬৪ সালের মার্চ মাসে ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। নির্মাণকার্য শেষ হতে সময় লেগেছিল আট বছর। এই ভবনে একটি ১৮০ ফুট উঁচু টাওয়ার আছে। হাইকোর্ট ভবনের নকশাটি বেশ জটিল। এই প্রসঙ্গে রথীন মিত্র লিখেছেন, ‘একটা চতুষ্কোণীর চারধারে অবস্থিত একটি আয়তাকার স্থাপত্য। ভেতরে অনেকগুলি বিচার কক্ষ, অন্যান্য ঘর। ছাদের সঙ্গে লোহার একটি সুন্দর গম্বুজ আছে, যা ভেতরের গরম হাওয়া টেনে বের করে নিয়ে বাহিরে পাঠিয়ে দিতে পারে। বাড়ির ভেতরের বাতাস হয়ে যায় নির্মল ঠান্ডা। চারিদিকে সুন্দর বাগান, ফোয়ারা।
পরবর্তী পর্যায়ে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর দিকে নতুন করে এর সংলগ্ন আরও একটি ভবন নির্মাণ করা হয় এবং পরবর্তী ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ দিকে হাইকোর্ট ভবনের বর্তমান স্থাপত্যের সঙ্গে সমতা রেখে আর একটি নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। চতুর্ভুজাকার এই হাইকোর্ট ভবন দৈর্ঘ্যে ৪২০ ফুট এবং প্রস্থে ৩০০ ফুট।
বিচারপতিগণঃ ১৮৭২ সালে স্যার বার্নেস পিকক কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হন। হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় বিচারক ছিলেন শম্ভুনাথ পন্ডিত। হাইকোর্টের প্রথম ভারতীয় প্রধান বিচারপতি ছিলেন রমেশচন্দ্র মিত্র এবং প্রথম পূর্ণ মেয়াদের ভারতীয় প্রধান বিচারপতি ছিলেন ফণীভূষণ চক্রবর্তী। হাইকোর্টের দীর্ঘতম মেয়াদের প্রধান বিচারপতি ছিলেন শংকরপ্রসাদ মিত্র।
কলকাতা হাইকোর্টের বাম দিকের সড়কে গাড়ি থামিয়ে দিলে আমরা নেমে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। শনিবার বন্ধ ছিল কোর্ট। ফলে কোন মক্কেলের আনাগোনা তেমন চোখে পড়লো না। আর আইনজীবীদের চেম্বারও তেমন একটা দেখলাম না। রাস্তার পাশের বিল্ডিংয়ে নোটারী পাবলিকের দু’একটা অফিস চোখে পড়লো। আমরা বার এসোসিয়েশন কোথায় জানতে চাইলে সিটি বার দেখিয়ে দিলো একজন। হাটতে হাটতে কলকাতা সিটি বার এসোসিয়েশন এর সামনে গেলাম। একটা ভবনের নিচতলায় এক রুমের বার এসোসিয়েশন রুম। ভিতরে প্রবেশ করে দেখা হলো এক শুকনা ভদ্রলোকের সাথে। জামাল ভূইয়া পরিচয় দিলো, আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আমরা সবাই এডভোকেট। আমাদের পরিচয় পেয়েও তার মধ্যে তেমন কোন ভাবলেশ নেই। ভিতরে রুমের পিছন দিকে আরো কয়েকজন আইনজীবী বসে গল্প করছে। আমাদের সাথে দায়সারা কিছু কথা বলার পর মনে হচ্ছে এই লোক সামাজিকতা বুঝে না। আমরা বার থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক একটু ঘুরে কলকাতা হাইকোর্টের সামনের দিকে চলে এলাম। সিনেমায় হাইকোর্টের যে চিত্র দেখায় সেই সামনের অংশের বর্ণনা আমার ভাষায় আসে না। হাইকোর্টের সামনে আসার আগে আমরা রাস্তার ধারে মাটির ভারে চা খেলাম। রাস্তার ধারে ধারে আমাদের দেশে যেমন লাল সালু কাপড় মোড়ানো তামারি থাকে, মাজারের নামে টাকা তোলার জন্য, এখানেও ছোট ছোট মন্দির আছে। এক লোক কালো লেংটি পড়ে ফুটপাতের পানির কল থেকে একটা বালতি ভরে গোসল সারলো। তারপর একবালতি পানি নিয়ে ছোট একটা বটগাছের নিচে স্থাপিত ছোট মন্দিরে পানি ছিটিয়ে প্রণাম করলো। লোকটি যে লেংটি পরেছে আমার মনে হলো ওটা পরা আর না পরা একই কথা। তারপরও তার ভক্তি দেখে আমার দেশের সাথে কিছু মিল পেলাম। ঢাকা হইকোর্টের মাজারে এমন ভক্ত অনেক দেখা যায়, সারা সপ্তাহ গোসল করে না, সারাদিন গাজা টানে তারপরও তাদের মধ্যে পীরের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা অঢেল।
আমরা ফুটপাত ধরে একটু এগিয়ে গেলেই কলকাতা হাইকোর্টের সামনের অংশ। হাইকোর্টের সামনে বিশাল বিশাল বটবৃক্ষ। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত এলাকাটা। বটগাছগুলোর মধ্যে কয়েকটার গোড়ায় পাকা করে বসার স্থান করে দিয়েছে সরকার। আমরা বসতে চাইলেও উপরের পাখিগুলোর আচরণ ভাল মনে হলো না। টুপ টাপ ঝরাচ্ছে। নিচের ফুটপাত সাদা করে ফেলেছে, কলকাতা হাইকোর্ট এলাকার পাখিরা কি চুন খায়!
আমরা হাইকোর্টের সামনে স্থাপিত বিপ্লবী সূর্য্য সেন (মাষ্টারদা) এর বিশাল এক ভাস্কর্য দেখে দাঁড়ালাম। আমাদের দেশ হলে এই মূর্তি এতদিন দাঁড়িয়ে থাকতো না। হেফাজত সরকারের সাথে আলাপ আলোচনা করে মূর্তির হেফাজত করে ফেলতো। কিন্তু কলকাতায় সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে সূর্য্য সেনের ভাস্কর্য। আমরা মাষ্টরদা সূর্য্য সেনের সাথে বেশ কিছু ছবি তুললাম। কলকাতা হাইকোর্টকে পিছনে রেখে ফটো সেসনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি তুলি মুরাদ মুন্সীর ছবি আবার মুরাদ মুন্সী তোলে আমার ছবি। বলে রাখা ভাল, মুরাদ মুন্সী আবার ফটোগ্রাফির উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। তাই মুরাদ মুন্সীকে দিয়ে ছবি তোলার আগ্রহটা আমার একটু বেশি। জামাল ভূইয়া একাই সেল্ফি তুলে যাচ্ছে। সেখানে আরেক বিদেশী এসে কিছু ছবি তুললো। সে যে বিদেশী তা বোঝার জন্য তার পাসপোর্ট দেখতে হয়নি! সাদা চামরার লোক। আমাদের দেখে সে একটু মুচকি হেসে হাই হ্যালো করলো। আমরাও স্বভাব সুলভ ভাবে তার সাথে হাই হ্যালো বিনিময় করলাম।
জামাল ভূইয়া যেহেতু আমাদের কলকাতা ভ্রমণের টিম লিডার তাই এরই মধ্যে সে একটা ট্যাক্সী ক্যাব ঠিক করে ফেলেছে। আমরা ক্যাবে উঠে নিউ মার্কেটের দিকে রওয়ানা দিলাম। কলকাতা ভ্রমণে একমাত্র মুসলিম ক্যাব ড্রাইভার পেলাম। ড্রাইভার বুঝতে পারলো আমরা বাঙ্গালী এবং মুসলমান। সে আমাদের সাথে গল্প জমিয়ে দিলো। কিভাবে ভারতে ইসলাম প্রচার শুরু হয়, কত কন্টকময় পথ ছিল এখানে ইসলাম প্রচার করা এবং প্রসার ঘটানো। বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ভারত বর্ষে ইসলাম টিকে আছে সেই বয়ান করছে আর গাড়ি চালাচ্ছে। ড্রাইভার সাহেব আবার পীর মুরশিদের ভক্ত। আমাদের সাথেও এক ভক্ত আছে। এডভোকেট জামাল ভূইয় মাইজ ভান্ডারীর মুরিদ। পীরের আরেক ভক্ত পেয়ে জামাল ভূইয়া তো বেশ পুলকিত! জমিয়ে দিলো দুজনে। আমি আর মুরাদ মুন্সী তাদের দুজনের কথার ফাকে ফাকে সুর মিলিয়ে আবার নজর ফিরিয়ে নিচ্ছি বাইরের দিকে। আমাদের আগ্রহ সৌন্দর্যের দিকে। দুজনেই কলকাতা শহরের ফুটপাতে সৌন্দর্য খুঁজে বেরাই। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ফুটপাত, গাছপালা, ভাস্কর্য, ফুটপাতে পশু-পাখি, দাড়ানো নর-নারী কিছুই বাদ যাচ্ছে না। যা দেখছি তাতেই মুগ্ধ হচ্ছি। চলতে চলতে জামাল ভূইয়া ড্রাইভারকে একটা গানও শুনিয়ে দিলো। ‘একদিন আমার বড় পীরে ডাকিয়া কয় খাজারে… আমার পিছে নামাজ পরবে যেইজনা যেইজনা ॥ ফজরেরও নামাজ যেইজন, আদায় করিবে সেইজন, বিনা হিসাবে বেহেশত বাসি বলছে রব্বানা।’ সাথে যেহেতু আছি, আমরাও বাদ পড়লাম না, শুনে ফেললাম গানটা। জামাল ভূইয়ার গানের গলা প্রশংসা পাবার মত না হলেও বেশ ভালই গাইলো। গান শেষ হতে না হতেই আমরা পৌছে গেলাম নিউ মার্কেটের সামনে। আবারও সেই একই অবস্থা, নিউ মার্কেট যে কোনটা বোঝা বড় দায়, সবগুলোই কি নিউ মার্কেট!
একটা মার্কেটের সামেনে নেমে ড্রাইভারকে বকসিস সহ ভাড়া মিটিয়ে ঢুকলাম মার্কেটের ভিতরে। অনেকক্ষণ হাটাহাটি করলাম মার্কেটের ভিতরে। কলকাতা এসেছি, কিছু কিনে নিয়ে যাব না এটা কি হয়। যদিও আমি ভ্রমনে বের হলে কেনাকাটার পক্ষে নাই। ভ্রমণ করতে এসেছি শপিং করতে নয়। কেনাকাটা করে যদি সময় ও পয়সা নষ্ট করি তবে ভ্রমণের আনন্দ থাকে না। তার উপর আমার স্থুলকায় দেহ। নিজের শরীর নিয়েই নিজে চলতে পারি না, তার উপর যদি কেনাকাটা করি তবে ব্যাগের ওজন বাড়বে। ব্যাগের ওজন বাড়া মানে শরীরের ওজন বাড়া। আমি ব্যাগ টানাটানির পক্ষে নাই। তবুও সবাই দেখি কেনাকাটা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে গেল। আমিও ওদের সাথে কয়েকটা জয়পুরি থ্রিপিছ কিনলাম। বাড়িতে নিজের বউ আছে, ভাইয়ের বউ, দুটি বোন। তাদের জন্যই শুধু কিনলাম। নিজের কন্যার জন্য ও বাবার জন্য কিনলাম শুধু চকলেট আর পঙ্গু বা প্রতিবন্ধী আম মানে ল্যাংড়া আম। আমি অবশ্য মেয়ের জন্য একটা ড্রেস পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু মেয়ের সাইজে পেলাম না। দামও ছিলো ভালো, কিন্তু আমার কলিজার টুকরা মেয়ের জন্য পছন্দের জামাটার কাছে দাম কোন বিষয়ই না। জামাল ভূইয়া ঈদের কেনাকাটা সেরে ফেললো। বউয়ের জন্য, পুত্র-কন্যার জন্য নিজের জন্য, মা-শাশুরির জন্য কেনাকাটা করলো। কারো জন্যই বাদ রাখলো না। মুরাদ মুন্সীও বউয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করলো। তবে নিজেদের জন্য সবাই কিনলাম।
আমি শ্রী লেদার থেকে নিজের জন্য জুতা, স্যান্ডেল, ভ্রমণের সময় পাসপোর্ট, মোবাইল, টাকা পয়সা রাখার মত লেদারের সাইট ব্যাগ কিনলাম। মেয়ের জন্য একটা সুন্দর জামা পছন্দ হলেও সাইজের জন্য কিনতে পারলাম না। আমার মেয়ের বয়স মাত্র আড়াই বছর, কিন্তু যা পছন্দ হয়েছে তা চার থেকে পাঁচ বছরের মেয়েদের জন্য। তাই মনটা একটু খারাপই হল।
আমার আর মুরাদ মুন্সীর কেনাকাটা সহজেই শেষ হলো কিন্তু জামাল ভূইয়ার কেনাকাটা তো আর শেষ হয় না। আমরা দুজন জামাল ভূইয়াকে মার্কেটের ভেতরে রেখে বাইরে চলে এলাম। মার্কেটের ভিতরে বেশ গরম। বাইরে একটু হাওয়া বাতাশ চলাচল করে তাই বাইরে এসে অপেক্ষা করছি আর কেনাকাটার চাইতে মার্কেট ও মার্কেটে আগতদের দেখাটাই বেশ উপভোগ্য মনে হলো। তাই আমি আর মুরাদ মুন্সী মার্কেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখছি!
জামাল ভূইয়ারও কেনাকাটা শেষ হলো। বেরিয়ে এলে এবার পেটের কামড়ানি অনুভব করলাম। অনেকক্ষণ হাটাহাটির পর ক্লান্ত ও খুধার্ত বোধ করছিলাম। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম বাংলা খাবারের হোটেল কোথায় আছে। সবাই গলি দেখিয়ে দিলো। আমরা গলি দিয়ে হাটতে হাটতে কোনের দিকে একটা হোটেল দেখতে পেলাম। শো-কেসে খাবার সাজিয়ে রেখেছে। ভেন্ডি ভাজি বা ডেঢ়স ভাজি, কড়লা ভাজি, বিভিন্ন ভর্তা, মোড়গের মাংস, মাছ দেখে খিদেটা ঝিলিক মেরে উঠলো। ভর্তা-ভাজি দেখে আমরা ঢুকে গেলাম হোটেলে। মুসলিম হোটেল। ছোট পরিসরে হোটেলটি। ঢোকার দরজার কাছেই বেসিন দেয়া। আমরা ব্যাগগুলো চেয়ারে রেখে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। এরপর খাবার অর্ডার দিলাম। আমাদের সাদা ভাত আর বিভিন্ন ভর্তা, মাছ, মোড়গের মাংস দিল। খাওয়া শেষে হাত মুখ ধুয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললাম। এখানকার ভাতগুলো বেশ ভাল। বাশমতি চালের ভাত। দেখতে মনে হয় নুডুলস ছোট ছোট করে ভেঙ্গে শিদ্ধ করা। ভাতের ঘ্রাণটাও বেশ মম করে। খাওয়া দাওয়া শেষে বেরিয়ে দেখি রাস্তার ধারে চকোলেটসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। আমরা দোকনটা থেকে চকলেট নিলাম। জামাল ভূইয়া জিরা কিনলো এক কেজি। এখানে জিরার কেজি মাত্র দুইশ টাকা। তাকে দেখে আমিও নিলাম। আমাদের দেশে জিরার দাম আকাশ ছোয়া। এখানে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে। কেনাকাটা শেষে রাস্তায় দাঁড়াতেই একটা ক্যাব পেলাম। বেশি দরদাম করতে হলো না। এখানে একটা কথা না বললেই নয়, কলকাতায় কিছু ক্যাবের গায়ে লেখা রয়েছে নো রিফিউজাল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্যাবই আপনাকে রিফিউজ করবে। আবার মিটারে যেতেও অনিহা দেখায়। একটু বাড়িয়ে দিলেই যেতে রাজি হয়। তবে বাড়িয়ে দেয়ার পরিমানটা খুব একটা বেশি নয়। গা সওয়া বলে আমরা বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করিনি কখনো। ক্যাব নিয়ে ছুটে চললাম মউলালী এজেসি বোস রোড হোটেল প্লানেট ইন্টারন্যাশনাল গেষ্ট হাউস। হোটেলে উঠেই ফ্রেশ হওয়ার পালা। পালাক্রমে তিনজন বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম। সেই ফাকে চলতে থাকে সারাদিনের ছবি আদান প্রদান। শেয়ারইট নামে একটা এ্যাপস আছে যা যাদুকরী কাজ করে। ছবি শেয়ারের পর চলতে থাকে ফেসবুকে পোষ্ট দেয়া। কিছুক্ষণ এভাবে চলতে থাকলো। এর পর একে একে রেডি হয়ে গেলাম বেরিয়ে পড়ার জন্য। আজ শনিবার। আজকের দিনটিই আছে হাতে। যা করার, যা ঘোরার আজকেই সারতে হবে।

॥ ১১ ॥
বেগম রোকেয়া স্মৃতি স্তম্ভ, সাইন্স সিটি,
হলে গিয়ে সিনেমা দেখা

বিকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে ক্যাবের জন্য অপেক্ষা। কোন ক্যাব আসছে না দেখে হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে পশ্চিম দিকে কিছুটা হেটে গেলাম ক্যাবের আশায়। সামনে কিছু ক্যাব দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভাবলাম দাঁড়িয়ে না থেকে এগিয়ে গিয়ে ক্যাব নেই। কিছুদূর হাটতে হাটতে পা থমকে গেল। কারন আর কিছুই না, একটা স্মৃতি স্তম্ভ দেখে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। একটা ভবনের পাশে ফুটপাতে বিশাল এক মিনার। রোকেয়া মিনার। মিনারে লেখা আছে
‘নারীমুক্তি আন্দোলনের দিশারী সাহিত্যিক শিক্ষাব্রতী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৬২/১ আচার্য জগদীশ চন্দ্র রোড (সাবেক ১৬২ লোয়ার সারকুলার রোড) স্থিত বাসভবনে প্রয়াত হন ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ সনে।
তিনি বঙ্গ বাসীকে ডাক দিয়েছিলেন
‘জাগো বঙ্গবাসী, দেখ কে দুয়ারে, অতি ধীরে ধীরে করো করাঘাত।’
আমরা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম বেগম রোকেয়ার স্মৃতি স্তম্ভ-‘রোকেয়া মিনার’। বাঙ্গালী নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত এই বাড়িতে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেছেন, তাঁর সম্মানে এখানে স্মৃতি স্তম্ভ করা হয়েছে অথচ তা চোখে পড়লো বিদায় বেলায়। আমরা কয়েকটা ছবি তুললাম মিনার নিয়ে। কলকাতায় বাঙ্গালী নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে, শ্রদ্ধা দেখিয়ে স্মৃতি স্তম্ভ করেছে, বাংলাদেশ থেকে এসে, দেখার পর দু’দন্ড দাড়াবো না তা কি হয়! এর পর আমরা একটা ক্যাব নিলাম সাইন্স সিটি যাওয়ার জন্য। কলকাতায় দর্শনীয় স্থান লিখে গুগলে সার্চ দিলে যে কয়টা স্থানের নাম আসে তার মধ্যে সাইন্স সিটি অন্যতম। আমাদের নিয়ে ক্যাব ছুটে চলছে। অবাক করার বিষয় একটার পর একটা ফ্লাই ওভার পার হচ্ছি কিন্তু কোন পয়সা নিচ্ছে না। টোল ফ্রি ফ্লাই ওভার, এটা ভাবা যায়? অথচ বাংলাদেশে একটা ফ্লাই ওভার পার হলে ইজারাদার পারলে দুইবার টোল নিতে চায় আর এখানে কোন টোল লাগলো না। আমরা কিছুক্ষণ পর পৌছে গেলাম সাইন্স সিটিতে। সাইন্স সিটির গেটে নেমে ভাবলাম কতক্ষণ লাগে সাইন্স সিটি ঘুরতে তাই একটু চা খেয়ে নেই। গেটের পাশে অল্প কয়েকটা খাবারের ভ্রাম্যমান দোকান। কিন্তু কোন দোকানেই চা পেলাম না। অবশেষে আমরা লেবু স্তুপ করা একটা দোকানের সামনে গিয়ে লেবুর সরবত দিতে বললাম দোকানিকে।
এখানে লেবুর সরবত নিয়েও কিছু বলার মত বিষয় আছে। সরবত বানাচ্ছে সেটাও যেন একটা শিল্প। লেবু কেটে হাত মেশিনে চেপে রস বের করে রাখলো গ্লাসে। এর পর কিছু বিট লবন, অল্প চিনি, কিছু মসলা, ঠান্ডা সোডা ওয়াটার মিশিয়ে দিলো। চুমুক দিয়েই অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম। ঠান্ডা শীতলতায় হৃদয় জুরিয়ে গেল। কলকাতায় প্রচন্ড গরম অনুভব করছিলাম। এক গ্লাস লেবু সরবত এতটা প্রশান্তি এনে দিলো যা ভাবার নয়। সরবত শেষ হতে না হতে মুরাদ মুন্সীর নজরে পড়লো কাচা ছোলা। কাচা ছোলা অর্ডার দিতেই দোকানদার বানানো শুরু করলো। কিছু কাচা ছোলা, পিয়াচ কুচি, কাচা লঙ্কা, সিদ্ধ আলু, কিছু মসলা আর তেতুলের টক মিশিয়ে কাগজে দিলো। তিনজনেই বেশ আয়েশ করে ছোলা খেয়ে সাইন্স সিটির প্রবেশ দ্বার পার হলাম। মনোরম পরিবেশে সুন্দর সাজানো গুছানো। ছোট ছোট বাহারি গাছ এমন ভাবে ছেটে রেখেছে মনে হচ্ছে সবুজ কার্পেটের নিপুন কারুকাজ। পায়ে হাটা রাস্তার পাশে বড় বড় গাছ থাকলেও রাস্তায় একটা ঝড়া পাতাও পাওয়া যাবে না। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন পায়ে হাটা রাস্তা দিয়ে মূল গেটের কাছে গেলাম। দেশিয় প্রযুক্তির মাধ্যমে সুন্দর ফোয়ারা করেছে দেখার মত।
জামাল ভূইয়া তিনটি টিকিট কিনলো। আমরা ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখা হয়ে গেল কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের থ্রিডি ভাস্কর্যের সাথে। বিভিন্ন এঙ্গেলে দেখলে ভিন্ন ভিন্ন কবি গুরুকে দেখা যায়। এক অনবদ্য কারুকাজ। এরপর পায়ে হাটা রাস্তার ধার ঘেষে সুসজ্জিত বাগানের ভিতর ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভারত বর্ষের বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের ভাস্কর্য। এর মধ্যে একজন বিজ্ঞানীর ভাস্কর্য দেখে বেশ আপন মনে হলো। সত্যেন্দ্র নাথ বোস। যে বোসের থিওরি নিয়ে গবেষনা করে আজ বিজ্ঞানীরা নোবেল পাচ্ছে। ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়ে কিছু ছবি তুললাম। ভাস্কর্যের নিচের দিকে সত্যেন্দ্র নাথ বোস এর জীবন কর্ম নিয়ে লেখা আছে ‘জন্মঃ ১৮৯৪, মৃত্যুঃ ১৯৭৪, শিক্ষাঃ এম,এসসি, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ১৯১৫, প্রোফেশনাল প্রোফাইঃ লেকচারার, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি, রিডার, ঢাক্কা ইউনিভার্সিটি, প্রোফেসর, ঢাক্কা ইউনিভার্সিটি, ভাইস চ্যান্সেলর, বিশ্ব ভারতী ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল প্রফেসর অফ ফিজিক্স, প্রেসিডেন্ট, ইন্ডিয়া সাইন্স কংগ্রেস, ফেলো, রয়েল সোসাইটি, লন্ডন, সম্মাননাঃ মেম্বার অফ পার্লামেন্ট, রাজ্য সভা, পদ্ম বিভূষণ, অনারারী ডীন ফ্রম সেভারেল ইউনিভার্সিটি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সত্যেন্দ্র নাথ বোস এর ভাস্কর্য দেখে একটু এগিয়ে গেলেই ছোট লেক। লেকের ভিতর প্লাস্টিকের বালতি দিয়ে সুন্দর একটি বৈজ্ঞানিক শিল্পকর্ম। লেকে বিভিন্ন প্রকার মাছ সাঁতার কাটছে। বিশেষ করে তেলাপিয়া মাছ, বড় সাইজের পাঙ্গাস মাছ চোখে পড়ার মত। আমরা লেকের পাড় ধরে এগিয়ে যাওয়ার পর সামনে পড়লো বিশাল এক ডাইনোসর হা করে আছে। আসলে ওটা একটা গুহা বা টানেল তৈরী করা হয়েছে। এ প্রান্তে হা করা মাথা, আর পিছন দিকে বিশাল লেজ। ডাইনোসরের সামনে অনেক গুলো বেঞ্চ পাতা আছে। বসতে গিয়ে হাত দিয়ে সিটে একটু টান দিয়ে দেখে নিলাম, ময়লা আছে কিনা। হাত উঠিয়ে দেখি যেমন হাত তেমনই আছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বেঞ্চ, একটুও ধুলা ময়লা নেই। আমাদের দেশে হলে পা উঠিয়ে টোকাইরা-ভবঘুরে-বখাটেরা শুয়ে থাকতো। অথচ মনে হয় কিছুক্ষণ আগে ঝাড়া মোছা দেয়া। পরিচ্ছন্ন কর্মীরা হেটে হেটে পাতা কুড়িয়ে পরিস্কার করছে। লেকের পানিতে, ফোয়ারার পানিতে পাতা পড়ছে আর কিছুক্ষণ পর পর পরিচ্ছন্ন কর্মীরা নেট দিয়ে তুলে নিচ্ছে। অন্য কিছু দেখার চাইতে এগুলোই বেশি নজরে আসছে। সাইন্স সিটির ভিতর দিয়ে রাস্তায় সিটির নিজস্ব যন্ত চালিত গাড়িতে চড়ে ঘোরা যায়। আস্তে আস্তে চলছে গাড়িটি, একাধিক বগি নিয়ে তৈরী গাড়িটি হর্ণ বাজিয়ে বাজিয়ে চলছে। আমরা সিটির ভিতরের বেঞ্চে বসে বিশ্রাম নিতে নিতে পরিকল্পনা করছি এবার কি করা যায়? সিটির ভিতরে ক্যাবল কার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে, জীবন রহস্য নিয়ে চলচ্ছিত্র প্রদর্শনসহ আরো নানা ইভেন্ট আছে।

কলকাতার সায়েন্স সিটি :
বিজ্ঞানের জটিল বিষয় সন্তানকে বুঝিয়ে উঠতে গিয়ে সমস্যার সম্মুখীন হই আমরা। তাই সন্তানকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সবচেয়ে আশ্চর্যজনক স্থানে নিয়ে যান, যা হল-কলকাতার সায়েন্স সিটি। কলকাতার একটি বিজ্ঞান সংগ্রহালয় ও বিজ্ঞান কেন্দ্রিক বিনোদন উদ্যান। এটি ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ জাতীয় বিজ্ঞান সংগ্রহালয় পরিষদের অধিভূক্ত একটি বিজ্ঞানকেন্দ্র। পূর্ব কলকাতার ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস ও জে বি এস হ্যালডেন অ্যাভেনিউ-এর সংযোগস্থলে ৫০ একর জমির উপর সায়েন্স সিটি অবস্থিত। কলকাতার জনপ্রিয় পর্যটক আকর্ষণের মধ্যে আধুনিক সংকলন, সায়েন্স সিটি ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহত্তম বিজ্ঞান কেন্দ্র। মজা এবং স্বচ্ছন্দের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রচার করার উদ্দেশ্যে, সায়েন্স মিউজিয়ামের জাতীয় পরিষদের মস্তিস্কপ্রসুত এই অনন্য বিজ্ঞান চিত্তবিনোদন পার্ক ১৯৯৭ সালে স্থাপন করা হয়। এটা শুধুমাত্র তার স্বাতন্ত্র্যসূচক স্থাপত্য নয় বরং বিজ্ঞানের ক্ষমতা উপলব্ধি করার জন্য দর্শকদের উদ্দ্যেশে তৈরি।
এই স্থানের সুবুদ্ধিসম্পন্ন উদ্ভাবন, প্রবেশদ্বার থেকেই আপনাকে আশ্চর্য করবে, সেখানে একটি রোপওয়ে আছে যেখান থেকে পুরো মিউজিয়ামের এক ঝলক দৃশ্য উপলব্ধ করা যায়। এই মিউজিয়ামের পুরো চত্বরটি অনেক রকমের বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলি হল-স্পেস অডিসি, মেরিটাইম কেন্দ, সায়েন্স পার্ক, ডায়নামোশন এবং ইভোলিউশন থিম পার্ক। এখানের কিছু জনপ্রিয় আকর্ষণ হল- দৃষ্টিভ্রম, একটি বিস্ময়কর সময় যন্ত্র, থ্রিডি থিয়েটার, একটি বিশেষ প্রজাপতি কর্নার, একটি মাছের চৌবাচ্চা এবং ডাইনেসর চত্বর।
এছাড়াও এখানে বিশেষ করে শিশুদের জন্য দোলনা, স্লাইড, ট্রেন রাইড, মিউজিক্যাল ফোয়ারা এবং অন্যান্য বহু বিনোদনমূলক সুবিধা রয়েছে। সায়েন্স সিটির প্রচল কেন্দ্রে ২০০০ জনের অধিক আসনবিন্যাস ক্ষমতা সহ একটি বিশাল থিয়েটার, একটি ছোট রঙ্গশালা এবং একটি খোলামেলা প্রদর্শন শালা রয়েছে। নানা ধরনের সুযোগ সুবিধাসহ সায়েন্স সিটি আপনার শিশুদের নিয়ে সময় কাটানোর একটি সম্পূর্ণ আনন্দদায়ক চিত্তবিনোদন বিকল্প। ভেবে দেখুন আপনি এখানে নিজস্ব ইচ্ছায় ভূমিকম্প উৎপন্ন হওয়া দেখতে পারেন বা ডাইনোসরের যুগের একটি ভ্রমণে যেতে পারেন! এই সকল অবাস্তব কার্যকলাপ শুধুমাত্র কলকাতার সায়েন্স সিটিই বাস্তব করতে পারে।
সায়েন্স সিটির বিভিন্ন ইভেন্ট দেখতে এক বিকাল লেগে যাবে। তাই সাইন্স সিটি এখানেই সংক্ষেপে দেখা শেষ করলে কেমন হয়? আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, কলকাতায় এলাম আর সিনেমা হলে এক শো সিনেমা দেখবো না এটা কি হয়! সাথে সাথে শরীয়তপুর বাসীর জন্য কলকাতায় পরম মিত্র অতনু ঘটক চৌধুরীকে ফোন দিলাম। এখানে অতনু ঘটক চৌধুরী সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। শরীয়তপুর জেলার পালং ইউনিয়নের দীর্ঘ কালের চেয়ারম্যান শরীয়তপুর জেলা গঠনের অন্যতম সংগঠক কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র কবি রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরী। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক চিঠিতে লিখেছিলেন আমার রথীন বাংলা জানে। সেই রথীন্দ্র কান্ত ঘটক চৌধুরীর নাতি অতনু ঘটক চৌধুরী। অতনু কলকাতায়ই থাকে। শরীয়তপুর থেকে যত লোকই কলকাতা আসে সে চিকিৎসার জন্য হোক আর ভ্রমণের জন্যই হোক তাদের অতনু সহযোগীতা করেনি এমনটি হয়নি। আমরা যাওয়ার পর শত ব্যাস্ততায়ও সে বার বার ফোন করে আমাদের খোজ খবর নিয়েছে এবং পরামর্শ দিয়েছে।
যেহেতু সিনেমা দেখবো তাই প্রথম পছন্দের ছবি হলো সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বহুল আলোচিত বিগ বাজেটের ছবি বাহুবলী টু। অতনুকে ফোন দিলাম বাহুবলী টু কোথায় চলে, কয়টায় শো, কিভাবে যাব আমাদের একটু জানানোর জন্য। অতনু আমাকে একটু পরে যানাচ্ছি বলে ফোন রাখলো। কিছুক্ষণ পরেই ফোন বেজে উঠলো। ধরতেই আমাদের জানালো প্যারাডাইস হলে বাহুবলি টু চলে, সিনেমা হলটি বড় বাজারে। পরবর্তী শো সন্ধা ছয়টায়। আপনারা সাইন্স সিটি থেকে একটা ক্যাব নিয়ে সোজা চলে যান সিনেমা হলে। কথামতো আমরা একটা ক্যাব নিলাম। যেতে যেতে দেখা হলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে করা সড়কের সাইন বোর্ড। বঙ্গবন্ধু সড়ক দিয়ে যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে বেশ উচ্ছসিত ভাব দেখা গেল। আমরা যে দেশ থেকে এসেছি সেই দেশের স্থপতির নামে ভিন্ন কোন দেশে সড়ক এটা একটা গর্বের বিষয়। বঙ্গবন্ধু সড়ক দিয়ে যেতে যেতে আবার ফ্লাই ওভার। সাইন্স সিটি থেকে বড় বাজার দীর্ঘ পথ সামান্য সময়ে চলে আসলাম। কোন ট্রাফিক জ্যাম নেই। শুধু আছে ট্রাফিক সিগনাল। সামনে রাস্তা ফাকা, রাস্তার ধারে কোন ট্রাফিক পুলিশও দাঁড়িয়ে নেই, কোন সিসি ক্যামেরাও নেই। তারপরও ড্রাইভাররা এখানে এক ইঞ্চি আগায় না। নিয়ম মানে বলেই কোন জ্যাম নেই। কলকাতার রাস্তাগুলো ওয়ান ওয়ে। প্যারাডাইস হলের সামনে নামালে ড্রাইভারের অনেক দূর ঘুরতে হবে তাই আমাদের নামিয়ে দিলো কেসি দাসের মিষ্টির দোকানের কাছে। কেসি দাসের মিষ্টির দোকানের বিপরীতেই টিপু সুলতান মসজিদ। অনেক গুলো গম্ভুজ দিয়ে তৈরী টিপু সুলতান মসজিদটি দেখতে অনেক সুন্দর। রাস্তার এপার থেকেই আমরা মসজিদটি দেখতে দেখতে প্যারাডাইস হলের সামনে চলে গেলাম। হাতে বেশ সময় আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একটু চা খেয়ে নেই। জামাল ভূইয়া তিনটা টিকিট কেটে নিয়ে এলো। হলের সামনে কিছু দোকান আছে। মুরাদ মুন্সীর খিদে পেয়েছে। বললো, আগে কিছু খেয়ে নেই তারপর চা খাব। হলের সামনে ভাপা পিঠার মত দেখতে গোল গোল কিছু পিঠা নিয়ে বসে আছে একজন। আমরা জানতে চাইলে জানালো,
-এগুলোকে ইটলি বলে।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম কেমন খেতে,
-কিভাবে খায়। দোকানি বললো,
-এগুলো টমেটো সস, চাটনি, টক দিয়ে খেতে হয়। এগুলো সাউথ ইন্ডিয়ান খাবার। তিন পিস বিশ টাকা।
আমরা লোকও আছি তিনজন। বললাম এক প্লেট দেন। দোকানি আমাদের একটি প্লেটে তিনটি ইটলি দিল। ইটলির উপরে কিছু টমেটো সস, শরিষা বাটা, তেতুলের টক, লবন দিয়ে দিলো। তিনজনে তিনটি ইটলি পুরোটাই খেলাম। বিল মিটিয়ে রাস্তার ওপারে সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ অব কলকাতা বিল্ডিং এর পাশে ফুটপাতের দোকানে চায়ের অর্ডার দিলাম। মাটির ভাড়ে তিনটা চা দিলো। টগবগে গরম চা হাতে নিয়ে বেশিক্ষণ রাখতে পারলাম না। বিস্কিটের বয়ামের উপর রেখে হাত কচলাতে শুরু করলাম। চা খেয়ে চলে গেলাম হলের গেইটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেইট খুলে দিলো। আমরা সুশৃঙ্খল ভাবে হলের ভেতরে প্রবেশ করলাম। একটা শো শেষ হয়েছে মাত্র। প্রবেশ দ্বার দিয়ে কোন লোক বের হলো না। সিনেমা শেষে হল থেকে বাহিরের রাস্তা আলাদা। আমরা ভিতরে প্রবেশ করে ওয়াশ রুমে গিয়ে একটু হালকা হয়ে নিলাম। দীর্ঘক্ষণ ছবি দেখবো, তাই কেউ রিক্স না নিয়ে ফ্রেশ হয়ে দোতলায় ডিসি রুমে চলে গেলাম। টিকিট চেকার আমাদের সিট দেখিয়ে দিলো। আমরা হলের বাম কোনের দিকে তিনটা সিট পেলাম। বসে পড়লাম তিনজন। কোন সময় ক্ষেপণ না করে যথাসময়ে শুরু হয়ে গেল বাহুবলি টু।
বাহুবলীর পরিচালক এস এস রাজামৌলীর নির্মাণ শৈলীর প্রশংসা না করে পারা যায়না। ইতিহাস নির্ভর চলচ্ছিত্রটিতে প্রতিটি পদে পদে রয়েছে রোমাঞ্চ। ভালবাসা ও যুদ্ধ বিগ্রহের সংবিশ্রণে তৈরী ছবিটি দেখে বেশ তৃপ্তি পেলাম। ছবিটিতে মানবিকতার পাশাপাশি আছে মিরজাফরি। পুত্র মায়ের সাথে যে প্রতারণার দৃশ্য দেখলাম তা যুগে যুগে ঘটেছে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজ দৌলার সাথেওতো প্রতারণা হয়েছিল, মনে পরে গেল সেই সব ইতিহাসের কথা। ছবি দেখে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেও হল থেকে বেরিয়ে আরেক বিপদ। জামাল ভূইয়ার ভিতরে প্রচন্ড নি¤œচাপ আন্দোলিত হচ্ছে। আমরা যেহেতু হল থেকে বেরিয়ে গেছি তাই আর ভিতরে প্রবেশ করতে পারছি না। আমরা বের হওয়ার সাথে সাথে পরবর্তী শো চালু হবে তাই লোক প্রবেশ করছে। হলে থাকাবস্থায় চাপ এলে সারতে পারতো। কিন্তু এখন কি করা যায়। সিদ্ধান্ত হলো হোটেলে চলে যাই, ভূইয়ার নি¤œ চাপ কমিয়ে তার পরে নিচে নেমে খাওয়া দাওয়া সারবো। কিন্তু জামাল ভূইয়া জানালো, চাপ কিছুটা কমেছে। হোটেলে যাওয়া অতটা জরুরী নয়। বর্তমানে সহনশীল অবস্থায় আছে। আমরা এবার একটু স্বস্তির নিঃস্বাশ ছাড়লাম। এর পর শুরু হলো ক্যাব ডাকা। মোড়টায় ক্যাব পাচ্ছিলাম না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা ক্যাব পেলাম। দরদাম করে উঠে বসলাম। ড্রাইভার আমাদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিলো। সময় ঘনিয়ে আসছে। রাত পোহালেই চলে যাব দেশে। আনন্দ ও বেদনার এক সংমিশ্রণে মিশেল অনুভূমি। থাকতেও মন চাইছে না, আবার যেতেও ইচ্ছে করছে না। যাহোক, আমরা হোটেলের সামনে নেমে আর উপরে উঠলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম একবারে খেয়ে হোটেলে উঠবো।
কলকাতা এসে প্রথম যে হোটেলটায় রাতের খাবার খেয়েছিলাম, সেই লাজিজ বিরিয়ানিতে শেষবারের মত রাতের খাবার খেলে কেমন হয়? সবাই একমত হলাম আজও বিরিয়ানিই খাব। লাজিজ হোটেলে যাওয়ার পর হোটেল মালিক আমাদের চিনতে পারলো। দেখেই বেশ সমাদর করে বসিয়ে হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে বললো, কি দেব দাদা। আমরা বিরিয়ানি দিতে বললাম। ওদের এখানে চায়ে ছোট বড়, সিগারেটে ছোট বড়, বিরিয়ানিতে ছোট বড়, সব কিছুতেই ছোট বড় আছে। আমরা বাঙ্গালী, বাংলাদেশী। আমাদের সব কিছু বড়, হৃদয় বড়, হাত বড়, আত্মা বড়, পেট বড়, খাওয়ার চাহিদাও বড়। আমরা বড় দিতে বললাম। মুরাদ মুন্সী আলু দিতে বললো দুই টুকরা। খাসির বিরিয়ানি, সাথে আলু, পিয়াজের সালাদ, কাচা লঙ্কা, লেবু। বেশ আয়েশ করে রাতের খাবার খেয়ে প্রথম দিনের খাওয়া সেই পুলিশ বক্সের পিছনের চা। মুরাদ মুন্সী আর চা নিলো না, আমি আর জামাল ভূইয়া মাটির ভারে চা খেলাম। এরপর হোটেলে গিয়ে প্রতিদিনের মত ফ্রেশ হয়ে ফেসবুকিং, ছবি আদান প্রদান। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ব্যাগ গুলো গুছিয়ে ছোট করে ফেললাম কিন্তু সেই বড়ই হয়ে গেল, বাঙ্গালি যে! সকালে পরার কাপড় চোপর রেখে বাকি সব গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম সবাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই শান্তির ঘুম এসে চুমু দিলো দুচোখে।

॥ ১২ ॥
কলকাতার জীবন যাত্রাঃ
রিক্সা বিহীন সড়ক, ওয়ান ওয়ে, যত্র তত্র ট্যাক্সি ক্যাব, পোশাক পরিচ্ছদ, ওড়না বিহীন চলাচল, সুপেয় পানির সু ব্যবস্থা, কর্পোরেট দায়িত্ববোধঃ

স্বল্প সময় কলকাতা ভ্রমণে কিছু বিষয় হৃদয়ে দাগ কেটেছে। কিছু বিষয় ভাল লেগেছে, কিছু বিষয় খারাপ লেগেছে। সব বিষয় ভাল লাগবে এমন কোন কথা নেই। কথায় আছে না? এক দেশের গালি আরেক দেশে বুলি। আমাদের দেশের চুল এখানে এসে দেখি বাল। ভিন্ন দেশ ভিন্ন পরিবেশ। ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ কিছু মেলে কিছু মেলে না। তারই কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই এখানে।

রিক্সা বিহীন সড়ক
রাস্তায় নামলে মনে হবে একদম ফাকা রাস্তা। চলতি পথে ট্রাফিক সিগনাল ছাড়া গাড়ির কোন জ্যাম নেই, সিগনাল গুলোতেও যে জ্যাম আছে তা কিন্তু নয়। এর অন্যতম কারণ হলো রিক্সা বিহীন সড়ক। মূল সড়কগুলোতে কোন রিক্সা চোখে পড়বে না। রিক্সা যে নেই তাও নয়। কিছু রিক্সা আছে প্যাডেল চালিত, কিছু রিক্সা মানব চালিত। মানব চালিত রিক্সা গুলো আমার কাছে অমানবিক লেগেছে। মানুষ বসে আছে আর একজন লোক তার বুক দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বাহনটি। একবিংশ শতাব্দিতে এমন কষ্টকর কাজ আর হতে পারে না। অনেকটা ঠেলাগাড়ির মত করে চালাচ্ছে। বাবুদের মত করে আরোহী বসে আছে আর একজন ভৃত্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে রিক্সা আর আদম টানা রিক্সা যাই হোক না কেন সবই চলে গলির ভিতর দিয়ে। তারা কখনো ব্যস্ত সড়কে ওঠে না। আর এ কারনেই রাস্তায় কোন জ্যাম নেই। মানবিকতার দোহাই দিয়ে আমাদের দেশের প্রধান সড়কে রিক্সা চলাচল বাতিল করা যায় না। এতে আমাদের ক্ষতিই হচ্ছে। আমাদের দেশের রাস্তায় নিয়ম নীতিহীন ভাবে নেমেছে রিক্সার পাশাপাশি নতুন জঞ্জাল অটোবাইক। বিদ্যুতের বারোটা বাজিয়ে রাস্তায় অযথা জঞ্জাল তৈরী করেছে। রিক্সা, অটোবাইক উঠিয়ে দিয়ে অধিক পরিমানে গণ পরিবহন নামিয়ে দেয়া উচিত। রিক্সা আর অটো চালকরা কি করবে সেটা তারাই ঠিক করে নেবে। যার যার যোগ্যতা অনুযায় কাজ খুজে নেবে। অযোগ্য লোক রাস্তায় বেরিয়ে জীবণের চাকা স্লত করে দেবে এটা কোন মানবিকতা হতে পারে না। রাষ্ট্র বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে অযোগ্য লোকগুলোকে দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তর করলেই সমাধান হতে পারে। মানবিকতার দোহাই দিয়ে অর্থনীতির চাকা মন্থর করার কোন যুক্তি নেই।

ওয়ান ওয়ে রোড, যত্র তত্র ট্যাক্সি ক্যাব
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনাকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। আপনি যদি হাত উচু করে বগল চুলকান তবেও দুচারটা ক্যাব দাঁড়িয়ে যাবে, বলবে দাদা কোথায় যাবেন? আছে আধুনিক ব্যবস্থাও। উবার বা ওলে অ্যাপস মোবাইলে ডাউনলোড করে নিলে আপনি যেখানে যাবেন, কোথায় আছেন লিখে সার্চ দিলেই বিভিন্ন ক্যাটাগরির ক্যাব চলে আসবে। এত আধুনিক ব্যবস্থা যা মানুষকে আরো স্বস্তি দিয়েছে। কলকাতার রাস্তাগুলো সবই ওয়ান ওয়ে। সকালে যে রাস্তা দিয়ে যাবেন বিকালে সে রাস্তা দিয়ে যেতে পারবেন না। ওয়ান ওয়ে হওয়ার কারণে কোন জ্যাম থাকে না রাস্তায়। আর ট্রাফিক আইন সহ আইন মানার প্রবণতা গড়ে উঠেছে কলকাতাবাসির মধ্যে। রাস্তা ফাকা পেলেও কেউ আইন ভাঙ্গছে না। একারণে কলকাতার ড্রাইভারদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধটাও বেড়ে গেছে। আমাদের দেশে ক্যাব কালচারটা সিন্ডিকেটের হাতে না রেখে সেটা সার্বজনীন করা উচিত। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী একজন দক্ষ ড্রাইভার যদি ক্যাব নামাতে চায় তবে তাকে সহযোগীতা করা উচিত বলে আমার কাছে মনে হয়। যোগ্য লোক ক্যাব চালালে রাস্তায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমাদের দেশে পঞ্চাশ টাকায় রিক্সাও যেতে চায় না আর কলকাতায় ত্রিশ-চল্লিশ টাকার বিনিময়ে ক্যাবে চড়ে রাজকীয় হালে ঘুরতে পারবেন। কোন গন্তব্যই ছোট করে দেখে না এখানকার ড্রাইভাররা। আমাদের দেশে দূরপাল্লায় যাওয়ার আশায় মোড়ে মোড়ে রিক্সা, অটো, ক্যাব সবাই দাঁড়িয়ে থাকে। অল্প দূরত্ব যেতে চাইলে তাদের গাল ওঠে না। প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে থাকবে, রিক্সার সিটে বসে বসে বিশ্রাম নেবে, আর ফুটপাত নিজের বাপের জায়গা মনে করে জ্যাম তৈরী করবে। নীতি নির্ধারকদের এসব ক্ষুদ্র বিষয়ে বৃহৎ চিন্তা করা উচিত।

পোশাক পরিচ্ছদ, ওড়না বিহীন চলাচল
এখানকার মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। বৃদ্ধ বয়সের মানুষজন একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর একটা শর্ট প্যান্ট পরে বাড়ির সামনে বসে আছে বা দোকানে গিয়ে কেনাকাটা করছে। তবে মেয়েরা এখানে বেশ আধুনিক। মেয়েরা এখানে ওড়না খুব একটা পরে না বললেই চলে। আধুনিকতার শ্রোতে গা ভাষিয়ে দিয়েছে সবাই। জিন্স প্যান্ট সাথে টিশার্ট জাতীয় পোশাকই বেশি ব্যবহার করে। কামিজের ক্ষেত্রে শর্ট কামিজ কিন্তু কেউই ওড়না ব্যবহার করে না। কালে ভদ্রে ওড়না দেখা যায়, তা গণায় ধরার মত নয়। একশত তাল গাছের বাগানে একটা চন্দন গাছ থাকলে তাকে যেমন কেউ চন্দন বাগান বলবে না তেমনই আরকি। এখানকার মেয়েরা বেশ সাহসি। ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করছে, পড়াশুনা করছে, ঘুরছে ফিরছে, কোন জড়তা দেখলাম না। মার্কেটগুলোতে গেলে মনে হবে স্ফীত বক্ষ প্রদর্শনী চলছে। পাঠক হয়তো ভাববেন আমার নজর খারাপ। আসলে আমার নজর খারাপ না, আমি যা দেখেছি, তই উপস্থাপন করলাম মাত্র। ভাল-খারাপের সংমিশ্রণে এক অনন্য অনুভূতি।

সুপেয় পানির সু ব্যবস্থা, কর্পোরেট দায়িত্ববোধঃ
রাস্তার মোড়ে মোড়ে সুপেয় পানির সু ব্যবস্থা করা আছে। তাও ঠান্ডা পানিয় জলের সু ব্যবস্থা। সরকার নয়, বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানি তাদের দায়িত্ববোধ থেকে পানিয় জলের ব্যবস্থা করেছে, সরকার তাদের সহায়তা করেছে মাত্র। যেমন আমাদের হোটেলের পাশেই সেন্ডো গেঞ্জি-আন্ডার ওয়ার কোম্পানি রুপা একটা প্লান্ট করেছে। ঠান্ডা ও শোধন করার মেশিন বসিয়ে দিয়েছে। মানুষ পানি নিয়ে যাচ্ছে। তবে কেউ পানি নেয়ার পর কল খুলে রাখে না বা সুযোগ পেলে কল চুরিও করে না। আমাদের দেশে যেভাবে পানি বিক্রি হয় সেখানে এতটা হয় না। আমরা পানির বোতল কিনে খেয়ে যত্রতত্র খালি বোতল ফেলে আবর্জনার স্তুপ তৈরী করছি। তাদের কর্পোরেট দায়িত্ববোধ দেখে বেশ ভাল লাগলো, আফসোস হলো, আমাদের দেশের কোম্পানিগুলোর মধ্যে এ দায়িত্ববোধটা কি জাগ্রত হলে খুব বেশি ক্ষতি হতো?

সূরার সুব্যবস্থাঃ
শহরের মোড়ে মোড়ে আছে মদের দোকান। এখানে মদ-বিয়ার এতটা সহজলভ্য যে পেপসি সেভেন আপ পেতে কষ্ট হবে কিন্তু মদ-বিয়ার পেতে কোন কষ্ট হবে না। কিংফিসার বিয়ার এখানে সবচেয়ে সহজলভ্য। কিংফিশারের প্লান্ট আছে এদেশে। মদ নিয়ে কোন লুকোচুরি নেই। উন্মুক্ত পরিবেশে বিক্রি হওয়ায় দামও কম। পুলিশকে কোন মাসোহারা দেওয়া লাগে না তাই দাম হাতের নাগালেই। মানুষ কাজ করছে, সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বা সময় সুযোগ মত বারে যেয়ে মদ-বিয়ার খাচ্ছে। তবে কাউকে মাতলামি করতে দেখিনি রাস্তা ঘাটে। এখানে সিগারেট পাওয়া যায় বিভিন্ন সাইজের। ছোট, বড় যে সাইজ চান সেই সাইজই পাবেন। আছে সস্তার পাতার বিড়ি। এখানকার অভিজাত সিগারেট হলো গোল্ডফ্ল্যাগ। গোল্ডফ্ল্যাগও আছে দুই ধরনের ছোট, আর বড়। আপনার অল্প নেশা তাই ছোট নিবেন, বেশিক্ষণ টানতে চান তো বড় নিবেন।
ছিনতাই-ঠ্যাকবাজ মুক্ত শহরঃ
তিন দিনের কলকাতা ভ্রমণে সকাল থেকে রাত অবধি ঘুরেছি। মোড়ে মোড়ে বা অলিতে গলিতে কোন ছিনতাইকারী ঠ্যাকবাজ চোখে পড়েনি। শুনসান নিরব রাস্তা ঘাট নিরাপদই মনে হয়েছে। রাতবিরাতে কোন ভয় কাজ করেনি। রাস্তায় পুলিশ বক্স আছে অনেক। সাদা পোশাক পরা পুলিশ বন্ধুদের সাদা মন নিয়েই ডিউটিরত অবস্থায় বসে বসে পেপার পড়া ছাড়া খুব একটা কাজ নেই মনে হয়েছে। রাতের ট্রাক থামিয়ে চাদাবাজি করার ধান্দা নেই তাদের। আমাদের দেশে রাতে পণ্যের ট্রাক, মোড়কবাহী ট্রাক থামিয়ে টাকা আদায়ে ব্যস্ত থাকে পুলিশ ভাইয়েরা। এখানে সেটা চোখে পড়েনা।

॥ ১৩ ॥
ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে ভোগান্তি

রবিবার সকাল। ঘুম থেকে চোখ মেলেই দেখি জামাল ভূইয়া ফ্লোরে দাঁড়িয়ে জামা কাপড় পরছে। মাঝে মাঝে তাগিদ দিচ্ছে ওঠার জন্য। বুঝলাম বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে। বেড়িয়ে পড়তে হবে মাটির টানে, আপন ঘরে। আস্তে আস্তে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে কাপড় চোপর পরে নিলাম। রুমে কিছু ফেলে গেলাম কিনা চেক করে বেরিয়ে পড়লাম। নিচে নেমে কাউন্টারে চাবি জমা দেয়ার পর ম্যানেজার লোক পাঠালো রুম চেকের জন্য। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। হোটেলের ম্যানেজার আমাদের তিনজনকে হোটেলের লোগো লাগানো তিনটা চাবির রিং উপহার দিয়ে আবার আসার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। বেরোবার আগে হোটেল বয়দের ও দাড়োয়ানকে বকসিস দিতে ভুল হলো না। আমরা বাঙ্গালি। আমাদের শরীরের চাইতে কলিজা বড় দেখিয়ে দিলাম আরকি!
রাস্তায় বেরিয়ে একটা প্রাইভেট কার চালক আমাদের ডাকলো। দরদাম করে উঠে গেলাম শিয়ালদহ স্টেশনে যাওয়ার জন্য। বারতি ইনকামের জন্য সকালে গাড়ি চালায় লোকটা। হয়তো নিজের গাড়ি অথবা বসের গাড়ি ফুয়েল লোড করতে এসে একটু নাস্তার পয়সা জোগার করছে। সকাল বেলা রাস্তা ঘাট একদম ফাকা। আমরা অল্প সময়ের মধ্যে চলে এলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। যথারীতি কোন টানা হ্যাচরা ছাড়া নিজেদের ব্যাগ নিজেরা নিয়ে স্টেশনের বারান্দায় দাঁড়ালাম। জামাল ভূইয়া টিকিট কিনে নিয়ে এলো। সকালে যেহেতু আগে আগে ঘুম থেকে উঠেছি তাই খুধাও আগে আগেই লেগে গেছে তা পেটের মোচরামুচরিতে টের পেলাম। স্টেশনের একটি দোকান থেকে কেক, পানি কিনে নিয়ে বনগাঁও স্টেশনমুখী প্লাটফর্মের দিকে রওয়ানা দিলাম। প্লাটফর্ম খুঁজে নিয়ে কিছুটা অপেক্ষা করতেই চলে এলো ট্রেন। আমরা আবারও জানালার পাশে সিট নিয়ে বসে পড়লাম। আমাদের যাওয়া আসায় বসা নিয়ে কোন ঝক্কি পোহাতে হলো না। সঠিক সময়ে সঠিক গন্তব্যর উদ্দেশ্যে ছেড়ে দিলো ট্রেন। আস্তে আস্তে বারছে গতি, একে একে পিছনে ফেলছে একেকটা স্টেশন, আর দুরত্ব বারাচ্ছে কলকাতার সাথে আমাদের। একসময় কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে ছিলাম। এখন একটা দুটা করে স্টেশন পার হচ্ছি। হৃদয়ে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো নাড়া দিচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে কলকাতার জন্য। বাংলাদেশে যাচ্ছি, নিজের মাতৃভূমিতে। নিজের স্বজনদের কাছে পাবো, সেই আনন্দে বুকটা ভরে উঠছে। এ যেন মুদ্রার দুটি পিঠ।
আমি তাকিয়ে আছি কখন আসবে দত্তপুকুর স্টেশন। যেখানে থাকে আমার বন্ধু সুশান্ত কুমার কংসবণিক, দীপক কুমার কংসবণিক। দত্তপুকুর স্টেশনটার কথা হৃদয়ে গেথে আছে সেই সুদীর্ঘ কাল থেকে। বন্ধু তো অনেক থাকে। কিন্তু হৃদয়ের কাছাকাছি অবস্থান করে আর কয়জন! সুশান্ত হৃদয়ের খুব কাছে থাকা বন্ধু। তাইতো হৃদয়ের টানে ছুটে গেছে কলকাতা। যখন শুনেছে আমি কলকাতা আসছি। বাড়িতে কেন গেলাম না, হোটেলে কেন উঠেছি নানান অনুযোগ, অভিযোগ। ‘দাদা খেয়ে এসেছেন না যেয়ে খাবেন, পরের বার আসলে খেয়ে যাবেন কিন্তু’ কলকাতা নিয়ে এমন নানান গাল গল্প শুনেছি অনেক। কিন্তু সুশান্তর ভালবাসা, আতিথেয়তা, আগ্রহ ও আবেগের মধ্যে তেমনটা পাইনি। বন্ধু যেখানেই থাকে বন্ধুকে ভুলতে পারে না। আমরা দেখতে দেখতে দত্তপুকুর স্টেশনে এসে থামলাম। পৌছামাত্রই মনে হলো আপন জায়গা, যেখানে আমার বন্ধু থাকে। সামান্য সময় থেমে কিছু লোক নামিয়ে কিছু লোক উঠিয়ে আবার ছুটে চললো ট্রেন তার গন্তব্যের দিকে। দত্তপুকুর থেকে ট্রেন যতই দূরে যাচ্ছে হৃদয়ে বন্ধুর জন্য কষ্টটা ততই বারছে। একসময় ছোখের আড়ালে চলে গেল স্টেশনটি।
আমরা চলে এলাম বনগাঁও স্টেশন। যার যার ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের মূল গেইট দিয়ে না বের হয়ে বের হলাম পাশের রাস্তা দিয়ে। বড় একটা তেতুল গাছের কাছে বেবি টেম্পো স্টেশন। লোক হবে দুইশ আর বেবি নাই একটাও! একটা আসে তো দীর্ঘ লাইন থেকে পাঁচজন তুলে দেয় সিরিয়াল ম্যান এক দাদা। প্রচন্ড রোদে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়! আমরা লাইন ছেড়ে দিয়ে চলে আসলাম সামনের প্রধান সড়কে বেবি রিজার্ভ করে নেব সেই চিন্তা করে। কিন্তু কোন বেবি রিজার্ভ যাবে না লাইন ছেড়ে, কারণ পরে এসে আর লাইনে ঢুকতে পারবে না। আবার লাইনে এসে দেখি লাইন আরো দীর্ঘ হয়েছে। আমাদের পিছনে দাঁড়াতে হবে। সকালে একটুকরা কেক আর পানি খেয়ে কি আর পেট ভরে? আমরা পাশের একটা দোকানে গেলাম নাস্তা করতে। ছোট দোকান যাকে বলে কমদামি হোটেল। আমাদের দেশের হোটেল ছালাদিয়া এর চেয়ে অনেক ভাল। তবে দোকানের বিশেষত্ব হলো এর পরিচালকরা সবাই মধ্য বয়সি মহিলা। আমরা ভাত চাইলাম। আমাদের ভাত, আলু ভর্তা, আলুর ফ্রেঞ্চফ্রাই এর মত দেখতে আলু ভাজি, কাচা লঙ্কা, পিয়াজ দিল, সাথে পাতলা ডাল। আমরা তিনজনের জন্য তিনটা ডিম দিতে বললাম। সকাল বেলার ভাত, ভাজি, ডাল, ডিম ভাজা দিয়ে খেতে যে কত মধুর লাগে তা টের পেলাম। মোটা মোটা কাচা মরিচ আমার মত সাস্থ্য। কচকচিয়ে খেয়ে আবার চাইলাম। মরিচ নামেই, কামে না। একটুও ঝাল নেই। তবুও তৃপ্তি সহ খেয়ে পেট ঠান্ডা করে নিলাম। কারণ মাথা তো ঠান্ডা হবে না। উপরে প্রচন্ড গরম, তার উপরে গাড়ি পাচ্ছি না। তাই মাথা প্রচন্ড গরম। হোটেলের মহিলারা ভিতর থেকে বোতলজাত বিয়ার বিক্রি করছে মজুর-শ্রমিক টাইপের লোকদের কাছে। একটু গোপনে গোপনে বের করে দিচ্ছে আর মজুর-শ্রমিক শ্রেণীর লোকগুলো গামছা দিয়ে ঢেকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। গোপনে বিক্রি করলেও আমাদের চোখ এড়াতে পারলো না। খাবার বিক্রির সাথে মহিলারা বিয়ারও বিক্রি করে! খাওয়া শেষে হোটেল থেকে বেরিয়ে লাইন ম্যানকে ঝারি দিলাম, দাদা আমরা নাস্তা খেতে গিয়েছিলাম, আমাদের সিরিয়ালটা দিয়ে দিন, আমাদের একটা বেবি রিজার্ভ দিন। লোকটা আমাদের ছায়ায় দাঁড়াতে বললে আমরা একটু আস্বস্ত হলাম। কিছুক্ষণ পরে একটা বেবি আসার সাথে সাথে আমরা তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমরা অনেক ক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি। লোকটি আমাদের বেবিটি দিয়ে দিলো। উঠে পড়লাম তিনজন। বেবি চলতে থাকলো বেনাপোলের দিকে। কিছুক্ষণ পর বেনাপোল বর্ডারে নেমে আমরা লাইনে না দাঁড়িয়ে ভিতরে ঢোকার ফন্দি আটতে থাকলাম। কিন্তু কাউকে পেলাম না। এরই মধ্যে অনেক লোককে ভিতরে প্রবেশ করতে দিলো। আমরা ভাবলাম এই বুঝি ইমিগ্রেশন ফেস করবো। কিন্তু আমাদের ভিতরে নিয়ে গেল একটি সেডের নিচে। যেখানে লোক দাঁড়িয়ে আছে কম হলেও তিন হাজার। একবার যেহেতু ফাইলে ঢুকে পড়েছি আর বেরোবার উপায় নেই। আমি যেহেতু একটু বেশি ভারি তাই আমার দায়িত্ব হলো ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আর জামাল ভূইয়া ও মুরাদ মুন্সী লাইনে দাঁড়িয়ে সাপের মত পেচিয়ে পেচিয়ে মূল সিরিয়ালে আসার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলো। আমি ব্যাগগুলো একজায়গায় রেখে বসে পড়লাম। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথা করছে। দীর্ঘ সময় পার হয়ে যাচ্ছে আমাদের সিরিয়াল আসে না। মাঝে মধ্যে লাইনে কে আগে ছিল কে পিছে ছিল তা নিয়ে মারামারি করছে যাত্রীরা। ইন্ডিয়ান পুলিশ এসে চর থাপ্পর দিয়ে আবার সোজা করছে। তিনজন বিএসএফ জওয়ান ভারি অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে শরনার্থীরা যেন দাঙ্গা না বাধায় তার জন্য রেডি তারা! লাইনের শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা ইমিগ্রেশন অফিসার মাঝে মাঝে কিছু লোক যেতে দিচ্ছে। লাল জামা গায়ে জড়ানো কুলিরা যখনই সুন্দর বেটে করে অফিসারটার সাথে কানে কানে কথা বলে তার কিছুক্ষণ পরই এমন দলছুট লোক যেতে পারছে। বুঝলাম সুন্দর লোকটার মাঝে লুকিয়ে আছে এক অসুন্দর দুর্নিতিবাজ চরিত্র। দীর্ঘ তিন ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে সবাই ক্লান্ত আর বিরক্ত। সিদ্ধান্ত নিলাম আর ইন্ডিয়া আসবো না, যদি আসি তবে বাই এয়ারে আসবো, ল্যান্ড পোর্ট দিয়ে নয়। এবার আমাদের সিরিয়াল আসবে দেখে আমি ব্যাগ নিয়ে লাইনের মাথার কাছে দাঁড়ালাম। সিরিয়াল ডাক পড়ার সাথে সাথে যার যার ব্যাগ নিয়ে ছুটে চললাম ইমিগ্রেশন বিল্ডিংয়ের দিকে। ইমিগ্রেশন বিল্ডিংয়ের ভিতর এসি চলছে। কিন্তু সবাই ঘামছে। সেডে দাঁড়িয়ে সবাই বেশ গরম হয়ে গেছে, এখানকার এসিও ঠান্ডা করতে পারছে না। ভিতরে গিয়ে সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট দিলাম। ছবি তুলে, নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে পাসপোর্টে সিল মেরে ছেড়ে দিলো কাস্টমসের হাতে। পরের রুমে যাওয়ার সাথে সাথে শুরু হলো ব্যাগ তল্লাশির ভান। এক পুলিশ বলেই ফেললো, তিনছ টাকা দিন। আমি আর মুরাদ মুন্সী একসাথেই আছি। জামাল ভূইয়া আমাদের পিছনে ফেলে আগে চলে গেছে। মুরাদ মুন্সী ও আমার কাছে টাকা চাওয়ার পর বললাম সব টাকাতো আপনাদের দেশে খরচ করে এসেছি, এখন বাড়ি যাওয়ার ভাড়াটাও নেই, আপনাকে দিব কোথা থেকে? নাছোর বান্দা ছোটলোক তা বুঝে গেলাম, তাই মুরাদ মুন্সী একশত টাকা বের করে দিলো। অমনি আমাদের দুজনকে ছেড়ে দিলো। ছোটলোকের চাহিদাও ছোট থাকে। ওদের চাহিদাও ছোট তাই অল্প প্রাপ্তিতেই খুশি। আমরা দুজন এগিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ার প্রবেশদ্বারে। গেট পার হতেই নো-ম্যান্স ল্যান্ড। ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনের ভোগান্তি শেষে শান্তির এক সুবাতাশ বইছে। প্রাণ ভরে নিঃস্বাস নিলাম। আহ! কি শান্তি। এবার ঢুকে গেলাম বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন এলাকায়।

॥ ১৪ ॥
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে শান্তি

বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে তেমন একটা ভির নেই। বিশ পচিশ জনের সিরিয়াল। লাইনে দাঁড়াতেই আমাদের পাসপোর্টে সিল দিয়ে দিলো। ব্যাগ চেক করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কাস্টমস এরিয়া পার হয়ে বেরিয়ে গেলাম। আমাদের পরিচিত এক সহযাত্রী শরীয়তপুর গামী ফেম গাড়ীর কাউন্টারে পৌছে গেছে। সেখানে গিয়ে মুরাদ মুন্সীকে ফোন দিল, আপনারা কি ফেম গাড়িতে যাবেন? মুরাদ মুন্সী জানালো, আমাদের জন্য তিনটা সিট রাখেন। আমরা বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পার হয়ে বের হতেই এক যুবক এসে জানতে চাইলো আপনারা তিনজন কি ফেম গাড়িতে যাবেন বলেছেন? আমরা জানতে চাইলাম, আপনি কে? সে জানালো, আমি ফেম গাড়ির স্টাফ। আমার কাছে ব্যাগ দেন। প্রথমে আমরা একটু অবিশ্বাস করলেও পরে মনে হয়েছে, লোকটা কাউন্টারে জানানোর পর কাউন্টার থেকে যুবককে পাঠিয়েছে। যুবকটি জামাল ভূইয়ার ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে গেল। আমি আর মুরাদ মুন্সী আস্তে আস্তে কাউন্টারে গিয়ে দেখি এডভোকেট আসাদ খান মামা কাউন্টারের সামনে বসে বেশ আয়েশ করে সিগারেট টানছে। আমরা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কাউন্টারের পাশে একটা হোটেলে দেশি মাছ দিয়ে ভাত খেলাম। ভাত খেয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ফেম গাড়ির তিনটি টিকিট নিয়ে বাসে উঠে পড়লাম।
এবার প্রাণের টানে বাড়ি ছুটে চলা। দুপুরের সময় বেনাপোল থেকে ফেম গাড়ি ছেড়ে রাত নয়টার দিকে শরীয়তপুর এসে পৌছালাম। পালং বাজারে নেমে আমি আর আসাদ খান মামা দুটি রিক্সা নিয়ে চলে গেলাম নিজ ঠিকানায়। বাসায় গিয়ে দেখি আমার অর্ধপ্রাণ মা রওশন আসাদ প্রিয়ন্তী এখনও জেগে আছে। আমাকে দেখে ঝাপিয়ে পড়লো আমার কোলে। আমি আমার প্রাণ ফিরে পেলাম, মাকে পেলাম, মাটির পরশ পেলাম। এক অপূর্ব অনুভূতির সংমিশ্রণে দ্রভিভূত হয়ে রাতের খাবার সেরে শান্তির ঘুমে নিমজ্জিত হলাম। আসলেই সত্যি, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্ম ভূমি… সে যে আমার জন্ম ভূমি…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here