বেলচা, ওড়া, কোদাল আমাদের নিত্যদিনের অতি প্রয়োজনীয় উপকরণ। কৃষি কাজে, ঘর-গৃহস্তালির কাজে এর ভূমিকা অপরিসীম। অনেক পিতা-মাতা-ভাই আছেন যাদের এগুলো প্রয়োজন হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে! তাই সন্তানের জন্য একটা বাইক কিনার সাথে সাথে বেলচা-ওড়া-কোদাল কিনে রেডি থাকুন! কেন একথা বলছি হয়তো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। সে কথা বলার জন্যই আজকের এ লেখা। এ লেখার মানে এই নয় যে কেউ বাইক কিনবেন না, বাইকে চড়বেন না!

আজকের লেখাটার কারন আর কিছুই নয়, দুটি তাজা প্রাণ কেড়ে নিলো মোটরবাইক। সম্প্রতি মোটর রেস করতে গিয়ে মাদারীপুর-শরীয়তপুর মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পণ্যবাহী একটি ট্রাকের পেছনে মোটরবাইক নিয়ে আছড়ে পড়ে দুই যুবক। এতে দুজনই ঘটনাস্থলে নিহত হয়। ১০ এপ্রিল ২০১৯ বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে মাদারীপুর সদর উপজেলার মঠেরবাজার সংলগ্ন সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হয়েছে শরীয়তপুর পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের তুলাসার গ্রামের মোঃ ইউনুস মোল্লার ছেলে তালহা তানজিম দিগন্ত মোল্লা (১৭) ও উত্তর বালুচরা গ্রামের খোকন সরদারের ছেলে সুমন সরদার জুম্মান (১৭)। দুজনই পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। দুজনই পরিবারের একমাত্র আদরের পুত্রধন। দিগন্ত দ্রুত গতিতে মোটরবাইক চালাতো। এজন্য মাঝে মাঝেই বাড়িতে বিচার আসতো। গতকালও দ্রুত গতিতে মোটরবাইক চালানোর কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে।

নিহত দুজনের বয়স ও মৃত্যুর বিবরণ দেখলেই বুঝাযায় তারা কতটা বেপরোয়া ছিলো। সবে মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। এখনও ফল বের হয়নি। শরীয়তপুরের মত একটা পশ্চাদপদ জেলার এসএসসি পরীক্ষার্থী রাত এগারোটায় মাদারীপুর ঘুরতে যায় তারা কেমন বাবা মায়ের সন্তান হয়তো আমার নয় অনেকেরই মনে এমন প্রশ্ন। তাদের বন্ধুরা বলছেন তারা দীর্ঘদিন যাবৎই এমন বেপরোয়া গতিতে বাইক চালাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে শরীয়তপুর-মাদারীপুর হাইওয়েতে রেস করতো। এই অবুঝ শিশুদুটির মৃত্যুতে ওদের কোন ভূমিকা ছিলো বলে আমি মনে করি না। ওদেরকে ওদের বাবা-মা’ই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। মানবিকতার কারনে আমরা সবাই আজ বাবা-মাকে সান্তনা দিচ্ছি ঠিকই কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা হওয়া উচিত বলে আমি একজন বাবা হিসাবে মনে করি।

শরীয়তপুর জেলায় সবচেয়ে বেশি যে পেশার মানুষ বাস করে তা হলো কৃষির পরেই প্রবাসী পেশা। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি অখ্যাত দেশেও অনেক মানুষ থেকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের দেশের জন্য মহা মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্র পাঠায়। যার কারনে আমরা মাঝে মাঝেই গর্বের সাথে পরিসংখ্যান দেই যে, এখন আমাদের রিজার্ভে এত মুদ্র আছে! প্রবাসী ছাড়াও অনেক ব্যবসায়ী, চাকুরিজীবী রয়েছে, সেই সাথে রয়েছে অনেক ঘুষখোর। তবে টাকা যেভাবেই কামাই করিনা কেন আমাদের সবার উদ্দেশ্য থাকে একটাই সেটা হলো পরিবারকে ভালো রাখা, খুশি রাখা, সুখে রাখা। সন্তানদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে বাবা-মা। এর পরে যারা শিশুদের ভালোবাসে তারা হলেন তাদের ভাই-বোন। আমরা ছোটরা বাবা-মা, ভাই-বোনদের অনেক সময় বিভিন্ন আবদারে মানসিক নির্যাতন করি। এতটাই নির্যাতন করি যে আমাদের অন্যায় আবদারও তারা মিটাতে পিছপা হয় না। বাবা-ভাই প্রবাসী, ব্যবসায়ী বা ঘুষের চাকুরী করেন, অঢেল টাকা হাতে। সন্তানের অন্যায় আবদারও মিটাতে বেগ পেতে হয় না। একসময় কৃষক বাবার পক্ষে সন্তান দুইদিন একটা বাইসাইকেলের জন্য না খেয়ে থাকলেও আবদার মিটাতে পারেনি বা মিটায়নি। কিন্তু এখন দুচারটা গ্লাস ভাঙ্গলেই আধা ঘন্টার মধ্যে ছেলের পাছার নিচে নতুন মটর বাইক তাও আবার একশত পঞ্চাশ থেকে দুইশ সিসির বাইক কিনে দেন। কৃষক বাবার সন্তান ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। ঘন্টায় পাঁচ টাকা দিয়ে বাইসাইকেল ভাড়া করে চালানোর ক্ষমতা ছিলো না এখন অঢেল টাকা হয়েছে তাই ভাইয়ের আবদার মিটাতে নতুন দ্রুত গতির মোটরবাইক কিনে দেন। আসলে কি তারা অবুঝ সন্তান বা ভাইকে মটর বাইক কিনে দিলেন না মৃত্যুর যন্ত্র কিনে দিলেন সেটা কখনো ভাবেন না।

১৮৭৫ সালে পাস করা ব্রিটিশ প্রশাসনের ফ্রেন্ডলি সোসাইটিস অ্যাক্টে ছিল ৫০ বছর বয়সের পর থেকেই একজন মানুষ ‘বার্ধক্যে’ প্রবেশ করল। আর জাতিসংঘের খাতায় বার্ধক্যে প্রবেশের সীমানা দেয়াল হচ্ছে ৬০ বছর। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মানুষকে তারুণ্যের শক্তি প্রদর্শনের জন্য ৬৫ বছর পর্যন্ত সময় দেয়ার পক্ষপাতি। এ ব্যাপারে তারা নতুন একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। বর্তমানের স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের সুযোগ, জীবনমান, গড় আয়ু ইত্যাদি বিবেচনায় জীবনচক্রের নতুন বিভাজন তৈরী করেছে। এগুলো হচ্ছে: (ক) ০ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু, (খ) ১৮ থেকে ৬৫ বছর পর্যন্ত তরুণ, (গ) ৬৬ থেকে ৭৯ বছর পর্যন্ত মধ্যবয়সী, (ঘ) ৮০ থেকে ৯৯ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধ এবং (ঙ) ১০০ বছরের উপরে গেল দীর্ঘজীবী। গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যানের বিবেচনায় নিহত দুই ছাত্র এখনও শিশুই ছিলো। শিশুর হাতেই আমরা তুলে দিয়েছিলাম মৃত্যুর উপাদান।

শিশুর আবদার বিবেচনা করার মত ক্ষমতা থাকা উচিত। আপনার শিশু এখন যদি আপনার কাছে আবদার করে যে, বাবা আমাকে একটা একে-৪৭ রাইফেল কিনে দাও, ওটার ট্রিগারে একবার চাপ দিলে কি সুন্দর ঘট ঘট করে গুলি বের হয়, একবার চাপলে অনেক মানুষ মারা যায়। আমাকে এখনই একটা কিনে দিতে হবে নইলে আমি ভাত খাবো না, ঘরে ভাঙ্গচুর করবো। আপনি কি কিনে দিবেন? নিশ্চই দিবেন না। হয়তো বলবেন, লাইসেন্স দেবে না সরকার, মার্ডার কেইসে পড়বা ইত্যাদি ইত্যাদি! শিশু পুত্রকে মোটর সাইকেল কিনে দিলেন, ওকে কি সরকার গাড়ির লাইসেন্স দিবে, ওকে কি সরকার ড্রাইভিং লাইসেন্স দিবে? দিবে না। তাহলে কেন ওকে অবৈধ ভাবে রাস্তায় একটা বাইকাস্ত্র দিয়ে ছেড়ে দিলেন? শিশু ছিলো সে, ওরতো কোন অপরাধ নেই, অপরাধটাতো আপনি করলেন প্রিয় বাবা, ভাই। রাত এগারোটায় নিজ বাড়ি থেকে পনের-ষোল কিলোমিটার দূরে আপনার সন্তানকে কি করতে পাঠিয়েছিলেন? হয়তো বলবেন আমি পাঠাইনি, এত দ্রুত গতিতে কেন বাইক চালাতে দিলেন, এই বয়সে মাদারীপুর-শরীয়তপুর (যা চট্রগ্রাম-মংলা হাইওয়ে) হাইওয়ের মত ব্যস্ত রাস্তায় কেন রেস করতে দিলেন? বলবেন আমিতো দেইনি। তবে কেন বাড়িতে ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার পর আটকালেন না? যদি আটকাতেন তবে আজ শোক সইতে হতো না। রাস্তায় বেরোলে দুর্ঘটনা হবে না এমন নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না, কিন্তু এটাকে আমি দুর্ঘটনা মানতে নারাজ, এটা হত্যাকান্ড, একটা শিশুর জন্য একটা বাইক নিরব ঘাতক ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

একটা বেকার সন্তানকে, একটা ছাত্রকে বাইক কিনে দিলে সব দায়িত্ব বা চাহিদা শেষ হয়ে যায় না। এর পর আসে তেলের খরচ, মেইনটেনেন্স খরচ, হাত খরচ ইত্যাদি। যখন তার হাতে এসব খরচ দিতে অনিহা প্রকাশ করবেন তখন সে কি করবে একবার ভেবে দেখেছেন? তখন সে ছিনতাই করবে, মাদক কেনা-বেচার সাথে জড়াবে, সন্ত্রাসের সাথে সঙ্গ দিবে। একটা বাইক হলে সেই ছেলের বন্ধুর অভাব হবে না। অতীতে কেউই ছাত্র বা বেকার সন্তানকে বাইক কিনে দিয়ে সুখস্মৃতি হাতড়াতে পারেনি। একটু খোজ খবর নিলেই দেখতে পারবেন কি ঘটেছে সেই সন্তানদের সাথে। বাইক চালাতে চালাতে আর পড়ারই সময় পায়নি!

হয়তো অনেকে বলবেন একটা বাইক দরকার আছে, ছেলেটা স্কুলে যায, কলেজে যায়, প্রাইভেট পড়ে। রিক্সা ভারা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, বাইক হলে ভালো হয়। হতে পারে। কিনে দিন একটা বাই সাইকেল বা সর্বোচ্চ ফিফটি সিসির স্কুটি। দেখবেন সে নেবে না। তার দরকার দ্রুত গতির লেটেস্ট মডেলের দৃষ্টিনন্দন বাইক। তারতো যানবাহন প্রয়োজন নেই, ফুটানি দেখানোর জন্য প্রয়োজন! একটা বাইক প্রয়োজন আছে, একজন কর্মির জন্য, একজন চাকুরিজীবীর জন্য, একজন ব্যবসায়ীর জন্য। সে প্রয়োজন বুঝে নিজের আয় থেকে ফুয়েল কিনে চালায়, আর তখন সে ব্যয়ের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হয়। বাপের দামী শাল চাদর দিয়ে নিজের টাকায় কেনা ছেড়া স্যান্ডেল মুছা যায় এটা আমরা সবাই জানি, আর নিজের কেনা শাল হলে? তখন ওটাকে কাধে আগলে রাখে যেন ভাজ নষ্ট না হয়। এটাই বাস্তবতা।

তাই পরিশেষে বলবো, বেকার সন্তান, ছাত্র সন্তানকে একটা বাইক কিনে দেয়ার সময় একটা বেলচা, একটা ওড়া ও একটা কোদাল কিনে রাখুন ঘরে! আপনারই কাজে লাগবে। কিভাবে? বেকার সন্তান বা ছাত্রটি যে দ্রুত গতিতে মোটর বাইকটি চালাবে তাতে দুর্ঘটনায় পড়লে সন্তান সহ গাড়ি গুড়াগুড়া হয়ে যাবে, হয়ে যাচ্ছে। কোথাও হতে গাড়ির পার্টস, কোথাও হতে সন্তানের মগজ, কোথাও হতে হাড়গোড় তুলতে বেলচাটা আর ওড়া খুব কাজে দেবে আর বাড়িতে এনে দাফন করতে কোদাল ওড়া প্রয়োজন হবে! আমার এ লেখায় যদি কেউ মনে কষ্ট পান তবে আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমি কষ্ট দেয়ার জন্য লেখাটা লিখিনি। সতর্ক করার জন্য লিখলাম। প্রয়োজনের বেশি আদর আবদার মিটাবেন না। যাতায়াতের জন্য হাটা পথ হলে বাইসাইকেলও নয়, একটু দুর হলে বাইসাইকেল দিন মটর বাইক নয়, যদি বেশি দুরত্বর কোথাও নিয়মিত যাতায়াত করতে হয় তবে ফিফটি সিসির স্কুটি দিন রেসার মোটরবাইক নয়। এতে সন্তান ভালো থাকবে, সুস্থ্য থাকবে, আপনাকে কাদতে হবে না। তবে এসবই যে দুর্ঘটনা রোধ করবে তা কিন্তু নয়। দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই, যে কোন সময় যে কারোর সাথে ঘটে যেতে পারে।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here