১৫ জুলাই ২০১৯ বেলা ১১টায় দেশে ঘটে যায় এক কলঙ্কজন ঘটনা। ঘটনাটি আর কিছুই নয়, আদালতের বিচার কক্ষে এবং বিচারকের কক্ষে (খাসকামরায়) ঘটেযায় হত্যাকান্ডের মত ঘটনা। সিনেমার ঘটনার মত ডায়লগ দিতে দিতে বিচার কক্ষের আসামী হাজিরার ডক থেকে কোপাতে কোপাতে খাসকামরায় গিয়ে কোপানো শেষ হয়। আদালতে বিচার প্রার্থী বিচারকের কক্ষেই উপর্যুপরি কোপে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এক আসামী। ঘাতক অপর আসামী তখন ডায়লগ দিচ্ছিলো-‘তোর কারণে মামলা খাইছি’। কি বিভৎস্য ঘটনা ভাবাযায়? ঘটনার পর পরই ঘাতককে গ্রেফতার, তদন্ত কমিটি গঠন এবং এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা এবং নিরাপত্তা জোরদারের বিষিয়টি সামনে চলে এসেছে। হাস্যকর মনে হলেও নিরাপত্তার জন্য সেই পুলিশ কর্মীরাই থাকবে এবং সেটাই স্বাভাবিক।

বিচার বিভাগ যদি একটি পাখি হয় তবে তার দুইটি ডানার মধ্যে একটি হলো বিজ্ঞ বিচারক অন্যটি আইনজীবী। একটি ডানা যদি ভেঙ্গে যায় বা ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেক্ষেত্রে পাখিটি যেমন উড়তে পারে না। এই কথাটা আমরা মাঝে মাঝেই শুনি বাণীর মত। তবে একটি পাখির শুধু দুইটি ডানা থাকলেই হয় না, এর মজবুত পা থাকতে হয়, শক্ত ঠোট থাকতে হয়, থাকতে হয় পালকও। সব মিলিয়েই পাখিটির সৌন্দর্য ও কর্মক্ষমতা প্রকাশ পায়। বিজ্ঞ বিচারক আর আইনজীবী যদি পাখির দুটি ডানা হয় তবে আদালতে কর্মরত কর্মীরা হলেন কেউ পা, কেউ ঠোট, কেউ পালক।

আদালত পাড়ার ঘটনা নিয়ে মাঝে মাঝেই আলোচনার ঝড় ওঠে। কখনো আইনজীবীদের দোষ দেয়া হয়, কখনো বিজ্ঞ বিচারকদের দোষ খুজে বেড়াই। কিন্তু কেউ কি অন্য অঙ্গগুলোর খোজ রাখি? আদালতে পেশকার, সেরেস্তাদার, জারিকারক, পিয়ন থেকে শুরু করে আরো নানান শ্রেণী-পদ মর্যাদার লোক কাজ করে। সেই সাথে আদালতে নিরাপত্তার জন্য কাজ করে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। সকলে যদি আন্তরিকতা, নিষ্ঠার সাথে সমান্তরাল গতিতে কাজ না করে তাহলেতো দুর্ঘটনা ঘটবেই।

সারা দেশে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে সাথে আদালত পাড়ায় আগত বিচার প্রার্থীদেরও ব্যয় বেড়ে গেছে। আগে শুনেছি বিচারপ্রার্থীরা তার নিয়োজিত আইনজীবীকে বিশ টাকাও বায়না দিতেন। পূর্বে হয়তো আরো কম ছিলো। এখন বায়না বেড়ে দাড়িয়েছে পাঁচশত টাকায় ক্ষেত্র বিষেশ আরো বেশি। বিচার প্রার্থীদের ব্যয় বৃদ্ধির কারন আইনজীবীদের উচ্চাভিলাশী চিন্তা নয়। প্রকৃত খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় এমনটা হয়েছে। আদালতের কর্মচারীদের স্পিড মানি দিতে হয়। নয়তো দরখাস্ত থাকে না, নথী থাকে না বা পাওয়া যায় না। নকলখানায় গেলে কোন নথীই পাওয়া যায় না টাকা ছাড়া, জারিকারকরা মামলার রায় পর্যন্ত বিক্রি করে আসে। মোটা অংকের উৎকোচ না দিলে দিনের পর দিন সমন জারি হয় না এমন অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। কর্মচারীদের আচরন দেখলে মনে হয়, আইনজীবীরা কাড়ি কাড়ি টাকা নেয়, তাদের কেন দেবে না! তাইতো মানুষের মুখে মুখে-‘কোর্ট কাচারির দুর্বা ঘাসও নাকি টাকা চায়’! এই অভিযোগটা কিন্তু গোপন নয়। প্রকাশ্য হলেও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কখনোই নজর দেয় না। আর দেবেই বা কিভাবে? একজন কর্মচারী যদি প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করে নিয়োগ লাভ করে থাকে তবে সেতো সেই টাকা উঠানোর জন্য শুধু বেতনের দিকে তাকিয়ে থাকবে না বা তাকিয়ে থাকলে হবেও না। চাকরিটায় লাভ শুধু পেনশনে। সারা জীবনের বেতনের টাকা একবারে ঢেলে নিয়োগ পেয়েছে, সংসার চালায় স্পিড মানি দিয়ে, শেষ জীবনের ভরসা পেনশনের টাকাটাই, এমনটা ভেবেই তাদের চরিত্র নষ্ট হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন!

একসময় বাদশারা ছদ্মবেশে বের হতেন। অন্য কোন কারনে নয়, দেখতে কেমন চলছে তার রাজ্য, বাদশা সম্পর্কে প্রজাদের মনোভাব কেমন। ছদ্মবেশে বের হয়ে দেখতো দেশে কিভাবে বিচার চলছে, শাসন চলছে, অনিয়ম হচ্ছে। নিজ চোখে দেখে বিচার করতেন বাদশারা। বর্তমান সময়ে কর্তাব্যক্তিদের উচিত মাঝে মাঝে তার অধস্তন কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক কিনা খোজ নেয়া। শুধু অভিযোগপত্র পেলেই ব্যবস্থা নেয়া যাবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। নিজে যদি সৎ এবং সঠিক হন তবে অধস্তন ব্যক্তিদের উপরও নজর দেয়া উচিত। দুই চারটা সমন জারির খবর নেন গোপনে বা প্রতিদিনের বিভিন্ন দরখাস্ত জমা দেয়ার সময় নিজের লোক দিয়ে জমা দিয়ে দেখেন পেশকার কি করে, বা নকল প্রাপ্তির জন্য একটু নকলখানায় দূত পাঠান বা জামিন শেষে খোজ নেন পুলিশ কি করে তবেই পেয়ে যাবেন প্রকৃত চিত্র। নিজে ভালো হলেই তো হবে না, পরিবেশ ভালো করতে হবে নিজে ভালো থাকার জন্য। একটু নজর দিলে আদালত পাড়ায় দালালি, ঘুষ লেনদেন, অনিয়ম, বকসিস বাণিজ্য সব ঠিক হয়ে যাবে।

আদালতের নিরাপত্তার কথায় আসি। প্রতিটি আদালতের প্রতিটি এজলাসের সামনে-ভিতরে পুলিশ দায়িত্বে থাকে। তারা শুধু শৃঙ্খলাই রক্ষা করে না, এজলাসে উপস্থিত সকলের নিরাপত্তার জন্যও থাকে। কিন্তু যারা আদালতে যান বা যাতায়াত আছে তারা দেখবেন, পুলিশ কি করে? একটা জামিন হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ জামিনপ্রাপ্ত আসামীর পিছু নেয় বকসিসের জন্য। কোন কোন পুলিশ আসামীর নিয়োজিত আইনজীবীর চেম্বার পর্যন্ত চলে আসে! নিরাপত্তা বিঘিœত হলো কি হলো না তার থেকে বেশি নজর বকসিসের দিকে থাকলে যে কেউ ছুরি-কাচি নিয়ে প্রবেশ করতেই পারে! একজন আসামী যখন কোর্টে ওঠে তখন নূন্যতম তল্লাশিটাও করে না। যে অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে গেলো সেই ঘটনা কোন বিজ্ঞ বিচারক বা আইনজীবী বা বিচার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথেও ঘটতে পারতো। বিশেষ করে আইনজীবীর সাথেও ঘটতে পারতো। ঘাতকের ধারনা নিহত ব্যক্তির কারনেই সে আসামী শ্রেণীভূক্ত হয়েছে! যে মামলায় আসামী হয়েছে সেই মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবীর শুনানী শুনেতো তার মনে হতে পারে যে ঐ আইনজীর কারনেই সে জেলে গেছে! তাই অনাকাঙ্খিত ঘটনা যাদের কারনে ঘটেছে তাদের কর্মকান্ড এখন আর অনাকাঙ্খিত নয়। তারা এমনটাই করে থাকে। তবে সবাই যে করে এমনটি যেমন ঠিক নয়, আবার সবসময় অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে এটাও ঠিক নয়। যখন ঘটে তখন সবাই নড়েচড়ে বসে। সবসময় সতর্ক থাকলে এমনটা ঘটতো বলে মনে হয় না।

আদালত পাড়ায় হত্যার ঘটনা আগেও ঘটেছে। এর আগে আদালত, বিচারক এবং আইনজীবীদের ওপর জঙ্গি সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনা ঘটেছে যা সবার মনে আছে। এসব ঘটনায় বিচারক-আইনজীবীসহ কয়েকজন নিহতও হয়েছেন। এরপর থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার দাবি উঠেছিল। এবার এই ঘটনা জনগণকে আবারও শঙ্কিত করে তুলেছে। একেকটা ঘটনা ঘটার পরে আমরা শঙ্কিত হই। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অবশ্যই সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিচারসংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। ছাড় দিলে বার বার আমাদের শঙ্কিতই হতে হবে।

বিচার প্রার্থীদের সুবিচার দিতে হলে আদালতের পরিবেশ ঠিক করা জরুরী। যার যার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করার দিকে নজর দেয়া উচিত। আদালতের ভিতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা আদালতের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তির নজরে থাকতে হবে। কঠোর ভাবে যদি যার যার দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা যায় তবে বিচার প্রার্থীরা সুবিচার পাবে, বিচার সংশ্লিষ্টরা নিরাপত্তা পাবে এবং বার বার অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটবে না বলেই মনে হয়।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here