শুকরের বাচ্চার যখন দাঁত গজায় তখন তার বাবার পাছায় কামড় দিয়ে পরীক্ষা করে দাঁতের ধার কতটুকু হয়েছে। আর মাকড়শা নামের কুৎসিত পোকাটাকে ঘৃণা করে না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। আমার তো মাকড়শা দেখলেই গা ঘিন ঘিন করে। সেই মাকড়শা নামের ভয়াবহ কুৎসিত প্রাণীটা যে মাতৃত্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণ সেটা জানার পর আমি কিছুক্ষনের জন্য হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। হতবাক হওয়ার কারনও আছে। অন্যান্য পোকামাকড়ের মত মাকড়শা নামের আর্থ্রপোডা শ্রেণীর পোকাটিও ডিম পাড়ে। কোন কারণে যাতে ডিমগুলো নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য ডিমগুলো সবসময় নিজে বহন করে মা মাকড়শা। প্রকৃতির নিয়মে একদিন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। কিলবিল করে ছুটতে থাকে খাবারের জন্য ক্ষুধার্ত বাচ্চাগুলো। এতগুলো বাচ্চার খাবার জোগার করা মাকড়শা মায়ের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। ক্ষুধার জ্বালায় মাকড়শার বাচ্চাগুলো জন্মদাত্রী মায়ের দেহই খাওয়া শুরু করে দেয়। সব কষ্ট সহ্য করে মা মাকড়শা বাচ্চাদের কাছে নিজের দেহ বিলিয়ে দেয়। সময় যায়, মৃত মা পড়ে থাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে, মায়ের দেহ খেয়ে বেঁচে থাকা মাকড়শার দল আবার পায় মামৃত্বের স্বাদ! কি অদ্ভুত! তাই না? আমরাও পিতার পাছায় কামড় দিতে বা মাকে হত্যা করতে কখনো কখনো পিছপা হইনা। জাতীগত ভাবে আমরা পিতা-মাতা হত্যার জন্য প্রতিষ্ঠিত ও সু-পরিচিত। যার প্রমান দেখিয়েছি পনেরই আগষ্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতাকে বঙ্গমাতাকে হত্যা করে আমরা দম্ভের সাথে কথা বলেছি, পুরস্কৃত হয়েছি, একটুও লজ্জাবোধ হয়নি আমাদের। এখন আমরা মা ইলিশ হত্যা করছি। এত বিধি নিষেধ থাকা স্বত্বেও হত্যাযজ্ঞ থামছে না।

বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের ৭০-৭৫ ভাগ বাংলাদেশ আহরণ করে। উৎপাদন ও আহরণের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত। বাংলাদেশে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যমতে, এ সময় প্রজননক্ষম মা ইলিশের হার ছিল ৯৩ ভাগ এবং এর মধ্যে ৪৮ ভাগ পরিপক্ব মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। ইন্সটিটিউট পরিচালিত গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী গত বছর ২২ দিন মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকরণের ফলে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি ডিম উৎপাদিত হয়েছে। এতে ৫০ ভাগ ডিমের সাফল্যজনক পরিস্ফুটন হলে এবং এর ১০ ভাগ বেঁচে থাকলে ৩৫ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে গবেষকরা মনে করছেন।

ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে দেশে ইলিশের ছয়টি অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মধ্যে মেঘনা নদী, শাহাবাজপুর চ্যানেল, তেঁতুলিয়া নদী, পদ্মা নদী এবং বরিশাল জেলার সদর, হিজলা এবং মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কালাবদর নদী, গজারিয়া ও মেঘনা নদীতে (৮২ কিলোমিটার) মার্চ-এপ্রিল মাসে মাছ ধরা সম্পূর্ণরুপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট তিন প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে দুটি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারা জীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর একটি মিঠা পানি ও লোনা পানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭০ কিলোমিটার অভিপ্রায়ণ করতে পারে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৭-২০১৮ সালে তা ৫.১৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ বিগত ১০ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য।

গত ২০১৬ সালে ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। ইলিশের স্বত্ব এখন শুধুই বাংলাদেশের। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় ৫০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। ওই ফ্যাটি এসিডের প্রায় ২ শতাংশ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, যা মানবদেহের কোলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করে হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া ইলিশের আমিষে ৯ ধরনের অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়, যা মানুষের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না। ইলিশের চর্বিতে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ থাকে। এ জন্য ইলিশ স্বাস্থ্যবান্ধব মাছ হিসেবে অধিক পরিচিত।

দেশের এমন একটি সম্পদ আমরা ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে পরেছি। সরকার ইলিশ প্রজন বৃদ্ধিতে নানান কর্মসূচী হাতে নেয়। সরকারের সেইসব ইলিশ বান্ধব কর্মসূচীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে জেলেরাই নয়, প্রশাসনও ক্ষেত্র বিশেষ উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে। অল্প কয়েকটা পয়েন্টে ইলিশ ধরা বন্ধ করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। হাতে গোনা কয়েকটি পয়েন্ট আমরা রক্ষা করতে পারলে ইলিশ মাছ আর পানি হয়তো সমান হয়ে যেতো! আমরা যদি ইলিশ রক্ষার্থে মাত্র আটটি পয়েন্ট নিরাপত্তা দিতে না পারি তাহলে আমরা আমাদের বিশাল সমুদ্র সীমা আমরা কিভাবে পাহাড়া দেই? আমাদের দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে আমাদের সেনাবাহিনী ও বিশাল সীমান্ত রক্ষার্থে বিজিবি কাজ করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের অভ্যন্তরে মাত্র কয়েকটি পয়েন্ট প্রশাসন ও পুলিশ রক্ষা করতে পারছে না যা শুধু দুঃখজনকই নয় অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ও দুর্ভাগ্যজনক।

মাত্র বিশ দিন মা ইলিশ রক্ষার্থে সরকার ইলিশ নিধন বন্ধ করার ঘোষণা দেয়। এই বিশ দিন জেলেরা যদি একটু কষ্ট সহ্য করে তবে সারা বছর ইলিশ ধরবে আর মোটা টাকা মুনাফা করার সুযোগ পাবে। সারা বছর ইলিশ ধরে জেলেরা কী কিছুই সঞ্চয় করতে পারে না? তার পরও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু প্রনোদনা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। যদিও সেটা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল এবং আমাদের দেশের চাটার দল চেটে খেয়ে যে পরিমান জেলেদের কাছে যায় তাতে জেলেদের চাহিদার সিকি ভাগও পূর্ণ হয় না।

বিশ দিনের কর্মসূচী দেয়া সত্বেও আমাদের জেলেরা নদীতে জাল নিয়ে নেমে যায়। প্রশাসন মাঝে মাঝে ঝটিকা হামলা করে কিছু জেলেদের আটক করে সাজা দেয়, মাছ ও জাল ছিনিয়ে নেয় এবং মাছ কিছু কিছু এতিম খানায় আর জাল পুরে ফেলে। রাস্তা ঘাটে পুলিশ পাহাড়া দিলেও মটর সাইকেল, টেম্পু, নসিমন, পিকাপ ভরে ইলিশ পরিবহন করে। মাঝে মাঝে পুলিশ নিজেরাও পরিবহন করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায় যা দুর্ভাগ্যজনক। অভিযোগ আছে কোন কোন থানা নির্দিষ্ট উৎকোচের বিনিময়ে জেলেদের নদীতে নামার অনুমতিও দেয়। এভাবে বেড়া যদি ক্ষেত খায় তবে ক্ষেতের ফসল রক্ষা করা কঠিন বলেই মনে হয়।

সব শেষে বলবো, আমাদের আন্তরিকতাই পারে ইলিশ রক্ষা করতে। সকলকে আন্তরিক হতে হবে। জেলেদের উচিত হবে শত কষ্ট হলেও মাছ ধরতে না নামা, পুলিশের উচিত হবে জেলেদের নামতে না দেয়া ও ইলিশ পরিবহন করতে না দেয়া, জনগণের উচিত হবে এই সময় ইলিশ না কেনা, ব্যবসায়ীদের উচিত হবে এই সময় মজুদ না করা, প্রশাসনের উচিত হবে পরিস্থিতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ করা। জেলেরা ইলিশ ধরে যদি আমাদের কাছে বা মজুদদারদের কাছে বিক্রি করতেই না পারে তবে ধরে কী লাভ হবে? তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই আমরা ইলিশ রক্ষা করতে পারবো। আর সেটা যদি পারি তবে আমাদের দেশ ৭০-৭৫ ভাগ ইলিশ আহরণ করে প্রথম স্থানে নয় ৯০ ভাগের উপরে ইলিশ আহরণ করে প্রথম স্থানে অবস্থান করতে পারবো। তাই পিতার পাছায় কামড় দেয়া বা মায়ের দেহ খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সেটা হবে এখনই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here