কবি রামনিধি গুপ্ত লিখেছিলেন ‘নানান দেশের নানা ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা?’ আর স্বদেশী ভাষা মানেই মায়ের ভাষা, যে ভাষায় আমরা প্রথম কথা বলা শিখি। তাই যত ভাষাই শিখিনা কেন, যত ভাষায়ই কথা বলিনা কেন মায়ের ভাষায়, স্বদেশী ভাষায় কথা বলতে না পারলে যেন বুক ফেটে যায়। বিদেশ বিভূইয়ে ভোজনে যে তৃপ্তি পায় মানুষ তার চেয়েও অধিক তৃপ্তি পায় স্বদেশী কাউকে পেলে, তার সাথে একটু মায়ের ভাষায় কথা বলেতে পারলে।

সেই মায়ের ভাষা, স্বদেশী ভাষা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হয়েছিলো আমাদের মুখ থেকে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়ার প্রতিবাদে এবং বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকায় আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন তরুণ শহীদ হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো রফিক, জব্বার, শফিউল, সালাম, বরকত সহ অনেকেই। শহীদদের সেই দিনের অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয় যা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও সম্মানের এক অর্জন।

ঢাকার সেদিনের সেই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিলো জেলায় জেলায়, গ্রামে গঞ্জে, পাড়ায় মহল্লায়। পাকিস্তানের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে, গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে অন্যান্য এলাকার মতো শরীয়তপুরেও হয়েছিলো প্রতিবাদসভা, মিছিল, মিটিং, আন্দোলন। মায়ের ভাষা রক্ষার দাবীতে সেদিন শরীয়তপুরে যারা রাস্তায় নেমেছিলো, মিছিল করেছিলো, পুলিশের হাতে আটক ছাত্রদের ছিনিয়ে এনেছিলো তাদের মধ্যে আমার বাবা আব্দুর রশিদ খানও ছিলেন সেই প্রতিবাদীদের একজন।

ঢাকার আন্দোলনের ঢেউ যখন পালং এসে আছড়ে পড়ে তখন বুড়ির হাটের চৌধুরী মজিবুর রহমান, উত্তর বালুচড়ার নারায়ন চন্দ্র দে, দক্ষিণ বালুচড়ার রমেন্দ্র ঘটক চৌধুরী, তুলাসারের অধ্যাপক আলী আহাম্মদ মিয়া, আটংয়ের আব্দুল মান্নান হাওলাদার, ধানুকার সত্য রঞ্জন দে, তুলাসারের হাজী মোঃ আব্দুস সাত্তার, জালাল উদ্দিন আহমেদ, ধানুকার সম্ভুনাথ দাস, নিরঞ্জন পাল, বুড়ির হাটের মাকসুদুর রহমান চৌধুরী, বিনোদপুরের আব্দুল মজিদ মিয়া, হুগলীর আব্দুল খালেক ঢালী, আমার বাবা পালংয়ের আবদুর রশিদ খান, তুলাসারের আব্দুল খালেক সিকদার (মরণ), নয়ন খাঁ, ধানুকার পূর্ণ চন্দ্র দে, স্বর্ণঘোষের সামসুল হক তালুকদার, তুলাসারের আব্দুল কাদের বেপারী, কাগদীর ইউসুফ আলী রাড়ী, আড়িগাওয়ের মোঃ বাদশা হাওলাদার, তুলাসারের নারায়ন চন্দ্র সাহা, দক্ষিণ বালুচড়ার আব্দুর রশিদ খান, নড়িয়ার হাফেজ মোশারফ হোসেন, পালংয়ের আব্দুল খালেক মোল্লা সহ অনেকেই আন্দোলনে নেমে পড়েন। মিছিল করে স্লোগানে স্লোগানে থানা শহরের রাস্তা কাপিয়ে তোলেন। সেদিনের সেই আন্দোলনকারীদের অনেকেই আজ আর বেঁচে নেই।

প্রতি বছর যেমন ভাষা শহীদদের স্মরণে নানান অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়, শরীয়তপুরেও এর ব্যতিক্রম হয় না। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শরীয়তপুরের ভাষা সৈনিকদের সম্মাননা দিয়ে সম্মানিত করেছেন। ২০২০ সালের অনুষ্ঠানে ক্রেষ্ট, প্রাইজ বন্ড, ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়ে শরীয়তপুরের ভাষা সৈনিকদের সম্মান জানিয়েছিলো শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন। এই সম্মাননা গর্বের, সম্মানের, ভালোবাসার।

আমার বাবা আব্দুর রশিদ খানের জন্ম ২০ মে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ। ১৯৫২ সালে ২০ বছরের টগবগে যুবক, ছাত্র। ঢাকায় ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের খবর পালং থানায় পৌছালে বন্ধুদের নিয়ে নেমে পড়েছিলেন রাস্তায়। প্রায় নব্বই বছর বয়সে এখন বার্ধক্যের কাছে ধরাশায়ী। বয়সের ভারে, নানান রোগে শোকে এখন আমার বাবা শয্যাশায়ী। আমার বাবা অসুস্থতার কারনে নিজে উপস্থিত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করতে পারেনি। জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ আমার বাবাকে সম্মান জানানোর জন্য। সকলের নিকট আমার বাবার সুস্থ্যতার জন্য প্রার্থনা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here