আমার মমতাময়ী মা রওশনারা বেগম

২০১২ সাল। ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় একুশে বইমেলা। যারা বই বড়তে ভালোবাসেন এবং লেখালিখি করেন তাদের কাছে এক ভিন্ন মাত্রা এনে দেয় এই একুশে বইমেলা। বইমেলা শুরু থেকেই বেশ জমে ওঠে। সেবছরও মেলা জমে উঠেছে। আমার কাছে ২০১২ সালের বইমেলা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এতদিন ছিলাম পাঠক। টুকটাক লেখালিখি করি। কিন্তু দুই মলাটের ভিতরে কোন লেখাকে আবদ্ধ করে পাঠকের হাতে পৌছাতে পারিনি এতদিন। এবছর সেই প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা থেকে আমার ডাক আসলো যাওয়ার জন্য। কারন আর কিছ্ইু নয়। আমার জীবনের প্রথম বই পাঠকের হাতে দেয়ার জন্য একেবারেই প্রস্তত। স্টলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এবার একটু আনুষ্ঠানিকতা বাকী মাত্র।

বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে বইমেলা চত্তরে। আমার বন্ধুরা সবাই আসবে। আমি চলে গেলাম ঢাকায়। মা বাড়ির পাশেই ছোট বোন শিখার বাসায় গেলো বেড়াতে। মায়ের সবচেয়ে প্রিয় নাতী রজিবুল ইসলাম শান। ওকে মা কোলে পিঠে করে বড় করেছে। মায়ের প্রতিও শানের অনেক টান। টান তো থাকবেই। আমার বাবা-মায়ের প্রথম নাতী যে রজিবুল ইসলাম শান।

ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ। সন্ধায় আমি বন্ধুদের সাথে বই মেলায় জীবনের প্রথম মলাটের উপর প্রকাশিত নিজ নাম উন্মোচন করবো। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছি। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে সনদ প্রাপ্ত হয়ে নামের সাথে এখন এডভোকেট টাইটেল ব্যবহার করি। সাংবাদিকতা করা কালে অনেক মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ খুব কাছের থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সেসব নিয়ে প্রচুর প্রতিবেদনও তৈরী করেছি যা প্রথম আলোতে প্রকাশিতও হয়েছে। আমাদের শরীয়তপুর জেলায় প্রচুর প্রবাসী রয়েছে। ইউরোপ রাষ্ট ইতালি যাওয়ার জন্য কত তরুন তাজা প্রাণ ঢেলে দিয়েছে বনে, জঙ্গলে, বরফের শীতল জমিনে তার কোন ইয়ত্তা নেই।অনেকেই প্রবাস থেকে এসে শুনিয়েছে তাদের জীবনের গল্প। সুখ-দুঃখের কথা শুনে অনেক সময় চোখের কোন ভিজে গেছে। নীরবে নিভৃতে চোখের পানি মুঝে শুনেছি সেই মর্মস্পর্শি কাহিনী। তেমনি এক লন্ডন প্রবাসী শুনিয়েছিলো তার বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রাণের প্রিয়তমাকে ফেলে রেখে গিয়েছিলো লন্ডন। সোনার হরিণের খোঁজে লন্ডন গিয়ে হারিয়েছে হীরের চেয়ে দামী প্রিয়তমাকে। প্রবাসী ভাই তার জীবনের গল্প রাতের পর রাত, দিনের পর দিন আমাকে ফোনে, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে, ইমেইলে এবং মুখোমুখি বসে শুনিয়েছে। আমাকে অনুরোধ করেছে তার জীবনের কাহিনী নিয়ে একটি বই লিখতে। আমি কখনো লন্ডন যাইনি। বইয়ের পাতায় পাতায় লন্ডনের প্রতিচ্ছবি দেখে অনেকেই মনে করেন আমিই বুঝি লন্ডন গিয়েছিলাম। কিন্তু সাংবাদিক, কবি, লেখকরা জীবনের থেকে লেখে না, পরিবেশ-প্রতিবেশ দেখে, শুনে লেখেন। আমিও তাই করলাম। লন্ডন প্রবাসী সেই ভাইয়ের জীবন কাহিনী নিয়ে লিখলাম এক উপন্যাস ‘যেমন আছি লন্ডনে’ বইটি।

বন্ধুরা ঢাকার একেক এলাকায় বসবাস করে। কেউ মোহাম্মদপুর থেকে, কেউ পুরান ঢাকা থেকে, কেউ নারায়নগঞ্জ থেকে, কেউবা শাহাবাগ থেকে চলে এসেছে মেলা চত্তরে। আমি শরীয়তপুর থেকে যাওয়ার পর বটবৃক্ষির তলে আমার জীবনের প্রথম বই, প্রথম উপন্যাস, প্রথম দুই মলাটের মাঝে পরম মমতায় লিপিবদ্ধ জীবনের গল্প ‘যেমন আছি লন্ডনে’ বইটির মোড়ক উন্মোচন হলো। আমি খুবই আনন্দিত, উৎফুল্ল। মা’কে ফোন করে জানালাম। আমার চেয়ে আমার মা আরো বেশি খুশি হলেন। এতদিন প্রথম আলো পত্রিকায় সাংবাদিকতা করার কারনে বড় বড় প্রতিবেদনে নাম প্রকাশিত হয়েছে। নাম সহ প্রতিবেদন দেখলে খুব ভালো লাগতো। এবার আর প্রতিবেদন নয়। নিজের একটা বই, সেই বইয়ের কভারে বড় হরফে নিজের নাম। এ এক অন্য রকম অনুভ‚তি যা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। যারা লেখালিখি করেন তারাই অনুধাবন করতে পারবেন বিষয়টা।

সন্ধার পর বটগাছের নিচে উন্মুক্ত মঞ্চে বন্ধুরা মিলে মোড়ক উন্মোচন করলো। বিশেষ কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়। একদম সাদামাটা ভাবে বন্ধুরা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে ফটোসেসন করলো। ছবি তোলার কাজটি শেষ হওয়ার পর আমরা সবাই দল বেধে মেলা প্রাঙ্গনে ঘুরলাম। পুকুর পাড়ে বসে সময় কাটালাম। আমি প্রকাশকের কাছ থেকে সঙ্গে করে কয়েকটি বই নিয়ে নিলাম বাড়িতে আনার জন্য। কারন আর কিছুই নয়, আমার মমতাময়ী মা আর বাবা গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে ছেলের লেখা বইটি পড়ার জন্য, একটু নেড়ে চেড়ে দেখার জন্য, একটু ঘ্রাণ নেয়ার জন্য। প্রিয়জনের বই নেড়েচেড়ে দেখার মধ্যে আলাদা আনন্দ পাওয়া যায়। বইটা যদি হয় প্রিয় সন্তানের তবেতো কথাই নেই। আমার মা আমাকে এতটাই ভালোবাসতো, আমি মায়ের এতটাই প্রিয় ছিলাম যে আমি যাই করতে চাইতাম মা তাতে কোন বাধা দিতো না। যার কারনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে অনার্স পড়া বাদ দিয়ে দেশে চলে আসার কারনে মা কোন টু শব্দটিও করেনি। বরংচ পরিবারের অন্য সদস্যদের বলেছে, ওর যেটা ভালো লাগবে সেটাই করুক। আমার বই নিয়ে আমার পরিবারের অন্যদেরও আগ্রহের কমতি নেই। তারাও গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলো বই প্রকাশের, দেখার ও পড়ার।

গভীর রাতে খবর আসলো বোনের বাসার খাট থেকে মা পড়ে গেছে। কোন সমস্যা হয়নি। তবে ব্যথা কমছে না। মেরুদন্ডে প্রচন্ড ব্যথা। শ্বাস নিতে খুবই কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখানো হয়েছে কিন্তু মাঝে মাঝেই ব্যথাটা তীব্র হচ্ছে। নাতী শান নানুর সাথে ঘুমাবে বায়না ধরেছিলো। নানী-নাতী এক খাটে ঘুমিয়েছে। শান ঘুমের মধ্যে প্রচন্ড নড়াচড়া করে। এ কারনে শানকে দেয়ালের পাশে শুতে দিয়েছিলো। মা শুয়েছিলো অপর প্রান্তে। ঘুমের মধ্যে মা খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। খবরটা শুনে আর রাতে ঘুমাতে পারিনি। তখন ঢাকা থেকে যখন তখন রওয়ানা দিয়ে বাড়িতে আসাও সম্ভব ছিলো না। রাত আর পোহাচ্ছিলই না। কোন মতে সকাল হওয়ার সাথে সাথেই রওয়ানা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি পৌছে দেখি মা অনেকটা স্বাভাবিক। বিছানায় বসে আছে মা। পান খাচ্ছে। মায়ের প্রচুর পান খাওয়ার অভ্যাস। সবাই মায়ের আশে পাশে বসে কথা বলছে। আমি মায়ের অবস্থা দেখে কেদে দিলাম। মা আমাকে সান্তনা দিলো। বললো, আমি ঠিক আছি, তুই কাদিস না। আমি ঠিকই বুঝতে পারছি মা ঠিক নেই। ঘুমের মধ্যে এই পড়ে যাওয়া কোন ভালো লক্ষণ নয়। সেই পড়ে যাওয়া থেকেই মায়ের কাউন্টডাউন শুরু। এর পর মা অসুস্থ্য হয়ে যাচ্ছে আবার একটু সুস্থ্য হচ্ছে। নানান জটিলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। ডায়াবেটিস এর মাত্রা হুহু করে বাড়ে। উচ্চ রক্তচাপ বার বার হানা দেয়, আবার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। খাওয়া দাওয়াও অনেক কমে গেছে। ঠিক মত ঘুম হচ্ছে না। আরো নানান সমস্যা এসে ভড় করছে মায়ের উপর। আর আমার উপর ভর করছে মা হারানোর আশংকা।

খাট থেকে পড়ে যাওয়ার পর থেকেই মা খুব অসুস্থ বোধ করছিলো। হার্টের সমস্যা, সাথে উচ্চ মাত্রার ডায়াবেটিস। অতিরিক্ত ওজনের কারনে সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছিলো। মা বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ দম নিতে পারতেন না। খুবই কষ্ট হতো। কোন কথাও বলতে পারতেন না। হাপাতে হাপাতে ঘেমে যেতো। আস্তে আস্তে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতো মায়ের। এর পর আবার বিছানায় শুয়ে পড়তো। মায়ের কষ্ট দেখলে খারাপ লাগতো। এক অজানা ভয় তাড়া করে বেড়াতো প্রতিনিয়ত। বাড়ি থেকে বাইরে বের হওয়ার পর বাড়ির কেউ ফোন দিলে রিংটোন শুনেই আৎকে উঠতাম। এক অজানা শংকায় বুক কেপে উঠতো। কি কথা বলে বসে ওপাস থেকে সেই চিন্তায় ভয়ে ভয়ে ফোন তুলতাম। অপ্রয়োজনে বা ক্ষুদ্র প্রয়োজনে কেউ ফোন দিলে রাগ করতাম।

অসুস্থ্য শরীর নিয়ে মা মাঝে মাঝেই কাদতো। কান্নার কারন তার সবচেয়ে আদরের বড় ছেলে আজাদ। দীর্ঘ দিন হয়ে গেছে ইতালি প্রবাসী হয়েছে আজাদ। ইতালি গিয়ে ঠিক মত কাজ কর্ম করতে পারছে না। মন মত কোন কাজই পাচ্ছে না। প্রাণী বিজ্ঞানে বিএসসি অনার্স শেষে মৎস্য বিজ্ঞানে এমএসসি করেছে আজাদ। রেজাল্টও ছিলো ভালো। চাকুরির চেষ্টা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে বিদেশ যাওয়ার ভুত চেপেছিলো আজাদের মাথায়। সবসময় আদরে আদরে বেড়ে উঠা আজাদ আর দশজনের মত যে কোন কাজ করতেও পারে না। ফলে যে স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিলো সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আদরের বড় ছেলের কাঙ্খিত সাফল্যের খবর না পাওয়া এবং বিদায় বেলায় চেলের মুখটা দেখতে না পাওয়ার আশংকা ও গভীর বেদনা মাকে বিদায় বেলায় তাড়িয়ে বেড়াতো। মায়ের এই কষ্টের বিষয়টা আমরা বুঝতাম। কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিলো না। আজাদকে দেশেই কিছু করতে বলেছিলো সবাই। ইতালি যাওয়ার পর যখন ভালো কিছু করতে পারছে না তখনও বলা হয়েছিলো দেশে চলে আয়, দেশেই কিছু কর। প্রয়োজনে এলএল.বি কমপ্লিট করে সনদ নিয়ে আইন পেশা শুরু কর। একই পরিবারে একাধিক আইনজীবী থাকে, সবাই কম বেশি করে খাচ্ছে। তাও যদি ভালো না লাগে তবে দেশে এসে যা মন চায় কর। কিন্তু এতগুলি টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়ে এভাবে আজাদ ফিরে আসতে রাজি হয়নি।

মায়ের মনে হয়তো জানান দিয়ে দিয়েছে যে, বেশি দিন আর থাকবেন না আমাদের মাঝে। দুই মেয়ের পরে আমার বড় ভাই আজাদের জন্ম। তাইতো ওর প্রতি মায়ের দরদ একটু ভিন্ন রকম। প্রতিটি মায়ের কাছেই পুত্র অনেক আদরের। আর প্রতিটি বাবার কাছে তার কন্যারা। আমি এখন বাবা। আমি বুঝি কার কাছে বেশি আদর পায়। মেয়েরা বাবার প্রতি বেশি অনুরক্ত থাকে আর ছেলেরা থাকে মায়ের প্রতি। মায়েরা মেয়েদের কম ভালোবাসে তা কিন্তু নয়। মা আজাদকেই বেশি ভালোবাসতো তা কিন্তু নয়। প্রতিটি সন্তানই মায়ের কাছে সমান। একেকজন একেক কারনে প্রিয় হয়। আমি ছোট ছেলে তাই আমাকে বলতো কোলের পোলা। আদরের সীমা পরিসীমা ছিলো না। বড় দুই বোন আমাদের। বোন দুজনকেও অনেক ভালোবাসতেন মা। বড় বোনের জন্যও মায়ের চিন্তা ছিলো অনেক যেমন চিন্তা আজাদের জন্য করতেন। মেঝ মেয়ে শিখা পড়াশুনা করে সরকারী চাকুরি করে। বাড়ির কাছেই বাড়ি করেছেন। বড় বোনও বাড়ির পাশে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। ছোট বোন শিখা অফিস-সংসার সেরে চলে আসতেন আমাদের বাড়িতে। মায়ের কাছে কাছেই থাকতেন। বড় বোনও বাড়ির পাশে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। বড় বোনের কোন সন্তান না থাকায় এবং স্বামী বিদেশ থাকায় অনেকটা ফ্রি থাকতেন। তাই মায়ের সেবা করার কাজটা আমার বড় বোন রেখাই করতেন, এখন যেমন বাবার দেখাশুনা করেন।

বাড়িতে আমি, বাবা-মা, বড় ভাবি ও তার বড় ছেলে পাপন এই আমাদের সংসার। একান্নবর্তী পরিবারের মত একসাথে থাকার মজাই আলাদা। বড় ভাবিও মায়ের অনেক যত্ন নিতেন। ভাবি লাভলীর যত্নে কখনো মনে হয়নি যে বউ যত্ন করছেন, মনে হতো মেয়েই যত্ন করছেন। বাড়তি পাওনা হিসাবে দুই বোন বাড়ির কাছে থাকায় সবসময় দেখাশুনা করতেন। বিশেষ করে সন্তানের মত মাকে আমার বড় বোন রেখা আগলে রেখেছেন। শিশুদের মত কথা না শুনায় মাঝে মাঝেই দুজনে ঝগড়া লেগে যেতো। ঐযে বললাম, সন্তানের মত আগলে রাখতো। সন্তানের নানান খুনসুটিতে যেমন মায়ের মান অভিমান, রাগ হয় তেমনি মায়ের অনেক কথায়, কাজে বড় বোনও রাগ করতো। আমরা সবাই বুঝাতাম। মাকেও বলতাম আবার বোনকেও বলতাম। রাগ-অনুরাগ, মান অভিমান নিমিশেই কেটে যেতো। যেমন কেটে যায় সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের রাগ-অভিমান।

স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলছিলো মায়ের চিকিৎসা। বন্ধু ডাক্তার মাহবুবুল হক যাকে আমরা রকেট বলেই ডাকি। আমার বন্ধুদের মা অনেক ভালোবাসতেন। ছাত্রজীবনে মা মাঝে মাঝেই বন্ধুদের দাওয়াত করে খাওয়াতেন। প্রচন্ড ভালোবাসা থেকেই মা এটা করতেন। তাই আমার মায়ের প্রতি বন্ধুদেরও অসীম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ ছিলো। রকেট যখনই নিজের বাড়ি আসতো আমার সাথে এসে মাকে দেখে যেতো। রকেট শিশু বিশেষজ্ঞ হলেও মায়ের অসুখ-বিসুখ সম্পর্কে সম্যক ধারনা রাখতেন। যার ফলে যে কোন বিষয়ে আগে রকেটকে ফোন দিতাম। রকেট যেভাবে পরামর্শ দিতো সেভাবেই চিকিৎসা সেবা দিতাম এবং মাও তা মেনে চলতো। দিন দিন স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে সিদ্ধান্ত হলো মাকে ঢাকা নিয়ে যাবো। হাতে টাকা পয়সার জোগারও ছিলো যথেষ্ট। সিদ্ধান্ত হলো আমি আর বড় বোন রেখা আপা মাকে ঢাকা নিয়ে যাবো। আমি স্বাধীন পেশা আইন পেশায় নিয়োজিত। ইচ্ছে করলে একমাসও চেম্বার ছেড়ে থাকতে পারি। আমার কাজকর্ম চালিয়ে নেয়ার অর্থাৎ মামলা মোকদ্দমা পরিচালনা করার জন্য আমার আইনজীবী বন্ধুরা আছে। তারা আমার সহকারীকে যা যা প্রয়োজন সেভাবেই সহযোগিতা করতো। বড় বোন একা। স্বামী প্রবাসে থাকে। যার কারনে আমরা দুই ভাই-বোন মায়ের সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছোট বোন শিখা সরকারী চাকুরি করে। চাইলেই দীর্ঘদিন ছুটি কাটাতে পারবে না। বড় ভাই আজাদ প্রবাসে থাকে। তাদের পক্ষেতো আর যাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমরা যাবো বলেই সিদ্ধান্ত হলো।

বারো মার্চ দুই হাজার বারোর সোমবার মাকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম ঢাকায়। বারডেম নিয়ে গেলাম মাকে। নিয়ে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে মাকে ভর্তি করে নিলো বরডেম কর্তৃপক্ষ। একটা কেবিনে জায়গা হলো মায়ের। রুমের ভিতর মায়ের সাথে বড় বোন রেখা আপা থাকতো। আর আমি বারান্দায় বিছানার চাদর বিছিয়ে রাতে ফ্লোরে ঘুমাতাম। কাছেই থাকতাম। আর কাছে থাকার প্রত্যয়ের কারনে বিদেশ যাইনি আমি। যখন আমি এসএসসি পাস করি তখন মা বলেছিলো সৌদি আরব যাওয়ার জন্য। এভারেজ স্টুডেন্ট হিসাবে মা আমার উপর তেমন আস্থা রাখতে পারেনি। তাই কোলের পোলার উজ্জল ভবিষ্যতের চিন্তা করে আমার ছোট খালু বিল্লাল হোসেন খানের কাছে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো। মায়ের প্রস্তাবে আমি বলেছিলাম, বিদেশ গেলে ঘুরতে যাবো, কাজ করতে নয়। ঘুরতে গেলে কয়েকদিন বাদেই চলে আসতে পারবো, আপনাকে দেখতে পারবো। কিন্তু প্রবাস জীবনে গেলে সেই সুযোগ হবে না। যেমনটা হয়নি বড় ভাই আজাদের। মন চাইলেই মায়ের মায়াবী মুখখানা দেখতে পাবো না। আমার আর বিদেশ যাওয়া হলো না। রইলাম মায়ের পাশে পাশেই আঁচল ধরে। আর ছিলামও শেষ নিঃস্বাস পর্যন্ত।

বন্ধু ডাক্তার মাহবুবুল হক থাকতো বারডেমের অপজিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতালের) পশ্চিম-উত্তর দিকের একটা বাসায়। বন্ধুর বাসায় বা আমার ছোট খালা খুশি খালার যাত্রাবাড়ির কাছেই শনির আখড়ার বাসায়ও থাকার যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। কিন্তু মায়ের কাছেই থাকলাম। কারন, কখন কি প্রয়োজন হয় সেই আশংকায় দূরে কোথাও যাওয়ার সাহস করলাম না। ভর্তির পর মাকে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা দেয়া হলো। কিছুক্ষণ পর পর একেক বিভাগে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলাম। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে যে রেজাল্ট পেলাম তা সুখকর নয়। বাড়িতে বোন শিখা, ইতালিতে ভাই আজাদকে ফোনে প্রতিটি রিপোর্টের খবর, ডাক্তারদের দেয়া তথ্য জানালাম। যাকে ফোন করি সেই শুনে কাদে, সাথে আমিও কাদি। তখন আমাদের কান্নাই ছিলো সঙ্গী। ফোন করে কেউই বেশি কথা বলতে পারতাম না। গলা আটকে আসতো, বুক ভারি হয়ে উঠতো। শুধু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নাটাই করতো সবাই। কারন, মাকে যে আমরা সবাই খুব ভালোবাসতাম। ভালো না বাসার কোন কারনও নেই। আজকে আমাদের যে অবস্থান তা সবই হয়েছে মায়ের জন্য। বাবার ভ‚মিকা কিছুই ছিলো না তেমনটি কিন্তু নয়। একজন মমতাময়ী মা’ই পারেন একটা সংসারকে ফুল বাগানের মত সাজিয়ে তুলতে। আমার মাও তাই করেছিলেন। সবাইকে পড়াশুনা করিয়ে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। আর আমাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে, শিক্ষার আলো হৃদয়ে জ্বালতে নিজেকে জ্বালি পুড়িয়ে অঙ্গার করতে হয়েছে। সেই মা আজ মৃত্যু পথযাত্রী সেটা ভাবলে কার না কণ্ঠ জড়িয়ে আসে?

ঘুরে ফিরে মায়ের কোলের পোলা আমি মায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকি। শরীরের কাছে ঘেষে থাকি। মায়ের শরীরের গন্ধ নেই। মায়ের হাতটা ধরি, কাপড়টা ধরি, কখনো কাদি, মাও কাদে। মা থাকবে না আমাদের মাঝে মেনে নিতেই পারি না। নানান বিষয়ে কথা বলি। মা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেয়। কিভাবে চলবো, কী করবো, কী করবো না ইত্যাদি। আজও মায়ের কথামত চলতে চেষ্টা করি। কতটুকু পারছি তা হয়তো আমি জানি না।

বারডেমের বেডে বসে মা যখন কিছুটা সুস্থ্য বোধ করছেন তখন আমাকে ডেকে বললো, বাবা, সবার জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি এক রকম হয় না। তুমি সবার চেয়ে ছোট এবং একটু অন্য রকম। তুমি এখন আল্লাহর রহমতে উকিল হয়েছো। আমি অনেক খুশি হয়েছি। তুমি সবাইকে দেখে শুনে রাখবে, সবার ভালো মন্দ দেখবে। আজাদ বিদেশ থাকে। ও একটু সহজ-সরল। চার ভাই বোন মিলে মিশে থাকবে। তোমাদের পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে কোন দরবার সালিশ যেন অন্য কেউ করতে না পারে। বাবা, এমন কোন কাজ করবা না যে কাজের জন্য মানুষ তোমাকে খারাপ বলে এবং আমাদেরও খারাপ বলে। মনে কোন হিংসা, ঘৃণা পুষে রাখবা না। হিংসা-ঘৃণা মনে পুষে রাখার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই। হিংসাকে দমন করার মধ্যেই বীরত্ব আছে। আমি না থাকলে সবাই মিলে মিশে একসাথে থাকবা, একে অপরের খেয়াল রাখবা। কোন সমস্যা হলে চার ভাই বোন একসাথে বসে সমাধান করবা। তোমাদের পারিবারিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার সময় বউদের বা বনইয়াদেরও কাছে রাখবা না, নিজেরা বসেই সকল সমস্যার সমাধান করবা। অন্যরা তোমাদের সমস্যার সমাধান করতে এসে হাসাহাসি করবে। তোমাদের বিরোধ নিয়ে অন্যরা মজা নিবে। তোমাদের জন্য আমাদের যা করনীয় তা করেছি। তোমরা বাকীটা করবে। তোমাদের জন্য যে সম্পদ করে রেখেছি তা কখনো বিক্রি করবা না। এই সম্পত্তির উপর তোমরা নিজেরা চেষ্টা করবা কিছু করতে। সম্পদ বিক্রি করলে আর হাতে আসে না। আমি মায়ের সেদিনের কথাগুলো শুনেছি আর চোখ মুছেছি। আজ আবারও লিখতে গিয়ে চোখ মুছতে হলো।

হাসপাতালে মাকে দেখতে এলো অনেকেই। আমার ছোট খালা খুশি প্রতিদিনই চলে আসতো। কী খাবে না খাবে খোজ নিয়ে তা তৈরী করে নিয়ে আসতো। রকেট কাছেই থাকার কারনে প্রতিদিনই এসে দেখে যেতো। উত্তরা থেকে নয়ন আসতো। আমার বড় মামা আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ কোতোয়ালের বড় ছেলে সাইদুর রহমান অপু দাদা, যাত্রাবাড়ি থেকে ফুপাতো ভাই সেলিম, পিরি খালা (পিয়ারা খালা) স্বপরিবারে এসে মায়ের সাথে দেখা করতে আসতেন। মার সাথে যেই দেখা করতে আসতো তাকেই বলতো আমার জন্য মেয়ে দেখতে। আমাকে বিয়ে করানোর জন্য মা পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু বিয়েতো আর মুখের কথা নয়। আল্লাহ যখন নির্ধারণ করে রেখেছে তার একদিন আগেও হবে না পরেও হবে না। মায়ের খুব ইচ্ছে ছিলো তার কোলের পোলার বউ দেখে যাওয়ার। কিন্তু মায়ের ভাগ্যে নেই। আমার পক্ষ থেকে আন্তরিকতার বা ইচ্ছার কোন ঘাটতি ছিলো না। মা নিজে, বোনেরা অনেক মেয়ে দেখতো। কিন্তু তাদেরই পছন্দ হতো না আমার হবে কী। তাই যারাই মাকে দেখতে আসতো তাদের কাছে এই একটা কমন দাবী মা করতো।

প্রায় সপ্তাহ খানেক চিকিৎসা শেষে মায়ের শারীরিক অবস্থা বেশ ভালোই হলো। মাকে দেখলে মনেই হতো না যে মা অসুস্থ্য ছিলো বা এখনও অসুস্থ্য আছে। বারডেম কর্তৃপক্ষ রিলিজ দিলে আমরা একটা এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে এলাম বাড়িতে। শরীয়তপুরে ঢুকে মা বললো মিস্টি কিনতে। খালি হাতে বাড়ি যাবে না। আমরা হারু ঘোষের দোকানের সামনে এ্যাম্বুলেন্স দাড় করিয়ে মিষ্টি কিনে নিলাম। এ্যাম্বুলেন্সের শব্দটা মায়ের বড় নাতী আজাদের বড় ছেলে পাপনের খুব পছন্দ। প্যা-পু শব্দটাকে পাপন বলতো নিম্বো-নিম্বো! মা বাড়িতে বিছানায় শুয়ে থাকতো। পাপনকে মায়ের পিছন দিকে রাখতো। পাপন মাকে ধরে হাটাহাটি করতো বিছানার উপর। খেলনা এ্যাম্বুলেন্স চালাতো মায়ের শরীরের উপর দিয়ে। হাত দিয়ে মায়ের শরীরের উপর খেলনা এ্যাম্বুলেন্স ঠেলে ঠেলে চালাতো আর মুখে শব্দ করতো নিম্বো নিম্বো নিম্বো…। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে মা বললো এবার এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনটা বাজাতে। তার নাতী শুনবে, দৌড়ে আসবে এ্যাম্বুলেন্সের কাছে। খুশিতে নাচবে তার প্রিয় নাতী সেটা দেখার জন্য মা সাইরেন বাজাতে বললো। মায়ের কথামত এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনটা বাজিয়ে দিলো ড্রাইভার। পাপন সহ সবাই দৌড়ে এলে বাড়ির ঘাটায়, রাস্তার কাছে। এ্যাম্বুলেন্সটা বাড়ির দরজার কাছে থামার পর একটা ছোট পিড়ির উপর দাড়িয়ে মা নামলেন। একটু হেটেই উঠে দড়জার সমনের দাওয়ায় হেলান দিয়ে বসলেন। বাড়িতে পৌছে মা বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন। এক মুহুর্তে যেন মায়ের সব রোগ ভালো হয়ে গেলো। দেখে মনে হলো মা যে সেই সাবেক অবস্থায় ফিরে গেছেন। ঘরের দাওয়ায় বসে সবার সাথে কথা বললেন, সকলের কুশলাদি জানলেন। বাড়ি ফিরে মা বেশ চনমনে, প্রফুল্ল। কে বলবে, মায়ের ভিতরের রোগের ছিটে ফোঁটাও কমেনি!

মায়ের অবস্থা আপাত দৃষ্টিতে তখন কিছুটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো। আমাদের আইনজীবী সমিতিতে প্রতি বছরই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শুধু যে আমাদের আইনজীবী সমিতিতে তা নয়, সকল আইনজীবী সমিতিতেই এক বছর মেয়াদী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর প্রতি বছরই নির্বাচন পরবর্তীতে আমরা সমমনা আইনজীবীরা ঘুরতে বেরিয়ে যাই। দুই হাজার বারো সালের নির্বাচন শেষেও এর ব্যাত্যয় হলো না। এডভোকেট মুরাদ হোসেন মুন্সী আর এডভোকেট জামাল ভ‚ইয়া বিবাহিত। মুরাদ মুন্সী স্বামী-স্ত্রী দুজন, জামাল ভ‚ইয়া স্বামী-স্ত্রী আর সাথে পুত্র প্রান্ত। এডভোকেট রাকিবুল হক রুমান আর আমি তখন বিয়ে করিনি। কিন্তু আমাদের চার জনের মধ্যে বেসুমার ভাব ছিলো, এখনও তেমনই আছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কক্সবাজার ঘুরতে যাবো। দুই পরিবার আর আমরা দুজন ব্যাচেলর ছাব্বিশে মার্চের ছুটিকে সামনে রেখে বেরিয়ে পড়লাম ভ্রমণে। শরীয়তপুর থেকে ঢাকা গিয়ে বাসে উঠলাম। কক্সবাজার গিয়ে ঘুরে বেড়ালাম সবাই। আমি ওদের সাথে ঘুরতে গেলেও মায়ের শারীরিক অবস্থার কারনে আমার মন পড়ে আছে বাড়িতে। সবসময় পকেটের দিকে খেয়াল। কারন পকেটে রাখা আমার মোবাইল ফোন দুটি। কখন বেজে উঠে, কোন খবর আসে সেই আশংকায় কান খাড়া রাখি ফোন দুটির দিকে, আমার পকেটের দিকে।

আমি যখন শরীয়তপুরের সাংবাদিকতা ছেড়ে ঢাকায় এলএল.বি পড়তে যাই তখন সিটিসেল মোবাইল সার্ভিস চালু ছিলো। সিটিসেল সিডিএম সার্ভিস চালু করেছে। রিম দিয়ে বিশেষায়িত সেট কাজ করতো। আমি রিমসহ দুইটি সেট কিনলাম। কারন আর কিছুই না, একটি মায়ের জন্য আরেকটি আমার জন্য। সংযোগ দুটি ছিলো বিশেষ প্যাকেজ। চীপ রেটে দুটি এফএনএফ নাম্বারে কথা বলার জন্য সিটিসেলের এই সংযোগ খুবই সাশ্রয়ী ছিলো। এছাড়াও জিএসএম সার্ভিসের সিমকার্ডসহ আমার আরো একটি সেট ছিলো। সেই সংযোগ দিয়ে আমি সবার সাথে যোগাযোগ করতাম। সিটিসেলটা ছিলো শুধুই আমার আর আমার সবচেয়ে প্রিয় মায়ের জন্য। মায়ের সংযোগে আমিই টাকা রিচার্জ করতাম। এক সাথে দুটি সেটেই টাকা রিচার্জ করতে হতো। সবসময় মায়ের সাথে যোগাযোগের জন্য এটাই ছিলো আমার অবলম্বন। দুপুর গড়িয়ে গেলে যে ফোনটা আমায় খাবার খেতে ডাক দিতো সেটা আর কারো ফোন নয়, আমার মায়ের ফোন। রাতে বাসায় ফিরতে দেরি হলে যে ফোনটা আসতো সেটা আমার মায়ের ফোন থাকতো। আমি বাড়ির বাইরে থাকাবস্থায় কোথাও কোন সমস্যার কথা শুনলে সাথে সাথে আমাকে ফোন দিয়ে সতর্ক করতো যে কলটি সেটি আমার মায়ের ফোন কল থাকতো। এভাবেই আমি সবসময় মায়ের কাছে কাছে থাকতে চেয়েছিলাম, থেকেছিও।

বারডেম থেকে মাকে বাড়িতে আনার পর শারীরিক অবস্থা একটু ভালোর দিকেই দেখা গেলো। কিন্তু প্রদীপ নিভার আগে যে একটু উজ্জল আলো দিয়ে যায় সেটা জানলেও বুঝতে পারছিলাম না। মায়ের এই হঠাৎ সুস্থ্যতা, স্বাভাবিক আচার আচরণ ও শারীরিক পরিস্থিতি আমাদের ক্ষণিকের জন্য নিভে যাওয়া প্রদীপের আলোর ঝলকানীর মতই ছিলো। এরই মাঝে আমাদের ভ্রমণের দিন তারিখ নির্ধারণ হলো। বাইশে মার্চ বৃহস্পতিবার আমি, এডভোকেট রাকিবুল হক রুমান, আর এডভোকেট মুরাদ হোসেন মুন্সী ও এডভোকেট জামাল ভ‚ইয়া স্বপরিবারে রওয়ানা দিলাম কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। রাতভর বাস জার্নি শেষে সকালে পৌছে তেইশে মার্চ কক্সবাজার ঘুরলাম। কক্সবাজার ঘুরাঘুরি শেষে আমরা চলে গেলাম বান্দরবন। বান্দরবন ভ্রমণের মাঝে নীলগীরি ঘুরে ফেরার পথে ফোন এলো আমার। বুকটা কেপে উঠলো মুহুর্তেই। ফোন ধরার সাথে সাথে আমাকে বাড়ি থেকে জানালো মায়ের শরীরটা খুব একটা ভালো না। খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমার মন আর ভ্রমণের মধ্যে থাকলো না। ঐ দিনই রওয়ানা দিলাম আমরা। আমরা সবাই চট্রগ্রাম চলে আসলাম। আমাদের ভ্রমণ সূচী অনুযায় আরো কয়েকদিন থাকার কথা। চট্রগ্রাম থেকে আমি বাড়ি রওয়ানা দিব দেখে এডভোকেট জামাল ভ‚ইয়াও থাকবে না। সেও আমার সঙ্গী হলো। এডভোকেট রাকিবুল হক রুমান আর এডভোকেট মুরাদ হোসেন মুন্সীর পরিবারসহ থেকে গেলো চট্রগ্রামে। আমরা চলে এলাম শরীয়তপুর। বাড়িতে এসে দেখলাম মায়ের অবস্থা এই ভালো, এই খারাপ। ক্লিনিক থেকে নেবুলাইজার এনে নেবুলাইজ করা হচ্ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডারও আনা হয়েছে। দুই বোন সবসময় মায়ের পাশে পাশেই আছে। আমি দৌড়াদুড়ি করি কখন কী লাগবে তা নিয়ে। একটা ঔষধ আনার পর শুনি আরেকটা লাগবে। কোন কাজে মন বসছে না। কিছুই ভালো লাগছে না। এক অজানা আশংকায় খুব ভয়ে ভয়ে সময় পার করছি। প্রতিটি মুহুর্ত যেন শত বছরের ন্যয় দীর্ঘ মনে হচ্ছে। মনের ভিতর অস্থিরতা বিরাজ করছে। সুযোগ পেলেই মায়ের কাছে গিয়ে বসছি। মায়ের মমতা মাখা মুখটা আস্তে আস্তে বিবর্ণ হয়ে আসছে। কারো কোন কথাই মায়ের ভালো লাগছে না। বড় বোন রেখার কথায় বার বার বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। মায়ের আচরণ এমন কখনোই ছিলো না। আমি বুঝতে পারছি, মায়ের চলে যাওয়ায় যাতে আমাদের কষ্ট কমে সে জন্যই মায়া কমাতে ব্যর্থ চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব। গর্ভধারণী মমতাময়ী মা যে আচরণই করুক না কেন, এত সহজে কি মা মায়া ছাড়াতে পারবে? আমরা রেখা আপাকে শান্তনা দেই। মাকেও শান্ত হতে বলি। কিন্তু কোন কথায়ই মায়ের অসুস্থ শরীর মনকে শান্ত করতে পারে না। এতটা অসুস্থ শরীর নিয়েও মায়ের চোখের কোনে মাঝে মাঝেই অশ্রু কনা জমে যাচ্ছে। কখনো গড়িয়ে পড়ছে কপল বেয়ে। মায়ের প্রতিটি অশ্রু কনা পাহাড়সম পাথর হয়ে আমাদের বুকের উপর আছড়ে পড়ছে।

ডাক্তারের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছি। একটার পর একটা ঔষধ বদলে দিচ্ছে। কিন্তু কোন ঔষধেই কোন কাজ হচ্ছে না। শ্বাস কষ্টটা ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে যাচ্ছে। এতটাই বেড়ে যাচ্ছে যে মায়ের কষ্ট দেখে আমরাও কষ্ট পাচ্ছি। আত্মীয় স্বজনরা যারা কাছে আছেন তারা দেখতে আসছে, যাচ্ছে। বাড়িতে দিন দিন প্রচন্ড ভীর বেরে গেছে। এমনি করে চলছিলো প্রতিটি সেকেন্ড। দুই বোন রেখা ও শিখা মায়ের কাছেই থাকছে। আমি রাতে শিখা আপার বাসায় চলে যাই ঘুমাতে। এমনি করে ৩০ মার্চ শুক্রবার গভীর রাতে আমি শিখা আপার বাসায় চলে গেলাম ঘুমের জন্য। যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার মোবাইলে শিখা আপার ফোন কল বেজে উঠলো। আমি একটা রিং বাজার সাথে সাথেই উঠে বসে পড়লাম। ফোন হাতে নিয়ে শিখা আপার কল দেখে বুঝতে বাকী রইলো না যে কি কথা হতে পারে। ফোন ধরার সাথে সাথে শিখা আপা জানালো মায়ের অবস্থা আরো খারাপ। আমি দ্রুত চলে আসলাম বাড়িতে। বাড়িতে আসার পরে মায়ের পাশে বসলাম। মায়ের মাথার নিচে হাত রেখে মাথাটা একটু উচু করে ধরে রাখলাম। মা আমার দিকে মমতামাখা শেষ চাহনিটা দিলো। এর পর মুখে পানি দেয়ার পর মায়ের মুখ থেকে পানিটা গড়িয়ে পড়ে গেলো। তখনই সবাই বুঝে গেছেন আমার মমতাময়ী মা আর আমার কোলে নাই। শিখা আপার স্বামী আমিনুল ইসলাম উপসহকারী মেডিকেল অফিসার। সে বিপি মেশিন দিয়ে দ্রুত প্রেশার মাপলেন। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ হয়ে গেছে। মা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে চীর দিনের জন্য না ফেরার দেশে। আমি কথাটা শুনার পরেও বেশ কিছু মুহুর্ত কোন শব্দ বা কান্না করতে পারিনি। এর পর শেষবারের মত মায়ের বুকে মাথা রাখলাম। চোখ ভিজে গেলো, ডুকরে কান্না করতে লাগলাম। যেমনটি এখন লেখাটা লেখার সময় আমার চোখ বেড়ে ঝড়ছে, পড়নের গেঞ্জিটা ভিজছে, সেদিনও কেদেছিলাম তেমনি।

সকালে মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকলো। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই আসলো। মাকে নতুন সাজে সাজিয়ে খাটিয়াতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো মসজিদের পাশে মরহুম হারুন বেপারী সাহেবের বাড়ির খোলা ভিটায়। সেখানে জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হলো। মায়ের জন্য দোয়া চাইলেন, ক্ষমা চাইলেন তার বড় ভাই আলহাজ্ব নুর মোহাম্মদ কোতোয়াল। পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে কিছু বলতে বলা হলো। আমার তখন কথা বলার মত পরিস্থিতি নাই। তবুও কাছে থাকা একমাত্র পুত্র হিসাবে আমি সবার কাছে মায়ের জন্য দোয়া চাইলাম, মায়ের কথা ও কাজে যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে ক্ষমা চাইলাম। জানাজা শেষে বাড়িতে প্রবেশের পশ্চিম পাশে মায়ের উপস্থিতিতে করা কবরস্থানে দাফন করা হলো। কাছে থাকতে চেয়েছিলাম সারাজীবন। কিন্তু নিজেকেই একদিন সেই মাকে মাটি দিতে হবে, নিজের পায়ে মাড়িয়ে মাড়িয়ে কবরের মাটি শক্ত করতে হবে সেটা কোনদিন ভাবিনি। মা হয়তো ভেবেছিলো। সন্তানরা, আত্মীয় স্বজনরা এখানেই তাকে মাটি দিবে। জায়গাটা একটু নিচু জায়গা, পানি উঠতে পারে। সেই আশংকায় নিজে বসে থেকে মাটি কাটিয়ে উচু করেছিলো।

মা নেই আজ অনেক দিন হয়ে গেলো। অনেক স্মৃতি রেখে যেছেন মা আমাদের জন্য। আমি মাকে চাইলেও জীবনে ভুলতে পারবো না। প্রতিটি মানুষেরই কিছু অভ্যাস বলি বা বদ অভ্যাস থাকে। আমারও তেমন আছে। আমার একটি অভ্যাস বা বদ অভ্যাস হলো সারা বছরই পাতলা কাথা গায়ে দেয়া। গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমেও আমি আমার বুক পর্যন্ত পাতলা কাথা জড়িয়ে ঘুমাই। আমার জন্য পাতলা কাথার সাইজ একটু বড় লাগে। খাটো হলে আমার চলে না। আমার মা আমার জন্য অর্ডার দিয়ে পাতলা কাথা বানিয়ে তার আলমারিতে রেখে দিয়েছে। যে কয়টা পাতলা কাথা আমার জন্য বানিয়ে রেখেছে তা আমি আমার জীবন পার করতে সবকটাকে গায়ে জড়াতে পারবো না। মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলো, তার অনুপস্থিতিতে কে করে দেবে কাথা? অন্যরা হয়তোবা বুঝবে না তার কোলের পোলার জন্য কত বড় কাথা লাগে। এখনও মায়ের আলমারিটায় থরে থরে সাজানো আছে কাথাগুলো। আছে মায়ের ব্যবহৃত, অব্যবহৃত শাড়ি। বারান্দার গ্রিলের সাথে এখনও ঝুলছে মায়ের বেতের লাঠি, স্টিলের লাঠি। কীভাবে ভুলবো মাকে? বাড়ির প্রতি ইঞ্চি মাটিতে মায়ের গন্ধ জড়ানো।

আমি মায়ের কোলের পোলা। সারা জীবন বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলতাম, ‘মা যাই’। যতক্ষণ মা না বলতো, ‘যাও’ ততক্ষণ বলতেই থাকতাম ‘মা যাই’। অনেক সময় হাতের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারনে মা বলতেও পারতেন না যে ‘যাও’। কিন্তু আমি যে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বিরক্ত হয়ে যেতেন। কিন্তু পরক্ষণেই মা বুঝতেন। এই ‘মা যাই’ কথাটা মায়েরও ভালো লাগতো। গল্পের ছলে অনেককেই বলতো। আমি যে এখনও বলি ‘মা যাই’। তবে মা এখন আর শুনতে পায় না। মা এখন আর জবাবও দেয় না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথেই মায়ের কবর। যাওয়ার সময় মনে মনে বলে যাই ‘মা যাই’। নয়টি বছর হয়ে গেলো। আমার মা আমাকে উত্তর দেয় না, বলে না, ‘যাও, সাবধানে যাইও বাবা’। আমার মায়ের মুখের বাবা ডাক কতটা মধুর তা একমাত্র আমিই জানি। হয়তো অন্যরাও জানে। কিন্তু আমি এমন মমতামাখা মধুর কন্ঠে কাউকে বলতে শুনিনা। একদিন আমিও চলে যাবো এই দুনিয়া থেকে। সেদিন হয়তো মনে মনে বলে যাবো ‘মা যাই’। মা কী বলবে ‘যাও বাবা, সাবধানে যাইও’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here