বেশ কিছুদিন যাবৎ মা খুব অসুস্থ বোধ করছিলো। হার্টের সমস্যা, সাথে উচ্চ মাত্রার ডায়াবেটিস। অতিরিক্ত ওজনের কারনে সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছিলো। মা বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ দম নিতে পারতেন না। খুবই কষ্ট হতো। কোন কথাও বলতে পারতেন না। হাপাতে হাপাতে ঘেমে যেতো। আস্তে আস্তে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতো মায়ের। এর পর আবার বিছানায় শুয়ে পড়তো। মায়ের কষ্ট দেখলে খারাপ লাগতো। এক অজানা ভয় তাড়া করে বেড়াতো প্রতিনিয়ত। বাড়ি থেকে বাইরে বের হওয়ার পর বাড়ির কেউ ফোন দিলে রিংটোন শুনেই আৎকে উঠতাম। এক অজানা শংকায় বুক কেপে উঠতো। কি কথা বলে বসে ওপাস থেকে সেই চিন্তায় ভয়ে ভয়ে ফোন তুলতাম। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে মা মাঝে মাঝেই কাদতো। কান্নার কারন তার সবচেয়ে আদরের বড় ছেলে আজাদ। দীর্ঘ দিন হয়ে গেছে ইতালি প্রবাসী হয়েছে আজাদ। ইতালি গিয়ে ঠিক মত কাজ কর্ম করতে পারছে না। মন মত কোন কাজই পাচ্ছে না। প্রাণী বিজ্ঞানে বিএসসি অনার্স শেষে মৎস্য বিজ্ঞানে এমএসসি করেছে আজাদ। রেজাল্টও ছিলো ভালো। চাকুরির চেষ্টা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে বিদেশ যাওয়ার ভুত চেপেছিলো আজাদের মাথায়। সবসময় আদরে আদরে বেড়ে উঠা আজাদ আর দশজনের মত যে কোন কাজ করতেও পারে না। ফলে যে স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিলো সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। আদরের বড় ছেলের কাঙ্খিত সাফল্যের খবর না পাওয়া এবং বিদায় বেলায় চেলের মুখটা দেখতে না পাওয়ার বেদনা মাকে বিদায় বেলায় তাড়িয়ে বেড়াতো।

মায়ের মনে হয়তো জানান দিয়ে দিয়েছে যে, বেশি দিন আর থাকবেন না আমাদের মাঝে। দুই মেয়ের পরে আমার বড় ভাই আজাদের জন্ম। তাইতো ওর প্রতি মায়ের দরদ একটু ভিন্ন রকম। এর মানে মা আজাদকেই ভালোবাসতো তা কিন্তু নয়। প্রতিটি সন্তানই মায়ের কাছে সমান। একেকজন একেক কারনে প্রিয়। আমি ছোট ছেলে তাই আমাকে বলতো কোলের পোলা। আদরের সীমা পরিসীমা ছিলো না। বড় দুই বোন আমাদের। বোন দুজনকেও অনেক ভালোবাসতেন মা। বড় বোনের জন্যও মায়ের চিন্তা ছিলো অনেক যেমন চিন্তা আজাদের জন্য করতেন। মেঝ মেয়ে শিখা পড়াশুনা করে সরকারী চাকুরি করে। বাড়ির কাছেই বাড়ি করেছেন। বড় বোনও বাড়ির পাশে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। অফিস-সংসার সেরে চলে আসতেন আমাদের বাড়িতে। মায়ের কাছে কাছেই থাকতেন। বড় বোনও বাড়ির পাশে জমি কিনে বাড়ি করেছেন। বড় বোনের কোন সন্তান না থাকায় এবং স্বামী বিদেশ থাকায় অনেকটা ফ্রি থাকতেন। তাই মায়ের সেবা করার কাজটা আমার বড় বোনই করতেন, এখন যেমন বাবার দেখাশুনা করেন।

বাড়িতে আমি, বাবা-মা, বড় ভাবি ও তার বড় ছেলে পাপন এই আমাদের সংসার। একান্নবর্তী পরিবারের মত একসাথে থাকার মজাই আলাদা। বড় ভাবিও মায়ের অনেক যত্ন নিতেন। ভাবি লাভলীর যত্নে কখনো মনে হয়নি যে বউ যত্ন করছেন, মনে হতো মেয়েই যত্ন করছেন। বাড়তি পাওনা হিসাবে দুই বোন বাড়ির কাছে থাকায় সবসময় দেখাশুনা করতেন। বিশেষ করে সন্তানের মত মাকে আমার বড় বোন রেখা আগলে রেখেছেন। মাঝে মাঝেই দুজনে ঝগড়া লেগে যেতো। ঐযে বললাম, সন্তানের মত আগলে রাখতো। সন্তানের নানান খুনসুটিতে যেমন মায়ের মান অভিমান, রাগ হয় তেমনি মায়ের অনেক কথায়, কাজে বড় বোনও রাগ করতো। আমরা সবাই বুঝাতাম। মাকেও বলতাম আবার বোনকেও বলতাম। রাগ-অনুরাগ, মান অভিমান নিমিশেই কেটে যেতো।

স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলছিলো মায়ের চিকিৎসা। দিন দিন স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে সিদ্ধান্ত হলো মাকে ঢাকা নিয়ে যাবো। হাতে টাকা পয়সার জোগারও ছিলো যথেষ্ট। সিদ্ধান্ত হলো আমি আর বড় বোন রেখা আপা মাকে ঢাকা নিয়ে যাবো। বারো মার্চ দুই হাজার বারোর সোমবার মাকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম ঢাকায়। বারডেম নিয়ে গেলাম মাকে। নিয়ে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে মাকে ভর্তি করে নিলো বরডেম কর্তৃপক্ষ। একটা কেবিনে জায়গা হলো মায়ের। রুমের ভিতর মায়ের সাথে বড় বোন রেখা আপা থাকতো। আর আমি বারান্দায় বিছানার চাদর বিছিয়ে রাতে ঘুমাতাম। কাছেই থাকতাম। আর কাছে থাকার প্রত্যয়ের কারনে বিদেশ যাইনি আমি। যখন আমি এসএসসি পাস করি তখন মা বলেছিলো সৌদি আরব যাওয়ার জন্য। এভারেজ স্টুডেন্ট হিসাবে মা আমার উপর তেমন আস্থা রাখতে পারেনি। তাই উজ্জল ভবিষ্যতের চিন্তা করে আমার ছোট খালু বিল্লাল হোসেন খানের কাছে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো। মায়ের প্রস্তাবে আমি বলেছিলাম, বিদেশ গেলে ঘুরতে যাবো, কাজ করতে নয়। ঘুরতে গেলে কয়েকদিন বাদেই চলে আসতে পারবো, আপনাকে দেখতে পারবো। কিন্তু প্রবাস জীবনে গেলে সেই সুযোগ হবে না। মন চাইলেই মায়ের মায়াবী মুখখানা দেখতে পাবো না। আমার আর বিদেশ যাওয়া হলো না। রইলাম মায়ের পাশে পাশেই আঁচল ধরে। আর ছিলামও শেষ নিঃস্বাস পর্যন্ত।

বন্ধু ডাক্তার মাহবুবুল হক থাকতো বারডেমের অপজিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতালের) পশ্চিম-উত্তর দিকের একটা বাসায়। বন্ধুর বাসায় বা আমার ছোট খালা খুশি খালার বাসায়ও থাকার যথেষ্ট সুযোগ ছিলো। কিন্তু কাছেই থাকলাম। কারন কখন কি প্রয়োজন হয় সেই আশংকায় দূরে কোথাও যাওয়ার সাহস করলাম না। ভর্তির পর মাকে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা দেয়া হলো। কিছুক্ষণ পর পর একেক বিভাগে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলাম। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে যে রেজাল্ট পেলাম তা সুখকর নয়। বাড়িতে বোন শিখা, ইতালিতে ভাই আজাদকে ফোনে জানালাম। যাকে ফোন করি সেই শুনে কাদে, সাথে আমিও কাদি। তখন আমাদের কান্নাই ছিলো সঙ্গী। ফোন করে কেউই বেশি কথা বলতে পারতাম না। গলা আটকে আসতো, বুক ভারি হয়ে উঠতো। শুধু ফুপিয়ে কান্নাটাই করতো সবাই। কারন, মাকে যে আমরা সবাই খুব ভালোবাসতাম। ভালো না বাসার কোন কারনও নেই। আজকে আমাদের যে অবস্থান তা সবই হয়েছে মায়ের জন্য। বাবার ভূমিকা কিছুই ছিলো না তেমনটি নয়। কিন্তু একজন মমতাময়ী মা’ই পারেন একটা সংসারকে ফুলের মত সাজিয়ে তুলতে। আমার মাও তাই করেছিলেন। সবাইকে পড়াশুনা করিয়ে শিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। আর আমাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে, শিক্ষার আলো হৃদয়ে জ্বালতে নিজেকে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার করতে হয়েছে। সেই মা আজ মৃত্যু পথযাত্রী সেটা ভাবলে কার না কণ্ঠ জড়িয়ে আসে?

ঘুরে ফিরে মায়ের কোলের পোলা আমি মায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকি। শরীরের কাছে ঘেষে থাকি। মায়ের শরীরের গন্ধ নেই। মায়ের হাতটা ধরি, কাপড়টা ধরি, কখনো কাদি, মাও কাদে। মা থাকবে না আমাদের মাঝে মেনে নিতেই পারি না। নানান বিষয়ে কথা বলি। মা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেয়। কিভাবে চলবো, কী করবো, কী করবো না ইত্যাদি। আজও মায়ের কথামত চলতে চেষ্টা করি। কতটুকু পারছি তা হয়তো আমি জানি না। বারডেমের বেডে বসে মা যখন কিছুটা সুস্থ্য বোধ করছেন তখন আমাকে ডেকে বললো, বাবা, সবার জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি এক রকম হয় না। তুমি সবার চেয়ে একটু অন্য রকম। তুমি এখন আল্লাহর রহমতে উকিল হয়েছো। আমি অনেক খুশি হয়েছি। তুমি সবাইকে দেখে শুনে রাখবে, সবার ভালো মন্দ দেখবে। আজাদ বিদেশ থাকে। ও একটু সহজ-সরল। চার ভাই বোন মিলে মিশে থাকবে। তোমাদের দরবার যেন অন্য কেউ করতে না পারে। এমন কোন কাজ করবা না বাবা যা মানুষে খারাপ বলে। মনে কোন হিংসা, ঘৃণা পুষে রাখবা না। হিংসা-ঘৃণা মনে পুষে রাখার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই। হিংসাকে দমন করার মধ্যেই বীরত্ব আছে। আমি না থাকলে সবাই মিলে মিশে একসাথে থাকবা। আমি মায়ের সেদিনের কথাগুলো শুনেছি আর চোখ মুছেছি। আজ আবারও লিখতে গিয়ে চোখ মুছতে হলো।

প্রায় সপ্তাহ খানেক চিকিৎসা শেষে মায়ের শারীরিক অবস্থা বেশ ভালোই হলো। মাকে দেখলে মনেই হতো না যে মা অসুস্থ্য ছিলো। বারডেম কর্তৃপক্ষ রিলিজ দিলে আমরা একটা এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলে এলাম বাড়িতে। শরীয়তপুরে ঢুকে মা বললো মিস্টি কিনতে। খালি হাতে বাড়ি যাবে না। আমরা হারু ঘোষের দোকানের সামনে এ্যাম্বুলেন্স দাড় করিয়ে মিষ্টি কিনে নিলাম। এ্যাম্বুলেন্সের শব্দটা মায়ের বড় নাতী পাপনের খুব পছন্দ। প্যা-পু শব্দটাকে পাবন বলতো নিম্বো-নিম্বো! বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে মা বললো এবার এ্যাম্বুলেন্সর সাইরেনটা বাজাতে। তার নাতী শুনবে, দৌড়ে আসবে। মায়ের কথামত এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনটা বাজিয়ে দিলো ড্রাইভার। পাপন সহ সবাই দৌড়ে এলে বাড়ির ঘাটায়, রাস্তার কাছে। এ্যাম্বুলেন্সটা বাড়ির দরজার কাছে থামার পর একটা ছোট পিড়ির উপর দাড়িয়ে মা নামলেন। একটু হেটেই উঠে দড়জার সমনের দাওয়ায় হেলান দিয়ে বসলেন। সবার সাথে কথা বললেন। বাড়ি ফিরে মা বেশ চনমনে, প্রফুল্ল। কে বলবে, মায়ের ভিতরে রোগের ছিটে ফোঁটাও কমেনি!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here