শরতের পড়ন্ত বিকেল। পাখির কলকাকলিতে চারদিক মুখরিত। শালিকের কিচির-মিচির, কাকের কা-কা শব্দে কাল ঝাঝিয়ে ওঠে। দূর বাশঁবনে বিরহী ডাহুকের করুন আর্তনাদ। সামনেই বিশাল বিল, বিলের মাধ্যে কচুরীপানা, লতা, বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ জন্মেছে। বিলের মধ্যে ঝাকে ঝাকে পাখি এসে পড়েছে। এটাই হয়তো আজকের জন্য ওদের রাতের আশ্রয়। কারো কারো বাসা এখানেই। বিকেল হলেই ঝাকে ঝাকে পাখি নামে। এক ঝাক পাখি নামলেই আরেক ঝাক ওঠে। পুরো বিলটা পাখিতে ছেয়ে যায় বিকেল হলে। বিলের এপাড় দাড়ালে অপর পাড় দেখা যায় না। সামনে তাকালে শুধু ধূ-ধূ করে। বিলের এপার ধরে শিমুল গাছ। সাড়ি সাড়ি শিমুল গাছ। তার একটু উপরে হেটে চলার মত পথ। আকাবাকা সাপের মত দেখতে। সামনে একটি জায়গা যেখানটা একদম নিরব নিস্তব্ধ। নির্জনতা যেন ওখানেই শোভা পায়। জায়গাটার উপর একটা করুন ছাপ। সুমন সেই আকাবাকা বিলের তীরবর্তী পথ ধরে হাটছে। বিকেলে ওখানে হাটলে মনটা কেমন উদাস উদাস লাগে। ফুরফুরে হাওয়া, পাখির কলকাকলি। এমন পরিবেশে হাটলেই মনের কান্তি দূর হয়। হঠাৎ সুমনের চোখ যায় সেই নির্জন জায়গাটিতে। সেখানে বসে আছে একটি পনের বছরের ছেলে। সে একান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বিলের পানে। সে বসে আছে করুন ভঙ্গিতে। তার দৃষ্টি যেন ধূ-ধূ প্রান্তের দিকে। সুমন ছেলেটাকে দেখে আস্তে আস্তে সেদিকে এগোতে থাকে। এর মধ্যে একটি লোকের সাথে দেখা হয় সুমনের সাথে। লোকটি মাঝ বয়সী, মুখে কাচা-পাকা দাড়ি। ছেলেটি সম্পর্কে জানার কৌতুহল জাগে সুমনের মনে। সুমন লোকটিকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে-

ঃ আচ্ছা ভাই, ঐ ছেলেটাকে চেনেন?

লোকটি সহজ সরল ভাবে উত্তর দেয়-

ঃ হ চিনি।

কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায় সুমনের দিকে। কারন ওর নাম ঠিকানা জানেনা এমন লোক আশেপাশে দু’এক গ্রামের মধ্যে নেই বললেই চলে। লোকটি সুমনকে আর কখনও দেখেনি। তাই জিজ্ঞেস করে-

ঃ আপনারে তো ঠিক চিনলাম না!

ঃ আমার নাম সুমন। আমি এ গ্রামে বেড়াতে এসেছি।

ঃ ওহ! তাই কন। নাইলে ওরে চেনেনা এমন লোক এই গ্রামে আছে বইলা মনে হয় না।

সুমন কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। লোকটি একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। তার পর বলতে শুরু করে-

ঃ সে অনেক দিন আগের কতা। ঐ যে দেখতাছেন ওর নাম মনু। এক অভাগা পোলা। ঐ যে দখতাছেন না সামনের দিকে ধূ-ধূ করতাছে, ঐডা এক সময় ছিল প্রমত্তা গাঙ্গ। এক সময় এই কিনার দিয়া বড় বড় জাহাজ, ইস্টিমার যাইতো। ঐ মাঝ গাঙ্গ দিয়া যাইতে সাহস পাইতো না। এর পর আস্তে আস্তে চর পড়তে থাকে। অহনতো পুরা চর। শীতের দিনে এহনতো মাইনসে চাষ-বাস কইরা খায়। এমন একদিন ছিল ঐহানে কেউ ভয়েও যাইতো না। এহনতো গাঙ্গ মইরা গেছে। চর পরছে। এহনতো চাষ কইরা, মাছ ধইরা খায় সবাই। এইডা ছিল একসময় ভয়ংকর রাক্ষুইস্যা গাঙ্গ। মনুর বাবার নাম ছিল কাদু মিয়া। কাদুর অবস্থা ছিল মোটামুটি। বেশি ভালও না আবার বেশি খারাপও না আরকি! কাদুরা আছিল আট ভাই চার বোন। বাপের যা সম্পত্তি আছিল ভাই বইনেরা ভাগাভাগি কইরা অল্প অল্প কিছু পাইছে। মনুর বাপ আছিল কৌশলী এবং ভাল মানুষ। মনুর দাদায়ও আছিল দয়ালু প্রকৃতির। সে মইরা গেছে সেই কবে আজও মানুষ তার নাম লয়। মনুর বাবাও আছিল অত্যন্ত ভাল মানুষ। সংসার ভিন্ন হওয়ার আগেই কাদু বিয়া করছিল। বউডা আছিল খুবই ভাল, মনে হইতো সাক্ষাৎ লক্ষী। ভিন্ন হওনের তিন বছর পর এই মনুর জন্ম হয়। আস্তে আস্তে কাদুর উন্নতি হইতে লাগলো। কাদুর গোয়ালে চারটা গরু আছিল। জায়গা জমি যা আছে তাই চাষ-বাস করে। কোন রকম দিন কাইট্যা যায়। দুধের গাই আছিল। কাদু আছিল একটা জুয়ান মরদ। বাহুতে আছিল বল। নিজের কাজ নিজেই করতো। প্রত্যেকদিন গরুগুলারে নাওয়াইতে যাইতো ঐখানে। গরুগুলারে কাদু বড় আদর করতো। ঐ যে দেখতাছেন মনু ওর বয়স তহন পাঁচ বছর। মনুরে ওর বাপ বড় আদর করতো। পোলারে নিজের পরানের চাইতেও বেশি ভালবাসতো। পোলাও সারাদিন বাপের লগে লগেই থাকতো। মাঝে মাঝেই মনু ওর বাপের লগে গরু নাওয়াইতে আইতো। মনু উপরে দাড়াইয়া থাকতো। একদিন মনু উপরে দাড়াইয়া ওর বাপেরে জিগায়-

ঃ বাজান গরুগুলা কার?

ঃ তোমার বাজান।

ঃ আমার গরুগুলারে কারে দিমু জানো বাজান?

ঃ কারে বাজান?

ঃ তোমারে দিমু!

ঃ বাজান, প্রত্যেক দিন গরুগুলারে নাওয়াও ক্যান?

ঃ গরুগুলা যাতে ভাল থাকে হেইয়ার লাইগ্যা প্রত্যেকদিন নাওয়াই।

ঃ আমাগো গরুতো ভালোই।

এইভাবে মনু তার বাপেরে একটার পর একটা প্রশ্ন করতেই থাকে। কাদু এর পর রাগ হইয়া কয়-

ঃ এত কতা কইসনাতো বাজান।

ঃ কতা কইলে কি হইবো বাজান?

ঃ এত কতা কইলে আমি হারাইয়া যামু।

ঃ আমারে থুইয়া তুমি কই হারাইয়া যাইবা বাজান?

ঃ ঐ যে দেহসনা কিছু দেহা যায় না। খালি ধূ-ধূ করতাছে ঐ হানে হারাইয়া যামু।

ঃ এ্যা, তোমারে যাইতে দিলে সেনা।

সুমনকে পিছনের দিকটা দেখিয়ে লোকটা বলে-

ঃ ঐ যে দেহেন না, একটা জাম গাছ ঐ হানে আছিল একটা ঘাট। ঐ হানে সবাই গোসল করতো। একদিন করিম বেপারীর পুতের বউ নাইতে আইছিল একটা কলসি লইয়া। হেইযে আইছিল আর বাড়ি ফিরা যায় নাই। তার আর কোন খোজও পাওয়া যায় নাই। নদীর ঘাটে খালি কলসি পাওয়া গেছে। কিন্তু বউরে আর পাওয়া যায়নাই। রহিম বয়াতীর পোলা একদিন বশ্যি বাইতে আইছিল নদীর ঘাটে। সন্ধায় ডুলাডা পাওয়া গেছে, বশ্যিও নাই, পোলাও নাই। কই গেছে কেউ কইতে পারে নাই।

হেইদিন বিয়ান বেলা ঘুম থেইকা উইঠ্যা বাইরে যাওয়ার সময় কাদু দরজার কপাটে একটা উষ্ঠা খায়। তখনই কাদুর মনটা খারাপ হইয়া যায়। বাইরে গিয়া গোয়াল ঘরের তোন গরু বাইর করতে যায়। বাইর করার সময় গাই গরুডা আইজ একটা গুতা দেয় কাদুর কোকষা বাড়াইয়া। কাদু খুব অবাক হয়। যেই গরুর নিচে হুইয়া থাকলেও একটা পারা দেয় না। মনু নিচে বইয়া গরুর বানের থোনে মুখ লাগাইয়া দুধ খায় তাতেও গরু একটা লাত্তি দেয় না। মাডির মত ঠান্ডা কাদুর গাই গরু, হেই গরুতে গুতা দিল? এতে কাদুর মনডা আরো খারাপ অইয়া যায়। কাদু সব গরু বাইর কইরা আড়ালে বান্ধে। তার পর ফ্যান, কুড়া মিশাইয়া পানি খাওয়ায়। পানি খাওয়া হইলে কাদু সব গরু লইয়া চকে যায়। চক থেইক্কা আইয়া দেহে বউর এহনো রান্দা অয় নাই। আইজ এত সক্কালে কাদুর রাক্ষুইস্যা খিদা লাগছে দেইখ্যা কাদুর বউ তাজ্জব হইয়া যায়। আইজ কাদুর কতাবাতি কেমন যানি চাড়া চাড়া। এতদিন ধইরা সংসার করতাছে একদিনও এমন ব্যবহার করতে দেহে নাই। কাদুর বউর মনটাও খারাপ হইয়া যায়। কাদু বউরে কর্কশ গলায় জিগায়-

ঃ ভাত অইছে?

ঃ ভাত অইছে, তয় তরকারি রান্দা অয়নাই। একটু বহেন অহনই অইয়া যাইবো। আমনের বেশি খিদা লাগলে উরুম দেই, উরুম খান। ভাত হইছে, গরম ফ্যান আছে, আউষ চাউলের ফ্যান তো আমনের খুব পছন্দ, খাইবেন? হেলে ওলদি দিয়া, দুগ্গা ভাত লইয়া খান।

ঃ মুড়ি খাইমু ক্যান, ভাত হইছে তরকারি অয়নাই কিয়ের লাইগ্যা? মাগি বাইত্তে বইয়া কি ছিরচ? এহনও রান্দা হয়না?

ঃ আমনে এমনে কতা কন ক্যা?

ঃ এমনে কইম না তো কেমনে কইম? তোর কাছে কি এহন কতা কওয়া হিগদে হইবোনি?

কাদুর এই ব্যবহারে বউ খুব দুঃখ পায়। সংসার জীবনে এত দিনের মধ্যে কোন ঝগড়া ঝাটি অয় নাই। অভাব অনটনের সংসার ঠিকই কিন্তু কোনদিন কাদু বউরে কডুকতাও হুনায় নাই। এক কতায় দুই কতায় কাদুর লগে বউর ঝগড়া বাইজ্জা যায়। ঝগড়ার হেশে কাদু না খাইয়াই একটা কাচি লইয়া বাড়ি থেইকা বাইর অইয়া যায়। যাইতে যাইতে কাদু কইতে থাকে-

ঃ আল্লায় আমারে যানি আর বাইতে না আনে।

তহন মনু বাপেরে কয়-

ঃ বাজান আমি তোমার লগে যামু।

ঃ না, তুই বাইতে থাক।

এমনে আর কোন দিন মনুর লগে কাদু মিয়া কতা কয় নাই। মনুর কচি মনে বড় একটা আঘাত লাগে। বাড়ি থেইকা যাইয়া আর খাইতে কাদু আর খাইতে আহে না। দুফার গরাইয়া বিয়াল হয়, মনুর কোন খবর নাই। এমিহি একটা কাউয়্যা কা-কা করতে করতে যেন গলাডা ফাডাইয়া হালাইতাছে। কাদুর বউর মনডাও আজ কেমন যানি করতাছে। বউ বিরক্ত অইয়া কতগুলা ভাত দেয় কিন্তু কাউয়্যাডা হেই ভাত ছুইয়াও দেহে না। ভাত দেওয়ার পরেও কাউয়্যাডা কাবলাইতেই থাকে। মনুর মায়ও ভাত খায় নাই। হেইদিন আমরা ঐ ঘাটটায় নাইতে নামছি। ঐ যে মনু বইয়া রইছে ঐ হানে কাদু গরু নাওয়াইতে নামছে। প্রত্যেকদিন কাদু কত হাসি খুশি থাহে। কত কতা কয়, কত রঙ্গ রস করে। আমাগো ডাইকা ডাইকা কতা কয়। পোলার লগে কতা কয় আর গরু নাওয়ায়। আইজ কাদু চুপ-চাপ। এক্কেবারে মন মরা। মাত্র দুইডা গরু নাওয়াইয়া উপরে উডাইছে। দুইডা পানিতে নামাইছে। নামাইয়া গরুর পিঠ ডলতাছে। এমন সময় একটা চিৎকার হোনতে পাইলাম। চাইয়া দেহি পানির গরু দুইডা লাফালাফি কইরা উপরে উঠতাছে। একটা মাত্র চিৎকার আর কোন শব্দ নাই। আমরা সবাই ডরে উপরে উঠ্যা গেলাম। উপরে উঠ্যা দেহি মনুর বাপেরে দেহা যায় না। আমরা গাঙ্গের মিহি চাইলাম। পানিতেও দেহি নাই। ইট্টু পরেই দেহি ঐ মাঝ গাঙ্গে একটা বড় কুমইর মাথা ঝাকাইতাছে। কুমইরের মুখের মধ্যে মনুর বাপের পাও দেহা যায়। মনুর বাপেরে দেইখা আমরা সবাই আল্লার নাম লইতে থাকি। আর হৈ-চৈ করতে থাকি। মনুর বাপেব পাও কামরাইয়া ঝাকাইতে ঝাকাইতে মাছ গাঙ্গের দিকে যায়। মাঝ মিহি যায় আর ঝাকায়। মনুর বাবার দেহ নিথর নিষ্প্রাণ। মনুগো বাড়িতে একজন খবর পাডাইলো। মনুর মায় দৌড়াইয়া আইলো, সাথে মনুও আইলো। মনু, মনুর মার কিযে কান্দন! মনুর মার কান্দনে গাছের পাতা ঝইরা যায়। মনু কানতে কানতে কইতো-

ঃ আমার বাজান ঐহানে হারাইয়া গেছে। আমিও ঐহানে যামু।

মাঝে মাঝেই মনু এইহানে আইয়া বইয়া থাকে। একলা একলা বইসা কান্দে। দুই চোখের পানিতে বুক ভাইস্যা যায়। এহনও মানুষ মাঝ রাইতে মনুর বাবার চিৎকার হোনতে পায়। হেই করুন আর্তনাদ! এহনও মনুর মায় মাঝ রাইতে উইঠ্যা কান্দে।

এই করুন হৃদয় স্পর্শী কাহিনী শুনে কখন যে সুমনের চোখের কোনা বেয়ে অশ্রু ফোটা ঝরে পড়ে তা সে নিজেও টের পায় না। লোকটিরও দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। দু’হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছতে মুছতে লোকটি চলে যায়। সুমন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে- হায়রে শর্বনাশা নদী!

১৩ ডিসেম্বর ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ।

asadjewel@gmail.com, www.asadjewel.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here