করোনার করুনায় দীর্ঘদিন যাবৎ ঘর বন্দি মানুষ। শুধু আমিই নই। সারা বিশ্বের মানুষের একই দশা। কোথাও বের হওয়ার সকল দরজা বন্ধ। তা’ও পাকাপোক্ত ভাবে বন্ধ হয়েছে। মানে সরকারী নির্দেশনা মতে নানান বাঁধা বিপত্তির কারনে বাইরে যাওয়া নিষেধ। মানুষ হলো মুক্ত বিহঙ্গের মত। এক জায়গায় বেশিক্ষণ বা বেশিদিন স্থির থাকতে পারে না। আমি নিজেও নিজেকে মানুষ দাবী করি। তাইতো আমিও বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে পারি না। কিছুদিন পর পর আমার আবার একটু হাওয়া বদল করার বদ অভ্যাস আছে! ঘরে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না, বাইরে যাওয়ার জন্য মন কাঁদে। বাইরে গেলে বেশিক্ষণ বা বেশিদিন থাকতে পারি না, ঘরের জন্য মন কাঁদে। বেশিক্ষণ হাটতে পারি না বিশ্রাম নিতে মন কাঁদে আবার বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারি না একটু হাটতে মন কাঁদে। একটানা বেশিক্ষণ কাজ করতে পারি না, একটু বেকার হতে মন চায়। আবার বেশিক্ষণ বেকার থাকতে পারি না, কাজের জন্য মন কাঁদে। কিন্তু এত কাঁদাকাঁদির মাঝেও আগে মন চাইলেই বেড়িয়ে পড়া যেত। যেখানে খুশি যাওয়া যেতো। যেভাবে খুশি ঘুড়া যেত। বিশ্ব পরিস্থিতি সেই সুযোগের দরজা বন্ধ করে দিয়ে যেন চাবি ফেলে দিয়েছে কাজলা দীঘির গভীর জলে!

এক হাতে তালি বাজে না এটা একটা চিরন্তন প্রবাদ এবং সত্যি কথাও বটে। তেমনি একা একা ঘুড়তেও ভালো লাগে না। আর ঘুড়াঘুড়ির জন্য সকলের মন মানসিকতাও এক হয় না। ভ্রমণের জন্য ভ্রমণ পিপাসু মানুষ দরকার। তেমনি একজন বন্ধু আছে আমার। সে হলো শামীম সরদার। পেশায় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার মানুষ শামীম সরদার। শত ব্যস্ততার মাঝেও, শত কাজের মাঝেও, শত চাপের মাঝেও একটা ভ্রমণ পিপাসু মন আছে সরদারের। শামীম সরদার রথ দেখার সাথে কলা বেচতে পছন্দ করে। বিটুমিন-রড-রোলার প্রয়োজন তো দে ছুট চট্রগ্রাম! পাথর প্রয়োজন তো ছুটে চলো সিলেট, রাজশাহী, কুষ্টিয়া। শামীম সরদারের নিজস্ব গাড়ি আছে। সেই সাথে সরদার নিজে ভালো ড্রাইভও করতে পারে। বিরামহীন গাড়ি চালাতে পারে। সরদারের ধৈর্যের যেন কোন বাঁধই নেই, ভাঙ্গবে কী!

শামীম সরদারের একটা কাজের জন্য প্রচুর সিলেটি মোটা বালু ও পাথর লাগবে। তাই যেতে হবে সিলেটের গোয়াইনঘাট। আগে থেকেই গোয়াইনঘাটে কয়েকজন পাথর-বালু ব্যবসায়ীর সাথে এবং জাহাজের চালকের সাথে কথা বলে রাখলো। সরাসরি দেখে শুনে কেনাই উত্তম ভেবে পরিকল্পনা শুরু হলো সিলেট যাওয়ার। সিলেটের গোয়াইনঘাটে ভালো বালু ও পাথর পাওয়া যায়। এছাড়া জাফলংয়ের তামাবিল পোর্ট দিয়ে ভারত থেকেও বড় বড় কালো পাথরের বোল্ডার আমদানী হয় যেগুলো স্থানীয়ভাবে এলসি পাথর নামে পরিচিত। বোল্ডারগুলো বাংলাদেশে এনে স্টোন ক্রাশারের মাধ্যমে বিভিন্ন সাইজে ভাঙ্গা হয়। পাহাড়ের বুক জুড়ে পাথরের গদি আর পাথর ভাঙ্গার গগণবিদারী শব্দ এক ভিন্ন আমেজ উপভোগ করা যায়। গোয়াইনঘাট উপজেলার মধ্যেই জাফলং। স্পটদুটি কাছাকাছি হওয়ায় পরিকল্পনা হলো সিলেট থেকে প্রথমে গোয়াইনঘাট যাওয়ার। গোয়াইনঘাটে বালু ও সিঙ্গেলস পাথর দেখার পর জাফলংয়ে রাত্রি যাপন ও সৌন্দর্য উপভোগের সাথে তামাবিলের আমদানীকৃত কালো বোল্ডার ক্রাশ পাথর বা এলসি পাথরও দেখা হবে এমটাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

এমনই পরিকল্পনা মাফিক এক মঙ্গলবার রাতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম শরীয়তপুর থেকে। করোনার কারনে সব কিছু যে খারাপ হয়েছে তা কিন্তু নয়। আমাদের জন্য সময়টা ভালোই হয়েছে মনে হয়। ফেরি ঘাটে যাওয়ার সাথে সাথেই পেয়ে গেলাম ফেরি। ঢাকা পৌছাতে পৌছাতে গভীর রাত হয়ে গেলো। মঙ্গলবার রাতটা ঢাকায় কাটানোর জন্য হোটেলে উঠতে হবে। হোটেলে উঠার আগে রাতের ঢাকা দেখার জন্য এবং রাতের হাতিরঝিলের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের জন্য চলে গেলাম হাতিরঝিলে। হাতিরঝিল ঘুরে চলে আসলাম হোটেলে। গভীর রাতে ঘুমুতে যাওয়ার একটা বিরম্বনা আছে। সহজে ঘুম আসতে চায় না আবার ঘুম একবার আসলে সহজে ভাঙ্গতেও চায় না। সকালে আমাদের ঘুম ভাঙ্গলো দেরিতে। বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পরলাম। ঢাকা শহরের কিছু কাজ সেরে এবার সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার পালা।

মিরপুর বিআরটিএতে কিছু কাজ ছিলো শামীম সরদারের। গাড়ির ট্যাক্স টোকেন নবায়ন, কাগজত্র আপডেট সংক্রান্ত কিছু কাজ করতে হবে। সেখানে পরিচিত একজন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। অসহ্য যানজট ঠেলে আমরা বিআরটিএর কাছে যেতেই পেয়ে গেলাম সেই কাঙ্খিত ব্যক্তিকে। তাকে সকল কাগজপত্র বুঝিয়ে দেয়া হলো। এবার মিরপুর থেকে রওয়ানা দিব আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে। ঢাকা থেকে সিলেট বের হওয়ার রাস্তা আমরা কেউই চিনি না। কোন দিক দিয়ে ঢাকা ছাড়লে সিলেট রোড ভালো হবে তা জানার জন্য গুগলের সহযোগীতা চাইলাম। গুগল ম্যাপসে ঢুকে ডেসটিনেশন দেয়ার পর আমাদের পথ দেখালো। গুগলের দেখানো পথে চলতে চলতে আমরা চলে গেলাম এয়ারপোর্ট রোডে। বিশ্বরোডের ফ্লাইওভারে উঠার নির্দেশনা দেখে ভাবলাম আমরা বসুন্ধরা এলাকার পাশ দিয়ে তিনশ ফিট রাস্তা ধরে মনে হয় ঢাকা ছাড়বো। কিন্তু গুগল আমাদের ফ্লাইওভার দিয়ে দুটি চক্কর কাটালো এবং খিলখেতের কাছে যাওয়ার পর গুগলের নির্দেশনামতে ফ্লাইওভার চক্কর দিয়ে এগুতে থাকলে গুগল ম্যাপস আমাদের নিয়ে গেলো উত্তরার পথ ধরে টঙ্গী। এর পর আর গুগলের প্রতি আস্থা রাখতে না পেরে মানুষকে জিজ্ঞেস করতেই বলে দিলো কিভাবে ঘোড়াশাল দিয়ে ভৈরব হয়ে সিলেটের পথে এগুতে হবে। চলতে থাকলো আমাদের গাড়ি…

গাড়িতে আমরা যাত্রী পাঁচজন। আমি, শামীম সরদার, চালক রাসেল, ধানুকার ইয়াসিন ভাই ও বাবুল সিকদার। বাবুল সিকদারকে আমরা কখনো বাবু ভাই বলি, কখনো বলি হাবু ভাই। বয়স্ক মানুষ হলেও রসিক বটে। হাবু ভাই দীর্ঘ পনের বছর আগে সিলেট গিয়েছিলো মাজার জিয়ারত করতে। এর পর আর যাওয়া হয়নি। আমরা সিলেট যাবো শুনে বায়না ধরে সেও যাবে। গাড়িতে গল্পের মাঝে চলছে গান। নানান ধারার গান বাজছেই। কখনো বাংলা, কখনো হিন্দী। কখনো বিরহের গান যাকে আমরা বলি কইলজা কাটা বিচ্ছেদ, কখনো পুতুপুতু প্রেমের গান। মাঝে মাঝে চলছে চলমান হিন্দী গানগুলোও। ভিডিওর সাথে অডিও। কেউ কথার ফাঁকে ফাঁকে ভিডিওতে চোখ বুলাচ্ছে, কেউ জানালা দিয়ে রাতের সৌন্দর্য দেখার সাথে সুরেলা গানগুলো শুনছে। কেউ ঘুমিয়ে পড়ছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য আমি আর শামীম সরদার একেক সময় একেক জনকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে জাগিয়ে দিচ্ছি। ঢাকার যানজট থেকে বের হওয়ার পর পরই স্টিয়ারিং হুইল চলে গেছে শামীম সরদারের হাতে। গাড়ি যখনই শামীম সরদার ড্রাইভ করে তখনই আমার আসন হয় সামনে চালকের পাশের সীটে। সামনে বসে আর যাই করি না কেন ঘুমানো যাবে না এটা হলো আমাদের ভ্রমণের অন্যতম শর্ত। তাই বলে যে পিছনের আসনে বসে ঘুমানো যাবে তাও কিন্তু নয়। ঘুম একটি ছোয়াচে ধাচের রোগ। একজন ঘুমাতে শুরু করলে পাশের জনও ঘুমানো শুরু করে দেয়। ঘুমের ভাইরাস করোনার চেয়েও দ্রুত ছড়ায়! এভাবে যদি ঘুমের ভাইরাস ছড়াতে থাকে তবে এক সময় দেখাযাবে চালকও ঘুমের দেশে ঘুড়তে চলে যাবে আর গাড়ি যাবে সেই চিরচেনা লডা ক্ষেতে! তাই কেউ যাতে ঘুমিয়ে না পড়ে সেদিকে আমি আর শামীম সরদার কড়া নজর রাখছি।

রাত জাগলে মাঝে মাঝে ঘুম একটু আধটু ধাক্কা মারবেই। আমাদেরও মাঝে মাঝে ধাক্কা মারছে। কিন্তু ঘুমের ধাক্কায় পড়ে গেলেতো হবে না। ঘুম তাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা আছে। হাইওয়ে রাস্তার ধারে ঘুম তাড়ানোর দারুন সব বন্দোবস্ত করা আছে। বিশেষ করে পেট্রোল পাম্পে বা হোটেলগুলোতে সারা রাতই কেনা বেচা চলে। ঘুম ঘুম ভাব হলে দাড়িয়ে যায় গাড়ি কোন দোকানের সামনে। সবাই নেমে একটু গা ঝাড়া দেয়। কেউ কেউ ছুটে যায় দূর্বার বেগে মুত্র বিসর্জন দিতে। এর পর চা বা কফির ফাঁকে ফাঁকে চলে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আড্ডা। কিছুক্ষণ আলাপচারিতা ও খাওয়া দাওয়ায় ঘুম চলে যায় পরবাসে। আমরা চাঙ্গা হয়ে আবার ছুটে চলি মহাসড়কের বুকচিরে। রাস্তার দু’ধারে নিকষ কালো অন্ধকারেরও যে অপরূপ সৌন্দর্য থাকে তা উপভোগ করতে থাকি। কখনো কখনো শেয়াল পন্ডিত রাস্তার ধার থেকে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে, আমাদের দেখে মুখ লুকায় লজ্জায় কিংবা ভয়ে। ছোট ছোট বাজারগুলোতে বন্ধ দোকান পাট পাহাড়ায় বসে আছে রাতের নিরাপত্তা কর্মী। শুনশান নিরব বাজারের বেওয়ারিশ নেড়ীকুত্তাগুলো আমাদের গাড়ির দিকে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে আসে। গাড়ির ভিতরে থাকায় ভয় না পেয়ে বেশ মজাই পাই আমরা। এমন একটা ভাব করে যেন এখনই কামড়ে দেবে আমাদের। বাজারের উচ্ছিষ্ট খেয়ে বাজার কর্তৃপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞার প্রতিদান স্বরূপ এহেন আচরণ করছে কুকুরগুলো।

আমাদের গাড়ি চলতে চলতে গভীর রাতে গিয়ে পৌছায় সিলেট শহরের কাছাকাছি। রাত যেহেতু গভীর তাই শরীরও বেশ ক্লান্ত। একটু গা এলিয়ে না দিলে শরীর মন রিচার্জ হবে না। ভ্রমণে শরীর-মন সর্বদা সতেজ থাকা চাই। এত রাতে আর কোন দিকে মুভ না করে সিলেটেই বাকী রাতটুকু কাটিয়ে দেয়া উত্তম ভেবে ছুটছি শহরের দিকে। এর আগেও একবার সিলেট গিয়ে আমরা উঠেছিলাম হিল টাউন হোটেলে। নতুন হোটেল, তিন তারকা বিশিষ্ট বলে দাবী করে ওরা। সেই বার বেশ ভালই থেকেছিলাম ওখানে। আগে যেহেতু ছিলাম তাই এবারও ভাবলাম হিল টাউনেই যাই। হোটেলে পৌছাতে কোন সড়ক ধরলে ভালো হবে চিন্তায় পড়ে গেলাম আমরা। গভীর রাত। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগও নেই। রাস্তাও আমরা চিনি না। আবার গুগলের সহযোগীতা নিলাম। এখন একটা প্রবাদ বেশ চলমান তা হলো, গুগল মামা সব জানে। কিন্তু একটু ঘুরিয়ে পেচিয়ে জানায়। শরীয়তপুর থেকে ঢাকা যেতে জাজিরা হয়ে মাওয়া সড়ক ধরলে সহজে যাওয়া যায় সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু গুগল হয়তো বলে বসবে তোমরা শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার আলুবাজার-হরিণাঘাট ফেরি পার হয়ে চাঁদপুর দিয়ে দৌড়াও! এই যা সমস্যা। তবুও এত রাতে কাকে আবার জিজ্ঞেস করবো তাই গুগল ম্যাপ চালু করলাম। আবারও সেই ঘুরিয়ে পেচিয়ে আমাদের গাড়ি নিয়ে গেলো সিলেটের হিল টাউন হোটেলে। গাড়ি পার্ক করতে করতে আমি আর শামীম সরদার উঠে গেলাম দোতালায় হোটেল রিসেপশনে। গিয়ে দেখি নাইট গার্ড ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে। আর যাওয়ারই কথা। কার এত সখ আমাদের মত রাত জাগার? গার্ড রিসেপশনের লোক ডেকে নিয়ে আসলো। রুমের কথা বলতেই তারা আকাশ ছোঁয়া দাম চাইছে। দাম শুনে মনে হচ্ছে করোনার কারনে যে লস হয়েছে এবং হোটেলে গেষ্ট হয়নি তা আমাদের দিয়ে পুষিয়ে নিবে। তবুও আমরা বললাম যে, রুমগুলো আগে দেখানো হোক। লোকটা আমাদের নিয়ে দেখালো তিন বেডের একটা রুম। রুমের অবস্থা দেখে মনে হয় কোন হাসপাতালে ঢুকেছি! তিনটা সিঙ্গেল বেড সাড়ি সাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দেখে বেশ বিরক্ত হলাম আমরা। বললাম একটা ডাবল ও একটা সিঙ্গেল বেডের এসি রুম দেখান। এবার নিয়ে গেলো যেটায় সেটা মোটামুটি বলা যায়, যা দিয়ে অন্তত রাতটা পার করা যাবে। কিন্তু দর-দামের সময় তারা যা চাইছে তাতে কিডনি, কলিজা চাইলেও মনে হবে ভাড়ার চেয়ে কম কিছু চেয়েছে! দর-দামে বনিবনা হলো না আমাদের। অগত্যা আমরা বেরিয়ে গেলাম নিচে। গাড়িতে উঠে দিলাম টান। আমাদের শেষ গন্তব্য যেহেতু গোয়াইনঘাট তাই চিন্তা করলাম গোয়াইনঘাট গিয়ে একটা হোটেল নিয়ে একটু বিশ্রাম নেব। যেই ভাবা সেই কাজ। গাড়ি টান দিয়ে চলতে শুরু করলাম আবারও।
আবারও সেই গুগলের সহায়তা নিয়ে শহর ছাড়ার চিন্তা করতেই আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দিলো গুগল ম্যাপস। গুগল ম্যাপস চালু রাখলে মোবাইলের ব্যাটারি লেভেল সাই সাই করে নামতে থাকে। মোবাইলের ব্যাটারী খাওয়া দেখে মনে হচ্ছে ব্যাটারিতে চুমুক দিয়ে চার্জ পিয়া খাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মোবাইলের ব্যাটারি লেবেল বিপদ সংকেত দেখাতে শুরু করলো। গুগল ম্যাপসের দোষ নয়, সবাই দোষ দিলো আমার মোবাইলের বয়সের। বয়স হয়েছে কম নয়। তিন বছর হয়ে গেছে আমার হাতে। আর কত? বয়সের ভারে এখন আর পারছে না তাই চার্জ দ্রুত কমে যাচ্ছে বললো সবাই। আমরা যেহেতু সিলেট টু গোয়াইনঘাট সড়কে চলছি তাই ভাবলাম এবার মোবাইল থেকে গুগল ম্যাপস এ্যাপসটাকে স্টপ করে দেই। এবার আমাদের গাড়ি চলছে রাস্তা দেখে, ম্যাপস দেখে নয়।

আমাদের গাড়ি সুন্দর এক রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। পাথরের ঢালাই করা রাস্তা। অত্যন্ত প্রসস্ত চকচকে নতুন রাস্তা। খুব একটা আকা বাকা নয়, একদম সোজা রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে বিশাল বিশাল বিল-বাওর। মাঝে মাঝে দু’একটা ছোট খাটো বাজার পরছে চোখে। কোথাও কোথাও দু’একটা বাড়িও দেখা যাচ্ছে। আমরা দূর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। রাস্তা দেখে এবং মাঝে মাঝে ব্রিজগুলো দেখে শামীম সরদার ধারণা দিচ্ছে রাস্তাগুলো প্রতি কিলোমিটার করতে কেমন খরচ পরেছে, ব্রিজগুলোর জন্য কেমন টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। আসলে মুচির নজর জুতার দিকে, রাজার নজর সিংহাসনের দিকে আর ঠিকাদারের নজর ব্রিজ-রাস্তার দিকে। এ কারনেই ঠিকাদার শামীম সরদার যেখানেই নতুন কোন রাস্তা দেখলে বা রাস্তার কাজ চলছে দেখলে, কোথাও নতুন ব্রিজ দেখলে বা ব্রিজের কাজ চলতে দেখলে আমাদের ধারণা দিচ্ছে কেমন বাজেট আছে এই কাজে! নতুন নির্মিত রাস্তা। চকচকে ঝকঝকে দেখতে ও চলতে খুবই মজা। মাঝে মাঝে দু’এক কিলোমিটার বা কোয়াটার কিলোমিটার রাস্তা ফিনিশিং দেয়া হয়নি। কোথাও কোথাও ব্রিজের এপ্রোচ ঠিক করা হয়নি। আমরা রাস্তা ধরে ছুটে চলার মাঝে দেখি একটা পুলিশের গাড়ি দাড়িয়ে আছে। আমাদের কোন প্রকার বাঁধা না দেয়ায় এবং না থামানোতে আগের গতিতেই গাড়ি চালিয়ে তাদের পাশ কেটে চলে গেলাম। যেতে যেতে দূরে দেখা যায় আলোক সজ্জার মত বাতি জ্বলছে। অসাধারণ দৃশ্য যা নিজ চোখে না দেখলে বুঝানো যাবে না। ঝলমল করছে আলো। দেখে এটুকু বুঝা যাচ্ছে যে পাহাড়ের গায়ে আলোর ঝলকানি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সামনের আকাশে একঝাক তাঁরা জ্বল জ্বল করছে। এ যেন ঝাকে ঝাকে তাঁরার মেলা। কিন্তু ভালো ভাবে লক্ষ্য করলে বুঝাযায় পাহারের গায়ে জ্বলছে। আলো দেখে আমরা চিন্তা করছি হয়তো এখনও সিলেটেরই কোথাও আছি। সহযাত্রী একজন বললো এটা মনে হয় হযরত শাহ পরাণের মাজার শরীফ। সিলেট শহরে হযরত শাহ জালালের মাজার। ভাগ্নে শাহ পরাণের মাজার মামার মাজার থেকে একটু দূরে। এটাই হয়তো হযরত শাহ পরাণের মাজার শরীফ তাই এতো আলো জ্বলছে। কিন্তু আমরা পরক্ষণেই দ্বিধায় পড়ে গেলাম, কিছু দূর পর পর এতো আলোর ফোয়ারা কেন? হযরত শাহ পরানের মাজার হলে এক জায়গায় আলোকিত দেখা যাবে। কিন্তু সামনেতো দেখা যাচ্ছে থেকে থেকে বিশাল এলাকা নিয়ে আলোর খেলা। আলোর রূপ দেখে দেখে সামনে এগুতে থাকলে দেখি রাস্তা শেষ। রাস্তার দুই পাশে ছোট বড় অফিসের মত ভবন। রাস্তার সামনেই একটা বড় সাইনবোর্ড দেয়া আছে। লেখা আছে, থামুন, সামনে ভারত, ভোলাগঞ্জ স্থল বন্দর, কোম্পানিগঞ্জ, সিলেট। আমরা থেমে গেলাম। তাজ্জব হয়ে গেলাম সবাই। যাবো গোয়াইনঘাট, চলে এসেছি কোম্পানিগঞ্জের ভোলাগঞ্জ। সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। চারদিক শুনশান নিরব। একটু ভয় ভয়ও লাগছে। নেমে এবার কাছ থেকে দেখলাম চেরাপুঞ্জির পাহাড়ের আলোর ঝলকানি।

গভীর রাতে কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সীমান্তে দাড়িয়ে আমরা। রাতের আলো আধারিতে কিছুইতো দেখা হলো না। তাই ভোলাগঞ্জ সম্পর্কে সম্মানিত পাঠকের জন্য কিছু তথ্য তুলে ধরছি। ভোলাগঞ্জ বাংলাদেশের সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার একটি দর্শনীয় স্থান। সিলেট শহর হতে ৩৩ কিলোমিটার দূরবর্তী ও ভারতের চেরাপুঞ্জি সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারীর অবস্থান। মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে বর্ষাকালে ঢল নামে। ধলাই নদীতে ঢলের সাথে নেমে আসে পাথর। পরবর্তী বর্ষার আগমন পর্যন্ত চলে পাথর আহরণ। এছাড়াও রয়েছে ১৯৬৪-১৯৬৯ সালে সোয়া দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প যার দৈর্ঘ্য ১১ মাইল ও টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্টের সংখ্যা ১২০টি। উত্তোলিত পাথর ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে পাঠানো হতো। ১৯৯৪ সালের পর এই পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এখান থেকে ২০ মিনিটের ইঞ্জিন নৌকা দূরত্বে রয়েছে বিশেষ কোয়ারীর অবস্থান। মূলত সীমান্তের অতি নিকটবর্তী হওয়ায় এই জায়গাকে বিশেষ কোয়ারী বলা হয়। সেখান থেকে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করা যায়।
ভোলাগঞ্জ রোপওয়েঃ ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা ধলাই নদীর সাথে প্রতিবছর বর্ষাকালে নেমে আসে প্রচুর পাথর। ধলাই নদীর তলদেশেও রয়েছে পাথরের বিপুল মজুদ। এই পাথর দিয়ে পঞ্চাশ বছর চালানো যাবে এই হিসাব ধরে ১৯৬৪-১৯৬৯ সাল পর্যন্ত সময়কালে সোয়া দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে প্রকল্প। বৃটিশ রোপওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানী প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ভোলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত সোয়া ১১ মাইল দীর্ঘ রোপওয়ের জন্য নির্মাণ করা হয় ১২০টি টাওয়ার এক্সক্যাভেশন প্ল্যান্ট। মধ্যখানে চারটি সাব স্টেশন। দু’প্রান্তে ডিজেল চালিত দুটি ইলেকট্রিক পাওয়ার হাউস, ভোলাগঞ্জে রেলওয়ে কলোনী, স্কুল, মসজিদ ও রেস্ট হাউস নির্মাণও প্রকল্পের আওতাভূক্ত ছিল। এক্সক্যাভেশন প্লান্টের সাহায্যে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাথর উত্তোলন করা হলেও বর্তমানে এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। জানাযায়, পর্যাপ্ত লোকবলের অভাব, পাথরের অপর্যাপ্ততা ও বিকল ইঞ্জিনের কারণে দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর ধরে এক্সক্যাভেশন মেশিন বন্ধ রয়েছে। আগে উত্তোলিত পাথর ভাঙ্গা, ধোয়া ও টুকরোর আকার অনুসারে বালু, স্টোন চিপস ও ট্রাক ব্যালাস্ট ইত্যাদি শ্রেণীতে ভাগ করা হতো। শ্রেণী অনুসারে সেগুলো পৃথক পৃথক ভাবে বের হয়ে রোপওয়েতে ঝুলানো চারকোনা বিশিষ্ট ষ্টীলের বাকেটে জমা হতো। প্রতিটি বাকেটের ধারণ ক্ষমতা ২৩৭ কেজি (প্রায় ১২০ফুট)। পাথর ভর্তি বাকেট পাঠানো হতো ছাতকে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে ঠিকাদাররা স্থানীয়ভাবে বোল্ডার পাথর ক্রয়ের পর তা ভেঙ্গে বিভিন্ন সাইজে বিভক্ত করে। তারপর তা বাকেটে পুরে ছাতকে প্রেরণ করা হয়। মজার ব্যাপা হলো, এলাকাটি দেখতে অনেকটা ব-দ্বীপের মতো। ধলাই নদী বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে প্লান্টের চারপাশ ঘুরে আবার একীভূত হয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সদরের কাছে ধলাই নদী মিলিত হয়েছে পিয়াইন নদীর সাথে। রোপওয়ের আয়তন প্রায় একশ একর। আর এ কারণেই স্থানটি পর্যটকদের কাছে এত আকর্ষণীয়।
চেরাপুঞ্জির নিচেঃ পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান ভারতের পাহাড়ী রাজ্য মেঘালয়ে। ধলাই নদীর উজানে এ রাজ্যের অবস্থান। খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় ঘেরা এ রাজ্যের দৃশ্য বড়ই মনোরম। ভোলাগঞ্জ রোপওয়ে এলাকায় অবস্থান করে পাহাড় টিলার মনোরম দৃশ্যাবলি অবলোকন করা যায়। বর্ষাকালে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির পানি ধলাই নদীতে পাহাড়ী ঢলের সৃষ্টি করে। গ্রীষ্মকালে অনেকে ধলাই নদীকে মরা নদী হিসাবে অভিহিত করলেও বর্ষাকালে নদীটি ফুলে ফেঁপে উঠে।
পাথর আহরণের দৃশ্যঃ ভোলাগঞ্জ কোয়ারীতে শুষ্ক মওসুমে প্রধানত গর্ত খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে শ্রমিকরা প্রথমে কোয়ারীর ওপরের বালি অপসারণ করে। পর্যায়ক্রমে গর্ত খুঁড়ে নিচের দিকে যেতে থাকে। ৭-৮ ফুট নিচু গর্ত খোঁড়ার পর কোয়ারীতে পানি উঠে যায়। পানি উঠে গেলে শ্যালো মেশিন দিয়ে কোয়ারীর পানি অপসারণ করে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন করে। এর বাইরেও শিবের নৌকা পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলন করা হয়। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের উপায় হচ্ছে একটি খালি নৌকায় শ্যালো মেশিনের ইঞ্জিন লাগানো হয়। ইঞ্জিনের পাখা পানির নীচে ঘুরতে থাকে। পাখা অনবরত ঘুরতে ঘুরতে মাটি নরম হয়ে পাথর বেরোতে থাকে। সংশ্লিষ্টরা ঝাঁকির সাহায্যে পাথর নৌকায় তুলে। এ পদ্ধতিতে সহস্রাধিক শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে থাকে। এ পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও খুব উপভোগ্য।
ভোলাগঞ্জ ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনঃ ভোলাগঞ্জে রয়েছে একটি ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন। এ স্টেশন দিয়ে আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম চলে। এ স্টেশন দিয়ে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা প্রধানত চুনাপাথর আমদানী করে থাকেন। চুনাপাথর নিয়ে প্রতিদিন শত শত ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সীমান্তের জিরো লাইনে এ কাস্টমস স্টেশনের অবস্থান। চুনাপাথর আমদানির দৃশ্য অবলোকনের বিষয়টিও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।

এত সমৃদ্ধ, এত অপরূপ ভোলাগঞ্জের কিছুই দেখা হলো না আমাদের। চুপিচুপি যা দেখলাম তাতেই হৃদয় জুড়িয়ে গেলো। ভোলাগঞ্জও জানলোনা কিছু তৃষ্ণার্ত ভ্রমণ প্রেমী এসেছিলো তার হৃদয়ে। ভোলাগঞ্জ শেষ পয়েন্টে আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না ভেবে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম। আবার পিছনের ফেলে আসা রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলো আমাদের গাড়ি। এবার কিছুদূর এগুনোর পরে দূর থেকে দেখি দুটি লাইট জ্বলজ্বল করছে। লাইট হালকা নেড়ে আমাদের দিকে গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিচ্ছে। ডাকাত কিনা সেই ভেবে একটু ভয় ভয়ও লাগছে। আবার চিন্তা করলাম আসার সময় যেহেতু পুলিশের গাড়ি দেখে এসেছি নিশ্চই সেই পুলিশ হবে। যেমন ভাবা তেমনই হলো। গাড়ির আলোতে দেখলাম দুজন পুলিশ রাস্তার দুধারে টর্চ জ্বালিয়ে আমাদের থামতে হালকা নির্দেশ করছে। আসলে দাড়াতে বলছে না কি বলছে প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না আমরা। তেমন একটা তোরজোর দেখলাম না তাদের সিগনালে। আমাদের মধ্যে যেহেতু কোন অপরাধবোধ নেই এবং সৎসাহস আছে তাই দাড়াতে সমস্যা কী? পুলিশ পার হয়ে একটু সামনে গিয়ে দাড়িয়ে জানালা দিয়ে জানতে চাইলাম আমাদের সিগনাল দেয়া হয়েছে কিনা। এবার তারা আমাদের দিকে টর্চের আলো দিয়ে তাদের দিকে আসতে বললো। আমাদের গাড়ি এবার পিছনের দিকে নিয়ে তাদের কাছে গেলাম এবং জানালা খুলে দিলাম। পুলিশ আমাদের জানালা দিয়ে জানতে চাইলো, আপনাদের পরিচয় কী, কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন, কোথা থেকে আসছেন। আমরা এবার গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালাম। আমি আমার পরিচয় দিলাম যে, আমি একজন আইনজীবী। জানতে চাইলো কোথায় প্রাকটিস করি। আমি জানালাম শরীয়তপুর বারের মেম্বার এবং শরীয়তপুর জজ কোর্টে প্রাকটিস করি। শামীম সরদার জানালো সে শরীয়তপুরের শ্রেষ্ঠ করদাতাদের একজন এবং একজন ঠিকাদার ব্যবসায়ী। শামীম সরদার এনবিআর প্রদত্ত তার শ্রেষ্ঠ করদাতার কার্ডটি পুলিশের হাতে দিলো এবং বললো আমরা গোয়াইনঘাট যাবো পাথর কেনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু গুগল ম্যাপস অন করে গাড়ি চালানোর পর এই রাস্তায় ভুলক্রমে ঢুকে গেছি। আমাদের গন্তব্য গোয়াইনঘাট। আমরা এখন কিভাবে গোয়াইনঘাট যেতে পারি সেই নির্দেশনা দিন। আমাদের অপর যাত্রীরাও নেমে দাড়ালে রাস্তায়। এবার পুলিশ বেশ সক্রিয় হয়ে উঠলো। আমাদের গাড়ি চেক করবে, ব্যাগ চেক করবে ইত্যাদি বললো। বলার সাথে সাথে আমরা কাল বিলম্ব না করে তাদের গাড়ির সকল দরজা খুলে দিলাম। তারা গাড়িতে উকি ঝুকি মারছে আর আমাদের সাথে কথা বলছে। দুজন গাড়ির ব্যাকডোর খুলে আমাদের ব্যাগ হালকা উল্টে পাল্টে দেখছে। পরিচয় পাওয়ার পর খুব বেশি ঘাটালো না এবার। তারা আমাদের সাথে এবার বেশ সমীহ করে কথা বলা শুরু করলো। জানতে চাইলো, আপনারা কখন গেছেন এখান দিয়ে? আমরা বললাম আপনাদের সামনে দিয়েইতো একটু আগে গেলাম। যাওয়ার সময় আপনাদের গাড়ি দাড় করানো দেখলাম। আপনারা তো আমাদের কোন ডাক দেননি। পুলিশ আমাদের বললো, এলাকাটা ভালো না। প্রচুর ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
রাস্তার দুপাশেই হাওর। যতদূর চোখ যায় শুধু হাওর। হাওর গিয়ে মিশে গেছে পাহাড়ের পাদদেশে। পাহাড়গুলো সীমানা প্রাচীরের মত দেখা যায়। ডাকাতরা হাওরের এই রাস্তায় নৌকায়, ট্রলারে করে এসে রাস্তার উপর গাছ ফেলে গতিরোধ করে ডাকাতি করে চলে যায়। পুলিশ ভয়ে ভয়ে বললো, এই যে আমরা দাড়িয়ে আছি, এখান থেকে এক কিলোমিটার সরার সাথে সাথে এখানেই কাজ সেরে ফেলবে এমন পরিস্থিতি। একটু সাবধানে যাবেন আপনারা। পুলিশের কথা বলার সময় তাদের চোখে-মুখে বেশ ভয়ের চিহ্ন দেখা গেলো। একবার ভাবুনতো, যে রাস্তায় দাড়িয়ে পুলিশ ভয় পায় সেই রাস্তায় আমাদের কি অবস্থা হওয়ার কথা। আর কেমন পুলিশই বা এই রাস্তায় ডিউটিতে দিয়েছে যে, তাদের নাকের উপর দিয়ে আমরা গাড়ি টেনে সাই সাই করে চলে গেলাম ভোলাগঞ্জ সিমান্তে অথচ তারা টেরই পেলো না। ফেরৎ আসার সময় টের পেলো! তাহলে কী তারা ভয় পেয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলো না ঐ এলাকা থেকে ফিরে আসার সময় কিছু পাবার আশায় আমাদের গাড়ির গতি রোধ করে তল্লাশির নামে হয়রানি করছে? আমরা আশাবাদী মানুষ। তাই পুলিশের কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়ে সর্বাত্বক সহযোগিতা করেছি। পুলিশও আমাদের সাথে ভালোই ব্যবহার করেছে। পুলিশ আমাদের এবার রাস্তা বলে দিলো। আমরা সিলেট শহর থেকে প্রায় বিয়াল্লিশ কিলোমিটার দূরে চলে এসেছি। এখন ভোলাগঞ্জ থেকে সাতাশ কিলোমিটার যেতে হবে যেখানে সালুটিকর বাজার। যে রাস্তায় এসেছি সেই একই রাস্তা দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। যেতে যেতে পরবে সালুটিকর বাজার। সালুটিকর বাজার যাওয়ার পর হাতের বাম দিকে একটা রাস্তা চলে গেছে গোয়াইনঘাট উপজেলায়। এক রাস্তা ধরে যেতে হবে, কোন ডান-বাম নেই! যাওয়ার সময় আমাদের সতর্ক করে দিতে ভোলেনি পুলিশ ভাইয়েরা। বিদায় বেলায় অত্যন্ত আন্তরিক ভাবে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে দিলো।

বিদায় নিয়ে আমরা গাড়িতে বসে হাসাহসি করতে লাগলাম পুলিশ ভাইদের কর্মকান্ড দেখে। কেমন নিরাপত্তাকর্মী যে তাদের চোখের সামনে দিয়ে আমরা ভোলাগঞ্জ সীমান্তে গেলাম অথচ তারা দেখতেই পেলো না! আমাদের উল্টো জিজ্ঞেস করে আপনারা ভোলাগঞ্জ কবে গেছন, কখন গেছেন? কত উদাসীন ভাবে নিরাপত্তার জন্য দাড়িয়ে আছে। নিজেরাই নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছে! কোনো ডাকাত দল বা আতঙ্কবাদীরা এসে হামলা করার কিছুটা পরেই তারা বুঝতে পারবে যে তাদের উপর হামলা হয়েছে! রাস্তায় চলতে চলতে এবার একটু ভয় ভয় লাগছে আমাদের। গাড়ির সব জানালা বন্ধ করে দরজা লক করে দিয়ে এসি ছেড়ে দেয়া হলো। রাস্তার দু’ধারে বিস্তির্ণ বিল বা হাওর। শামীম সরদার গাড়ি ড্রাইভ করছে। প্রশস্ত চকচকে নয়া রাস্তা। শামীম সরদার অত্যন্ত অল্প জায়গায় গাড়ি ঘুরাতে ওস্তাদ। আমাদের অভয় দিলো কোন চিন্তা না করতে। হেডলাইটে রাস্তায় কোন প্রতিবন্ধকতা দেখলে সাথে সাথে গাড়ি ঘুড়িয়ে পিছন দিকে চলে যাবে আর যদি রাস্তায় দাড়িয়ে কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তবে দ্রুত গতিতে উড়িয়ে দিয়ে চলে যাওয়া হবে এমনই সিদ্ধান্ত হলো। তবে সব কথার শেষ কথা হলো, রাস্তার দু’ধারে দেখলাম হাওরে ঘাস দেখা যাচ্ছে। এর মানে হলো হাওরে পানির পরিমান খুবই কম। এই অবস্থায় নৌকা বা ট্রলারে চড়ে ডাকাতি করা সম্ভব হবে না। সাত পাঁচ চিন্তা করতে করতে সূর্য্য মামা উকি দিতে শুরু করেছে। সালুটিকর বাজারের কাছে পৌছে গেলাম বাধাঁহীন ভাবে। বাজারে পৌছে দেখি দু’একজন মানুষ হাটাচলা শুরু করে দিয়েছে। এবার জানালা খুলে তাদের কাছে জানতে চাইলাম গোয়াইনঘাট যাওয়ার রাস্তা কোনটা? চোখে ঘুম ঘুম ভাব আছে আমাদের সবারই। গাড়ি চালাতে আর চলতে কারোরই ভালো লাগছে না। কিন্তু সালুটিকর বাজারে কোন হোটেলও নেই। হোটেল থাকলে এখানেই গা এলিয়ে দিতাম। হোক সে ভালো বা মন্দ হোটেল। অতঃপর সিদ্ধান্ত হলো গোয়াইনঘাট গিয়ে একটা হোটেলে উঠে একটু গা এলানো যাবে। সালুটিকর বাজার থেকে গোয়াইনঘাটের রাস্তার ভালো মন্দ সম্পর্কে কেউ কিছুই বললো না। সালুটিকর বাজার থেকে গোয়াইনঘাট চব্বিশ কিলোমিটার দূরত্বে। এখানে রাস্তার দূরত্ব কোন বিষয়ই না। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম এক বাজার থেকে আরেক বাজার বিশ-ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্ব মামুলি বিষয়। রাস্তায় ঢোকার পরে দেখি বেশ সরু রাস্তা। এরই মধ্যে শুনতে পাচ্ছি ফজরের আযানের ধ্বণি। কিছুদূর যেতেই শামীম সরদার একজনকে জিজ্ঞেস করলো মসজিদ কোথায় আছে। লোকটা মুরব্বি গোছের, মাথায় টুপি পড়া। সে নিজেও নামাজে যাচ্ছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সামনেই মসজিদ দেখিয়ে দিলো। গাড়ি একটু এগিয়ে দেখি মসজিদটা। শামীম সরদার নেমে মসজিদে গিয়ে ওজু সেরে জমায়াতের সহিত নামাজটা আদায় করে নিলো। আমরা গাড়ি থেকে নেমে একটু শরীর সোজা করে আড়ষ্টতা ও জড়তা ভাঙ্গার চেষ্টা করলাম। গাড়ি থেকে নেমেই সবাই দাড়িয়ে গেলো মুত্র বিসর্জন দিতে। ফজরের নামাজে সময় যেহেতু কম লাগে তাই শামীম সরদার জমায়াতের সহিত নামাজ আদাল করে আসার পর আবার চলতে শুরু করলো আমাদের গাড়ি।

সদ্য ভোরের আলো আধারিতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে গোয়াইনঘাটের দিকে। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু ভারতের পাহাড় আর পাহাড়। প্রতিটি পাহাড়ের গায়ে মিটি মিটি জ্বলছে আলো। ছোট ছোট শহরে ভরা পাহাড়গুলো। ভোরের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথে বৈদ্যুতিক আলো ম্লান হয়ে জ্বলছে পাহাড়ের গায়ে। আকাবাকা রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি চলছে। ভোরের আলোতে রাখালের দল গরু নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে মাঠে চড়ানোর জন্য। এখানকার গরুর একটা বিশেষত্ব আছে যা না বললেই নয়। আমাদের সহযাত্রী বাবুল সিকদার গরুর পাল দেখে বলে ভেড়া নিয়ে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, গরুর সাইজ কেমন। একটা খাসিতে যে পরিমান মাংস হবে তারচেয়েও কম মাংস হওয়ার সম্ভাবনা একেকটা প্রাপ্তবয়স্ক গরুর। বাছুরকে মনে হয় ছোট ছাগলের মত। হয়তো মনে করছেন যে দূর থেকে দেখেছি বলে এমনটা দেখেছি। আসলে তা কিন্তু নয়! একদম কাছ থেকে দেখা গরুর সাইজগুলো। এতটা ছোট বা খর্বাকার গরুওযে আমাদের দেশে আছে তা না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। এখানে একটা দুটো গরু নিয়ে কেউ বের হয় না। একেকজন রাখাল ঝাকে ঝাকে গরু নিয়ে রাস্তার ধার ধরে হেটে যাচ্ছে। হয়তো দূরের কোন জেগে ওঠা হাওর বা ফসলহীন মাঠে গরুগুলোকে নামিয়ে দেবে। কোন গরুর গলায়ই কোন রসি নেই। গরুর সাইজ নিয়ে সবাই গাড়িতে হাসাহাসি করছিলো। সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। রাস্তার অবস্থা একটু না বললেই নয়। রাস্তাগুলো বেশ উচু। নিচে পানির স্তর দেখলে কেউই বলবে না এই রাস্তা কোনদিন ডুবতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এমন যে, রাস্তার বেশির ভাগ জায়গায়ই পানি উঠেছিলো। শুধু পানি উঠেছিলো বলা ভুল হবে। প্রচন্ড গতিতে স্রোত বয়ে গেছে রাস্তার উপর দিয়ে। বড় বড় গর্ত তৈরী হয়েছে একেটা। গর্তের পাথর-বালি ধুয়ে ধুয়ে পাশেই স্তুপ হয়ে পড়ে আছে। রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি তার পাশে সরু খাল। খালে একদল মানুষ ফেলনি জাল দিয়ে মাছ ধরছে। গুড়ামাছ পাচ্ছে দেখেই বুঝাযায়। আমরা দুরু দুরু বুকে এগিয়ে চলছি গোয়াইনঘাটের দিকে। ভাঙ্গাচোরা রাস্তার উপর দিয়ে প্রাণটা হাতে নিয়ে পৌছে গেলাম গোয়াইনঘাট। কিন্তু গোয়াইনঘাট গিয়ে কোন হোটেল পাওয়া গেলো না যাতে অন্তত থাকা যায়। আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য পাথর ও বালু কেনা। পাথর ও বালু নেয়ার জন্য শরীয়তপুর থেকে আগেই জাহাজ ভাড়া করে রাখা হয়েছে। জাহাজের চালককে ফোন করা হলে সে আমাদের জানায় যে, বাংলাবাজার নয়াগাঙ্গের পাড় অবস্থান করছেন সে। যাদের জিজ্ঞেস করলাম তারা সবাই বললো আপনারা জাফলং চলে যান। সেখানে ভালো মানের হোটেল পাবেন। জাহাজের চালককে বলা হলো আপনার ওখান থেকে জাফলং যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে এবং কিভাবে যেতে পারবেন? সে জানালো মটর সাইকেলে করে যাওয়া যায় এবং যেতে বিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লাগবে। তাকে বলা হলো একটা মটর সাইকেল নিয়ে এখনই বেরিয়ে যান এবং জাফলং গিয়ে একটা হোটেল বুক করেন যেন আমরা পৌছে সাথে সাথে বিশ্রাম নিতে পারি। সে আমাদের জানালো, তার যেতে যে সময় লাগবে তাতে আমরা তার আগেই জাফলং পৌছে যাবো আর এত ভোরে মটর সাইকেলও পাওয়া যাবে না। স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে নিলাম জাফলং যাওয়ার রাস্তা কোনটা। তারা আমাদের দেখিয়ে দিলো জাফলংয়ের রাস্তা। গোয়াইনঘাট থেকে জাফলংয়ের দূরত্ব মাত্র এগারো কিলোমিটার।

গোয়াইনঘাট উপজেলার সংক্ষিপ্ত পটভূমি সম্মানিত পাঠক বন্ধুদের সাথে শেয়ার না করলেই নয়। আমার নিজের জানার জন্য এবং সম্মানীত পাঠকদেরও জানানোর জন্য সরকারী তথ্য বাতায়ন ঘাটলে দেখা যায়-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি, প্রকৃতির লীলা নিকেতন, প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে গোয়াইন নদীর তীরবর্তী কথিত ০৫ পরগনা (ধরগ্রাম, আড়াইখা, পিয়াইনগুল, পাঁচভাগ ও জাফলং) নিয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা গঠিত। ব্রিটিশ কর্তৃক ভারত উপমহাদেশ দখলের দীর্ঘ ৯০ বছর পর ১৮৩৫ সনের ১৬ মার্চ জৈন্তা ব্রিটিশের অধিকারে আসে। জৈন্তা রাজ্যের পতনের পর ১৮৩৬ সালে গোয়াইনঘাট সিলেট জেলা কালেক্টরেটের অধিনে ন্যস্ত হয়। এলাকার শান্তি-শৃংখলা রক্ষার জন্য ১৯০৮ সালে ব্রিটিশ সরকার গোয়াইনঘাট বাজারে গোয়াইনঘাট থানা স্থাপন করেন। তারপর ক্রমান্বয়ে অন্যান্য প্রশাসনিক কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৮৩ সানের ১৫ এপ্রিল গোয়াইনঘাট থানার মান উন্নীত হয় এবং ১৯৮৩ সনের ১৯ শে জুলাই উপজেলায় রুপান্তরিত হয়।

গোয়াইনঘাট উপজেলার ভৌগলিক অবস্থানঃ ৪৮৬.১০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে অবস্থিত এই উপজেলার চারিদিকে আছে, উত্তরে মেঘালয়, দক্ষিণে সিলেট সদর উপজেলা ও জৈন্তাপুর উপজেলা, পূর্বে জৈন্তাপুর উপজেলা ও পশ্চিমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা। গোয়াইনঘাটের প্রধান নদী সারি, গয়ান, পিয়ান।
ভাষা ও সংস্কৃতিঃ গোয়াইনঘাটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ঐতিহাসিক। এখানে বিভিন্ন ধর্ম ও গোত্রের মানুষের বসবাস। বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তবে বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জন গোষ্ঠী খৃষ্টান ও সনাতন ধর্মাবলম্বী। খাসিয়া, মনিপুরী ও পাত্র সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে এ উপজেলায়। বাঙ্গালীদের ভাষা বাংলা এবং অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠী নিজ নিজ ভাষায় কথা বলে। পনেরশ শতাব্দি শুরু থেকে এ যাবৎ সিলেটবাসীরা যে সমস্ত ভাষায় সাহিত্য রচনা করে গেছেন, সেগুলো হলো-(১) সংস্কৃত, (২) বাংলা, (৩) সিলেটি নাগরী, (৪) আরবী, (৫) ফার্সী, (৬) উর্দু ও (৭) ইংরেজি। এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বিদ্যমান।
প্রাকৃতিক সম্পদঃ প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে ভরপুর গোয়াইনঘাট উপজেলা। খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছেঃ পাথর ও বালু। প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, সোয়াম ফরেস্ট রাতারগুল।
আমরা আবারও আধা ভাঙ্গাচোরা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে পৌছে গেলাম জাফলং। জাফলং ঢুকেই কিছু হোটেল পাওয়া গেলো। সহযাত্রীদের নামিয়ে খোঁজ খবর নেয়া হলো কিন্তু কোন হোটেলই পছন্দ হচ্ছে না। এর পর গাড়ি টান দিয়ে আমরা চলে গেলাম জাফলং জিরো পয়েন্টের দিকে। যাওয়ার আগে একটু ঢু মারলাম তামাবিল স্থল বন্দর। আমার আর শামীম সরদারের ভারতের ভিসা করা ডাউকী বর্ডার দিয়ে। তামাবিল বর্ডার পার হলেই ভারতের ডাউকী বাজার। তামাবিল স্থল বন্দর গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন সীমামত্মবর্তী এলাকা। তামাবিল স্থল শুল্ক বন্দর দিয়েই ভারত থেকে কয়লা আমদানী করা হয়। তামাবিলের অপর প্রান্তে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাউকী বাজার। তামাবিল থেকে মেঘালয় রাজ্যের শিলং পাহাড়ের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করা যায়। শীতের সময় শিলং পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বলে প্রচন্ড ঠান্ডা অনুভূত হয়। তাপমাত্রা সিলেট শহর বা জেলার অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক কম। আশেপাশে রয়েছে অনেক চা বাগান। জাফলং যাওয়ার পথে তামাবিল একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সিলেট থেকে তামাবিলের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার।

জাফলং জিরো পয়েন্টে গিয়ে জাফলং গ্রীণ রিসোর্ট দেখে বেশ ভালোই লাগলো। ভোর ভোর টাইম। রিসেপশনে গিয়ে কাউকেই পাওয়া গেলো না। একটু হাকডাক দিতেই নৈশ প্রহরি চলে আসলো। রুম আছে কিনা জানতে চাইলেই বললো, বসেন, ম্যানেজারকে ডেকে আনছি। নৈশ প্রহরী কিছুক্ষণের মধ্যেই ডেকে নিয়ে আসলেন ম্যানেজারকে। ম্যানেজার বললেন রুমের ব্যবস্থা আছে। আগে আসেন, দেখে নেন রুমগুলো পছন্দ হয় কিনা। আমরা ম্যানেজারের সাথে রিসেপশন থেকে রওয়ানা দিলাম। রিসোর্টের মূল গেইট দিয়ে প্রবেশ করে আমাদের প্রথমে নিয়ে গেলো ডান দিকের তিনতলা একটা ভবনে। খুবই মনোরম ডিজাইনে করা বিল্ডিং এর উপরে লাল টিনের ছাদ। আমি একটু হেভীওয়েট পার্সন হিসাবে পরিচিত, সাথে অলসও বটে। তাই আমি নিচ দিয়ে হাটাহাটি করতে থাকলাম। সফর সঙ্গীরা উঠে গেলো বিল্ডিংয়ে। ঘুরে ফিরে এলো বিরস বদনে। এর পর আরেকটা দ্বিতল ভিলায় আমাদের নিয়ে গেলো। এবার সকলেই ফিরে এলো হাস্যজ্জল বদনে। এসে রিসেপশনে নাম-পরিচয় রেজিষ্টারে এন্টি দেয়া হলো। রিসোর্টের ভিজিটিং কার্ড আমাদের দিলো আর আমাদের ভিজিটিং কার্ড নিয়ে আমাদের সকলের ছবি তুলে রাখলো রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ। প্রধান গেইট খুলে দিতে বলা হলো। প্রধান গেইট পেরিয়ে আমাদের গাড়ি নিয়ে ভিলার সামনে গিয়ে থামলো। দ্বিতল বিশিষ্ট ভবনটার দ্বিতীয় তলায় দুটি রুমে তিনটি কক্ষ ও দুটি বাথরুম। সামনে বিশাল জায়গা যেখানে একটা লোহার ছাতা দেয়া আছে এবং নিচের অংশ গোল টেবিলের মত করা। বসে প্রকৃতি দেখতে দেখতে চা সেবা ও গল্প করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ।

জাফলং গ্রীন রিসোর্ট নামকরণের স্বার্থকতা আছে। মোটামুটি ছোট্ট পরিসরে একটা ছোট্ট গ্রাম। ভিতরে তিনটা ভবন। একটা তিনতলা ভিলা, একটা দ্বিতল ভিলা আর একটা টিনসেড ভবন। ভিতরে পাহাড়ি পথের মত ঢালু পথ। রাস্তার দু’ধারে সুদৃশ্য বাহারি গাছ লাগানো। পুরো রিসোর্টটিতে সবুজের সমারহ। একটা ভবন থেকে আরেকটা ভবনের মাঝে বিস্তর ফারাক বা ফাঁকা জায়গা। সেই ফাঁকা জায়গায় নানা প্রজাতির গাছ লাগানো আছে। ভিতরে কবুতর উড়াউড়ি করছে। বেশ কয়েকটা ছোট ছোট টিনের ঘরের মত খোপ। দুটি দোলনার ব্যবস্থা রয়েছে বাগানে যা আমাদের ভিলার ঠিক সামনেই। রিসেপশন মূল রাস্তার সাথে। সেটাও একটা ভবন। ভিতরে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে রিসেপশনের ছাদে যাওয়া যায়। রাস্তা লাগোয়া তাদের রেস্টুরেন্টও আছে। তবে করোনার কারনে পর্যটক সংকটের কারনে মনে হলো বন্ধ রাখা হয়েছে। আমাদের ভিলার দোতলায় ছাতার নিচে বসে সরাসরি প্রধান সড়ক ও সামনে বিশাল বিশাল ভারতের পাহাড় নজরে পরবে। রাতে সেই দৃশ্যে অন্যরকম মাত্রা যোগ করে। রুম আমাদের জন্য রেডি করার সময়টা খোলা বারান্দা দিয়ে একটু পায়চারি করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই রুম সার্ভিস আমাদের জানালো যে, আমরা এখন রুমে যেতে পারি। আমরা রুমে ঢুকে সবাই পর্যায়ক্রমে ছোট ঘরে ছুটে গেলাম। পরম তৃপ্তি নিয়ে বেরিয়ে যার যার বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। প্রথমে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলাম। নতুন জায়গা, নতুন বিছানায় আমার মত সবারই ঘুম আসতে চায় না। কিন্তু আমরা নিরুপায়। সারারাত জেগেছি সবাই। এখন ঘুম আসুক বা না আসুক শুয়ে থাকতে হবেই। আমরা তাই করলাম। কিছুক্ষণ জেগে থাকার পর কেউ আর টেরই পেলাম না যে আমরা কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙ্গলো অনেক বেলা করে।

ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে ঢুকে ছোট কাজ, বড় কাজ সব সেরে একবারে গোসল করে বের হলো সবাই। রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম রিসোর্ট থেকে। বেরিয়ে একটা হোটেলে ঢুকে সবাই খেয়ে নিলাম। আমরা যেদিন জাফলং পৌঁছাই সেদিন তেমন একটা পর্যটক ছিলো না। একদম খাঁ খাঁ করছিলো। করোনার কারনে পর্যটক শুন্য বিরান ভূমিতে পরিনত হয়েছে জাফলং পর্যটন এলাকা। আমাদের পেয়ে হোটেল মালিক বেশ খুশি হলো। আমাদের খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে হোটেল মালিক কাছে এসে খোঁজ খবর নিলো। কথায় কথায় জানতে চাইলো আমরা কোথায় উঠেছি, কদিন থাকবো, রাতে কি খেতে চাই ইত্যাদি। আমাদের খাওয়া শেষে বাইরে থেকে চা এনেও খাওয়ালো। রাতের খাবার কি খাবো জিজ্ঞেস করার কারন আছে। আমরা তখন যা খেয়েছি সেটা সকালের খাবার আর দুপুরের খাবার একসাথে। তাকে রাতে কি খাওয়াতে পারবে জানতে চাইলে সে বিভিন্ন আইটেমের কথা জানালো। আমরা তাকে দেশি মুরগি আর গুড়া মাছ রান্না করতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। সে বললো পারবে। তবে দেশি মুরগি মানে পাকিস্তানি কক বা সোনালী মুরগিই দেশি হিসাবে রান্না করে বলে আমাদের কাছে সরল স্বীকারোক্তি করলো। তবে আমরা চাইলে একদম সত্যিকারের দেশি মুরগি বলতে যা বুঝায় তারও ব্যবস্থা সে করতে পারবে। আমরা তাকে বললাম একদম পিওর দেশি মুরগি পেলে রান্না করবেন আর সাথে গুড়া মাছ ও পুঁইশাক ভাজি। প্রথম দিনই হোটেল মালিক আমাদের শুটকি ভর্তা সহ বেশ কয়েক আইটেমের ভর্তা পরিবেশন করেছিলো। সেদিন দিনটি ছিলো বৃহস্পতিবার।

জাফলং সম্পর্কে একটু ধারনা নেয়া থাকলে আমার ও সম্মানিত পাঠকের এই ভ্রমণে ঘুরতে ভালো লাগবে। জাফলংঃ বাংলাদেশের সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার অন্তর্গত একটি পর্যটনস্থল। জাফলং সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং এখানে পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত। পর্যটনের সাথে জাফলং পাথরের জন্যও বিখ্যাত। শ্রমজীবি মানুষেরা পাথরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে সেই বহু বছর যাবৎ।
জাফলং এর অপর পাশে ভারতের ডাউকী অঞ্চল। ডাউকী অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাউকী নদী এই জাফলং দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মূলত পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত। সিলেট জেলার জাফলং-তামাবিল-লালখান অঞ্চলে রয়েছে পাহাড়ী উত্তলভঙ্গ। এই উত্তলভঙ্গে পাললিক শিলা প্রকটিত হয়ে আছে, তাই ওখানে বেশ কয়েকবার ভূতাত্বিক জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশে চার ধরনের কঠিন শিলা পাওয়া যায়, তন্মধ্যে ভোলাগঞ্জ-জাফলং-এ পাওয়া যায় কঠিন শিলার নুড়ি। এছাড়া বর্ষাকালে ভারতীয় সীমান্তবর্তী শিলং মালভূমির পাহাড়গুলোতে প্রবল বৃষ্টিপাত হলে ঐসব পাহাড় থেকে ডাউকী নদীর প্রবল স্রোত বয়ে আনে বড় বড় খণ্ডশিলাও যাকে বোল্ডার বলা হয়। একারণে সিলেট এলাকার জাফলং-এর নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাথর পাওয়া যায়। আর এই এলাকার মানুষের এক বৃহৎ অংশের জীবিকা গড়ে উঠেছে এই পাথর উত্তোলন ও তা প্রক্রিয়াজাতকরণকে ঘিরে।
জাফলং-এ পাথর ছাড়াও পাওয়া গেছে সাদামাটি বা চীনামাটিও। যদিও সেখানে মাটি বা বালি পরিশোধন করার মতো কোনো অবকাঠামো নেই। এই এলাকায় যেমন সাধারণ বাঙালিরা বসবাস করেন, তেমনি বাস করেন উপজাতিরাও। জাফলং-এর বল্লা, সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জি ও প্রতাপপুর জুড়ে রয়েছে পাঁচটি খাসিয়াপুঞ্জী। আদমশুমারী অনুযায়ী জাফলং-এ এক হাজার নয়শত তিপ্পান্ন জন খাসিয়া উপজাতি বাস করেন।
ইতিহাসঃ ঐতিহাসিকদের মতে বহু হাজার বছর ধরে জাফলং ছিল খাসিয়া জৈন্তা-রাজার অধীনে থাকা এক নির্জন বনভূমি। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে খাসিয়া-জৈন্তা রাজ্যের অবসান ঘটলেও বেশ কয়েক বছর জাফলংয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা পতিতও পড়েছিল। পরবর্তিতে ব্যবসায়ীরা পাথরের সন্ধানে বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌপথে জাফলং আসতে শুরু করেন, আর পাথর ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলে একসময় গড়ে ওঠে নতুন জনবসতি।
মুক্তিযুদ্ধে জাফলংঃ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সিলেটে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল জাফলংয়ের সীমান্তের ওপারে ভারতের ডাউকীতে। ১৩ জুলাই ইপিআর ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের একটি সশস্ত্র দল জাফলংয়ে ঢোকে। পিয়াইন নদীর ভাটিতে বাংলাদেশ অংশে রাজাকার আজিরউদ্দিনের বাড়িতে ছিল একদল পাকিস্তানী সেনা। উভয় পক্ষের মধ্যে দুই দফা যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানী বাহিনীর পাঁচ সেনা নিহত হলে পাকিস্তানীরা পলিয়ে যায়। একই সময় দুজন মুক্তিযোদ্ধাও আহত হন। এছাড়া জাফলংয়ের পাশে সারি নদীতেও বড় আকারের যুদ্ধ হয়। আর এভাবেই শত্রুমুক্ত হয়ে স্বাধীনতা পায় জাফলং। আর আজ জাফলং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থানের রূপ পরিগ্রহ করেছে। তামাবিল স্থল বন্দরের শুল্ক অফিসের পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণ কবর।
জাফলং-এর বাংলাদেশ সীমান্তে দাঁড়ালে ভারত সীমান্ত-অভ্যন্তরে থাকা উঁচু উঁচু পাহাড়শ্রেণী দেখা যায়। এসব পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরণা ধারা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া ভারতের ডাউকী বন্দরের ঝুলন্ত সেতুও আকর্ষণ করে অনেককে। সর্পিলাকারে বয়ে চলা ডাউকী নদীও টানে পর্যটকদের। মৌসুমী বায়ু প্রবাহের ফলে ভারত সীমান্তে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদীর স্রোত বেড়ে গেলে নদী ফিরে পায় তার প্রাণ, আর হয়ে ওঠে আরো মনোরম। ডাউকী নদীর পানির স্বচ্ছতাও জাফলং-এর অন্যতম আকর্ষণ। পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষকে ঘিরে জাফলং-এ আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলাকে ঘিরে উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো এলাকা। বর্ষাকাল আর শীতকালে জাফলং-এর আলাদা আলাদা সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। বর্ষাকালে বৃষ্টিস্নাত গাছগাছালি আর খরস্রোতা নদী হয় দেখার মতো। তাছাড়া পাহাড়ের মাথায় মেঘের দৃশ্যও যথেষ্ট মনোরম।
জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্রঃ জাফলং অঞ্চলের উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে খাটো জাতের পাম গাছ (খরপঁধষধ ংঢ়বপরবং) দেখা যায়। জাফলং-এ নারিকেল আর সুপারির গাছকে কেন্দ্র করে বাস করে প্রচুর বাদুড়। এছাড়া জাফলং বাজার কিংবা জাফলং জমিদার বাড়িতে আবাস করেছে বাদুড়। যদিও খাদ্য সংকট, আর মানুষের উৎপাতে, কিংবা অবাধ বৃক্ষনিধনে অনেক বাদুড় জাফলং ছেড়ে চলে যাচ্ছে জৈয়ন্তিয়া আর গোয়াইনঘাটের বেঁচে থাকা বনাঞ্চলে কিংবা প্রতিবেশী দেশ ভারতে।
পবিবেশ বিপর্যয়ঃ জাফলং-এর পাথর শিল্প একদিকে যেমন ঐ এলাকাকে সকল অঞ্চলের কাছে পরিচিত করেছে, তেমনি এই পাথর শিল্পের যথেচ্ছ বিস্তারে এলাকার বাতাস হয়ে পড়েছে কলুষিত। যন্ত্রের সহায়তায় উন্মুক্ত উপায়ে পাথর ভাঙ্গার কারণে ভাঙ্গা পাথরের গুঁড়া আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে আর সাধারণ্যের শ্বাস-প্রশ্বাসকে ব্যাহত করছে। এছাড়া সরকারি বিধি নিষেদের তোয়াক্কা না করে নদী থেকে যথেচ্ছ পাথর উত্তোলন নদীর জীববৈচিত্র আর উদ্ভিদবৈচিত্রকে করে তুলেছে হুমকির সম্মুখিন। এছাড়া অনুমোদনহীনভাবে ৩০-৩৫ ফুট গর্ত করে পাথর উত্তোলন নদী এবং নদী অববাহিকার ভূমিকে করছে হুমকির সম্মুখিন। এলাকার প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে বিপুল পরিমাণ গাছ কেটে ফেলার কারণে প্রায়ই সেখানে নানা রোগব্যাধির প্রকোপ লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া উজান থেকে নেমে আসা পাথর আর বালুতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় পিয়াইন নদীর নাব্যতা কমে গেছে। ফলে হঠাৎই উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় নিকটবর্তি অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা; যেমনঃ ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ডাউকী সীমান্তে এরকমই উজান থেকে ধেয়ে আসা ঢলে তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) এর ক্যাম্পসহ বেশ কিছু এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ মে তারিখেও অনুরূপ ঢলে ক্ষতিগ্রস্থ হয় চা-বাগানসহ বস্তি। এছাড়া নিষিদ্ধ ‘বোমা মেশিন’ (স্থানীয় নাম) দিয়ে নদী থেকে পাথর উত্তোলনের কারণে স্থানীয় পিয়াইন নদী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে বিপুল সম্পদের অপচয়ও পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম একটি উদাহরণ।
যাতায়াত ব্যবস্থাঃ ১৯৮০’র দশকে সিলেটের সাথে জাফলং-এর ৫৫ কিলোমিটার সড়ক তৈরি হওয়ার মাধ্যমে দেশের অন্যান্য সকল অঞ্চল থেকে এই এলাকার সাথে সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সড়ক পথে সিলেট সদর থেকে এই স্থানের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। জাফলং জিরো পয়েন্টে রয়েছে তামাবিল স্থল বন্দর, এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারতের সাথে পণ্য আমদানি রপ্তানী করা হয়। বিশেষ করে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করা হয়।
পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দিঃ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মেঘালয়ের কোল ঘেঁষে প্রকৃতি যেন মনের মাধূরী মিশিয়ে নিজ হাতে তৈরী করেছে পর্যটন স্পট বিছনাকান্দিকে। মেঘালয় থেকে নেমে আশা চকচকে শীতল পানি এবং পরপর অবস্থিত সাতটি সবুজ পাহাড়ের হাতছানি অজান্তেই মনে দোলা দিয়ে যায়। পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আশা মনমুগ্ধকর ঝরণা ধারা, পাথরের বিছানার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোত মনকে টেনে নেয় প্রকৃতির গহীনে। শুস্ক ও শীত মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০০-৫০০ জন দেশি-বিদেশি পর্যটক বিছনাকান্দির সৌন্দর্য অবলোকন করে তাঁদের মনকে তৃপ্ত করে।
পর্যটন স্পট রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টঃ প্রকৃতির ব্যতিক্রমী সৃষ্টি রাতারগুল সোয়াম ফরেস্ট একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। পানিতে অর্ধ নিমজ্জিত হিজল, করচ, বরুনা, বেত আর মুর্তার ঘন ঝোপে প্রায় দূর্ভেদ্য উপমহাদেশের একমাত্র মিঠা পানির সোয়াম ফরেস্ট এই রাতারগুল। শীতল বাতাস, পাখির কলতান, নয়নাভিরাম দৃশ্য আর নৌকাযোগে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ানো-এ যেন এক স্বর্গ রাজ্য। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫০-২০০ জন দেশি-বিদেশি পর্যটক রাতারগুল সোয়াম ফরেস্টের সৌন্দর্য অবলোকন করে তাঁদের মনকে তৃপ্ত করে।

বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে আমাদের সকাল হলো! রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে সেই একই হোটেলে ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ সেরে হোটেলের বাইরে এসে একটু পিছন দিকের ঢালে গেলাম। সামনে নয়ন যতদূর যায় সবই ভারত। একেকটা পাহাড়ের পিছনে আরেকটি পাহাড়। ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পৃথক করে দেয়াল তৈরী করে দিয়েছে এই পাহাড়গুলো। পাহাড়ের কোল ঘেষে একদম নিচু থেকে চূড়ার কাছাকাছি পর্যন্ত তিনতলা-চারতলা বিশিষ্ট ইমারত। একটা চার্চও দেখা যাচ্ছে। ক্রুশ দেখে এবং ভবনের নকশা দেখে দূর থেকে স্পষ্টই বুঝাযায় ওটা একটা চার্চ। আমরা কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে এবার কলা বেচতে যাবো মানে যে উদ্দেশ্যে আমাদের আসা সেই দিকে রওয়ানা করবো। এখানে বলে রাখা ভালো যে, যেই জাহাজে আমাদের বালু-পাথর যাবে সেই জাহাজের সুকানি সকালেই আমাদের রিসোর্টে এসে বসে আছে। আমাদের ঘুম ভাঙ্গছে না বলে আর ডাকেনি। সুকানিও আমাদের সাথে খাওয়াদাওয়া করলো। এবার আমাদের গন্তব্য গোয়াইনঘাটের বাংলাবাজার। গোয়াইন নদীর তীর ঘেষে আমাদের গাড়ি চলছে। সরু রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শামীম সরদার গাড়ি নিয়ে গেলো বাংলাবাজারের কাছাকাছি। এর পর আর গাড়ি যাওয়ার পথ নেই সামনে। গাড়ি থেকে নেমে অগত্যা আমরা হাটা শুরু করলাম। শামীম সরদার পাতলা মানুষ এবং প্রচন্ড দ্রুত হাটতেও পারে। আর প্রবাস ফিরৎ ইয়াছিন ভাই মোটাসোটা হলেও হাটায় ওস্তাদ। সমস্যা আমাকে নিয়ে। আমি বললাম তোমরা হাটতে থাকো, আমি পিছনে পিছনে আস্তে আস্তে আসি। এখানে এক ধুধু থেকে আরেক ধুধু যে কত কিলোমিটার তার কোন মাপঝোক নেই মনে হয়! হাটছি তো হাটছিই। হাটতে হাটতে পৌছে গেলাম নয়াগাঙ্গের পাড় নামে এক বাজারে। এই বাজারের পরেই বাংলাবাজার। আমাদের অপর দুই সহযাত্রী রাসেল ও বাবুল সিকদার গাড়িতেই থেকে গেলো। আমি প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে নয়াগাঙ্গের পাড় বাজারে একটা দোকানে বসে পড়লাম। এক কাপ চা চাইতেই লোকটা আগে থেকে রান্ধা চা পরিবেশন করলো। হালকা গরম চা, কোন ধুয়া উঠছে না। ধুমায়িত চা হাতে নিয়ে ঠান্ডা করে খেতে অনেক মজা। কিন্তু এখানে যে ব্যবস্থা আছে তাতে তো মানিয়ে নিতেই হবে। আমি যেহেতু খুব বেশি গরম চা খেতে পারি না তাই আমার জন্য বেশ ভালোই হলো। চটপট চা’টা খেয়ে নিলাম। চা’টা খেয়ে বেশ আরাম বোধ করলাম। আমার চা খেতে খেতে শামীম সরদার পৌঁছে গেছে বাংলাবাজারের কাছাকাছি। ওখানেই পার্টির বাড়ি। আমার বিলম্ব দেখে ফোন দিলো। আমি বললাম আসছি। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি চেয়ার নিয়ে বসে আছে পার্টির সাথে। আমি যাওয়ার পর আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের ভাই হলো এখানকার বালু-পাথর ব্যবসায়ী। সেখানে যাওয়ার পর পরই আবার আমার জন্য চা আনা হলো। আমি আবার চা’তে কখনো না করতে পারি না! দ্বিতীয় কাপ চা’ও খেয়ে নিলাম। ক্লান্তি একটু কমেছে। শামীম সরদার পার্টির সাথে ব্যবসায়ীক কথা বলছে। কিভাবে মাল দেবে, কত করে রেট নেবে, মালের কোয়ালিটি কেমন হতে পারে, পেমেন্ট মুড কেমন হবে ইত্যাদি নিয়ে আলাপ আলোচনা-দরকষাকষি করছে। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। নদীর পাড় দিয়ে একটু হাটাহাটি করলাম। নদীতে প্রচুর জাহাজ। ছোট, বড় বিভিন্ন সাইজের জাহাজ নোঙ্গর করা আছে। কোন কোন জাহাজে ছোট ট্রলার থেকে, কালেকশন নৌকা থেকে বালু টুকরিতে করে যাকে আমরা বলি ওড়া সেই ওড়ায় করে লোড করা হচ্ছে। কালেকশন নৌকা হলো ছোট ছোট নৌকা। যে নৌকায় করে একজন বা দুজন লোক নদী থেকে ডুব দিয়ে দিয়ে বালতি ভরে বালু তোলে। বালতি ভর্তি বালুর সাথে আসে বিভিন্ন সাইজের পাথর। নৌকায় তোলার পরে বালু থেকে পাথর আলাদা করে রাখে। সারা দিনে একেকজন শ্রমিক পাঁচশ থেকে হাজার টাকা আয় করতে পারে। এটাই তাদের জীবন ও জীবিকা। নৌকাগুলো এতটাই ছোট যে আমাকে উঠতে বললে উঠবো না। আর আমি উঠলে নৌকা ডুবে যাবে বলেই আমার ধারণা। নৌকা ও নোঙ্গর করা জাহাজগুলো দেখে নয়ন জুড়ালো। খুবই ভালো লাগলো দেখে। শত শত জাহাজ, ট্রলার ও নৌকা। নদীর তীর জুড়ে বিশাল বিশাল পলেথিনের ছাওনি করা আছে। ছওনির ভিতরটা একদম ফাঁকা। দেখে বুঝলাম এখানে একদম নিম্ন আয়ের শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করা হয়। সেই সব শ্রমিকদের রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা আরকি! গরিবের ঘুম-বিশ্রাম মানে কোন রকম চোখ বুজে পড়ে থাকা। সারাদিন হাড়ভাঙ্গ পরিশ্রম শেষে গা এলিয়ে দিলেই শান্তির ঘুম। কিন্তু হাজার কোটি টাকার মালিক রাতে ঘুমাতে পারে না। একাধিক ঘুমের বড়ি খেলেও ঘুম আসে না। সারাদিন চিন্তায় থাকে কখন কারখানায় আগুন লাগে, কোথায় জাহাজ ডুবলো, কখন সরকার ক্ষেপে গিয়ে এনবিআরকে দিয়ে দাবড়ানি দিলো, কখন অবৈধ অর্থের জন্য দুদক দরজায় কড়া নাড়লো এই সব ভেবে ভেবে আর ঘুম হয় না! নদীর তীরে ছোট খাটো কিছু হোটেল রেস্তরা গড়ে উঠেছে। নিম্ন আয়ের শ্রমিকরা সামান্য টাকায় কোন রকম পেট ভরে খেতে পারে সেই ব্যবস্থা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধা নেমে আসছে। যে রাস্তা দিয়ে আমরা গাড়ি নিয়ে আসছি তাতে সন্ধার পরে গাড়িটা নিয়ে যাওয়া কঠিন ও বিপদজনক হয়ে যেতে পারে। শামীম সরদার ড্রাইভার রাসেলকে ফোন করে বলে দিলো, তুমি গাড়ি নিয়ে জাফলং গ্রীণ রিসোর্টে চলে যাও। আমরা মটরসাইকেল দিয়ে চলে আসবো। পার্টির সাথে কথাবার্তা শেষে আমাদের দুটি মটর সাইকেল ঠিক করে দেয়া হলো। মানুষ তিনজন, কিন্তু মটরসাইকেল কেন দুটি প্রশ্ন জাগতে পারে মনে। কারন, একটা মটর সাইকেলে তিনজনতো উঠাই যায়! কিন্তু আমার সাথে আরেকজন বসার জায়গা পাবে না। তাই শামীম সরদার আর ইয়াছিন একটা মটর সাইকেলে উঠলো আর আমার জন্য আরেকটা মটর সাইকেল নেয়া হলো। আমরা আকাবাকা গ্রামীণ পথ ধরে জাফলং গ্রীণ রিসোর্টে পৌঁছে গেলাম। আগের রাতে এক ফোটাও ঘুম হয়নি। ভোরে ঘুমাতে যাওয়ায় দিনেও তেমন একটা ঘুম হয়নি। ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ একসাথে করে সাথে সাথে বেরিয়েছি কলা বেচতে। কলা বেচা শেষে শরীর সবারই কিছুটা ক্লান্ত। তার উপর রিসোর্টে পৌছার পর পরই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। সবাই রিসোর্টে পোশাক পরিবর্তন করে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সেই ঘুমে কখন যে সন্ধা পেরিয়ে গেলো আমাদের তা টেরই পেলাম না। রাত নয়টার দিকে সবাই বিছানা ছাড়লাম। ফ্রেশ হয়ে আবার বেরিয়ে গেলাম হোটেলে রাতের খাবারের জন্য। খাওয়া দাওয়া সারার মাঝেই ঝুম বৃষ্টি চলছে বাইরে। বাইরে অঝর ধারায় ঝড়তে থাকা বৃষ্টির একটা মোহনিয় রূপ আছে, আছে অপুর্ব এক সুরের ঝংকার। খাবার খেতে খেতে বৃষ্টির রূপ-সুর উপভোগ্য ছিলো। খাওয়া শেষ হতে হতে বৃষ্টিও কিছুটা কমলো। এখন ইলশেগুড়ি টাইপের বৃষ্টি হচ্ছে, এতে গা ভিজে না কিন্তু শুকনাও থাকে না! এই রাতে আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। তার উপর আমাদের গাড়ির ফুয়েলও শেষের দিকে। গোয়াইনঘাট থেকে জাফলং আসার পথে কোথাও ফিলিং স্টেশন পাইনি। এই রাস্তায় কোন ফিলিং স্টেশন নাই। আছে জাফলং-সিলেট রুটের রাস্তায়। তাই আর রাতে কোথাও বের হওয়া হলো না। খাওয়া শেষে আবারও বাইরে হোটেলের পিছনের ঢালে চলে গেলাম। পাহাড়ের গায়ে ঝলমল করছে আলো। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে আমরা আলোকিত ডাউকী বাজার, পাহাড়ের রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। এর পর আস্তে আস্তে রওয়ানা দিলাম রিসোর্টের দিকে। রিসোর্টে গেলে কি হবে, আমরা তো বাড়িতে থাকলেও এত তাড়াতাড়ি ঘুমাই না। তাই সবাই দ্বিতল রিসোর্টের সামনের খোলা বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। সুন্দর ছাতার নিচে বসে সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। পাহাড়ী এলাকায় গভীর রাতের নিজস্ব সৌন্দর্য রয়েছে। আমরা সবাই বসে সেই সৌন্দর্য উপভোগের সাথে সাথে গল্পে মেতে উঠলাম। বেশ কিছুক্ষণ আগের রাত জাগা, সারা দিনের ঘোড়াঘুড়ি নিয়ে চললো মূল্যায়ন। হঠাৎ আমাদের গল্পে বাদসাধলো বৃষ্টি। পাহাড়ে ঘন ঘন বৃষ্টি হয় আবার চলেও যায় দ্রুত। বৃষ্টির তাড়ায় আমরা চলে গেলাম কটেজের ভিতরে। রাত অনেক হয়েছে। পরদিন আবার বের হতে হবে। শরীরকে একটু রিচার্জ করা দরকার। মহান সৃষ্টিকর্তা একটা রিচার্জেবল বডি তৈরী করে যেন দুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছেন! ক্লান্ত হলেই একটু বিশ্রাম নিলে অলৌকিকভাবে রিচার্জ হয়ে যায় শরীর মন। সেই সাথে দরকার সকলের মোবাইল রিচার্জ করা। আমরা সবাই যার যার মোবাইল চার্জারে সেট করে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ টিভিতে গান দেখতে দেখতে ঘুমে চোখ বুজে আসতেই টিভি বন্ধ করে দিলাম। এর পর কখন যে নিদ্রার সাগরে ডুবে গেছে আমাদের দেহ-মন তা কেউ বলতে পারবো না।

শুক্রবার একটু সকাল সকাল আমাদের সবারই ঘুম ভাঙ্গলো। শুক্রবার যেহেতু জুমা বার। সবাই একটু আগে আগে রেডি হয়ে মসজিদের দিকে রওয়ানা দিলো। জুমার নামাজ শেষে সকলে মিলে সেই খাবারের হোটেলে ঢুকলাম। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে হাটতে হাটতে চলে গেলাম বিজিবির ক্যাম্পের কাছে জিরো পয়েন্টে। আগে জিরো পয়েন্ট থেকে নদীর তটে নামার জন্য কোন ব্যবস্থা ছিলো না। সবাই পাহাড়ী ঢাল বেয়ে নিচে নদীর তটে নেমে যেতো। যারা একটু আমার মত হেবিওয়েট ও ভীতু ধাচের তারা উপরে দাড়িয়েই সৌন্দর্য দেখতো। এর আগেও একবার আমি, শামীম সরদার, শহীদ তালুকদার, সাংবাদিক ইস্রাফিল এসেছিলাম জাফলং। সেই বার আমি উপরে দাড়িয়ে ছিলাম একা আর ওরা নিচে নেমে নৌকা দিয়ে ঘুড়ে বেড়িয়েছিলো নদীতে। এসে আমাকে লোভনীয় দৃশ্যের গল্প করেছিলো। আমি শুনেই মুগ্ধ হয়েছি কিন্তু যাওয়ার সাহস হয়নি। এখন সিলেট জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সুন্দর সিঁড়ি তৈরী করা হয়েছে একদম নিচ পর্যন্ত। সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর নামার পরে একদম নিচে আর নামার সাহস হলো না আমার। আমি দাড়িয়ে গেলাম। শামীম সরদার বললো, চলো নিচে যাই। আমি বললাম তোমরা যাও। আমি এখানেই দাড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করি। কিন্তু নাছোরবান্দা শামীম সরদার আমায় অভয় দিয়ে বললো, তুমি আস্তে আস্তে নিচে নামো। উঠার সময় আমরাও আস্তে আস্তে উপরে উঠবো, তোমাকে সঙ্গ দিব, তুমি একা বোধ করবে না, কোন চিন্তা নাই। আমরা আছিতো তোমার সাথে। নিচে অনেক সুন্দর দৃশ্য আছে দেখার মত যা মিস করবা যদি না নামো, আগেরবারও তুমি নিচে নামোনি, অনেক কিছু মিস করেছো, এবার আর মিস করা ঠিক হবে না, এসো। আমি উঠার সময় আমাকে সঙ্গ দেয়ার প্রতিশ্রুতিতে আস্বস্ত হলাম। নিচে নামার পর দেখি এলাহি কান্ড। লোকে লোকারণ্য। উপরে যে পরিমান পর্যটক ও দোকান পাট আছে তার কয়েক গুণ পর্যটক ও দোকানপাট আছে নিচের এই নদী তটে। এখান থেকে ভারতের ডাউকীর ঝুলন্ত লোহার ব্রিজটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখের সামনে ভারতের ডাউকী এলাকার বিশাল বিশাল পাহাড়। আমরা পাহারের অদূরেই দাড়িয়ে আছি। নদীতে শত শত শ্রমিক ডুব দিয়ে বালতি ভরে মোটা বালু তুলছে আর ট্রলার, নৌকায় স্তুপ করে রাখছে। বালু তোলা শ্রমিকদের কাছে আমরাই যেন পর্যটনের বিষয়বস্তু। আমরা একটা ভ্রাম্যমান হোটেলে বসলাম। উপরে রঙ্গীন কাপড়ের পর্দা টানানো। পর্দার উপরে প্রচন্ড রোদের চোখ রাঙ্গানী পর্দার নিচে বসেও আঁচ করতে পারছিলাম। ছোট ছোট হোটেলগুলোতে অত্যন্ত ন্যায্যমূল্যে ভ্রমণ পিপাসু মানুষ দুপুরের খাবার খাচ্ছে। এক টুকরা গরুর মাংস, শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা, এক প্লেট ছোট মাছ, ডাল ও ভাত এর দাম মাত্র আশি টাকা। অথচ উপরে আমরা যা খাওয়া দাওয়া করলাম তাতে জনপ্রতি দুইশত টাকার উপরে খরচ হয়েছে! আমরা যে খুব আহামরি খেয়েছি তা কিন্তু নয়। ভ্রমণে নিয়ন্ত্রিত খাবার গ্রহণ করতে হয় এবং আমরা সেটাই করি। ভ্রমণে প্রাণ ভরে উপভোগ করি পেট ভরে ভোগ করা থেকে বিরত থাকি। আমরা দোকানটায় বসে চা খেলাম। লাল চা বিক্রি করছে পাশের দোকানে, ডাক দিতেই আমাদের দৌড়ে এসে লাল চা দিয়ে গেলো। মানুষ দলে দলে নামছে আর ছোট নৌকা, ছোট ট্রলারে করে ওপার যাচ্ছে। ওপারে ঝর্ণা দেখার জন্য মানুষ লাইন দিয়ে হেটে যাচ্ছে, দেখে মনে হয় তাবলিগের কাফেলা। বর্ণিল পোশাক পড়া, নানান বয়সী মানুষের ঢল নামছে সিঁড়ি দিয়ে। দেখলে কেউ বলতে পারবে না যে আমাদের দেশে কখনো করোনা নামের কোন রোগ এসেছিলো বা এখনও আছে!

আমাদের এবার যেতে হবে কলা বেচতে! গোয়াইনঘাট ইটের ভাটার কাছে নদীর পাড়ে আমাদের বালুবাহী জাহাজ লোড লোড করা অবস্থায় অপেক্ষায় আছে। আমাদের সেখানে যেতে হবে। গোয়াইনঘাট থেকে গাড়ি নিয়ে আমরা জাফলং এসেছি, রাস্তার কী অবস্থা সেটা দেখার সুযোগ হয়েছে স্বচোক্ষে। সেই রাস্তা দিয়ে দ্বিতীয়বার যাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না! এর চেয়ে নদীপথে যাওয়াই আরামদায়ক হবে, বিকল্প পথ না থাকলে হেটেও যাওয়া ভালো! আমরা চা খেতে খেতে ট্রলার চালককে ডাক দিলাম। একজন এসে আমাদের কাছে তিন হাজার টাকা চাইলো। আমরা একটু দরদাম করে দুই হাজার টাকায় ঠিক করলাম। তবে শর্ত হলো আমাদের আগে ঝরণা দেখাবে, এর পর গোয়াইনঘাট নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে। আমাদের এই জিরো পয়েন্ট ঘাটেই নামিয়ে দিবে এবং শামীম সরদার কথামত আমাকে সঙ্গ দিয়ে আস্তে আস্তে উপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠবে। আরেক দফা চা খেতে খেতে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম সহযাত্রী বাবুল সিকদার ও রাসেলের জন্য। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমরা ফোন দিতে শুরু করলাম দুজনের ফোনে। কিন্তু রাসেল আর বাবুল সিকদার ফোন ধরছে না। ট্রলার যেহেতু রিজার্ভ করা হয়েছে শুধু আমরা তিনজন গিয়ে কি লাভ? আর আমরা ঘুরে সৌন্দর্য উপভোগ করবো, তারা করবে না এটা হতে পারে না। তাই অপর যাত্রী দুজনের জন্য অপেক্ষার ফাঁকে ফোন দেয়া হচ্ছে। বাবুল সিকদার আর রাসেল খেয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমাদের গোয়াইনঘাট গিয়ে আবার জাফলং ফিরতে হবে। গোয়াইনঘাট থেকে জাফলংয়ের সড়ক পথে দূরত্ব এগারো কিলোমিটার হলেও নদী পথে ঘুরে যেতে দূরত্ব বেড়ে দাড়িয়েছে প্রায় বিশ কিলোমিটারের মত। রাতে ছোট ট্রলারে নদী ভ্রমণ বিপজ্জনক। তাই আর দেরি করা সম্ভব হলো না। ট্রলার আমাদের তিন জনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো। প্রথমে ঘাট থেকে নদীর ওপারে নিয়ে গেলো। ঘাটে নেমে বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর ঝরণা দেখা যাবে। যেতে আসতে সময় লাগবে কমপক্ষে বিশ থেকে ত্রিশ মিনিট, জানালো ট্রলার চালক। আমরা যেহেতু অনেক দূরে যাবো-আসবো তাই আর এখানে সময় নষ্ট করতে আগ্রহী হলাম না। ট্রলার চালককে বললাম আমাদের এখান দিয়েই ভারতের যতটা কাছাকাছি যাওয়া যায় গিয়ে একটু ঘুড়িয়ে গোয়াইনঘাট ইট ভাটায় নিয়ে যাও। ট্রলার ঘুড়িয়ে দিলো গোয়াইনঘাটের দিকে। চালক আমাদের বললো, আর সামনে যাওয়ার অনুমতি নেই, বেশি সামনে গেলে ভারতীয় জওয়ানরা গুলি করে দেবে! রওয়ানা দিয়ে প্রথমেই পুরান ঘাটে নোঙ্গর করে প্রয়োজনীয় ফুয়েল নিয়ে নিলো। এর পর আমাদের নিয়ে চলতে শুরু করলো ট্রলার। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখি নদীর বুক চিরে বুদবুদ বের হচ্ছে। ট্রলার চালক বললো এখানে গ্যাস আছে। গ্যাস বের হচ্ছে। নদীর ওপারেই বিশাল রাস্তার ধার ঘেষে বিস্তির্ণ চা বাগান। গোয়াইনঘাট থেকে জাফলং আসার ব্রিজের নিচ দিয়ে চলে গেলো আমাদের ট্রলার। আমরা চলছিতো চলছিই। দশ কিলোমিটারের মত যাওয়ার পর মূল নদী থেকে সরু খালে ঢুকলো চালক। আমরা জানতে চাইলে বললো, মূল নদীতে স্রোত বেশি এবং পথও অনেক দীর্ঘ। আমরা যদি মূল নদী দিয়ে যাই তাতে স্রোতের কারনে বেশি সময় লাগবে। আমরা সরু খালের ভিতর দিয়ে চলছি। একটু দূরে দূরে পনির নাব্যতে এতটাই কম যে চালক ও তার হেলপার নেমে ট্রলার ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। এর পর বিশাল বিল বা হাওর। মাঝে মাঝে ছোট ছোট দীপের মত চর আছে কোথাও কোথাও। বিলে প্রচুর গরু ও মহিষ চড়াচ্ছে কৃষক। চলতে চলতে আমরা পৌছে গেলাম গোয়াইনঘাট ইটভাটার কাছে। গিয়ে আমাদের জাহাজ খুঁজে বের করলাম। জাহাজের শুধুমাত্র দেড়-দুই ফিট পানির উপরে আছে, বাকীটা বালুর ভারে তলানো। শামীম সরদার ও ইয়াছিন ভাই জাহাজে নেমে বালু নেড়ে চেড়ে কোয়ালিটি দেখলো। বেশ ভালো বালু উঠেছে। বালুগুলো ড্রেজিং করে লোড করেছে। এখানে যে জায়গায়ই ড্রেজার সেট করে সেখানেই বালু উঠে। তাও সাধারণ বালু নয়। আমাদের কাছে যেটা মহা মূল্যবান মোটা বালু। আমাদের এলাকায়ও নদীতে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলে। তবে সেটা ভিটিবালু নামে পরিচিত। সরবরাহকারীরা আমাদের জন্য দাড়িয়ে আছে নদীর তীরে। জাহাজ থেকে নামার পরে তাদের সাথে কথাবার্তা শেষ হলো। শামীম সরদার চেকের মাধ্যমে লেনদেন পরিশোধ করার পরে তারা চলে গেলো উপজেলা পরিষদের দিকে। প্রতিটি জাহাজের জন্য রয়্যালিটি দিতে হবে সরকারকে। চালানের কপি, রয়্যালিটি সনদসহ জাহাজ ছাড়বে শরীয়তপুরের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে ছাড়ার পরে অন্তত চার দিন সময় লাগবে শরীয়তপুর যেতে। দিন-রাত চালালেই চারদিনে পৌছাতে পারবে শরীয়তপুর। পার্টির কাছে বিদায় নিয়ে নিলাম আমরা। এবার আবার ফেরার পালা। যাওয়ার আগে নদীর পাড়ে ছোট্ট একটা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার জন্য গেলাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। দোকানে চা নেই। দোকানের সামনে ছোট ছোট কলা ঝুলছে। পাহাড়ি কলা। আমরা একেকজনে তিন-চারটা করে খেয়ে নিলাম। আমাদের নিয়ে এসেছে যে ট্রলার তার হেলপারের বয়স হবে সর্বোচ্চ দশ থেকে বারো বছর। ছেলেটাকে দেখলে মায়া হয়। যে বয়সে তার দূরন্তপনা করার কথা, হেসে খেলে বেড়ানোর কথা, স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়সে সে একটা ট্রলারের হেলপার হিসাবে কাজ করছে। এটা শিশু শ্রমের আওতায় পরে যা কিনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু কি করার আছে? যে ছেলেটা ট্রলারটা চালাচ্ছে সেও সদ্য কৈশর পেরিয়েছে। ওর বয়স হিসাবে কাজ করার কথা নয়, নিতান্তই পেটের দায়ে কাজ করছে দুজনেই! ছোট্ট শিশুটি যখন তখন নদীতে নেমে যাচ্ছে, ট্রলারের পাখায় ময়লা ধরলে বা ট্রলার নাব্যতার কারনে আটকে গেলে টুপ করে নেমে যায় এবং ঠেলে পাড় করে। পরনের উপরই ছেলেটার পাতলা মলিন প্যান্ট ভিজছে আবার শুকিয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ ট্রলারে বসে থাকে ততক্ষণ পানি সেচার কাজ করে। খুবই কষ্ট লাগছে শিশুটাকে শ্রম দিতে দেখে। কিন্তু কি করার আছে আমাদের? দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার কারনে ও দরিদ্র ঘড়ে জন্ম নিয়ে এ কাজ করা ছাড়া ওর কোন উপায় নেই। জন্মই ওদের যেন আজন্ম পাপ! ছোট্ট ছেলেটাকে ও ট্রলার চালককে ডাক দিয়ে কাছে এনে ছোট ছেলেটার হাতে একটা বড় বনরুটি ধরিয়ে দিলাম, সাথে দিলাম কলা। ছোট্ট ছেলেটা পরম তৃপ্তির সাথে গোগ্রাসে গিলছে। ওকে বললাম আস্তে আস্তে খাও বাবা, তারাহুরার কিছু নেই। ট্রলার চালক একটু বনেদী টাইপের মনে হলো। সে নিলো প্যাকেটজাত কেক! খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা আবার ট্রলারে উঠে বসলাম। চলতে শুরু করলো আমাদের ট্রলার।

গোয়াইনঘাট ইট ভাটার পাড় থেকে ছেড়ে ট্রলার নদী দিয়ে কিছুদূর আগানোর পরে আবার ঢুকে গেলো হাওরের মধ্যে। নদী মুখে ঢুকতেই চোখ পড়লো ভেসালের দিকে। ট্রলার চালককে দিয়ে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো মাছ আছে কী না বেচার জন্য। ভেসালের লোক জানালো, নাই। এভাবে হাওর দিয়ে চলতে চলতে বেশ কয়েকটি ভেসালিকে জিজ্ঞেস করা হলো মাছ আছে কী না। সবাই উত্তর দিলো বেচার মত মাছ নেই। আমাদের মাথায় ভেসাল থেকে তাজা মাছ কেনার ঝোক উঠেছে। তাই, যাকেই দেখি তাকেই জিজ্ঞেস করি। হাওরের মাঝামাঝি একজন আওয়াজ দিলো, আসেন, মাছ আছে। আমরা ভেসালির কাছে ট্রলার নিয়ে গেলাম। আমরা যাওয়ার পর ভেসালি তার ভেসালের জাল ভাসালো। কয়েকটা ছোট মাছ পেলো তখনই। ভেসাল থেকে নৌকায় নেমে আমাদেরকে মাছ দেখালো। বললাম ঝুড়িতে তোলেন। ভেসালি ঝুড়িতে সবগুলো মাছ তুলছে না। সবগুলো তুলতে বললে সে বলে, না না, খাওয়ার মাছ লাগবে বাড়িতে, সব মাছ বেচা যাবে না। আমরা বললাম আরো পাবেন তো, সেই মাছ বাড়ি নিয়ে যাবেন। কিন্তু সে আমাদের বললো, না, সন্ধা হয়ে গেছে, বাড়ি চলে যাবো। তার পর তাকে আমরা বললাম, তাহলে আপনি বড় বড় মাছগুলো রেখে দেন বাড়ির জন্য। আমাদের ছোট মাছগুলো দিয়ে দেন। ঝুড়িতে মাছ তোলার পরে দাম বলতে বললে সে ছয়শত টাকা দাম চাইলো। আমরা বললাম এই মাছের দাম এতো টাকা হবে না। কম কত বলেন? সে বললো পাঁচশত টাখা দিয়ালাও। আমরা চারশত টাকায় দরদাম ঠিক করে মাছ নিয়ে নিলাম। মাছ নিতে নিতে ভেসালি জানালো, সে একজন প্রবাসী। দীর্ঘদিন থেকে সৌদি আরব থাকে। দেশে আসার পরে করোনার কারনে আর যেতে পারেনি। এই যে জমির উপর ভেসাল পেতেছে সেই বিশাল জমিটা সে কিনেছে আশি লক্ষ টাকা দিয়ে। সখের কারনে ভেসাল পেতে বসেছে। আমরা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম! আশি লক্ষ টাকা দিয়ে যে জমি কিনতে পারে সে কিনা ভেসাল বাইছে এবং বাড়ির জন্য অল্প কিছু মাছ রেখে চারশত টাকার মাছ বেচছে?
একটা গল্প বলি তাহলে। এক লোক এক ভিখারীকে বললো, ধরেন, আপনাকে যদি দুই হাজার কোটি টাকা দেয়া হয় তবে আপনি সেই টাকা দিয়ে কি করবেন? ভিক্ষুক বললো, আমি সেই টাকা দিয়ে একটা পাঁচ তাঁরকা সুপার মার্কেট বানাবো! লোকটা আবার বললো, তার পরে আপনি কি করবেন? ভিক্ষুক উত্তরে বললো, এর পর আমি ঐ পাঁচ তাঁরকা সুপার মার্কেটের সামনে একা দাড়িয়ে ভিক্ষা করবো, আর কাউকে ওখানে ভিক্ষা করতে দেবো না! এবার বুঝুন অবস্থা! ভিক্ষুকের চিন্তা-চেতনা কেমন! আমরা ভেসালির কথা শুনে ট্রলারে ভিক্ষুকের গল্পটা মনে করে হাসাহাসি করলাম। আশি লক্ষ টাকা দিয়ে জমি কিনে সে একাই ভেসাল বাইবে, আর কাউকে ভেসাল বাইতে দিবে না! অনেকটা ভিক্ষুকের মত চিন্তা ভাবনা! যে প্রবাসী আশি লক্ষ টাকা দিয়ে হাওরে জমি কিনতে পারে তার বাড়ির অবস্থা কেমন তা অনুমান করলেই বুঝাযায়। সেই লোক একটা হাফ প্যান্ট পরে আধা ভিজা অবস্থায় ভেসাল বাইছে এবং অল্প কিছু মাছ বাড়ির জন্য রেখে চারশত টাকার মাছ বিক্রি করলো!

মাছ কিনে আমাদের ট্রলার গন্তব্যে উদ্দেশ্যে চলতে শুরু করলো। মাথা টনটন করছে ব্যথায়। দীর্ঘক্ষণ ট্রলারে বসে থেকে ভটভট শব্দে মাথা ধরে গেছে। দেখতে দেখতে সন্ধা নেমে এসেছে। একটু ভয় ভয়ও করছে। আমরা সবাই যদিও সাতার জানি। তারপরেও অন্ধকার রাত, তার উপর শুনশান নিরব জায়গায় ডাকাতের ভয়ও লাগছে। ট্রলার হাওড় থেকে ছোট ছোট খাল পেরিয়ে মূল নদীতে নামলো। নদীতে হালকা স্রোত ও ঢেউ আছে। অন্ধকার নেমেছে বেশ ভালোই। আমাদের মাথা ব্যথার কারনে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ট্রলারে বসে থাকা যাবে না। শামীম সরদার জাফলং ব্রিজের কাছে গাড়ি নিয়ে চলে আসতে বললো রাসেলকে। ট্রলার চালককে বললো আমাদের ব্রিজের ঢালে নামিয়ে দিও। ব্রিজ থেকে জিরো পয়েন্ট ঘাটে যেতে অন্তত আরো এক ঘন্টা লাগবে। ঘন্টাখানেক চলার পর ট্রলার গিয়ে থামলো ব্রিজের নিচে। সেখানে আমাদের নামিয়ে দিলো। আমরা নদীর ঢাল থেকে উপরে উঠে গাড়িতে করে চলে গেলাম জাফলং জিরো পয়েন্টের সেই হোটেলে। হোটেলে গিয়ে মাছগুলো দিয়ে বলা হলো মাছগুলো আমাদের রান্না করে দিবেন রাতের খাবারের সাথে। হোটেল মালিক একটু অবাক হলো। ভাবছে আমাদের জন্য যে রান্না করেছে তা হয়তো আমরা খাবো না! আমরা বুঝতে পেরে তাকে আস্বস্ত করলাম, আপনাদের খাবারও খাবো। এই মাছগুলো ভেসাল থেকে আমরা কিনে এনেছি সখ করে। আমাদের একটু রান্না করে দিবেন, এজন্য যা খরচ নেবেন তা দেবো। তবে মাছগুলো ভেজে রান্না করবেন না, মাখা মাখা করে রান্না করবেন। হোটেল মালিক তার কর্মীদের নির্দেশ দিলো, স্যারেরা যেভাবে বলছে সেভাবে রান্না করে রেখো। আমরা হোটেলে মাছ রান্না করতে দিয়ে রুমে চলে এলাম। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় শরীর খারাপ লাগছে। বিশ্রাম নিলে কমতে পারে সেই ভেবে শুয়ে পরলাম। কিছুটা বিশ্রাম নেয়ার পরে রাতের খাবার খাওয়ার সময় হলো। শামীম সরদার ডাক দিলো, উকিল ওঠো। খেতে যেতে হবে। মাথা ব্যথা খুব একটা কমেনি। উঠে ফ্রেশ হয়ে সবাই গেলাম হোটেলে। অল্প ভাত আর বেশি বেশি মাছ খেলাম সবাই। মাছের স্বাদ সম্পর্কে একটু না বললেই নয়। হাওড়ের মুক্ত জলাশয়ে বেড়ে ওঠা মাছগুলো স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। যেমন নরম তেমনি স্বুস্বাদু। সবাই বেশ তৃপ্তিসহকারে মাছই খেলাম। হোটেল মালিক তার খাবারের দাম ধরলেও মাছ রান্না করার জন্য কোন বিল ধরলো না। আমরা মাছ রান্নার বিলের কথা বললে তিনি বিনয়ের সাথে বললো, কিযে বলেন স্যার। আপনারা আমাদের গেষ্ট। সামান্য মাছ রান্না করেছি তার আবার বিল দিতে হবে? কথাগুলো শুনে বেশ ভালো লাগলো। রাতের খাবার খেয়ে আবার রুমে চলে আসলাম। মাথা ব্যথা শুধু আমারই হয়নি। আমাদের সফর সঙ্গী ইয়াছিন ভাইয়েরও একই অবস্থা। তারও প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। সে বাইরে থেকে ঔষধ নিয়ে আসছে। আমাকে বললো একটা খান, দেখবেন ভালো লাগবে। প্রচন্ড ব্যথার কারনে চিন্তা করলাম একটা খেয়েই নেই। একটা গ্যাসটিকের ঔষধসহ মাথা ব্যথার টেবলেট খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পরে বেশ আরাম বোধ করছি। এবার শুরু হলো সারাদিনের চুল চেরা বিশ্লেষণ ও আড্ডা।

রাসেল আর বাবুল সিকদারকে ধরা হলো তোমরা কেন ফোন ধরলে না? দুজনেই বললো তারা আমাদের খোঁজ করে পায়নি। তারাও নাকি বিজিবির জিরো পয়েন্টে সিঁড়ির কাছেই বসে ছিলো। মোবাইল ছিলো রুমে তাই আমাদের কল ধরতে পারেনি। বাবুল সিকদার সিঁড়ির কাছে বসা ছিলো। আগের দিন বাবুল সিকদার কিছু কেনাকাটা করেছে জাফলং পর্যটন মার্কেটে ঘুরে। একটা ফতুয়া কিনতে গিয়ে দোকানিকে ঝাড়ি দিলো, এতো দাম চান কেন, গত সপ্তাহেইতো নিলাম একটা। আমিতো প্রতি সপ্তাহেই আসি! ঝাড়িতে বেশ কাজ হয়েছে! বাবুল ভাইর কাঙ্খিত দামেই ফতুয়াটা দিয়ে দিলো। আরেক দোকান থেকে একটা কালো সানগ্লাস কিনলো একই ঝাড়ি দিয়ে। বাবুল ভাই যেই দোকানেই যায় সেই দোকানেই দামাদামির সময় একটা কথা বলে, গত সপ্তাহেইতো নিলাম একটা, এত দাম চান কেন, আমিতো প্রতি সপ্তাহেই আসি! অথচ আগেই বলেছি, বাবুল সিকাদর পনের বছর আগে একবার সিলেট এসেছিলো, জাফলংতো এই প্রথাম এবং হতে পারে এটাই শেষ! তার ঝাড়ি শুনে আমি বলেছিলাম, ভাই দেশের এই করোনা কালে অনেকেই দোকান খোলে না অনেক দিন হলো। হতে পারে আজ অথবা কালই প্রথম দোকান খুলেছে দোকানী। আপনি যদি বলেন যে, গত সপ্তাহেইতো আসলাম, গত সপ্তাহেইতো নিলাম। দেখবেন দোকানী কিছু না বললেও মনে মনে ভাববে যে লোকটা কত বড় টাউট, বাটপার ও মিথ্যাবাদী। আবার কেউ বলেও বসতে পারে যে, আমিতো আজই বা কালই দোকান খুললাম, তাহলে আপনি গত সপ্তাহে কিভাবে নিলেন? বাবুল সিকদার ফতুয়া আর সানগ্লাসটা পড়ে দাড়ালে তাকে বেশ ভালই লাগে। আমি বললাম, ভাই, আপনাকে যদি এই ড্রেসআপের সাথে হাতে একটা লাঠি ধরিয়ে দেয়া যায় তবে অতিরিক্ত কিছু আয় করার সুযোগ আছে! দেখতে মনে হয় একদম কানা! যাহোক, সেই ঐতিহাসিক ফতুয়া আর সানগ্লাস পড়ে বাবুল সিকদার সিঁড়িতে বসে একজন মধ্য বয়স্ক মহিলাকে হাপাতে হাপাতে উঠতে দেখে ডাক দিয়ে বললো এখানে আসেন, একটু বসে বিশ্রাম নেন। ক্লান্ত মহিলা বসে হাপাতে লাগলো দেখে বাবুল সিকদার বললো একটু আচার খাবেন? ভালো লাগবে। মহিলা রাজি হলো। এবার বাবুল সিকদার মহিলাকে বললো আপনার কাছে ভাংতি বিশ টাকা আছে? আমার কাছে এক হাজার টাকার নোট, আচার বিক্রেতা খুচরা দিতে পারবে না! মহিলা তার ব্যাগ থেকে বিশ টাকা বের করে দিলো। আচার বিক্রেতাকে ডাক দিয়ে দুজনকে আচার দিতে বললো বাবুল সিকদার! আচার দিয়ে গেলে দুজনে বসে আচার খেতে খেতে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে মহিলা তাকে জানালো তার স্বামী জাপান থাকে। সে সিলেট থেকে মাঝে মাঝে একাই জাফলং ঘুরতে আসে। বাবুল সিকদারও বললো, আমি প্রতি সপ্তাহেই আসি। পাথর কিনতে এসেছি। এরই মধ্যে রাসেল আসলে তাকে বাবুল সিকদার পরিচয় করিয়ে দিলো যে আমার ড্রাইভার! মহিলাকে বাবুল সিকদার আরো বললো, আপনার বেশি খারাপ লাগলে আমাদের রিসোর্টে এসি আছে, সেখানে চাইলে একটু বিশ্রাম নিয়ে ঠান্ডা হয়ে যেতে পারেন! মহিলা জানালো, এখন আগের চেয়ে একটু ভালো লাগছে। বাবু ভাইর গল্প শুনে আমরা সবাই হাসাহাসি করতে লাগলাম! জাফলং এসে এক হাজার টাকার নোট দেখিয়ে অপরিচিত মহিলার কাছ থেকে আচার খেয়েছে সেই বিষয়টা নিয়ে আমরা সবাই খুব মজা করলাম। গল্প করতে করতে গভীর রাত হয়ে গেছে। সকালে রুম ছাড়বো। রওয়ানা দিবো সবাই আপন ঠিকানায়। তাই সবাই ঘুমের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। শুভ রাত্রি বলে সকলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যার যার রুমে চলে গেলো।

শনিবার সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হতে হতে যার যার ব্যাগ গুছানো শুরু করলাম। এখানকার তরতাজা চা পাতা নেয়ার জন্য শামীম সরদার রাসেলকে জিরো পয়েন্টে পাঠালো। রাসেল বেশ কিছু চা পাতা কিনে নিয়ে আসলো। আমার বাড়িতে প্রতি মাসে প্রচুর চা পাতা লাগে। ভাবলাম আমিও কিছু নিয়ে নেই। আর বাড়ির পাশেই যেহেতু দুই বোন থাকে তাই তাদেরও কিছু দেয়া উচিত। জাফলং ঘুরে একদম খালি হাতে ফিরেছি এটা ভালো দেখায় না। বাবুল সিকদারকে পাঠালাম আমার জন্য কিছু চা পাতা আনতে। বাবুল সিকদার রাসেলকে নিয়ে গেলো চা পাতা কিনতে। এসে রাসেল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার জোগাড়! জানতে চাইলে রাসেল বাবুল সিকদারকে বলে, আপনিই বলেন কি হয়েছে। এবার বাবুল সিকদার বললো, উকিল সাহেবের কথা একদম হাতে নাতে ফলে গেছে। এক দোকানে গিয়ে চা পাতার দরদাম করতেই তাকে বললাম গত সপ্তাহেইতো আপনার কাছ থেক চা পাতা নিলাম, আজ এত বেশি দাম চান কেন? দোকানী অবাক হয়ে বললো, কন কি মিয়া! আমিতো আজই প্রথম দোকান খুললাম, গত সপ্তাহে আমার কাছ থেকে চা পাতা নিলেন কিভাবে? উকিল সাহেবতো আমাকে আগেই সতর্ক করেছিলো! কিন্তু এভাবে ধরা খেয়ে যাবো ভাবতেই পারিনি। শুনে আমরা সবাই হাসতে হাসতে পাগল প্রায়! বললাম, ভাই, চোরের দশদিন আর সাধুর একদিন। আপনার অতিরিক্ত কথাগুলো বলার কি দরকার ছিলো বলেন? একজনের কাছে ঠিকই ধরা খেয়ে গেলেন! একটা মিথ্যা কথা ঢাকতে হাজারটা মিথ্যা কথার আশ্রয় নিতে হয়। সত্য কথা সবসময়ই সত্য ও মধুর। কথাটা মনে রাখবেন!

শনিবার গুছিয়ে বের হতে হতে দুপুর হয়ে গেলো। আমরা রিসোর্ট থেকে চেক আউট হয়ে খাবার হোটেলে চলে আসলাম। খাবার দেওয়ার ফাঁকে আমি একটু মার্কেটে গেলাম। বাড়িতে আমি দুটি কলিজার টুকরা রেখে এসেছি। ঘুরতে যেতে যেমন মন কাঁদে আবার ওদের রেখে দূরে আসার পরেও মন কাঁদে। বাড়িতে ফেরার পরে প্রথমেই আমার মা প্রিয়ন্তী আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়বে। দুই গালে, কপালে, থুতনিতে চুমু দেবে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে, একটু কান্না করবে। ছোট মা’টার বয়স এক মাসের কিছু বেশি। সে হয়তো এখনও বাবার প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে শিখেনি। ওদের জন্য কিছু নিতেই হবে। আগেই কিছু কেনাকাটা করেছি কিন্তু তাতে মন তৃপ্ত হয়নি। মার্কেটে গিয়ে কন্যাদ্বয়ের জন্য বাঘ, সিংহ, হাতির বাচ্চা কিনলাম! জীবন্ত নয় কিন্তু! সবই কাপড়ের তৈরী। দেখলে যেন জীবন্তই মনে হয়। সামনে পেয়ে গেলাম প্রিয়ন্তীর প্রিয় ডার্ক চকোলেট বিস্কিট। ইতালি থেকে ভাবি আসার সময় নিয়ে এসেছিলো, ওর আগ্রহ নিয়ে খাওয়া দেখেছি! বিস্কিট, কাঠের ও প্লাস্টিকের খেলনা হাড়ি পতিল, প্লাস্টিকের সবজি, বটি, চুলাসহ আরো কিছু জিনিস কিনে হোটেলে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে হোটেল থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমরা যখন খাবার খাচ্ছিলাম তখন ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। দশ-পনের মিনিট প্রচন্ড বৃষ্টির পর আকাশ ঝকঝকে পরিস্কার হয়ে গেছে। জিরো পয়েন্ট থেকে প্রথমেই গেলাম তামাবিল ইমিগ্রেশন চেক পোষ্টে। নেমে খোঁজ নিলাম ভারত গমনের জন্য ইমিগ্রেশন খুলেছে কিনা। অফিসার আমাকে জানালো এখনও খোলেনি। কবে নাগাদ খুলবে সে সম্পর্কে কোন নির্দেশনা আসেনি। আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে সিলেটের পথে রওয়ানা দিলাম। রাস্তার বামদিকে যতদূর চোখ যায় সবই ভারতের পাহাড়। কিছুক্ষণ আগে প্রচন্ড বৃষ্টি হওয়ায় পাহাড়ের চার-পাঁচ জায়গা দিয়ে অনবরত ঝরণা ধারা ঝড়ছে। রাস্তায় গাড়ি দাড় করে দৃশ্যটা ক্যামেরায় ধারণ করলাম আমরা। রাস্তা ধরে যতই সিলেটের দিকে যাচ্ছি বামে তাকালে পাহাড় আর ঝরণার দৃশ্য আমাদের চোখ আটকে রাখছে। রাস্তায় বেশ কয়েকবার আমরা বৃষ্টির মুখোমুখি হলাম। যখন বৃষ্টি হয় প্রচন্ড রকমের হয়। দূরের পাহাড়গুলো দেখতে তখন অসাধারণ লাগে। আবার কোথাও আকাশ ঝকঝকে পরিস্কার। রাস্তায় চলতে চলতে ফুটপাতে জারা লেবুতে চোখ আটকে গেলো আমাদের। আমাদের এলাকায় লেবু আছে। কাগজি লেবু হয় তা ছোট ছোট। আরেক ধরণের লেবু হয় যাকে গোড়া লেবু বলে। পুকুর পাড়ে বা বাগানে বড় বড় সাইজের গোড়া লেবু ধরে। কিন্তু এমন সাইজের লেবু আমাদের এলাকায় দেখা যায় না। গাড়ি থামিয়ে তিনশত টাকা দিয়ে জাম্বুরা সাইজের বিশাল বিশাল চারটি জারা লেবু কিনলো শামীম সরদার।

আমাদের এখন প্রথম গন্তব্য হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর মাজার শরীফ। আমি গুগল ম্যাপস অন করে বসে আছি আর গাড়ি চলাচ্ছে শামীম সরদার। গুগলের প্রতি পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছি না। কাউকে জিজ্ঞেস করা দরকার। তাই একটা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি দাড় করিয়ে ফুয়েল নেয়ার ফাঁকে জেনে নিলাম হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর মাজার শরীফের লোকেশন। লোকটা জানালো এই প্রধান সড়ক ধরে এগিয়ে যেতে হবে। যেতে যেতে হাতের বাম দিকে দেখ যাবে মাজারের রাস্তায় প্রবেশের জন্য বিশাল গেইট আছে যা মূল রাস্তার পাশেই। আমরা লোকটার দেয়া নির্দেশনা মত চলতে চলতে পেয়ে গেলাম সেই গেইট।
হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) ও তাঁর মাজার সম্পর্কে কিছু তথ্য সবারই জানার আগ্রহ আছে যেমনটা আমারও আছে। উন্মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে তারই কিছু তথ্য উপস্থাপন করছি। হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর মাজার সিলেট শহরের একটি পুণ্য তীর্থ বা আধ্যাতিক স্থাপনা। যা হচ্ছে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য হতে বাংলাদেশে আসা ইসলাম ধর্ম প্রচারক হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর অন্যতম সঙ্গী অনুসারী হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর সমাধি। এটি সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিম নগর এলাকায় অবস্থিত। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর দরগাহ থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরত্বে হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর মাজার অবস্থিত। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর দরগাহর মতো এ মাজারেও প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন ঘটে। অনেক ঐতিহাসিক লিখেছেন; সিলেট বিভাগ ও ভারতের বিভিন্ন এলাকায় হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর দ্বারা মুসলিম ধর্ম বিশ্বাস ও সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার হয়েছে।
সিলেট শহরের পূর্ব দিকে খাদিমনগর এলাকায় টিলার উপর একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষের নিচে রয়েছে হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর কবর। মাজার টিলায় উঠা নামার জন্য উক্ত মাজার প্রাঙ্গনে উত্তর ও দক্ষিণ হয়ে সিঁড়ি আছে। যা প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট উঁচু দেখায়। এই সিঁড়িটি মোগল আমলে নির্মিত বলে লোক মুখে শোনা যায়। মাজারের পশ্চিম দিকে মোগল বাদশাদের স্থাপত্বকীর্তিতে নির্মিত তিনটি গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে। এই মসজিদে প্রায় ৫ শত মুসল্লী এক সাথে নামাজ আদায় করে থাকেন। মাজার টিলা থেকে প্রায় ১৫-২০ ফুট দক্ষিণ পশ্চিমে মহিলা পর্যটকদের জন্য এক চালা বিশিষ্ট দালান ঘর রয়েছে। উক্ত দালানের অল্প পরিসর দক্ষিণ পুর্বে আরেকটি ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এ ঘরখানা মুলত বিদেশ হতে আগত পর্যটকদের বিশ্রামাগার হিসেবে ব্যবহার হয়। এই ঘরের পাশেই একটি পুকুর রয়েছে, যা অজু গোসলের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর পুর্ব পুরুষগণ মুলত বোখারীর শহরের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর উর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ শাহ জামাল উদ্দীন, বোখারী হতে ধর্ম প্রচারে জন্য প্রথমে সমরকন্দ ও পরে তুর্কিস্থানে এসে বসবাস করেন। বংশ সূত্রে হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর পিতা মোহাম্মদও একজন খ্যাতনামা ধার্মিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর মাতা হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর আত্মিয় সম্পর্কে বোন ছিলেন। সে হিসেবে হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) হচ্ছেন হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর ভাগ্নে। হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর বয়স যখন ১১ বৎসর তখন তিনি তাঁর পিতাকে হারান। পরবর্তিকালে তাঁর আত্মীয় প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ আহমদ কবিরের কাছে তিঁনি ধর্ম শিক্ষায় দীক্ষিত হন। সেখান থেকে তিঁনি আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভে নেশাপুরের বিখ্যাত দরবেশ পাগলা আমীনের স্মরণাপন্ন হয়ে আধ্যাত্মিক শিক্ষায় দীক্ষিত হন। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) যখন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রার উদ্যোগ নেন এ সময় হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) খবর পেয়ে মামার সহচার্য লাভের আশায় হিন্দু স্থানে এসে মামার সঙ্গী হন। সিলেট বিজয়ের পর হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর আদেশে তিঁনি ইসলাম প্রচারের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) সিলেটের নবীগঞ্জ, হবীগঞ্জ সহ বিভিন্ন স্থানে ইসলাম প্রচার করেন। পরবর্তিকালে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশ হলে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর নির্দেশে হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) সিলেট শহর হতে ছয় মাইল দুরবর্তি দক্ষিণকাছ পরগণাস্থিত খাদেম নগর এলাকায় এসে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বসতি স্থাপন করেন এবং এখানেই জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করে বর্তমান মাজার টিলায় চির নিদ্রায় শায়িত হন।
হযরত শাহ জালাল (রাঃ) সিলেট আগমন কালে দিল্লী থেকে আসার সময় নিজামুদ্দিন আউলিয়া প্রদত্ত এক জোড়া কবুতর (সিলেটি উচ্চারণ-কৈতর) সঙ্গে আনেন। কবুতর জোড়া সিলেট নিয়ে আসার পর বংশ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর কবুতর বলে জালালী কৈতর নামে খ্যাত হয়। ধর্মীয় অনূভূতির কারণে এ কবুতর কেহ শিকার করতো না। হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এ বিষয়টি আমলে না নিয়ে, প্রতি দিন একটি করে কবুতর খেতেন। কবুতরের সংখ্যা কম দেখে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) অনুসন্ধানে মুল ঘটনা জেনে রুষ্ট হন। একথা হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) জানতে পেরে গোপন করে রাখা মৃত কবুতরের পাখ হাতে উঠিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বললেন; আল্লাহর হুকুমে কবুতর হয়ে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর কাছে পৌছে যাও। সাথে সাথে পাখগুলো এক ঝাক কবুতর হয়ে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর কাছে পৌছে গেল। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) ভাগিনাকে ডেকে বললেন; তোমার অলৌকিক শক্তি দেখে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে কেরামত প্রকাশ করা সঠিক নয়। সব মানুষের বুঝ শক্তি এক রকম হয় না। এভাবে কেরামত প্রকাশের কারণে মানুষ ভুল ব্যাখ্যায় পতিত হতে পারে। এরপর হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) কে খাদিম নগর এলাকায় ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেন। হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) খাদিম নগরে ইসলাম প্রচারে তাঁর জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত নিজেকে ব্যস্ত রাখেন এবং এখানেই তিঁনি চির নিদ্রায় শায়িত হন।
মাজারে প্রবেশের সাথে সাথেই অসংখ্য ভন্ডদের সাথে দেখা হলো। অপরিস্কার, অপরিচ্ছন্দ, নোংড়াহয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একেকটা গাড়ি আসার সাথে সাথেই কেউ আগরবাতি, মোমবাতি, তবারকের প্যাকেট, লাল ফিতা নিয়ে ছুটে আসছে। কেউ কেউ এসে হাত পাতছে, নানান রকম প্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে দোয়া করে টাকা চাইছে। গাড়ি থেকে নেমেই দেখি একজনের শবদেহ খাটিয়ায় ঢাকা অবস্থায় জানাজার জন্য রাখা আছে। কিছু মানুষ দাড়িয়ে আছে জানাজার জন্য। আমাদের সঙ্গীরা কেউ অজু করতে চলে গেলো কেউ উঠে গেলো হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর কবর জিয়ারত করার জন্য। আমি একটু এদিক ওদিক ঘুড়ে দেখলাম। উল্লেখিত বর্ণনার সাথে সবই মিলে গেলো। তবে অজু করার পুকুরের পানি দেখে খুবই খারাপ লাগলো। পানির অবস্থা এতই খারাপ যে এই পানি দিয়ে সৌচকর্ম করলে পশ্চাৎ দেশে ঘা হয়ে যাবে! আমরা অল্পকিছুক্ষণ থেকে রওয়ানা দিলাম সিলেট শহরের দিকে যেখানে শায়িত আছেন হযরত শাহ জালাল (রাঃ)।

হযরত শাহ পরাণ (রাঃ) এর মাজার থেকে বের হয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে চলতে থাকলাম আমরা। আস্থার সংকট থাকলেও আবার সেই গুগল ম্যাপস খুলে বসলাম। চলতে চলতে পৌছে গেলাম হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর মাজারের প্রধান গেইটে। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) জীবণ ও কর্ম সম্পর্কে একটু ধারণা নেয়া যাক।
হযরত শাহ জালাল (রাঃ) (১২৭১-১৩৪১) ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি দরবেশ। তাঁর পুরো নাম শেখ শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররদ। ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টীয় সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে, তদুপরি হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত ফার্সি ভাষার একটি ফলক-লিপি থেকে উল্লেখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়। ফার্সি ভাষায় লিখিত ফলক-লিপি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সিলেটে তাঁর মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে সিলেট বিজয়ের পরে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর সঙ্গী-অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর-দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেট সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর সফর সঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তার মৃত্যুর পর তাকে সিলেটেই কবর দেয়া হয়।
হিজরী ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে মক্কার কোরায়েশ বংশের একটি শাখা মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস করেন। ঐ শাখার মোহাম্মদ বা মাহমুদ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর পিতা। মাহমুদের পিতা ছিলেন ইব্রাহিম।
হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর রওজায় প্রাপ্ত ফলক-লিপি সুহেলি ইয়্যামনি অনুসারে, শাহ জালাল ৩২ বছর বয়সে ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট আগমন করেন। সুহেলি ইয়্যামনিতে উল্লেখিত তথ্য হতে জানা যায় যে, ৬৭১ হিজরী (১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে) হযরত শাহ জালাল (রাঃ) জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়্যামন দেশের কুনিয়া নামক শহর। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) যখন তিন মাসের শিশু বালক, তখনই তার মাতার মৃত্যু হয়।
হযরত শাহ জালাল (রাঃ) শিশুকালেই মাতৃহীন হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। মামা আহমদ কবির তাকে দত্তক নেন। আহমদ কবির আরবী ভাষায় কোরআন হাদিস শিক্ষা দেয়া সহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজায়) অভ্যস্ততার গুরুত্ব প্রদান করেন। পরবর্তিতে আহমদ কবীর হযরত শাহ জালাল (রাঃ) কে ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান। মক্কা শহরে আহমদ কবীরের একটি আস্তানা (হোজরা) ছিল। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সাথে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) কেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়।
গুরু পরিচিতিঃ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর মামা ও শিক্ষাগুরু শায়েখ সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি, সাধারণত; আহমদ কবির নামে তিনি বহুল পরিচিত। সৈয়দ আহমদ কবিরের পিতা নাম সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী। সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর জন্মের আগে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের লক্ষে মোলতানের নিকট আউচে এসে বসবাস করেন এবং সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দির পিতা সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী ছিলেন তার মুরশীদ।
হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর পীরদের ঊর্ধস্তন পীরগণের তালিকাঃ হযরত মোহাম্মদ (সঃ), হযরত আলী, শেখ হাসান বসরী, শেখ হবিব আজমী, শেখ মারুফ কর্খী, শেখ সিংরি সুকতি, শেখ মমশাদ সিকন্দরী, শেখ আহমদ দিন্নুরী, শেখ আমুবিয়া, শেখ আজি উদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, শেখ আবু নজিব জিয়াউদ্দিন, শেখ হিসাব উদ্দীন, শেখ মাখদুম, শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া, সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী, সৈয়দ শায়েখ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি, শাহ জালাল।
আধ্যাত্মিকতাঃ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) কে সুফি মতবাদে দীক্ষিত করাই আহমদ কবিরের মূল উদ্দেশ্য ছিল বলে জানা যায়; যে কারণে আহমদ কবিরের হযরত শাহ জালাল (রাঃ) কে নিয়ে মক্কায় আসা। মক্কা শহরে সোহরাওয়ার্দি তরিকার প্রবর্তক সিহাবুদ্দীনের প্রতিষ্ঠিত খানকায় (মরমী স্কুল) তৎকালে আহমদ কবির ছিলেন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। আহমদ কবির হযরত শাহ জালাল (রাঃ) কে ইসলামের শরীয়ত ও মারিফত উভয় ধারায় শিক্ষাদানে দীক্ষিত করেন।
দরবেশী জীবনঃ জন্মগতভাবে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) দরবেশ পরিবারে জন্ম নিয়েছেন। জানা যায়, তাঁর পিতা ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ, ইয়্যামনে ধর্ম যুদ্ধে তিনি নিহত হন এবং তার মাতার দিক দিয়ে তিনি সৈয়দ বংশের প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারীর দৌহিত্র ছিলেন। তদুপরি দরবেশ আহমদ কবির তার মামা, যাঁকে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর শিক্ষা গুরু হিসেবে পাওয়া যায়, তিনিও তৎকালের একজন বিখ্যাত দরবেশ ছিলেন বলে উল্লেখ রয়েছে। আহমদ কবির যখন হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর লালন-পালনের ভার গ্রহণ করেন সেই ছোটবেলা থেকেই তাকে দরবেশী তর-তরিকায় জীবন যাপনের প্রণালী শিক্ষা দিয়েছেন বলেও পাওয়া যায়।
সিলেট আগমন পর্বঃ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) মুজাররদ তাঁর মামা ও গুরু সৈয়দ আহমদ কবিরের আস্তানায় আরব দেশে ছিলেন। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখার পরে সৈয়দ আহমদ কবির-এর কাছে ব্যক্ত করেন। মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবিরকে তা জানান। কবির এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) কে ভারতবর্ষে যাবার পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে কবির হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বললেনঃ যে স্থানে এই মাটির ‘স্বাদ’ ‘গন্ধ’ ও ‘বর্ণের’ মিল এক হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে। মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রহ) এর দোয়া নিয়ে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) ধর্মপ্রচার অভিযানে আরবের মক্কা শরিফ হতে একা-একাই যাত্রা শুরু করেন।
হিন্দুস্থানে প্রবেশঃ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) মক্কা হতে বিদায় কালে যে কয়েক জন সঙ্গী তার সাথে যাত্রা করেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী ইউসুফ, হাজী খলীল, হাজী দরিয়া এবং আরেকজন সঙ্গী চাশনী পীর ছিলেন মৃত্তিকার তহবিলদার। হিন্দুস্থানে আসার পূর্ব পর্যন্ত সমরকন্দ থেকে সৈয়দ ওমর, রোম থেকে করিমদাদ, বাগদাদ থেকে নিজাম উদ্দীন, ইরান, জাকারিয়া ও শাহ দাউদ এবং সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখ তার অনুগামী হলেন। তাদের নিয়ে তিনি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করলেন। এরপর পাঞ্জাবের মুলতান থেকে আরিফ, গুজরাট থেকে জুনায়েদ, আজমীর শরীফ থেকে মুহম্মদ শরীফ, দাক্ষিণাত্য থেকে সৈয়দ কাসিম, মধ্যপ্রদেশের হেলিম উদ্দীন প্রমুখ তার মুরীদ হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এভাবে দিল্লী পর্যন্ত এসে পৌঁছালেন তখন শিষ্যদের সংখ্যা ২৪০ জন বলে ধারণা পাওয়া যায়।
নিজামুদ্দীন আউলিয়ার সাথে সাক্ষাৎঃ দিল্লিতে আসার পর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জনৈক শিষ্য গুরুর কাছে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর কুৎসা প্রচার করে। সঙ্গে সঙ্গে নিজাম্মুদ্দীন অন্যের কুৎসা রটনাকারী এ শিষ্যকে উপযুক্ত শাস্তিস্বরূপ দরবার থেকে তাড়িয়ে দেন এবং অন্য দুই শিষ্যকে ডেকে তাদের মারফতে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর কাছে সালাম পাঠান। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) সালামের উত্তরে উপঢৌকনস্বরূপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ্জলিত অঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরে নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নিকট পাঠান। নিজামুদ্দিন আউলিয়া হযরত হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাঁকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। মাজার সংলগ্ন এলাকায় সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায় তা ঐ কবুতরের বংশধর। যা জালালি কবুতর নামে খ্যাত।
শেখ্ বুরহান উদ্দীনের দেখা ও দুঃখ প্রকাশঃ উল্লেখ্য যে, শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে তুর্কি বিজয়ের মধ্য দিয়ে শ্রীহট্টে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠে ছিল। সিলেটের টুলটিকর মহল্লায় ও হবিগঞ্জের তরফে তৎকালে মুসলমানরা বসতি গড়েছিলেন। এ সময় শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে গৌড়-গোবিন্দ নামে এক অত্যাচারী রাজা ছিল। গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান নিজ ছেলের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন। এ কারণে, গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তৎকালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তার ভাগিনে সিকান্দর গাজীকে প্রকাণ্ড সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দ ভৌতিক শক্তির সাহায্যে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে ফেলে। গোবিন্দের ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহত ও বিফল মনোরথের সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীর নিকট পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন। পরবর্তিতে সম্রাট তার রাজদরবারী আলেম-উলামা সহ জ্যোতিষিদের সাথে আলোচনায় এই মর্মে অবহিত হন যে, সুলতানের সেনা বাহিনীতে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন এক ব্যক্তি রয়েছে, তার নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করা হলে গৌড় গোবিন্দের যাদু বিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট বা শ্রীহট্ট জয় সম্ভব হবে। জ্যোতিষিরা উক্ত আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয়ের পন্থা হিসেবে এও বলে ছিল, আগামী দুই-এক রাত্রের মধ্যে দিল্লী নগরীতে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সমস্ত নগরী ভেসে যাবে, প্রতিটি ঘর বাড়ির বিষম ক্ষতি লক্ষিত হবে, কোথায় কোন প্রদীপ থাকবে না; একটি মাত্র তাবু ব্যতীত। সম্রাট জ্যোতিষিদের কথামত অনুসন্ধান করে সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে দেখতে পেলেন একজন সাধারণ সৈনিক একটি তাঁবুতে একাগ্র মনে বসে কোরান পড়ছেন। সম্রাট সেখানে উপস্থিত হয়ে তার সব বিষয় অবগত হয়ে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব দেয়ার অনুরোধ জানান। তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন সম্রাটের আদেশে সম্মত হলে সম্রাট তাকে সিপাহসালার সনদ প্রদানের মাধ্যে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। এদিকে গাজী বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এসময় হযরত শাহ জালাল (রাঃ)ও তার সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন। ঐতিহাসিক আজহার উদ্দীন ধরনা করে দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন নিজের দুঃখময় কাহিনী তার নিকট বর্ণনা করেন।
সিপাহশালার নাসির উদ্দীনের দেখাঃ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীনকে সহ ২৪০ জন সঙ্গী সহচর সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন হযরত শাহ জালাল (রাঃ) সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। ত্রিবেণী থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন ধর্মযোদ্ধা অনুষঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
সিকান্দর গাজীর দেখা ও ব্রহ্মপুত্র পারঃ হযরত শাহ জালাল (রাঃ) সোনারগাঁ আসা মাত্রই শাহ সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। সিকান্দর গাজী হযরত শাহ জালাল (রাঃ) কে সসম্মানে গ্রহণ করলেন। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) তার সঙ্গী অনুচর ও সৈন্যসহ শাহ সিকান্দরের শিবিরে সমাগত হয়ে সিকান্দর হতে যুদ্ধ বিষয়েসহ সব বিষয় অবগত হন। সিকান্দর হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্যত্ব গ্রহণপূর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর শিষ্য সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ জনে পৌঁছায়। এদিকে গৌড় গৌবিন্দ নিজস্ব চর দ্বারা হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর সমাগম সংবাদ পেয়ে; নতুন এ দল যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে জন্য নদীর সমস্ত নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেয়। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে বিনা বাধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন।
সিলেটে প্রবেশঃ খ্রিস্টিয় দশম শতকে শ্রীহট্টভূমি লাউড়, জয়ন্তীয়া ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। উক্ত রাজ্য গুলোর মধ্যে গৌড় অন্যতম রাজ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। এ রাজ্যে প্রাচীন সীমা রেখা বর্তমান মৌলভীবাজার জেলা সহ হবিগঞ্জ জেলার কিয়দংশ নিয়ে বিস্তৃত থাকায় গৌড় রাজ্যের দক্ষিণ সীমাভূমি নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণার পাশে রাজা গোবিন্দের চৌকি ছিল। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে প্রথমত সেখানে অবস্থান করেন। এখানে গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা অগ্নিবাণ প্রয়োগ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়; কিন্তু মুসলমান সৈন্যের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। গোবিন্দ সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) পূর্বের মতো জায়নামাজের সাহায্যে বরাক নদী পার হন। বরাক নদী পারাপারে বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহপুর নামক স্থানে রাত্রিযাপন করেন। উল্লিখিত তথ্য-সম্বলিত প্রাচীন গ্রন্থ তোয়ারিখে জালালীতে উল্লেখ আছেঃ
চৌকি নামে ছিল যেই পরগণা দিনারপুর
ছিলটের হর্দ্দ ছিল সাবেক মসুর
সেখানে আসিয়া তিনি পৌছিলা যখন
খবর পাইলা রাজা গৌবিন্দ তখন।
এপারে হজরত তার লস্কর সহিতে
আসিয়া পৌছিলা এক নদীর পারেতে
বরাক নামে নদী ছিল যে মসুর
যাহার নিকট গ্রাম নাম বাহাদুরপুর।
যখন পৌছিলা তিনি নদীর কেনার
নৌকা বিনা সে নদীও হইলেন পার।
সর্ব প্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে রাজা গৌড় গোবিন্দ যখন দেখলেন সকল প্রয়াসই বিফলে হচ্ছে, তখন শেষ চেষ্টা করার লক্ষে যাদুমন্ত্রসহ এক প্রকাণ্ড লৌহ ধনুক হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর কাছে প্রেরণ করে; যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা উক্ত ধনুকের ‘জ্যা’ ছিন্ন করতে পারে তখন গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) তাঁর দলের লোকদের ডেকে বললেন, যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাযা হয়নি বা বাদ পড়েনি একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুক ‘জ্যা’ করতে। অতপর মুসলিম সৈন্যদলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে উপযুক্ত পাওয়া গেল এবং তিনিই ধনুক ‘জ্যা’ ছিন্ন করলেন।
সুরমা নদী পারাপারঃ উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিলেট বিভাগের বেষ্টনী হিসেবে ধর্তব্য এ নদীগুলো প্রাচীন কালে প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হত। বর্ষাকালের দৃশ্য প্রায় সাগরের মত দেখাতো। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবন বতুতা সুরমা নদীকে নহরি আজরফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) ফতেপুর হতে যাত্রা করে যখন সুরমা তীরে অবস্থান নিলেন, এ নদী পার হয়েই গৌড়ের রাজধানী। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) আউলিয়ার কেরামতি ও আলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হন। গোবিন্দ শত্রুবাহিনীকে কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। তা সত্ত্বেও হযরত শাহ জালাল (রাঃ) নদী পার হন।
‘শাহ্ জালাল বিসমিল্লাহ বলে সকল মুরিদকে নিয়ে জায়নামাজে করে, অনায়াসে গেলেন চলে নদীর ওপারে।’
গোবিন্দ গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে পেচাগড়ের গুপ্তগিরি দুর্গে আশ্রয় নেন। এরপর থেকে তার আর কোন হদিস মেলেনি। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর, মিনারের টিলায় অবস্থিত রাজবাড়ি প্রথমে দখল নিলেন।
সিলেট প্রথম আজান ধ্বনি সিলেট শহরে সর্ব প্রথম হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর আদেশে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন সিপাহসালার আজান দেন।
গৌড় গোবিন্দের আত্মগোপনঃ গৌর গোবিন্দের মুসলিম নির্যাতনের কথা জানতে পেরে বাংলার তৎকালীন সুলতান ফিরজ শাহ গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন, কিন্তু প্রথম অভিযান ব্যর্থ হলে ফিরজ শাহ সিকান্দার শাহের সহযোগিতা নিয়ে নাসির উদ্দীন নামের একজন সেনাপতিকে তার বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এই সময় হযরত শাহ জালাল (রাঃ) তাঁর সেনাবাহিনীসহ সোনারগাঁওয়ে অবস্থান করছিলেন; এই উভয় বাহিনী হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর নেতৃত্বে গৌর গোবিন্দের বিরুদ্ধে অভিযান করেন এই খবর শুনে গৌর গোবিন্দ পলায়ন করেন।
আমরা জুতা খুলে গাড়িতে রেখে মাজারের প্রধান গেইট দিয়ে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করে প্রথমেই গেলাম মাজারের ডান দিকে পুকুরের পাড়ে যে পুকুরে ঐতিহাসিক গজার মাছ থাকে। পুকুরের পাড়ে ওজু করার জন্য ঘাট আছে। ঘাটে যেন গজার মাছ আসতে না পারে সেজন্য এসএস পাইপ দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে। কিন্তু মাঝারি ও ছোট সাইজের গজার মাছগুলো বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘাটে এসে গোত্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। মাছ দেখার জন্য পুকুরের বাম দিকে গেলাম। সেখানে শত শত গজার মাছ এক জায়গায় জড়ো হয়ে ভির করে আছে। দেখে মনে হবে এখানে পানি আর মাছ সমান সমান। পুকুরের পাশেই একটা দোকান পাতা আছে। দোকানে ছোট ছোট মলা মাছের মত দেখতে কিছু মাছ প্লাস্টিকের পিরিচে করে বিক্রি করছে। দর্শনার্থী, ভক্তবৃন্দ সেখান থেকে ছোট মাছ কিনে গজার মাছকে খাওয়াচ্ছে। একটা একটা করে মাছ ছুড়ে দিচ্ছে আর হুরোহুরি করে সেই ছোট মাছগুলো খাচ্ছে গজার মাছে। কোন ভয় ডর নেই সেই মাছের। অনেকের ধারণা এই গজার মাছ সবার দেয়া মাছ খায় না এবং এগুলো মাছ নয় জ্বীণ। আমার ধারনা এগুলো সবার মাছই খায় এবং জ্বীণটিন কিছুই না এবং দেখলামও তাই। যে মাছ দিচ্ছে তারটাই খাচ্ছে, ওদের কোন বাছ বিচার করতে দেখলাম না! আমাদের সহযাত্রী বাবুল সিকদার এক পিরিচ মাছ নিলো। আমাকে বললো একটু ভিডিও করেন, আমি মাছ খাওয়াই। আমি বাবু ভাইর মাছ খাওয়ানোর দৃশ্য ধারণ করলাম। মাছগুলোর সাইজ দেখলে অবাক লাগে। এত বিশাল বিশাল জীবন্ত মুক্ত মাছ এতটা কাছ থেকে আমি কখনো দেখিনি।
গজার মাছ দেখা শেষে এবার রওয়ানা দিলাম হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর মাজার জিয়ারতের জন্য। একটা ফাঁকা উঠান পেরিয়ে হাতের ডান দিকে মাজার। ফাঁকা উঠানটা ফাঁকা ছিলো না। অস্যখ্য পর্যটকদের পাশাপাশি জটাধারী পাগলও আছে। ভবনগুলোর উপরের দিকে অসংখ্য কবুতরের বাসা তৈরী করে দেয়া হয়েছে। ছাদের উপর অসংখ্য জালালি কবুতর বসে আছে। শুধু যে জালালি কবুতর তা কিন্তু নয়। সাথে আছে নানান রঙ্গের কবুতর। মাজারে ঢোকার পর হাতের ডান দিকে কবুতরকে খাওয়ানোর জন্য স্তুপ করে গম রেখে দিয়েছে মাজার কর্তৃপক্ষ। সবই নাকি ভক্ত আশেকানের দান। কবুতর ইচ্ছেমত খেয়ে ছাদের উপরে, কার্নিশে দাড়িয়ে বাকবাকুম ডাকছে। মাজার জিয়ারত করতে যাওয়ার প্রাক্কালে এক জটাধারী তালা বাবা আমাকে ধরলো কিছু দেয়ার জন্য। আমাকে প্রলুব্ধ করার জন্য বললো, আমাকে দে, আমি একমাত্র তালা বাবা, তুই পাবি, আমি দোয়া করে দিলাম। তালা বাবাকে এড়িয়ে আসার পর আরেক ছিকল বাবা ধরলো। ভাবলেশহীন হেটে আমি উঠে গেলাম হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর রওজার কাছে। উপরে উঠে দেখি সেখানেও টোল প্লাজা খোলা আছে! তবে বাধ্যকর নহে! অতিভক্তগণ টোল প্লাজায় নজরানা দিয়ে প্রবেশ করছে আবার কেউ কেউ বের হওয়ার সময় টোল দিয়ে যাচ্ছে। উপরে উঠে কবর জিয়ারত করে হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর জন্য দোয়া করলাম। মাজারে প্রবেশের আগে আমাদের সফর সঙ্গী অতিভক্ত বাবুল সিকদারকে আমরা সতর্ক করে দিয়েছি যে, মাজারে চাওয়ার কিছুই নেই। ভুলেও কোন কিছু চাইবেন না। আসছেন, শুধু দোয়া করবেন। বাবুল সিকদার আমাদের কথায় সায় দিলো। উপরে গিয়ে সবার সাথে আমিও দোয়া করলাম। দোয়া শেষে নেমে মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে বের হয়ে দেখি রাস্তার দুধারেই দোকানগুলোতে নানান রকম তবারক বিক্রি করছে। সবাইকে কিনতে দেখে আমিও কিছু তবারক কিনলাম। তবারক বলতে তেমন কিছুই না, মিষ্টি জাতীয় গোল গোল বস্তু। শামীম সরদার তবারকের সাথে কিনলো বুটের ডালের হালুয়া। জানতে চাইলে বললো, এটা দিয়ে পথে রুটি খাবো, দারুন লাগবে! আমরা কেনাকাটা শেষে রওয়ানা দিলাম ঢাকার পথে।

সিলেট থেকে রওয়ানা দিয়ে সায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ গোলচত্তরে আসতে আসতে মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। আছরের ওয়াক্ত যায় যায় দেখে চৌরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে প্রথমে আছরের নামাজ আদায় করে সবাই নাস্তা করতে ফুটপাতের পাশে একটা হোটেলে বসলাম। গরম গরম পরোটা ভাজছে। হযরত শাহ জালাল (রাঃ) এর মাজার থেকে আনা হালুয়া দিয়ে গরম পরোটা খাবো ভেবে দোকানিকে পরোটা ভাজতে বললাম। পরোটা-হালুয়া-চা খেতে খেতে মাগরিবের আজান দিয়ে দিলো। মাগরিবের নামাজ শেষে আমরা রওয়ানা দিলাম ঢাকার মুখে। সায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রিজ গোলচত্তর থেকে ডানদিকে হবিগঞ্জ বাইপাস সড়ক আর বামদিকে চুনারুঘাট-সায়েস্তাগঞ্জ সড়ক বেরিয়ে গেছে। পিছনে প্রায় নব্বই কিলোমিটার দূরে ফেলে এসেছি সিলেট শহরকে। এখান থেকে ঢাকার দূরত্ব আছে দেড়শ কিলোমিটারের বেশি।
জাফলং থেকে আমাদের গাড়ি ছাড়ার সময় প্রথমে পেন ড্রাইভে সেভ করা কিছু গান চললো। বেশ কয়েকদিন যাবৎ একই গান শুনতে শুনতে আর ভালো লাগছিলো না আমাদের কারোরই। নতুন কিছু শুনা দরকার। শামীম সরদার তার মোবাইলের হটস্পট অন করে গাড়ির ডিভাইসের সাথে ওয়াইফাই কানেক্ট করে নিল। এবার গাড়ির ডিভাইসে ঢুকে ইউটিউব অন করে রফিকুল্লাহ আফসারীর ওয়াজ মাহফিল সার্চ দিয়ে চালালো। রফিকুল্লাহ আফসারীর জন্ম কুমিল্লায়, বেড়ে ওঠা নোয়াখালি। তাই সে নিজেই বলেন, বড় হইছি নোয়াখালি জন্ম নিছি কুমিল্লা, আছি মিল্লাজিল্লা! রফিকুল্লাহ আফসারী শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলায় একটি মাদ্রাসায় বেশ কিছুদিন মুহাদ্দিস হিসাবে চাকুরী করেছেন। তাই তার ওয়াজের প্রতি একটা ভিন্ন আগ্রহ আছে আমাদের। পরিচিতজনের লেখা পড়তে, পরিচিতজনের গান শুনতে, ওয়াজ শুনতে ভালো লাগে। সম্পূর্ণ নোয়াখাইল্লা ভাষায় মজা করে বয়ান করে দেখে আমরা সবাই বেশ ভক্ত হয়ে গেলাম। ‘হেতে চিটিং, হেতে ডাকাত, হেতে সতান (সয়তান)’ শুনতে শুনতে সবাই হাসাহাসি করলাম। রফিকুল্লাহ আফসারীর বয়ান শুনে আমাদের এক সফরসঙ্গী হেদায়েত পেলো। বাবুল সিকদার প্রচন্ড পান চিবায়, অনেকটা ছাগলের মত অনবরত! ইসলামের দৃষ্টিতে পান খাওয়া, জর্দ্দা খাওয়ার ঠিক নয় এই বয়ান শুনে সে সিদ্ধান্ত নিল আর পান খাবেন না। সিলেট ঘুরে এসে লেখাটা লিখতে লিখতে প্রায় পনের দিন চলে গেছে। সত্যিই আর পান খেতে দেখিনি তাকে। একের পর এক আফসারীর ওয়াজ চলছে আর একের পর এক বাজার, গ্রাম পাড় হয়ে রাস্তাকে পিছনে ফেলে রেখে চলছে আমাদের গাড়ি। কারো চোখে ঘুম নেই। সবাই ওয়াজ শুনছে, বাইরের রাতের প্রকৃতি দেখছে, গল্প করছে। চলতে চলতে চায়ের তেষ্টা পেয়েছে, সাথে ঘুম ঘুম ভাবও চলে আসছে। গাড়ির হালকা ঝাকুনিতে বেশ আরাম বোধ করি আমরা, তাই ঘুমও চুমু দিতে চায় চোখের পাতায়। ভৈরবের কাছে একটা হাইওয়ে হোটেলের সামনে থামলো আমাদের গাড়ি। যাত্রা বিরতী দিয়ে চা খেলাম সবাই। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে গা ঝাড়া দিয়ে শরীরটা একটু ফুরফুরা করে আবার চলতে শুরু করলাম। ভৈরব থেকে গাড়ির স্টিয়ারিং দিয়ে দেয়া হলো রাসেলের হাতে। রাসেল চিটাগাংরোড দিয়ে সাইনবোর্ড পেড়িয়ে শনির আখড়া আসার পর গাড়ির স্টিয়ারিংয়ের দখল নিয়ে নিলো শামীম সদরার। হালকা জ্যাম ঠেলে ঠেলে আমরা একসময় যাত্রাবাড়ি পার হয়ে ধোলাইর পাড় দিয়ে উঠে গেলাম ফ্লাই ওভারের উপরে। বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল দিয়ে গাড়ি টান দিতেই ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে দ্রুত মাওয়া ফেরিঘাট পৌঁছে গেলাম বিশ মিনিটের মধ্যে! এত দ্রুত ঢাকা থেকে মাওয়া পৌঁছানো যায় ভাবাই যায় না। আসা মাত্র আমাদের ভাগ্য এতই ভালো যে ফেরি পেয়ে গেলাম। আমাদের গাড়িটিই ফেরির শেষ গাড়ি। ফেরিতে উঠা মাত্র ফেরির ডালা উঠিয়ে ছেড়ে দিলো। আমরা এখন একটু খুধার্ত বোধ করছি। পেটের কৃমি মারা যাওয়ার আগেই কিছু খেতে হবে। ফেরির উপরে উঠে দেখি ইলিশ মাছ ভাজা আছে আগের যা ঠান্ডা হয়ে গেছে। দোকানিকে বললাম নতুন করে মাছ ভেজে দিতে পারবে কিনা। পাঁচজন দেখে সে রাজি হলো। মাছের সাথে যেন কিছু পিঁয়াজ কুচি ভাজা হয় বলে দিলাম। দোকানি গরম ভাত, ইলিশ মাছ, পিঁয়াজ কুচি ভাজা, শুকনা মরিচ দিয়ে খেতে দিলো। সাথে দিলো পাতলা ডাল। আমরা বেশ আয়েশ করে খেলাম। ফেরিতে ভাত ও ডালের কোন দাম নেই। শুধু মাছ কিনতে হয়। মাছের টুকরার দামের মধ্যেই যেন ইনক্লুড করা আছে ভ্যাট, ট্যাক্স, ভাত, ডাল! খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কিছুক্ষণ ওখানেই বসে বসে গল্প করতে করতে ফেরি কাঁঠালবাড়ি ঘাটে চলে এলো। নিচে নেমে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম। ফেরি থেকে নেমেই টান দিলো গাড়ি শরীয়তপুরের দিকে। আমাদের কলিজা এখন শরীরসম! আমরা এখন শরীয়তপুরের মাটিতে অবস্থান করছি। নিজের দেশ যেমন প্রিয় ভূমি তেমনি নিজের জেলা, নিজের থানা, নিজের গ্রাম এর পর নিজের ভিটে-বাড়ি সবচেয়ে প্রিয় প্রতিটি আদম সন্তানের কাছে। এর চেয়েও প্রিয় নিজের পরিবার-পরিজন। চলতে চলতে আমরা ভাবছি এখনইতো শুরু হবে নতুন উৎপাত। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা পাড় হয়ে বিশাল এক্সপ্রেসওয়ে চলে গেছে ভাঙ্গার দিকে। এক্সপ্রেসওয়ের বক্স কালভার্ট এর নিচ দিয়ে এগুলেই জাজিরার রাস্তা। রাস্তার শুরুতেই পুলিশ বসা থাকে আমাদের নিরাপত্তার জন্য। এক সাথে অনেক গাড়ি জড়ো করে এগিয়ে দিয়ে আসে নিরাপদ জোনে! ডাকাত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই তাই জনগনকে ভোগান্তিতে বসিয়ে রেখে সেবা করেন প্রিয় পুলিশ ভাইয়েরা! আমাদের ভাগ্য কেন যেন আমাদের সহায়তা করছে প্রতিটি প্রতিবন্ধকতায়। আজ পুলিশ নেই। আমরা টান দিয়ে চলে গেলাম। রাস্তায় ডাকাতের দেখা না পেলেও শিয়ালের দেখা পেলাম অনেক। এখনতো আর শিয়াল পন্ডিতকে দেখাই যায় না। রাস্তায় আমাদের গাড়ির আলো দেখে শিয়াল পন্ডিতরা লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে। আমাদের গাড়ি সব বাঁধা পেরিয়ে রাত তিনটার দিকে শরীয়তপুরে শামীম সরদারের শামীম প্লাজার নিচে থামলো। শামীম প্লাজার নিচে দাড়িয়ে বাড়িতে ফোন দিলাম গেইটের তালা ভিতর থেকে মারা না বাইরে থেকে? গৃহকর্তী জানালো বাইরে থেকে তালা মারা আছে। আমি বললাম আসতেছি কিছুক্ষণ পরেই।

এবার যার যার বাড়ি যাওয়ার পালা। কিন্তু এত রাতে কোন রিক্সা, ইজিবাইক নাই রাস্তায়। অগত্যা প্রথমে শামীম সরদারকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চললো আমার বাড়ির দিকে। আমাকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি চলে গেলো ইয়াছিন ভাই ও বাবুল সিকদারকে নামিয়ে দেয়ার জন্য। ইয়াছিন ভাই ও বাবুল সিকদারের বাড়ি পাশাপাশি। তাদের দুজনকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যাবে রাসেল তার বাড়িতে, এমনই সিদ্ধান্ত হলো।

গাড়ি থেকে নেমে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেইটের তালা খুলতে ব্যাগ হাতিয়ে চাবি বের করলাম। বাড়ির, চেম্বারের চাবির ছড়া ব্যাগেই ছিলো। তালা খুলে ভিতরে ঢুকে ভিতর থেকে আবার তালা মেরে হাটা দিলাম ঘরের দিকে। দরজায় ব্যাগটা রেখে প্রিয় পোষা খরগোশের খাচার কাছে গিয়ে মোবাইল টর্চ জালাতেই খরগোশ দুটি আমার দিকে দৌড়ে এলো। পাঁচ দিনে বড় বোন রেখা আপা খাবার দিয়েছে প্রতিদিন। কিন্তু ভিতরের ময়লা বর্জ্য পরিস্কার করা হয়নি। আমার ডাকে লুনা দরজা খুলে দিলো।
গভীর রাতে বাড়ি ফিরে দরজা খোলার সাথে সাথে দেখি লুনার পিছনে আমার প্রাণ প্রিয় মা আমার বড় কন্যা প্রিয়ন্তী দাড়িয়ে আছে। লুনার হাতে ব্যাগটা দেয়ার সাথে সাথে প্রিয়ন্তী ঝাপ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। কেঁদে কেঁদে আমাকে বললো, আমাকে ছেড়ে আর যাবে না। একটু বাড়িয়ে বললো, প্রিয় তোমার জন্য কান্না করেছে, বলেছে বাবা কোথায়, বাবা আসেনা কেন? প্রিয় আমার ছোট কন্যা, ছোট মা। প্রিয়র বয়স এক মাস হয়েছে। এক মাস বয়সে নিশ্চই কথা বলতে পারে না, কিন্তু আমাকে বলছে যে প্রিয় বাবার জন্য কান্না করেছে! কথা বলতে বলতে ওর চোখে পানি দেখে আমারও বুকটা ভারি হয়ে গেলো, চোখের কোনে জল জমে গেলো। আমি কোলে তুলে বললাম, তুমি এত রাতে জেগে আছো যে মা! প্রিয়ন্তী বললো, তুমি আসবে তাই আমি জেগে ছিলাম। আমি বললাম, তুমি কি করে বুঝলে যে আমি আসছি? প্রিয়ন্তী বলে, আমি আম্মুর ফোনে কথা বলা শুনে জেগে গেছি। আম্মু মোবাইল রাখার পরে আমি চুপিচুপি মোবাইলে দেখেছি শেষ কল তোমার। তখনই আমি বুঝেছি তুমি আসতেছো! এজংগ (এজন্য) আর ঘুমাইনি। কথা বলতে বলতে আমার কপালে, থুতনিতে, দুই গালে চুমু দিচ্ছে আর আমাকে আষ্টে পিষ্টে শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। মনে হচ্ছে আমি যেন হাজার বছর পর বাড়িতে ফিরেছি! এ যেন হারিয়ে যাওয়া কোন সন্তানের দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরা! আমি ওর কথাগুলো শুনে তাজ্জব হয়ে গেছি। এতটুকু মেয়ে মায়ের মোবাইলের শেষ কল বাবার দেখে বুঝে গেছে বাবা আসছে, নয়তো এত রাতে বাবা কল দিতো না!! মায়েরা যে এমনই হয়, তাইতো আমি প্রিয়ন্তীকে মা বলে ডাকি! প্রিয়ন্তীও আমাকে আমার মায়ের মত বাবা ডাকে। মা, আমি তোমাদেরকে অনেক অনেক ভালোবাসি মা!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here